এর আগে আমার কিছু লেখায় আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি আমরা কেন 'সচেতন চিন্তা' বা 'কনশাস থট' করতে চাই না। এটা কষ্টকর কাজ। আমাদের চিন্তার জ্বালানি আবার দৈহিক, আর আমাদের মস্তিষ্ক খুবই রিসোর্স-হাংরি একখান জিনিস। অফিসে কাজ করতে গিয়ে আমি নিজে পরিষ্কার টের পাই যে জটিল চিন্তার ক্যাপাসিটি দিন যেতে যেতে কমতে থাকে। এগুলো এড়ানোর উপায় নেই তা না; অনেক বড় একটি উপায় হল রিচুয়ালাইজ করে ফেলা, বা 'ক্রীড়া' হিসেবে নেয়া। পল গ্রাহামের একটা লেখায় পড়েছিলাম নিজের মস্তিষ্ককে ট্রিক করার ব্যাপারটা - সেগুলি করে অনেক বুদ্ধিশক্তিই সংরক্ষণ করা সম্ভব।
যাকগে সে কথা। সচেতন চিন্তা করতে না চাওয়াটা দোষের কিছু না। সুতরাং আমরা জেনারালাইজ/ স্টেরিওটাইপিং করি। এ কারণেই একেবারে সাধারণভাবে দেখলে আমরা 'আবেগ' আর 'যুক্তি'-কে আলাদা করি।
কিন্তু যদি মস্তিষ্কের ভিতরের কাজ-কারবার দেখি, সবকিছুই সিগন্যাল স্ট্রেংথ-এর ব্যাপার। 'আবেগ'-কে খুব বেশি হলে সাধারণভাবে বলা যায় আদিমস্তিষ্কের সিগনাল। 'যুক্তি' হল আধুনিক মস্তিষ্কের কাজ-কারবার। সরল সমীকরণ। আমি এটা নিয়ে এত প্যাঁচাইতেসি ক্যান তাইলে?!
*
কারণ সমীকরণ সহজ হলেও, বাস্তবজীবনে এর বাস্তবায়ন মোটেই কোন সহজ জিনিস না। এবং 'দিস ইমোশনাল লাইফ' অনুযায়ী, আজকে আমরা যেই জগতে বসবাস করি, সেটার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক একেবারেই ইভল্ভড না।
আজকের হোয়াইট-কলার অফিসজীবীদের কথা চিন্তা করেন। শনিবার রাত। আমার মাথা এখনই গণহারে কর্টিসল ছাড়তেসে, কারণ কালকে আমার ১০১ রকমের ডেডলাইন আছে। প্রায়োরাইটাইজেশনের মধ্যে প্রায়োরিটাইজ করতে হবে। কিছু কাজ পারবো না জানি।
কিন্তু আমার মাথা তৈরি হইসে খাবার তৈরি করে, খেয়ে, ঘুমাইতে। সে এত্ত কাজ করার জন্য তো কন্ডিশন্ড না। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স কোটি কোটি করান, কিন্তু আমাদের শরীর দিনে ১৬ ঘন্টা উঁচুমাত্রায় কর্টিসল নেয়ার জন্য তৈরি না। ড্রাগ এ্যাডিক্ট বলে কাকে গালি দেন - আজকের কর্মক্ষেত্র আমাদের শরীরকে তো হরমোন এ্যাডিক্ট বানায় ফেলতেসে। এবং এখানে আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করতে পারেন জ্যারেড ডায়মন্ডকে। ডায়মন্ড ('গানস, জার্মস এ্যান্ড স্টিল'-খ্যাত) এর মতে, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল হান্টার-গ্যাদারার সমাজ থেকে কৃষিজীবী সমাজে ট্রানজিশন করা। কৃষিজীবী সমাজ ব্যক্তির জন্য খুব একটা উপকারী না নানা কারণেই, শর্করা/চর্বি সংরক্ষণ থেকে হরমোন এবং স্ট্রেস লেভেল, নানা কারণেই। কিন্তু সমষ্টিকভাবে স্পিশিসের জন্য স্বল্পকালে উপকারি, যদিও সেখানেও ওনার কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। সমস্যা হল - আফ্রিকান মাগুর বা কচুরিপানার মত, কৃষিজীবী সমাজ একবার শুরু হলে রোলওভার এফেক্ট-টা থামানো সম্ভব না। এ ব্যাপারে এসমেরাল্ডা সান্তিয়াগোর 'কনকুইস্তাদোরা' বা জেমস মিচেনারের 'ক্যারিবিয়ান'-ই যথেষ্ট; যদিও ডায়মন্ডের বিখ্যাত বইয়ের জার্মস অংশটিও কম নয়।
