ক্যারিয়ার! আসলে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে লাগে আমার কাছে। ক্যারিয়ার শুনলেই ক্যারিয়ারশূন্য মেয়েটার কথা মনে পড়ে। বিলবোর্ডে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল বেচারী। আমার এক বন্ধু ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
আমি গিয়েছিলাম ওর মেসে। ও নেই। ‘ধৈর্য্য ধর- যদি মুমিন হও’- ছোট্ট একটা চিরকুট আমার জন্য রেখে বন্ধু কোথায় যেন গেছে। মোবাইল ফোনে ধরতে গিয়ে দেখি- বন্ধু সেটাও বন্ধ করে বসে আছে। সময়টাকে থমকিয়ে নিজেকে রাজা বানিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করি। বিরক্ত লাগে। ঘরের মধ্যে এখানে ওখানে হেঁটে বেড়াই। পড়ার মত বই ম্যাগাজিন পেলেও সময়টা কেটে যেত।
পড়ার টেবিলটায় সব গাইড জাতীয় বইয়ের ছড়াছড়ি। সবার উপরে একটা সাধারন জ্ঞান ও সাম্প্রতিক বিশ্বের বই উল্টে পড়ে আছে। বইটা এখন ওর বউয়ের মতন। সারাক্ষণ এটা নিয়ে পড়ে থাকে। তাও একটা চাকরী ওর কপালে এখনও জুটলো না। বইগুলোর ফোঁকর ফাকর খুঁজি। একটা ম্যাগাজিন জাতীয় যদি কিছু পাওয়া যায়। ম্যাগাজিন পাওয়া যায় না, তবে কোন এক অষুধ কোম্পানীর প্যাডের রুলটানা পৃষ্ঠায় প্যাচানো হাতে লেখা একটা চিঠি আবিষ্কার করে ফেলি। কাকে লিখেছে ও? কৌতুহল ঝাপটা মারে। কিন্তু চোখ রাখতেই বুঝি চিঠি নয়, কবিতা। আমি কবিতাটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়ি।
রাতভর বৃষ্টি নেমেছিল দূরে
অথবা নামে নি কোথাও ...
আমি জানালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির স্বপ্ন দেখছিলাম।
পায়ের উপর দিয়ে তেলাপোকাটা হেঁটে গেলে আমি টের পাই
তেল চিটচিটে দুপুরটা কেবল জেঁকে বসতে শুরু করেছে...
সূর্য গড়িয়ে পড়তে পড়তে ও একটা বিশাল পাথর হয়ে উঠবে।
আমি প্রত্যেকদিনের মতোই তাকিয়ে থাকবো ....
ছেলেরা কেউ ব্যাট আর কেউবা বল হাতে হেঁটে যাবে
আবার ফিরে আসবে...
মায়ের বকুনী এড়াতে রাতের অন্ধকার ভরে উঠবে গুনগুন শব্দের শব্দে।
বুকের ভেতরে একটু কেমন যেন লাগে
একটা হারিকেনের আলোয় ক্রমাগত এক বিষন্ন বালকের মুখ ভেসে ওঠে...
বিষন্নতা বাড়তে বাড়তে সেও একটা ছোট্ট পাথরের নুড়ি হয়ে যায়।
আল্লাহ রাতকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের বিশ্রামের জন্য ...
বন্ধুরা একে একে ফিরতে শুরু করলে বুকের খামচিটা কমে
আর তখনই একটা হাওয়া বইতে শুরু করলো...
আজকে রাতে আমিও সবার মতোই ঘুমিয়ে যাবো।
এই রাতটা যদি আর কখনও না ফুরোতো
তবু সবার মতোই আমারও রাত গভীর হতে থাকে ...
সবার মত ঘুম আমার চোখে নেমে আসে না।
অন্ধকারে ভাবনাগুলো জেগে উঠে ...
