আমি অয়ন। বাবা-মায়ের সাথে একটা ছোট্ট শহরে থাকি। একটা প্রাইমারী স্কুলে ক্লাশ ফোরে পড়ি। এবার রোজার ছুটিতে মায়ের সাথে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
আমার মামা ঢাকায় থাকেন। তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতে আমার নানুও থাকেন। মা, নানুকে দেখার জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন। আমার স্কুল বন্ধ থাকায় আমাকেও সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার একটু বেড়ানো হবে বিশেষকরে ঢাকা বেড়ানো হবে এই ভাবনায়ই এই সিদ্ধান্ত। ঐযে একটা বাগধারা আছেনা, রথদেখা আর কলাবেচা আরকি।
ঢাকা যাবার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। ঢাকায় এসে কয়েকদিনেই আমার আর ভাল লাগছিলোনা। সারাদিন কি আর কম্পিউটার গেম খেলে কাটানো যায়। মামাকে কদিন ধরেই বলছি, চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে, ফ্যান্টাসি কিংডমে নিয়ে যেতে। মামার সময় নেই। তিনি খুব ব্যাস্ত। কিন্তু মামী কোন কাজের কথা বললে সেটা সাথে সাথেই হয়ে যায়, তখন কিন্তু তিঁনি ঠিকই সময় পান।
এক শুক্রবারে মামা আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। খুব মজা পাচ্ছিলাম কিন্তু মামা শুধুশুধুই তাড়াহুড়ো করছিলেন বাড়ি ফেরার জন্য। আর পরেরদিন শনিবারে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্যান্টাসি কিংডমে। ওখানে আমি সব রাইডেই চড়তে চাচ্ছিলাম আর মামা প্রতিবারেই আমাকে বিরত করার চেষ্টা করছিলেন। এক সময় মামা জোর করেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সেদিন অবশ্য ইফতারের আগে আমরা বাসায় পৌঁছাতে পারিনি। মামা রাস্তার মাঝে পানি দিয়েই ইফতারি সেরেছিলেন। আমারকি দোষ। এটুকু আবদারতো মামার কাছে করতেই পারি। উনি কেন সকাল সকাল আমাকে নিয়ে এলেননা।
এই সময়ের মধ্যে মামা অবশ্য আমাকে পিঁজা হাট, সরমা হাউজ ও কে,এফ,সি,তে নিয়ে গিয়ে আমার পছন্দমত খাবার খাইয়েছেন।
একদিন হয়েছেকি, মামাবাড়ির এ্যাপার্টমেন্টের গ্যারেজে একটা মোটরসাইকেল দেখে আমার খুব ইচ্ছা হল ওটাতে চড়তে। মামাকে বলাতে উনি বললেন সেটা সম্ভব না। কারন ঐ মটরসাইকেলের মালিকতো অন্য কেউ। আমার বন্ধুর মামারা কত ভাল, তাঁরা তাদেরকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে ঘোরায়, আইসক্রিম কিনে দেয় আর আমার মামা আমার ছোট একটা শখও পুরণ করতে চায়না। এরকম মামা থাকা আর না থাকায় কি আসে যায়। শেষপর্যন্ত্য মামা মোটরসাইকেলের মালিককে ডেকে আনিয়ে আমাকে একটু মোটরসাইকেলে ঘুরিয়ে আনার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। মোটরসাইকেলের মালিক একজন ছাত্র। সে আমাকে মোটরসাইকেলে একটু ঘুরিয়ে আনলো।
বাসায় ফিরতেই মা আমার উপর চড়াও হলেন। আর মামাকে বকাঝকা করলেন। মায়ের কথা, মোটরসাইকেলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। যদি একটা কিছু হয়ে যেত।
মামার কাছে একদিন তাঁর মামাবাড়ির কথা জানতে চাইলাম। জানতে চাইলাম মামা ছোটবেলায় তাঁর মামাবাড়িতে গিয়েছেন কিনা। এইসব আরকি।
মামা সেদিন আমাকে তাঁর মামাবাড়ির গল্প শুনিয়েছিলেন। তাঁর মামাবাড়ি ছিল গ্রামে। মামাবাড়িতে তাঁরা খুব মজা করতেন। তাঁরা...। সেসব কথা নাহয় তাঁর কাছ থেকেই শুনুন।
আমি ফকির আহম্মদ চৌধুরী। শুনেছি আমার নানা ছিলেন জমিদার ( কিন্তু আমার নামটা এমন কেন রাখা হল ভেবে পাইনা)। তিনি গত হয়েছেন বহুদিন। আমার একমাত্র মামাও অকালমূত্যু বরণ করেছেন। তাই আমরা খালাতো ভাই-বোনেরা মামাবাড়ি বলতামনা। বলতাম নানীবাড়ি। সেখানে আমার নানী ও মামী থাকতেন।
