১.
মোতালেবের মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। রিসার্চ গ্র্যান্টটা মিলে গেছে, তারপরও। ৎসাইলবের্গারের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিটা সে ভুলতে পারছে না কিছুতেই। বুড়ো বিরাট খচ্চর।
ধবধবে সাদা পেয়ালায় কফি খেতে খেতে বুড়ো শুধু বলেছিলো, "অসীম হচ্ছে একটা বিমূর্ত বালছাল। ভুলো না কিন্তু।"
মোতালেব পছন্দ করেনি কথাটা। গণিতবিদ হিসেবে তার ক্যারিয়ারটাই দাঁড়িয়ে আছে অসীমের গায়ে হেলান দিয়ে। আর এই ব্যাটা এক পা কবরে ঢুকিয়ে আরেক পা নাচাতে নাচাতে বলছে, অসীম একটা বিমূর্ত বালছাল? এটা কোনো কথা হলো?
জাপানী বন্ধু হিদেকুশি আগেই সাবধান করে দিয়েছিলো মোতালেবকে, ৎসাইলবের্গার নাকি অতিশয় গিরিঙ্গিবাজ লোক। এর সাথে পোস্টডক করার বুদ্ধিটা সে মোটেও ভালো মনে করেনি। মোতালেব নিজেও জানে, ৎসাইলবের্গার সসীম সংখ্যার নানা প্যাঁচঘোঁচের সাথে মোকাবেলার কারণেই গণিতজ্ঞ মহলে সমাদৃত। কিন্তু উপায় ছিলো না তার, কারণ প্রস্তাবনাটা খোদ ৎসাইলবের্গারের পাকাচুলে ঢাকা মাথা টপকেই বেরিয়েছে। ব্যাটা বেশ মোটা গ্র্যান্টও যোগাড় করে রেখেছে, মোতালেবের কাজ শুধু কামলা খাটা।
ব্যাপারটা খুবই গণ্ডগুলে, কোনো সন্দেহ নেই। এটা একেবারে জ্বলন্ত সত্য, এমনই জ্বলন্ত যে একটা ভালো হাভানা চুরুট ধরানো যেতে পারে, যে সংখ্যার কোনো শেষ নেই। একবার গুণতে শুরু করলে আর থামার উপায় নেই। সবচেয়ে বড় সংখ্যা যদি কেউ প্রস্তাব করে, তার সাথে সবসময় একখান এক যোগ করে আরেকটা সবচেয়ে বড় সংখ্যা পয়দা করা সম্ভব, এবং সেটার সাথেও আবার এক যোগ করে আরেকখানা, এইভাবে চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের ঝোল থাকে, এক যোগ করে যাওয়ার মোজো থাকে। আর হ্যাঁ, ট্যাঁকে ফাণ্ডিঙের টাকা যতক্ষণ থাকে। ওটা ফুরিয়ে গেলে এক যোগ করার কাজে ক্ষান্ত দিয়ে সবচেয়ে বড় সংখ্যাটা ছাপিয়ে ৎসাইলবের্গারের কপালে সেঁটে দিয়ে আসা যায়।
কিন্তু বিটকেলটা বলছে, সবচেয়ে বড় সংখ্যা একটা আছে, এবং সেটাতে পৌঁছানোও খুব সম্ভব। কারণ সেটার সাথে এক যোগ করলে ফলাফল হবে শূন্য। সবচেয়ে বড় সংখ্যা এমনই এক সংখ্যা, যার গায়ে শেষ খড়টা চাপালে সে ভেঙে চুরমার হয়ে শূন্য হয়ে আছড়ে পড়বে মাটিতে।
এ-ও কি সম্ভব?
ৎসাইলবের্গার বলছে, হুঁ, সম্ভব নয় কেন? দাঁড়াও পথিকবর, একেবারে হাতে কলমে দেখাচ্ছি। বাবা মোতালেব ...! খাতা কলম নিয়ে আসো তো একটু!