সেইভাবেই, ব্যক্তিপর্যায়ে ডকিন্স সাহেবের 'দ্য সেলফিশ জিন' (১৯৭৬) এর কথা মনে পড়ছে। ডকিন্সের বই সম্পর্কে মরালিস্টদের কিছু সাধারণ সমালোচনা আছে। কিন্তু ডকিন্সের বইটা লেখা - মানে আমি এভাবে দেখে মজা পাই - এমিডালা পর্যায়ে। কেউ কখনো ফ্রন্টাল ওভাররাইড করতে মানা করে নাই।
কিন্তু সেলফিশ জিন-এর, সেলফিশ বিবর্তন-এর কার্যকলাপ প্রতিনিয়তই আমরা দেখি চোখের সামনেই। প্রেম-ভালবাসা এর বড় উদাহরণ। মেয়েটাকে এসএমএস করবো, না করবো না? কল করবো, না করবো না। জিটকে গুঁতাবো, না ফেসবুকে। লাইক মারবো, না শেয়ার দিবো? কথা বলবো, নাকি পাত্তা দিবো না। এসব ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক রাত-আর-দিন রিজনিং চালাতে থাকে, এদিকে সামনে এসে সরীসৃপ মস্তিষ্কের ওভারহোয়েলমিং বুলেট-ট্রেইন সিগনালে সব জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়। প্রেমিক-প্রেমিকার দোষ দিবেন? সামলায়! এ বিষয়ে বহু গবেষণা হইসে, আরিয়েলি থেকে হেলেন ফিশার পর্যন্ত। ড্রাগ এ্যাডিক্টদের করুণা করলে প্রেমে পড়া লোককেও করুণা করেন অনুগ্রহ করে, এরা বিবর্তনের আর্সেনালের নিউক্লিয়ার বোম সামলাচ্ছে। প্রেমের উইথড্রয়াল কোকেনের উইথড্রয়ালের থেকেও কড়া, এবং মস্তিষ্কের একই অংশ হুবহু কার্যকর হয়। মানুষ যে একা একা ছ্যাঁকা খেয়ে সামলায় উঠে, প্রতিনিয়ত প্রেম রিহ্যাবে যায় না, সেটাই কি যথেষ্ট না?
এখানেও দেখেন, পরিবেশ কিন্তু আমাদের অনুকুলে না। হোমো স্যাপিয়েনস এর ৭০ এর বেশি বাঁচার কথা না। ৩০-এর পর আমাদের শরীর হাল ছেড়ে দেয়। আধুনিক সমাজ যে কি পরিমান আরামদায়ক আমরা হয়তো সেটা উপলব্ধি করি না, কিন্তু আমাদের বেসিক ডিজাইন এত আরামে কুলায় উঠতে পারে না। পুবার্টির পর পর যৌন কীর্তিকলাপ করে, 'শর্ট বাট ভায়োলেন্ট লাইফ' লিড করে আমাদের মরে যাওয়ার কথা। আজকের আমরা খুব বেশি স্বার্থপর - প্রকৃতি আমাদের সাথে ডিল করে ব্যক্তি পর্যায়ে না; জিনিসটা আসলেই কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মত - একটা পার্টিকলের ব্যবহার বোঝা প্রায় অসম্ভব - অনেকগুলিকে নিয়ে কোরিলেশন সম্ভব। অথচ আমরা ইদানিং ব্যক্তির অধিকার, ব্যক্তির স্বার্থ এসব নিয়ে কথা বলি। আমরা পুরো সমাজ ডিজাইন করে ফেলেছি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের আলোকে। আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের প্রত্যেকেই সেই নিউ এজ 'বিউটিফুল ইভল্ভড হিউম্যান বিয়িং' (বাক্যাংশটা মাইকেল ক্রাইটনের)। আজকের সমাজপরিকল্পনা ব্যক্তির উপর চরম স্ট্রেস ফেলবে, ব্যক্তি এমিডালা-লোবের যুদ্ধে বিদীর্ণ হবে, এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না। আশার বিষয়, ডেভিড ব্রুকসের মত লোকজন এসব দেখেছেন এবং 'দ্য সোশ্যাল এনিম্যাল' ধরণের বই-ও লিখেছেন। ব্রুকস আমাদের রক্ষাকর্তা নন। কিন্তু ব্রুকস লিখছেন ক্লাসিসিস্টদের আলোকে - এপিকিউরাস, সেনেকা, লক, মন্টেইন, গ্যেটে। পঞ্চম শতাব্দীতে বোয়েথিয়াস লিখেছিলেন তার বিখ্যাত পিস 'দ্য কনসোলেশন্স অফ ফিলোসফি'; আজকে বোয়েথিয়াস-এর আলোকে এলেইন ডি বটন-রাও এ নামের বই লিখছেন।
