আমি যখন পণ্ডিতমশাই…(১)
আমি যখন পণ্ডিতমশাই…(২)
আমি যখন পণ্ডিতমশাই…(৩)
ছোটোবেলা থেকেই জেনে এসেছি স্টুডেন্ট মানে হলো শিক্ষার্থী বা ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে আমার এই আটপৌরে ধারণা অচল বলে প্রতীয়মান হলো। বিশেষতঃ হলে উঠার পর প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত হলাম যে, স্টুডেন্ট মানে ছাত্র-ছাত্রী নয়, স্টুডেন্ট মানে হলো শুধুই ছাত্রী। একজন ছাত্র হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে আমি এই স্টুডেন্টশীপ হারানোর ঘটনায় তীব্র মনঃক্ষুন্ন হলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলাম। তাছাড়া এ ঘটনার প্রতিবাদে বুয়েটের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত বিক্ষোভ-সমাবেশ, অনশন-ধর্মঘট কিংবা মানববন্ধনের ন্যায় কোনোপ্রকার বলিষ্ট কর্মসূচী নেয়া হয়েছিলো বলে শোনা যায় না।
তো, আমার ক্ষেত্রে এই জ্ঞানলাভের ঘটনাটা যেভাবে ঘটলো…
হলে উঠার পর প্রথম দিন টিউশনিতে যাচ্ছি। আগেরদিন আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কিনে আনা টি-শার্টটাই গায়ে চাপালাম। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বাংলার পাঁচমার্কা চেহারাটাকে ছয়ে নেয়ার জন্য কিছুক্ষণ কসরত করছিলাম। এমন সময় রূমের বড় ভাইয়ের হাঁক…
“কি মিয়া, এত মাঞ্জা মাইরা কই যাও?”
বিশ্বাস করেন, আমি মোটেও মাঞ্জা মারতেছিলাম না। বাইরে যাওয়ার আগে আয়নায় চেহারা দেখা আমার পুরানা অভ্যাস। আর টিশার্টের ব্যাপারটা পুরাই কাকতালীয়!
যাই হোক, মাত্র কয়েকদিন হইছে হলে উঠছি। তাই, মাঞ্জা শব্দটাকে হজম করে মুখে ভেজা ভেড়ালের ভাবটা ফুটিয়ে তুললাম।
আমিঃ জ্বে ভাইয়া, টিউশনিতে যাই।
ভাইয়াঃ ও আচ্ছা……স্টুডেন্ট নাকি?
(মনে মনে ভাবলাম, “আররে, স্টুডেন্ট না তো কি টিচার পড়ামু নাকি!”)
আমিঃ জ্বে ভাইয়া।
ভাইয়াঃ তা, দেখতে কেমন? ভাব বিনিময় চলে নাকি? দেইখো ফাইস্যা যাইও না আবার…(এরপর স্টুডেন্টের সাথে ভাব না করার ব্যাপারে আরো কিছু সদুপদেশ দিয়ে গেলেন…আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই…)
কিঞ্চিত হতভম্ভ হয়ে ভাবলাম, ভাইয়া কি আমাকে ‘ইয়ে’ মনে করলো নাকি? তারপর তার উপদেশের ঝড় থামলে সুপারকুল হয়ে বললাম, “না না ভাইয়া, স্টুডেন্ট তো ছেলে। আপনি মনে হয়…(মেয়ে ভাবছেন)”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, “ওই মিয়া, তাইলে তখন থেকে স্টুডেন্ট স্টুডেন্ট করতেছ ক্যান? ছাত্র কইতে পারো না?”
সেদিন থেকেই আমি খুব ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে নিলুম যে, স্টুডেন্ট আর ছাত্র-উহারা মোটেই এক বস্তু নহে!