ফ্যাকাসে অন্ধকারে হিমুর মুখ,
ও একটা আলাদা বাসা করবে ভাবছে।
সবুজের বাসায় টাকা পাঠাতে হয় বেতনের প্রায় পুরোটা
সহসা তার এ তল্লাট থেকে পাততাড়ি দেবার সূযোগ নেই।
রায়হানের এ জীবনে কোনদিনই বুঝি ছুটির হিসেব মিলবে না।
বিদেশের খোজে বাবলু সকালে দৌড়াবে এ্যামবেসী অথবা অন্য কোথাও।
আর যখনই দেখা হবে একটা অকৃত্রিম হাসি জড়িয়ে ওরা বলবে - হ্যা রে...
বিপুল এখনি দ্বিতীয় চাকরীটার অফার নিয়ে হিসেব কষছে
হিসেবের বাইরে কোন কিছুই হয় না।
এখন গণিত উৎসব হয় অনেক আয়োজন করে। আমাদের সময় এগুলো কোনকিছুই ছিল না।
সবুজ প্রায় পাখির মতো ... বিছানা ছেড়ে উঠলেই সূর্য উঠবে তার পিছে পিছে।
মনে ঘা দেয়-
আবারও একটা দিন হবে এখন।
ওরা সবাই কাজে বেরিয়ে যাবে।
আমি আবার দমবন্ধ ঘরে ...
বৃষ্টির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভুলে যাবো
আজ সার্টিফিকেটে আমার বয়স ৩০ পূর্ণ হলো।*১
ওর জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়। বয়সটা সত্যিই চলে গেল তাহলে। মার্কেটে টিকে থাকাই অনেক কঠিন হয়ে গেল ওর জন্য- ভাবি আমি। ক্যারিয়ারটা ঘোলাটে হয়ে গেল। ঠিক তখনই ক্যারিয়ারশূন্য মেয়েটার সাথে পরিচয় হলো।
মেয়েটা এলো বন্ধুর পকেটে চড়ে। এখনকার পৃথিবীতে অবাক হওয়াটাই অবাক ব্যাপার। এখন সবই পকেটে ঢুকে গেছে। মোবাইলের যুগ এটা। মোবাইলেই মেয়েটাকে দেখি। একটা ভিডিও ক্লিপিংসে ঢুকে মেয়েটা শুয়ে আছে।
নিখাদ নগ্ন একটা মেয়ে।
মেয়েটা মুখ ঢেকে আছে।
সে তার মুখ দেখাতে চাচ্ছে না।
ক্যামেরা তার শরীরের নিখাদ গোপনীয় অংশগুলো ছুঁয়ে আসে ... মেয়েটা মুখ ঢেকে আছে এখনও।
একটা অদৃশ্য লোকের গলা শোনা যাচ্ছে ... শুনতে চেষ্টা করি। কিন্তু বলছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ভল্যূম বাড়িয়ে দিলে কথাগুলো কানে লাফিয়ে ওঠে।
: প্লিজ..
: না না.. (মেয়েটা মাথা নাড়ে)
: সত্যি বলছি, আমি অনেকের ছবি তুলেছি .. এই ধরো জিনি, সানিয়া, কেতকী। ওরা সবাই কত নামীদামী মডেল এখন। ওদের ক্যারিয়ারওতা আমার হাতেই গড়া। ওদের কারো ছবিতো এক্সপোজ করিনি ...আচ্ছা এই তোমাকে বলছি নেক্সটবার দেখা হলে তোমার সামনে ডিলিট করে দেবো .. কথা দিচ্ছি।
: আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। (মেয়েটা অষ্ফুট স্বরে বলে)
: ক্যারিয়ার.. তোমার ক্যারিয়ারতো আমার হাতে .. আমিই তোমার ক্যরিয়ার গড়ে দিবো .. এটা আমার দায়িত্ব।
মেয়েটা আর চেষ্টা করে না . .হাতটা ছেড়ে দেয় .. আমি মেয়েটাকে দেখি ..