কিন্তু শুধু 'হিউম্যানিস্ট' লেখায় আমাদের এ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে সেটা কেউ বলছে না। আছেন পিংকার, আছেন গিলবার্ট, আছেন কাহনেম্যান, আছেন ডিয়েনার, আছেন সেলিগম্যান; আছেন হ্যারিস, মেডিনা, আরিয়েলি। আছেন আপনি। নিজের মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত আপনি/আমি যে যুদ্ধে লিপ্ত, সেখানে শান্তিচুক্তি এনে, এমনকি ইউনিয়ন বানিয়ে নিজের জীবন উপভোগ করা আপনার-আমারই হাতের মধ্যে। ব্যক্তিগতভাবে, আমি নিজের ভিতরে কি চলছে নিজেও কি পুরাপুরি বুঝি ছাই! কিন্তু অসম্পূর্ণভাবে যতদূরই বুঝি, আমার দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে খুব উপকার করেছেন এসকল মহোদয় ও মহোদয়া। নিজে কিভাবে চিন্তা করবো, সেটা আমি নিয়ন্ত্রণ করতেই পারি, আর সেটা আমি কিভাবে অনুভব করবো, সেটাও পাল্টাতে সাহায্য করে। নিজের 'দেহ-মন' যে আমার নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই (খুব বেশি হলে ৩%), সেটা যখন আমি উপলব্ধি করবো; আমার প্রজাতির (স্পিশিসের) ইতিহাস আর আর্জগুলো যখন আমি বুঝবো, তখন এই স্ট্রাগলের মধ্যে এপিফানিও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এটাকে ইসলাম ধর্মে বলে গ্রেটার জিহাদ, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস বলেন 'দিস ইজ ওয়াটার', সেনেকা বলবেন হাইয়ার স্টোয়িসিজম। হ্যাঁ, আমাদের বিবর্তনের এক পর্যায়ে হয়তো রেমন্ড কার্জভাইলের আশানুযায়ী আমরা মাইক্রো-পর্যায়ে আমাদের মস্তিষ্কের অয়্যারিং হয়তো পাল্টিয়ে এগুলোর প্রয়োজন বিলুপ্ত করে দিতে পারবো (ঠিক যেমন আমাদের শরীরের ডজনে ডজনে কমপোনেন্ট এখন এক্সটিংক্ট হয়ে গেছে, এপেনডিসাইটিসের মত এখন খালি বিপদই ঘটায় কালেভদ্রে), কিন্তু আজকে, এখন আমি অসহায় আমার দেহ-মন নিয়ে।
উরেব্বাপরে, আমি এগুলা কী লিখলাম!
মন্তব্য
কিন্তু 'দর্শণ' বানানটা কি ঠিক হলো?
ভুল করে ফেলেছি মনে হয়।:-( কোন মডু ঠিক করে দিবেন? মোবাইল দিয়ে করা যায় না।
নিজের দেহ মনের উপর নিয়ন্ত্রন ৩% এ কথাটা কি সত্য? তাহলে আর এত এই নিয়ে টানাটানি করার দরকার কি? খুব আরাম পেলাম, এখন থেকে কেউ ‘আবেগ’ নিয়ন্ত্রন কর বলতে এলে এটা রেফারেন্স সহ জানিয়ে দেয়া যাবে
চলুক............
_____________________
Give Her Freedom!
একটা আয়না- গোলোকাকৃতি.. মানে কমলালেবুর মত...
তার মধ্যে বসে আছি...
এই জায়গাটা খোলাসা হলো না। কারণ, ঐ যে আমার সরীসৃপ মস্তিস্ক!
লেখকের কাছে অনুরোধ, পাঠক পরিধি বাড়াতে আরেকটু একটু খোলাসা করে লিখুন। আর ঐ যে কিছু কিছু যুতসই ইংরেজী টার্ম ব্যবহার করেছেন, ওগুলোর যথাযথ বাংলা শব্দ জুড়ে দিন। স্পষ্টীকরণের সুবিধার্থে হয়ত বন্ধনীর ভেতরে ইংরেজী টার্মগুলোও রাখলেন। এই লেখা যতবেশী আমজনতার কাছে পৌঁছে যায় ততই লাভ!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সিরাত ভাই, আগের পর্বটা এই পর্বের চেয়ে বেশি সহজ আর উপভোগ্য ছিল। আরেকটু সহজ করে লেখার অনুরোধ জানাই। সিরিজ চমৎকার হচ্ছে, চলতে থাকুক।
নতুন মন্তব্য করুন