কিন্তু ভাইয়ার প্রশ্নবাণ এখানেই শেষ হলেও বাঁচা যেত। তার পরবর্তী প্রশ্ন, “তা মিয়া, ছাত্রের কি সুন্দরী বইন-টইন আছে নাকি? তোমার লক্ষণ তো খুব একটা সুবিধার লাগতাছে না।” বুঝলাম, যেকোন কারণেই হোক ভাইয়া এ ব্যাপারে চরম আত্মবিশ্বাসী যে, আমার এই নতুন টিশার্ট এবং আয়না দেখার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রমণীর অস্তিত্ব আছে। তাই ভাইয়াকে তার এই ভ্রান্তধারণা কপচানোর আর সুযোগ না দিয়ে বললাম, “না ভাইয়া, ওর আর কোনো ভাইবোনই নাই।” তারপর যত দ্রুতসম্ভব মোবাইলব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়েই তার সামনে থেকে তখনকার মত পালিয়ে বাঁচলাম।
এ পর্যন্ত তো গেলো পণ্ডিতমশাইদের ভাবনার কথা। এবার নাহয় একটু অভিভাবকদের ভাবনার জগত থেকে ঘুরে আসি। জগন্নাথ ভার্সিটির(আমার বাড়ির কাছের এলাকার) এক বড়ভাইয়ের সাথে পরিচয় ছিলো। উনি মিডিয়া হিসেবে টিউশনি সংগ্রহ করতেন। একবার তাকে বললাম একটা টিউশনি দিতে। উনি বললেন যে, এলাকারই এক আঙ্কেল নাকি কয়েকদিন আগে তাঁর মেয়েকে পড়ানোর জন্য ওনাকে একটা বুয়েটছাত্র যোগাড় করে দিতে বলেছেন। আমি বললাম, “ভাইয়া, দেখেন না টিউশনিটা আমাকে দেওয়া যায় কিনা।” উনি বললেন, “ঠিক আছে। আমি কথা বলে দেখতেছি। তুই যেহেতু এলাকারই ছেলে, আপত্তি করার তো কথা না।” তারপর বেশ কিছুদিন ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয়নি। টিউশনির খোঁজ নেওয়ার জন্য (নিজের দরকার বলে কথা) শেষে আমি নিজেই ফোন দিলাম।
“ভাইয়া, কি খবর? টিউশনিটার ব্যাপারে কি আঙ্কেলের সাথে কথা বলছেন?”
“হ বলছি। কিন্তু তুই হিন্দু তো, তাই মনে হয় রাজি হলেন না। আমাকে বললেন সৎ, ভালো, নামাজী দেখে একটা মুসলিম ছেলেকে পাঠাতে।”
“ও আচ্ছা। ঠিক আছে ভাইয়া, রাখি তাহলে। হিন্দু ছেলের দরকার হলে ফোন দিয়েন!”- আশাহত হয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।
এখন প্রশ্ন হলো, একটা ইন্টারমিডিয়েটের (ইন্টারমিডিয়েট এ কিন্তু ইসলাম ধর্ম শিক্ষাও নাই, থাকলে তাও একটা অজুহাত দাঁড় করানো যেত) বিজ্ঞান বিভাগের মুসলিম ছাত্রীকে পড়ানোর জন্য কেন একটা সৎ, ভালো, নামাজী মুসলিম ছেলে চাই? আংকেল কি গৃহশিক্ষক চাচ্ছেন নাকি গৃহজামাই(ঘরজামাই) চাচ্ছেন?? আমার মতে, নরপশু হাসান সাঈদের মতো দু’একটা **** ছাড়া কোন বুয়েটিয়ানেরই ঘরজামাই হওয়ার সাধ থাকার কথা নয়।
এদিকে এর কিছুদিন পরই ভাইয়ার কাছ থেকে ফোন পেলাম। জানালেন যে, “একটা হিন্দু ফ্যামিলির থেকে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রীর জন্য বুয়েটের একটা হিন্দু ছেলে চাইছে। তুই চাইলে ট্রাই করে দেখতে পারিস।” আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম যে, এ টিউশনিটা পাবোই। কারণ এখানে তো আর ধর্ম নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু না। এ টিউশনিটাও হলো না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম যে, ঐ ফ্যামিলিটা ছিল ব্রাহ্মণ জাতের। আর ঐ জন্য ওরা নাকি আসলে ব্রাহ্মণ ছেলেই চাইছিলো। কিন্তু আমি যেহেতু বামুনের ছেলে নই, তাই টিউশনির কম্পিটিশনে এযাত্রাও আমাকে কাটা পড়তে হলো।