মোতালেবকে যে ভাবায়নি ব্যাপারটা, এমন নয়। সে যথেষ্ট আগ্রহী, এই প্রকল্পকে একটা ডলা দিয়ে দেখার জন্য। সংখ্যা বড়ই রহস্যে ভরা একটা ব্যাপার, আর অসীমের আচরণ তো আরো রহস্যময়। অসীমের সাথে এক যোগ করলেও ফলাফল অসীম, অসীম থেকে এক বিয়োগ করলেও ফলাফল অসীম। অসীমকে দুই টুকরো করে ফেললেও সে অসীমই রয়ে যায়, দুটো অসীমকে জোড়া দিলেও সে অসীমই থাকে।
বেশি দেরি করেনি মোতালেব, প্রথম সাক্ষাতের সময় ৎসাইলবের্গারের সামনেই একটা কাগজ টেনে নিয়ে বড় বড় করে লিখেছে সে, গামা। Γ । ৎসাইলবের্গারের প্রস্তাবিত সবচেয়ে বড় সংখ্যা।
বুড়ো বসে বসে কান চুলকাচ্ছিলো একটা কানকাঠি দিয়ে, কাগজটা রগ-ওঠা বাঁদুরে হাতে টেনে নিয়ে দেখে নাক সিঁটকে বলেছিলো, সে কী, গামা বলে ডাকছো নাকি ওটাকে?
মোতালেব বিড়বিড় করে বলেছিলো, সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর, গামার মাঝে প্রকাশ তোমার তাই এত মধুর!
ৎসাইলবের্গার কিছুক্ষণ পিটপিটে চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছিলো, বেশ, গামাই সই।
২.
ব্যাপারটা যে এত ভোগাবে, মোতালেব আশা করেনি। একটা কম্পিউটার আর একজন গ্র্যাড স্টুডেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলো সে, কিন্তু ৎসাইলবের্গারের পেড়ে রাখা ডিম থেকে যে এতো ভূতপ্রেত ফুটে বেরোবে, সে ভাবেনি।
সপ্তম সপ্তাহের মিটিঙে মিনমিন করে তাই সে বুড়োকে জানিয়েছে, আরো দু'জন গ্র্যাড স্টুডেন্ট লাগবে তার। আর একখান কম্পিউটারে কিছুই হবে না, আরো দু'টো লাগবে।
ৎসাইলবের্গার উদার হাতে কান চুলকাতে চুলকাতে বলেছে, বেশ!
মোতালেব খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে আবার। কারণ একটাই, বুড়োর ঠোঁটের কোণে আবছা বাঁকা হাসিটা। কেমন যেন। দেখলে ভালো মেজাজও বিগড়ে যেতে বাধ্য।
৩.
ছয় মাস পর মোতালেব আচমকা নিজেকে আবিষ্কার করলো পাঁচজন গ্র্যাড স্টুডেন্ট আর একটা নতুন কম্পিউটার ল্যাবের মাঝখানে। আঠারোটা কম্পিউটার সেখানে একটা নেটওয়ার্কে নিরন্তর খেটে চলছে ৎসাইলবের্গারের প্রস্তাবনার পেছনে। কিন্তু ...।
কফির মগ হাতে উদভ্রান্তের মতো ৎসাইলবের্গারের ঘরে গিয়ে হাজির হলো মোতালেব, হাতে একটা কাগজ।
বুড়ো কোনো বাক্যব্যয় না করে কাগজটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখলো, তারপর হাতের তর্জনী নাকে গুঁজে বললো, "মেইনফ্রেম ল্যাবটা কিছুদিনের জন্যে ব্যবহার করতে পারো।"
মোতালেব ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এলো ৎসাইলবের্গারের ঘর ছেড়ে। মেজাজ খারাপ করার জোশও পাচ্ছে না সে। কাগজটা নামিয়ে রাখার আগে বুড়ো মুচকি হেসেছে শুধু, সেই খচ্চরমার্কা বাঁকা হাসিটা।
৪.
জাহাভি টেকনিকস যখন তাদের সুপারকম্পিউটার দুই বছরের জন্য ৎসাইলবের্গারের গবেষণার জন্যে ছেড়ে দিলো, মোতালেব অবাক হয়নি। বুড়োর কানেকশনের জোর মারাত্মক।
"কাজ আগাচ্ছে, কী বলো?" বিস্কুট খেতে খেতে বললো বুড়ো।
মোতালেব হাতে ধরা কাগজের তাড়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। কোনো সন্দেহ নেই। বুড়োর হাসিটা যতই বিরক্তিকর হোক না কেন, কথায় দম আছে।
৫.
