আমাদের বাড়িটা দোতলা।আশেপাশের অসংখ্য জীর্ণ দালানের ভেতরে আলাদা করে চোখে পড়েনা। দ্বিতীয়বার রঙ করা হয়নি, দেয়ালগুলো হলদে, শ্যাওলায় ঢাকা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় বাড়িটা ধসে পড়বার অপেক্ষায় আছে। ভেতরটাও দারুণ মলিন, স্যাঁতস্যাতে নোংরা দেয়াল, ভাঙ্গা মেঝে। আলো বাতাস সাধারণত এদিকে উঁকি দেয়না।তবু ভাড়াটিয়ার কখনো অভাব নেই। ভাড়া কম, বাড়িওলা ঝামেলা করেনা, এ জন্য বাড়ির মালিন্যও ভাড়াটিয়াদের নিরুৎসাহিত করেনা। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রায় পাকাপাকিভাবে এই মালিন্যের ছাপ পড়ে যায়। একতলার অন্ধকার ঘরগুলো থেকে দুঃখ-কষ্ট বের হবার রাস্তা পায়না।
ভোরের বারান্দায় সূর্যটা কখন উঠে যায় টের পাওয়া যায়না। আমি বারান্দায় বসে হঠাৎ আসা ভোরটা উপভোগ করার চেষ্টা করি। পাখির ডাক ছাপিয়ে একসময় ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যায়। আমি জানি ওরা কারা। সামনের গলির শেষ মাথায় টিনের ঘরটায় থাকে, স্বামী-স্ত্রী। লোকটা রোজ এ সময় এ ঘরে ফেরে,তাও মাতাল হয়ে, মেয়েটা চেঁচায় জোরে জোরে, একপর্যায়ে লোকটা মারধর শুরু করে, চিৎকার কান্নায় রূপ নেয়। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় এই গলির বাসিন্দাদের। তবু কেউ কিছু বলে না। এটাই যেন স্বাভাবিক।
একটু পরেই ঢল নামে গার্মেন্টসগামী মেয়েদের। রাস্তায় গাড়ি চলবার জায়গা থাকেনা। দ্রুত পায়ে রাস্তা জুড়ে হেঁটে চলে ওরা। জায়গা দিতে বললে অসম্ভব বিরক্ত হয় কয়েকজন, আবার কিছু মানুষ এই সুযোগটাও নেয়। ভীড়ের মধ্যে ইচ্ছে করে গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ওরা মাঝে মাঝে মুখ খারাপ করে গালি দেয়, মাঝে মাঝে সহ্য করে নেয়।
সেদিন একটা মেয়ে বেশ জোরেসোরেই প্রতিবাদ করেছিল। আমি বারান্দায় বসে গালিটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু চায়ের দোকানে বসে রোজ সকালে মেয়েগুলোর জন্য অপেক্ষা করা লোকটা উলটো ফেটে পড়েছিলো। এতগুলো মানুষের সামনে মেয়েটাকে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দিয়েছিল। মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিল, ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল বোধহয়। আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছিল সেদিন……নিজের অক্ষমতা আর ব্যর্থতার জন্য।
অফিসগামী লোকগুলোর ভীড় শুরু হয় আরো ঘন্টাখানেক পরে। আমাদের নিচতলার রফিক সাহেব এসময় বের হন। অফিস মগবাজার, এখান থেকে অনেকটা দূরে। কিন্তু উপায় নেই, ওদিকে কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যায়নি। দুপুরের খাবারটা বাসা থেকেই নিয়ে যেতে হয়। রফিক সাহেবের স্ত্রী রোজই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায়। কমবয়সী মেয়েটার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। এত অল্পদিনেই তাকে সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মনেহয়। কারণটা অবশ্য রফিক সাহেবই। প্রায় রাতেই ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসে। তারপর দীর্ঘক্ষণ মেয়েটার কান্নার আওয়াজ। রনি বলে রফিক সাহেব নাকি প্রায়ই মেয়েটার গায়ে হাত তোলেন। কেন, কে জানে! শুনতে না চাইলেও এসব কথা শুনতে হয় আমাকে। রনি কোন কথাই চেপে রাখেনা। সকাল-বিকাল সারা পাড়া ঘুরে জেনে আসা সব ঘটনাই তার আমাকে বলা চাই।