ছবি শেষ হয়ে গেলেও মেয়েটা আমার মাথা থেকে যায় না।
মেয়েটা যখন মুখের হাত সরিয়ে নিল .. ঠিক কী চলছিল তার মনের ভেতরে?
ঠিক কোন মুহূর্তে সে তার এই অবস্থাটি মেনে নিলো? তারপর সে কী ভাবছিল?
... এইসব কথা মনে হয়।
সে একটা সময় বুঝতে পেরেছিল- বিখ্যাত মডেল হবার সোনালী স্বপ্নের ফাঁদে সে ধরা পড়ে গেছে। তার স্বপ্নকে ঘিরে বাস্তবতা যে জাল বুনেছে, তা ছিন্ন করার আর কোন উপায় নেই। তখন কি যে ক্লাšিত ওর চোখে ... আমি মেয়েটার চোখের কথা ভাবি।
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিলো মেয়েটার জীবনে?
ভাবতে চেষ্টা করেছি। পারিনি। এক কথা দুই কথা ভাবতে গেলেই ক্যারিয়ার শব্দটা মাথার উপরে হাতুড়ির ঘাই মারে।
মেয়েটা বললো আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে .. সে বললো না আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে ...। মেয়েদের চরিত্রের ধবধবে পবিত্রতায় এরকম একটা কলঙ্কের ছোপ পড়লে সবাই সাধারণত- ‘জীবন নষ্ট হয়ে যাবে’ এই কথাটা বলে। কিন্তু মেয়েটা এই কথাটা বলেনি। ও বললো- ...
আবার মনে হলো -ঠিকইতো আছে মনে হয়। পৃথিবীতে এমন কোন ভুল, কোন পাপ কি আছে যা জীবনের চেয়েও বড়? ...আছে কি...? ... হতে পারে কি...?
এই জন্যই বোধহয় মেয়েটা বললো না জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
মেয়েটাকে ভাল লাগে। ও জীবনটাকে ক্যারিয়ার থেকে আলাদা করতে পেরেছে। ও তাহলে বেঁচে যেতেও পারে হয়তো।
আমি ভাবি। আবার ভাবি-
তবু ও কি বাঁচতে পেরেছে? ক্যারিয়ারটাকে বাদ দিয়ে জীবনটা কী?
ভাবনাগুলো ওর জন্য একটা খারাপ লাগা তৈরী করে। আমি ‘মন খারাপ মন’ নিয়ে এই শহরে ঘুরে বেড়াই। এই আশায় -একটু যদি মন ভাল হয় । এমনিতে ভাল লাগে না - তবুও মাঝেমধ্যে কখনও কখনও আমাদের বেঁচে থাকার এই শহরটাকে ভালো লাগে। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় যখন নদীর কোল ঘেঁষে শহরটায় আলো জ্বলে ওঠে- এই সময়টা আমার খুব প্রিয়। এক এক করে বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করলে সন্ধ্যার অন্ধকার নদীর জ্বলে ছায়া ফেলে। নদীর বুকে আলোর কি সব কারুকাজ ফুটে ওঠে। ছোট ছোট ঢেউ এ লাল নীল সবুজ রঙ তির তির করে কাপে। এর মধ্যে একটা জাহাজ সিটি দিয়ে শহর ছেড়ে কোথাও চলে যায়। তারপর একটা একটা করে - ঠিক সন্ধ্যার পর অনেকগুলো সাদা সাদা জাহাজ বেরিয়ে যাবে বরিশাল, হুলারহাট, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর সহ কোথায় কোথায়।
জাহাজগুলো ভোর বেলার শিউলীর মতো মনে হয় .. টুপ টুপ করে শহরের বুক থেকে খসে পড়ছে.. তাদের সারা গায়ে শিশির বিন্দুর মতো মানুষ জড়িয়ে থাকে। এত মানুষ শহর থেকে চলে যায় কিন্তু শহরের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই .. সে আছে নিজের তালে। শহরটার কথা থাক - আমার এই শুকনো খটখটে শহরের কথা একটুও ভাবতে ইচ্ছে করে না। এই শহরটা শুধু গিলতে জানে। শুরুতে মাথা, শেষে পুরোটা শরীর। তার চেয়ে ভাবতে চেষ্টা করি না কেন -অনন্ত অনাদি কাল ধরে এই নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