আমার ভাগনের অনুরোধে নানীবাড়ির গল্প শোনাতে গিয়ে আমি স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমি সত্যিই সেই দিনগুলোতেই ফিরে গিয়েছিলাম।
ছোটবেলায় সাধারনত পূজোর ছুটিতে আমরা সব খালাত ভাইবোনেরা একজোট হয়েই নানীবাড়িতে যেতাম। সেকারনে খুব মজা হত।
আমার নানা একটা এতিম ছেলেকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমার মামাত ভাইবোনেরা তাঁকে 'ওমর কাকা' বলে ডাকত। তাই আমরা খালাত ভাইবোনেরা তাঁকে 'ওমর মামা' বলে ডাকতাম। আমাদের যত আবদার সবই ছিল তাঁর কাছে। ঘুঘুপাখির বাচ্চা ধরে দিতে হবে, চড়ুইপাখির বাসা পেড়ে দিতে হবে, খেজুরের রস খাওয়াতে হবে অথবা পূজোর মেলায় নিয়ে যেতে হবে ইত্যাকার সব আবদার।
আমরা তাঁর কাছে কখনই পিঁজা, সরমা বা কে,এফ,সি খেতে চাইনি। আসলে তখন আমরা এ নামগুলোই জানতামনা।
নানীবাড়িতে তখন বড় বড় টিনের পাত্রে মুড়কী রাখা হত (খই ও গুড়ের সংমিশ্রণে তৈরি একধরনের খাবার )। আমরা চুরি করে সেই মুড়কী খেতাম। শীতকালে বাড়ির ভিতরউঠানে খেজুরের রস জ্বালিয়ে গুড় বানানো হত। সদ্য তৈরি গুড় থেকে পাটালি বানানোর জন্য 'বিচমারা' নামে একটা পর্যায় ছিল। আমরা সেই 'বিচমারা' গুড় খাবার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করতাম।
আমাদের নানীবাড়িতে তখন ঢেঁকি ছিল। মাঝেমধ্যে খুব ভোঁর থেকে ঢেঁকিতে ধান বাঁনা শুরু হত। কখনও সখনও চিড়ে কোঁটাও হত। গুড় মেশানো কুল ঢেঁকিতে পাঁড় দিয়ে কুলচুর বানানো হতো। আমরা মজাকরে ঢেঁকিতে পাঁড় দিতাম।
শীতের সন্ধ্যায় আমরা দল বেধে মাঠে যেতাম। প্রায় সবার হাতেই থাকতো ফুটখানেক লম্বা একটা পাটকাঠির টুকরো। খেজুরগাছ থেকে রসের ভাঁড় নামিয়ে তার ভিতর পাটকাঠি প্রবেশ করিয়ে শুষে শুষে সেই রস খেতাম।
দলবেধে পুকুরে নেমে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সাঁতার কেটে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করতাম। নানীবাড়ির কাছেই একটা বিল ছিল। আমরা ওমর মামাকে নিয়ে সেই বিলে যেতাম। ওমর মামা নৌকা বাইত আর আমরা নৌকায় বসে বসে পানি থেকে পদ্মফুল, ঢ্যাপ ( পদ্মের একধরনের ফল ) পদ্মের ডাঁটা এসব তুলতাম। ডাঁটা দিয়ে আমরা একধরনের মালা বানাতাম।
একদিন হয়েছেকি ! চুরি করে মুড়কী খেতে যেয়ে মুড়কীর টিনের পাশে থাকা গুড়ের ভাঁড় পড়ে ভেঙ্গে যেয়ে সব গুড় মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। আমি মায়ের ভয়ে গোলার মধ্যে ঢুকে লুকিয়ে ছিলাম। ( তখনকার দিনে গ্রামে প্রায় সব বাড়িতেই ধান মজুত করার জন্য গোলা থাকত। গোলা হচ্ছে, বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি গোলালো কাঠামোর বড় ধরনের ঘর বিশেষ। বাড়ির উঠানে মাটি দিয়ে তৈরি বেঁদির উপর স্থাপিত থাকতো )। সন্ধ্যা হতেই আমি ভয়ে গোলা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। আমাকে দেখামাত্রই অন্যদের কি চিৎকার, চেঁচামেঁচি। মা আমাকে বেশ বকাঝকা করলেন, দু-একটা চড়-থাপ্পড়ও মেরেছিলেন তবে তা ভাঁড় ভাঙ্গার জন্য নয় বরং তাদের যে উৎকন্ঠার মধ্যে রেখেছিলাম তার জন্য।
মামা বাড়ি বা নানীবাড়ির গল্প আর কি বলব, আমাদের প্রজন্মের সবার গল্পইতো প্রায় একই রকম।
আমার ভাগনে আমার মামাবাড়ির গল্প শুনেতো একেবারে তাজ্জব। আমায় বলল "তোমরা এরকম গাঁইয়া ছিলে"।
লিখেছি : প্রৌঢ়ভাবনা
মন্তব্য
আহা! গাঁয়ে বেড়ে উঠিনি কিন্তু প্রতিবছর যাওয়া হতো। পুকুরে সারাদিন ঝাপাঝাপি, বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়, শাপলা-শালুক, রাত জেগে পালাগান, নবান্নের উৎসব, বউচি-দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, কাদাপানিতে ফুটবল, প্রথম বন্যার পানিতে ভেসে আসা পোনা শোল মাছের ঝাঁক, হাওড়ের মেঘলা জলে পূর্ণিমার একথালা চাঁদ - আরো কত কিছু!