সাদা ওভারঅল পরা চারজন লোক মিলে যখন স্ট্রেইট জ্যাকেট পরিয়ে মোতালেবকে ল্যাব থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিলো, দৃশ্যটা হৃদয়বিদারক ছিলো। ৎসাইলবের্গারের অনুরোধে জাহাভি টেকনিকস গোটা ঘটনা নিয়ে একটা ছোটো ডকুমেন্টারি বানিয়ে ডিভিডি পাঠিয়ে দিয়েছে ডাকে। মন খারাপ থাকলে ৎসাইলবের্গার সেটা ছেড়ে দেখেন। প্রভূত আমোদপ্রদ দৃশ্য। বিশেষ করে মোতালেব যখন এক পর্যায়ে একটা কীবোর্ড তুলে কামড়াতে শুরু করে, সেটা অভূতপূর্ব। ডকুমেন্টারি যে সম্পাদনা করেছে, তার সুরজ্ঞান মন্দ নয়, মোতালেবকে ধাওয়া এবং পাকড়াওয়ের দৃশ্যগুলোকে সে একটা চমৎকার ওয়াল্টজ ছন্দে খুঁজে পেয়ে দ্মিত্রি শস্তাকোভিচের একটা কম্পোজিশন জুড়ে দিয়েছে।
মোতালেব আপাতত একটা আরোগ্যের অযোগ্য মানসিক রোগীদের অ্যাসাইলামে আছে। গবেষণা প্রকল্পটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মোতালেবের রিসার্চ থেকে বেশ কিছু মূল্যবান ডালপালা বেরিয়ে এসেছে, যেগুলো ফলিত গণিতের বেশ কিছু অমীমাংসিত ব্যাপারের একটা দফারফা করার কাজে আসবে, বিশেষ করে সসীম সংখ্যার বিশ্লেষণে।
নতুন পোস্ট ডক গনজালেস মোতালেবের ডিভিডিটা প্রথম সাক্ষাতকারেই দেখেছে, বলা যায়, দেখতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু গনজালেস হণ্ডুরাসের লোক, এত সহজে সে ভয় পাবার বান্দা নয়। নিরস গলায় গনজালেস শুধু জানতে চেয়েছে, আপনার প্রস্তাবনাটার কী হলো তাহলে?
ৎসাইলবের্গার কান চুলকাতে চুলকাতে উদাস গলায় শুধু বলেছেন, "কী আবার হবে?"
গনজালেস জানতে চেয়েছে, "গামা নিয়ে আর কিছু ভাবছেন না?"
ৎসাইলবের্গার কিছুক্ষণ গনজালেসের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, "দ্যাখো, শুরুতে একজন পোস্ট ডক ফেলো নিয়ে কাজ শুরু করলাম। তারপর একটা কম্পিউটার এলো, আর একটা গ্র্যাড স্টুডেন্ট। সেই থেকে গোণা শুরু। পুরো একটা সুপার কম্পিউটার ফ্যাসিলিটি যখন গামার পেছনে ছুটছে, তখন মোতালেব কী একটা বাংলা লেখার সফটওয়্যার ইনস্টল করতে গিয়ে পুরো সিস্টেম অকেজো করে ফেললো। এখন এই প্রজেক্টে একটা মশাও নাই। সব ফাঁকা, শূন্য। কী বুঝলে?"
গনজালেস চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে শুধু।
ৎসাইলবের্গার সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, "মাঝে মধ্যে একটা একের মতো এক যোগ করতে পারলে গোটা ব্যাপারটাই শূন্যে নেমে আসে। তার আগ পর্যন্ত যা থাকে হাতে, ওটাই গামা।"
অফটপিক: চণ্ডীশিরা লিখে শেষ করবো, কথা দিচ্ছি। সমস্যায় ভুগছি, সমস্যা কেটে গেলে পুরোটা লিখে একবারে পোস্টাবো।
মন্তব্য
চণ্ডীশিরার অপেক্ষায় আছি কিন্তু।
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
অঃটঃ হিম্ভাই আপনারা শব্দের আগে 'ৎ' উচ্চারণ করেন কেম্নে?