নদীর উপরে নীল আকাশ ভাল, কুয়াশায় মোড়া নদীতে ধোঁয়াটে নৌকা ভাল, ঝুম বৃষ্টিতে দুকুল ভেসে যাওয়া ভাল।
এই যেমন সেদিন।
জল বাড়তে বাড়তে সেই ঘর অবধি। তারপরও কি থামে, বাড়তে বাড়তে পুরো ঘরটাতেই অর্ধেক জল। হঠাৎ টের পাই ছোট ছোট মাছ আসছে। একটা বড় মাছ পাশ দিয়ে চলে গেল। জল বাড়ছে। একটা কালো বিড়াল কোথা থেকে আসে। ঘরের কোনে কাফকার বইটার ঠিক উপরে বসে আছে। কিচিরমিচির শব্দ। তাকিয়ে দেখি ঘুলঘুলি দিয়ে অনেক পাখি আসছে। হাজার হাজার পাখি। পুরো ঘর পাখিতে ভরে গেছে। একটা বই কি ভাবে পানির নিচে ডুবে গেছে, তার অক্ষরগুলো বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে ভাসতে ভাসতে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।
তারপরেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
এই স্বপ্নটাই আমাকে একটা চাকরীর ক্যারিয়ার থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। নাকি, যে চাকরীটা আমাকে বাঁচাতে পারছিল না- তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমিই স্বপ্ন দেখছিলাম? ঠিক বুঝতে পারি না।
বেশ একটা স্বপ্ন দেখা হলো ভেবে নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে যেই অফিসে যাওয়া ওমনি ঘটনাটার শুরু। ঠিক তখন নয় ঘটনাটা শুরু হয় বড়কর্তা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আগের দিন অফিসে আসি নি কেন। শুধু নিরীহ জানতে চাওয়া মাত্র, এর মধ্যে কৈফিয়তের সুরও ছিল না। আমি বলে দিলেই পারতাম- শরীরটা ভাল ছিল না কাল। এরকমতো কতই হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমার মনে হলো আমি আগেরদিন অফিসে এসেছিলাম। বড়কর্তাই কোথাও ভুল করছে মনে হয়।
: কিন্তু আমিতো কাল এসেছি।
: কালকে এসেছো! অ্যাবসার্ড, আমি নিজে তোমার তিনবার খোঁজ করেছি... কেউই তোমাকে দেখে নি।
আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকি। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করি। কাল বড় কর্তার সাথে দেখা হয় নি ঠিকই, কিন্তু সেতো কতদিনই হয় না। মেজোকর্তা পরশু দিন তার একগাদা কাজ কাঁধে চাপিয়ে বউকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে গেলেন একসপ্তাহের ছুটিতে। তার উপর নিজের কাজতো আছেই। সব সামলে উঠতে উঠতে ঘাড় ওঠানোরই ফুসরত পাই নি সেদিন। ক্লান্ত হয়ে কাল করবো ভেবে, ফাইলটা রেখে কোনমতে উঠে গিয়েছিলাম। অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে একবার মনে হয়েছিল লাল টেবিলে যাই। লাল টেবিল- মানে একটা আড্ডার নাম। আপনার