উপরের দুটি ঘটনাই ছাত্রী পড়ানো সংক্রান্ত দেখে অনেকে হয়তো ভেবে বসতে পারেন যে, সব মেয়ের বাবা-মাই বোধহয় এরকম হয়। আমার মধ্যেও প্রথমে সেইরকমই একটা ধারণার জন্ম হয়েছিলো এবং জীবনে কখনো ছাত্রী না পড়ানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম(যদিও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিলো )এখন জানি যে, আসলে এরকম বাবা-মায়েদের সংখ্যা খুবই কম এবং এই সংখ্যাটা দিনদিন আরো কমছে। বর্তমানেযুগে বেশির ভাগ বাবা-মাই একটা যোগ্য পাত্র খুঁজে বের করার চেয়ে নিজের মেয়েকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে বেশী উদ্যোগী হচ্ছেন।
দ্যাটস রিয়েলি এপ্রিশিয়েবল! আই স্যালুট দোজ প্যারেন্টস!!
নিজে কখনো ফেইস না করলেও অনেক ফ্রেণ্ডের কাছেই শুনেছি যে, টিউশনি করতে গিয়ে মাঝেমাঝে নাকি আইডি দেখিয়ে নিজের বুয়েটিয়ান পরিচয় প্রমাণ করতে হয়েছে। (অবশ্য বর্তমান সময়ে এই আইডি দেখেও অভিভাবকেরা যে সবসময় একটা বুয়েট, মেডিকেল কিংবা ঢাবি স্টুডেন্টকেই সন্তানের টিচার হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন, তাও বলা যায় না। কারণ নীলখেত থেকে এখন খুব সহজেই এইসব আইডি তৈরি করে নেয়া যায়। ফলে অনেকসময়ই অভিভাবকদের প্রতারণার শিকার হতে হয়…………অবশ্য আমি মনে করি যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তা সে যেই ভার্সিটিরই হোক না কেন, তার অবশ্যই একটা স্কুল-কলেজের ছেলে কিংবা মেয়েকে পড়াতে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাহলে কেন এই বুয়েট, মেডিকেল, ঢাবি ক্রেজিনেস?...ভালোছাত্র মানেই যে ভালো শিক্ষক হবে, তার নিশ্চয়তা কি?)
যাই হোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন টিউশনির জন্য জন্মসনদ, কুষ্ঠীপত্র কিংবা খৎনার মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে অভিভাবকদের সাথে দেখা করতে হবে!!!
--বাংলামায়ের ছেলে
মন্তব্য
আরও অভিজ্ঞতা চাই !
facebook
অভিজ্ঞতার ডালি এখনো খালি হয়নি।
সাথেই থাকুন...
নিজের অভিজ্ঞতা বলি, প্রথমদিন টিউশনিতে যেতেই ছাত্রীর বাবা বললেন, দেখো আজ পেপারের সাথে এই লিফলেটটা দিয়েছে, লিখেছে তো বুয়েটে পড়ে, কিন্তু এভাবে তো বিশ্বাস করা যায়না, তাই আমরা পরিচিত কারোর মাধ্যমেই টিচার খুঁজেছিলাম (এক সিনিয়র আপু, ওনার ভাগ্নি আমাকে টিউশনিটা দিয়েছিলেন)।
লিফলেট হাতে নিলাম। শুভ ও রেজা নামের দুই 'বুয়েটিয়ান' পড়াতে চান। সাথে তাদের ফোন নং দেয়া, এবং ঠিকানা দেয়া- ৩১০, রশিদ হল।
উল্লেখ্য, রশিদ হল ৩১০ এ থাকে আমার আপন ভাই, আমার ক্লাসমেট এবং এক জুনিয়র। শুভ বা রেজা নামের কেউনা। তাহলে বলেন কেন আইডি দেখতে চাইবেনা?