সব জন্মেই এমন গাঁইয়া হিসেবে আমার জন্ম হোক!
সেসব স্মৃতিতো লিখে শেষ করা যাবেনা। দু-একটা যা মনে আসলো তাই সহজ ভাষায় লিখে ফেললাম।
ধন্যবাদ, ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য। আর মন্তব্যের জন্যতো বটেই।
এই 'গাঁইয়া' গল্পটা অনেক মিষ্টি লাগল। লাড্ডুর মত মিষ্টি
সত্যিইকি লেখাটা লাড্ডুর মত মিষ্টি হয়েছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য।
প্রৌঢ়ভাবনা, দেখে ভাল লাগছে যে আপনি অবশেষে লেখা শুরু করে দিলেন। মন্তব্য বাদে আপনার এই লেখাটাই প্রথম চোখে পড়ল। সামনে আরো ভাল ভাল লেখা আশা করছি আপনার কাছে, ভাল থাকুন, লিখতে থাকুন।
এর মাঝে আরও একটা লেখা এসেছেতো।
ধন্যবাদ আপনাকে সাথে থাকার জন্য।
মনে পড়েছে ছেলের বিদেশ যাত্রা। তাই না?
গুঁড়ের মত মিষ্টি হয়েছে। নিজের বাচ্চাবেলা (যেটা এখনো যায় নি) নিয়ে লেখার উৎসাহ পাচ্ছি
facebook
সবই সোনালী অতীত। দিনগুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না
বর্ষায় মানুষের নৌকার তালা খুলে ভাসিয়ে দেওয়া, শাপলা-শালুক, ভ্যাট (স্হানীয় ভাষায় পদ্মের ফল), পানিফল, বেতের ফল সবই হজম হতো তখন।
ইস...সবই অতীত।
এখনকার বাচ্চারা কিন্তু এগুলি পাচ্ছেনা। হয়ত তাদের ধারণাতেও এসবকিছু নেই।
ধন্যবাদ, পড়ার জন্য।
পৌঢ়ভাবনা
ফের অমন 'গাঁইয়া' হতে মন চায়......
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
আপনার লেখা ভালো লেগেছে, প্রৌঢ়ভাবনা। আপনার লেখাটি পড়ে এক প্রিয় কবির লেখা একটি কবিতার কথা মনে পড়লো। নেট ঘেঁটে কবিতাটি পেলাম না, তাই তুলে দিলাম এখানে:
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
কবিতাটি পড়তে পড়তে আমিও ত্রিশ বছরেরও বেশ আগে ফিরে গিয়েছিলাম। মফস্বল শহরে তখন যানজট ছিলনা, সবুজকে, প্রকৃতিকে ছোঁয়া যেত। মাঝেমধ্যই গ্রামে যাওয়া হত। তখনকার দিনে গ্রামীন সমাজে রাজনীতির প্রকটতা ছিলনা। ছিল এক ধরনের আন্তরিকতা, সবার সাথেই ছিল আত্মীয়তা। আত্মীয় হতে গেলেতো পারিবারিক সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। আত্মার সাথে সম্পর্কইতো আত্মীয়তা।
কবিতাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আর মন্তব্যের জন্যও।
প্রৌঢ়ভাবনা
নতুন মন্তব্য করুন