আর তাই ঘর থেকে না বেরিয়েও পাশের গলির শফিক সাহেবের মেয়েটা কেন আত্মহত্যা করলো তা জানা হয়ে যায় আমার। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটাকে ছোটবেলায় দেখেছি আমি। আমার স্কুলেই পড়ত, কয়েক ক্লাস নিচে। আমি স্কুল ছাড়বার পর আর দেখা হয়নি। সবাই বলে ওকে নাকি কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, দু’দিন পর ফেরত ও দিয়ে যায়। তার মাসখানেক পরেই আত্মহত্যা করে মেয়েটা। ও কি তবে……অন্তস্বত্ত্বা হয়ে গিয়েছিল? নাকি মা-বাবার অপমান সহ্য করতে পারেনি? রনি বলছিল শফিক সাহেব নাকি অফিস যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। সবখানে সবাই একই কথা জিজ্ঞেস করত, মেয়েকে কি ওরা কিছু করেছে ভাই? মেয়েটা আর বেরোত ও না। কে জানে ওর জন্য হয়ত আত্মহত্যাই ভাল ছিল! আমরা ওকে একটু সমবেদনা দিতে পারিনি, ওর কি প্রয়োজন আমাদেরকে কিছু দেবার! ওর নিজের প্রয়োজনের বাঁচবার রাস্তাটাও বন্ধ করে ফেলছিলাম ধীরে ধীরে।
রনি সকালবেলা রান্না করে রেখে বেরিয়ে যায়। সারাবেলা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় কে জানে! ফিরে সেই সন্ধ্যাবেলা। বই নিয়ে বসতে বললে বসে কোনসময়, তারপর একসময় গল্প শুরু করে। সারাদিন কি দেখে এলো, কার কি হচ্ছে, এসব গল্প। আমার শুনতে মন্দ লাগেনা! সময় কেটে যায়। বহুদিন না দেখা শহরটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। যেন কতকাল আগে আমি হেঁটে বেড়াতাম এই শহরটার বুকে। আমার স্মৃতির দৌড় মলিন দেয়ালগুলো ছাড়িয়ে চলে যায় আরও দূরে। রনিকে বারবার বলা গল্পগুলো আবারও বলে ফেলি। ও হয়ত বিরক্ত হয়, কিন্তু মুখে বলেনা। কিংবা, কে জানে, হয়ত গল্প শুনতে শুনতে আমাকে ও নতুনভাবে দেখতে থাকে!
রনির গল্প শুনতে শুনতে আমার চোখ চলে যায় রাস্তার দিকে। আমার সকালবেলার সঙ্গীরা বাড়ি ফেরে একে একে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসে মেয়েগুলো, ঘরে গিয়ে আবার হয়ত কাজ। অফিস ফেরত লোকগুলো ঘরে ঢোকে, কোন কোন ঘর থেকে পড়ার আওয়াজ, কথার আওয়াজ ভেসে আসে। পাড়ার ছেলেরা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতেই থাকে, অবিরাম নেড়ে চলা চামচের টুনটুন শব্দ এখান থেকেও শোনা যায়।
কখনো কখনো বৃষ্টির রাতে আমি পশ্চিমের ঐ বাড়িটার ছাদে চেয়ে থাকি। ছেলেটা হাত ধরে নিয়ে আসে মেয়েটাকে, দু’জনে মিলে অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভেজে। আমি অদ্ভুত এক আনন্দ নিয়ে চেয়ে থাকি সেদিকে। আমারও ভিজতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু সেই বৃষ্টির পানি আমাদের মলিনতা ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায়না। আমার জীর্ণ বাড়ির দেয়াল ভেদ করে গভীর রাতে মেয়েটির কান্নার শব্দ ভেসে আসে…আমি নির্ঘুম চোখে অপেক্ষা করি রাত ফুরোবার।
দ্বিতীয় সুবর্ণরেখা
মন্তব্য
প্রথম প্যারাটা খুব সুন্দর হয়েছে।
লিখতে থাকুন, সচলে স্বাগতম।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
নির্মেদ ঝরঝরে গদ্য। খুব ভালো লাগলো নগরজীবনের বর্ণনা। এরকম আরো লেখা পাবো আশা করি।
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
পড়লাম। পর্যেবক্ষক মন আছে আপনার।
গল্প ভালো লেগেছে। এইফাকে বলে রাখি আপনার নামটা আমার খুব পছন্দ, সুবর্নরেখা চরিত্র টা আমার খুবি ভালো লাগা একটা চরিত্র।
ভালো লাগলো
সচলে স্বাগতম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনার লেখা হিপ্নোটাইজিং। পড়তে বসলে শেষ না করে উঠা যায় না।
নতুন লেখা কবে দেবেন?
মাথায় কিছু আসেনা.........আর আসলে লেখার সময় পাইনা
ধন্যবাদ সবাইকে
কেমন যেনো একটা ঘোর লাগা আবহ আছে আপনার লেখায়। আরও লেখা পাওয়ার আশায় থাকলাম।
অতীত
নতুন মন্তব্য করুন