সহমত।
সেকেণ্ড ইয়ারে থাকতে কন্সট্রাকশন কাজ দেখার জন্য একবার SEL এর একটা সাইটে গিয়েছিলাম। তো, সাইট ইঞ্জিনিয়ার কথা প্রসঙ্গে বললেন যে, তার মেয়েকে নাকি আশিক নামে বুয়েটেরই এক ছেলে পড়ায়। পরে তার দেওয়া হলের নাম ও রুম নাম্বার অনুযায়ী খোঁজ করতে গিয়ে সেই আশিকের হদিস আর পাওয়া যায় নি...
আপনার জন্য স্টুডেন্ট মানে "ছাত্রী" আমার জন্য স্টুডেন্ট মানে "ছাত্র"। কোন এক কথা প্রসঙ্গে একদিন বলছিলাম "আমার স্টুডেন্ট বলেছে" অম্নি বন্ধুরা জ্ঞান দিলো, "তোর তো স্টুডেন্ট না, তোরটা তো ছাত্রী"।
বাহ! দারুন তো...
তা, ভাব বিনিময় চলে নাকি?
টিউশনির একটা মজার দিক হচ্ছে আপ্যায়ন পর্ব। আমি প্রথম যে টিউশনি করাই ওখানে নাশতা-পানি ভালোই দেয়া হতো প্রথম দিকে। পরে খাদ্যের মান এবং পরিমাণ দুটোই দিন দিন সমানুপাতিক হারে কমেছে! আর দ্বিতীয় টিউশনির কথা না বলাই ভালো। প্রথম দিন দয়া করে চা দেয়ার পর দ্বিতীয় দিন থেকে তা বন্ধ হয়ে যাবার পর ভেবে নিলাম ওদের বাড়িতে আমি যখন যাই তখন গ্যাস থাকে না!
এদিক থেকে আমার ভাগ্যটা অবশ্য বেশ ভালো।
বেশির ভাগ টিউশনিতে আপ্যায়ন পর্বটা ভালোই ছিলো।
গ্যাস থাকে না! বর্তমানে গ্যাস, বিদ্যুতের যা অবস্থা তাতে আপনার হাইপোথিসিস সত্যও হতে পারে।
রেজাল্ট খারাপ হলে টিচারের দোষ
আর ভাল হলে - ডানো'র গুণ।।
ভাই আপনার এই কমেন্ট পড়ে আমার আফসোস হচ্ছে, ব্লগে যে কেনো কমেন্টে লাইক দেয়ার অপশনটা নাই...
পুরাই সিরাম একখান কথা কইছেন...
বাহ, আবারো জমিয়ে দিয়েছেন!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সত্যিই জমেছে নাকি! তবে তো বেশ!!
ভাবছি নেক্সট পর্বটা একটু উইকিলীয় ধাঁচে করবো...
দারুণ হয়েছে পর্বটা। বিশেষ করে ছাত্র আর স্টুডেন্টের ব্যাপারে কনফিউশনটা।
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
:ধইন্যা:
ভাবছি নেক্সট পর্বটা একটু উইকিলীয় ধাঁচে করব...
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
সব পপকর্ণ একাই খাইয়েন না...আমিও আইতেছি...
মজা পেলাম পড়ে!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
পরের পর্ব লেখা শেষ। কিছু টাইপো প্রব্লেম দেখা দিয়েছে। আশা করি প্রব্লেম সলভ করে খুব দ্রুতই প্রকাশ করতে পারবো...
আমার কোন ' ভাইয়া' টিচার ছিলনা, সব স্যার আর আপা ... দুক্খু
আহালে...............
নতুন মন্তব্য করুন