সায়ন মশাই একখান কাম করেন
দুপুর যখন ঠিক বারোটা তখন নাকের ডগায় একটা ইটের টুকরা ঝুলাইয়া সূর্যের দিকে চাইয়া থাকেন আর ১১১১ বার উচ্চারণ করেন - 'খন্ড বিখন্ড কইরা ৎ বলে '। তাহলেই আপনার সুমুস্যার সুমাধান হুইয়া জাইবেক
ডাকঘর | ছবিঘর
জাস্ট ফাটাফাটি ।
জাহাঁপনা তুসসি গ্রেট হো , তোফা কবুল করো
ডাকঘর | ছবিঘর
হিমু ভাই ভয় পাচ্ছি কিন্তু আপনার সাথে সৎ থাকার জন্যে বলি, এই গল্পটা তেমন ভাল লাগেনি। একটু তাড়াহুড়ো করে কি লেখা? এটা নিশ্চয়ই আমার অক্ষমতা, আমি নিশ্চয় বুঝতে পারিনি কারণ আপনি যেটা লেখেন সেটা খুব ভালই হয়। তাছাড়া মাথায় আপনার চন্ডীশিরা ভর করে আছে এটাও হয়ত একটা কারণ। সব সমস্যা কেঁটে যাক, অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার অফটপিকটার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আপনার গদ্য (এমন কি মন্তব্যগুলোও) অসাধারন লাগে আমার আর তাই আপনার লেখার অপেক্ষা থাকি সব সময়।
ভালোই লাগলো।
গণিতীয় কল্পকাহিনী কিংবা ম্যাথ ফিকশন যাকে বলে, এটা তেমনই একটা লেখা।
কিন্তু, শেষটাতে কি একটু তাড়াতাড়ি করা হয়ে গেলো না???
ভালো লেগেছে কল্পকাহিনি।
অফটপিক পড়েও ভালো লাগলো, শীঘ্রই পাচ্ছি আশা রাখছি। তবে সমস্যার কথা বললেন, সেটা আগে দ্রুত দূর হোক।
_____________________
Give Her Freedom!
মহাকাগুর তরে একলাইনের একখানা 'কোবতে' লিখলুম:
কাগুর কাগু, তাইতো তুমি মহাকাগু!
love the life you live. live the life you love.
বয়স বাড়তে বাড়তে... বুড়ো..
তারপর যোগ এক মূহূর্ত
তারপরে শূন্য..
পূনর্জন্ম থাকলে
বয়স আবার ১ দিন...
গল্পটায় একটা বেশ রহস্য আছে...
জমাট বাধাতে চাইলে ...
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
গতমাসে এক মার্কিন গণিতবিদের লেকচার গিয়েছিলাম, মহিলা সেট থিওরি নিয়ে জাঁহাবাজ বক্তব্য দিয়ে গেল দেড় ঘণ্টা, মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সবচেয়ে বড় সংখ্যা। গল্পটা সেই লেকচারের তুলনায় অনেক গুণ উপভোগ্য।
facebook
এতক্ষণে রহস্য ফাঁক হইল!
মোতালেবের অভিসন্দর্ভের কয় চ্যাপ্টারের ব্যাকাপ নেওয়া ছিল না?
মোতালেবকে পাকড়াও করার সময়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে কি এইটার কথা কস? না কইলেও সই- আমি জনৈক বিচারপতিদের মতো স্বপ্রণোদিত হয়েই দিয়া গেলাম।
গল্পটায় একটা 'হালক্কায়ে কাহিনি' থাকলেও বেশি জুইতের হয় নাই। তবে ব্যাপার না, কাগুরও হাগু পায়।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
হ
আমার কাছে বেশ ভালো লাগলো। একটু তাড়াহুড়ার ছাপ আছে কিন্তু লেখনীর গুনে সেটা উতরে গেছে। আসলে হিমুর কাছে পাঠকের প্রত্যাশা আকাশ ছোয়া। চণ্ডীশিরার অপেক্ষায় রইলাম। ঝামেলা সামলে উঠে লেখা শেষ করবেন আশা রাখছি।
শস্তাকোভিচ
বরাবরের হিমুর মত ফাটাফাটি না লাগলেও ভালই লেগেছে।
হিম্ভাই এর মতন লিখতে হইতে মঞ্চায় ।
(গামা অকেজো থাক, বাংলা সফটওয়্যারই চলুক)
লেখায় গুগলপ্লেক্স
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
নতুন মন্তব্য করুন