নানা রঙের বন্ধুদের মতো ওখানেও নানা রঙের মানুষ আসে। এখনতো আর এভাবে আড্ডা হয় না, আগে খুব হতো। বটতলা, চায়ের ষ্টল, ক্লাব, সিঁড়িঘরের ছায়া, মাঠের কোনায় জড়াজড়ি হয়ে সেইসব আড্ডার সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। এখন আড্ডা হয় মোবাইলে, নেটে। প্রেমিকার সাথে ডেটটার একটা ভার্চুয়াল ফর্ম বের করতে পারলে পুরো ব্যাপারটার একটা কমপ্লিট সল্যূশন হয়। মানুষের আর প্রয়োজনই থাকবে না। কিন্তু মানুষ আমার ভাল লাগে, তাই লাল টেবিলটা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি। তখনই চিন্তাটা আসে- নিউমার্কেটে গিয়ে একটা প্যান্ট কিনবো কিনা।
সেদিন ছিল ঠাণ্ডা আর বৃষ্টি। আকাশটা মোষের মত ছাইবর্ণ। একটা ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। রাস্তার পাশে আলগোছে পড়ে থাকা একটা মুদিখানা থেকে রেডিওর এনাউন্সে ভেসে আসে ১০ নাম্বার মহাবিপদ সঙ্কেত, জলচ্ছ্বাস আর সেই সঙ্গে প্রবল ঝড়োহাওয়ার পূর্বাভাস - মাথার মধ্যে ভো করে ওঠে ৭০ সালের কথা। বড় কোন ঝড়ের কথা উঠলেই ঐ ঝড়টার কথা মনে আসে। কেন আসে?
এই ঘূর্ণিঝড়ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল বলে?*২
আমি আবার আকাশের দিকে তাকাই। মেঘে মেঘে ১৯৭০ নাচে। ছাই বর্ণা বুনো মোষের মত রঙ ধরে আছে। এই ঝড়টাও ওরকম প্রলয়ঙ্করী হবে? ফিডব্যাকের গানটা মনে পড়ে।
মাঝি তোর রেডিও নাই বলে জানতেও পারলি না ...
সারা বাংলাদেশ জানলো মাঝি তুইতো জানলি না রে ..
ব্যান্ডের দলটা ভালই ছিল। কেন যে ভাঙলো?
কেন যে সবাই একসাথে থাকতে পারে না!
চিন্তাগুলো পাখির মতো। পাখা ঝাপটে মাথার মধ্যে কেবল উড়াউড়ি করে। কোথাও স্থির থাকে না। এটা ওটা ওসটা ওটা ভাবতে ভাবতে খানিকটা এগুতেই চোখে পড়ে একটুকরো আগুন। বিশাল এপার্টমেন্ট বিল্ডিং হচ্ছে, ইট রড বালুর স্তুপের ভেতরে লেবাররা আগুন জ্বালিয়ে ওঁম নিচ্ছে। আগুনের আঁচে সবার লালমুখ। আমাকে দেখেই ওরা জায়গা করে দেয়। পট পট আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের আঁচে শরীর গরম হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার আড্ডা, নিউমার্কেটের ব্যস্ত কেনাকাটা কোনকিছুই তখন মাথায় নেই। মনে হচ্ছিল এভাবেই রাতটা পার করে দি। কিন্তু একটু পর আগুনটা কমতে শুরু করে। চারপাশ খুঁজেও আর কোন ছেঁড়া কাগজ, কাঠের টুকরো খুঁজে পাওয়া যায় না। নিভু নিভু আগুনটা থেকেও ফুলকি ওড়ে। কারো মুখ আর দেখা যায় না। কেন জানি সেই সময় বাবার শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। একটু বাতাস শরীরে নেবার চেষ্টায় তার রগগুলো ফুলে ফুলে উঠছিল। কেমন একটা ঘড় ঘড় শব্দ। আমি মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে এক এক ছড়িয়ে দি। তাতে আগুনটা আর একটু জ্বলে ওঠে। সবার মুখ বিষ্ময়ে আর একটু লালচে হয়ে ওঠে। আগুন নিভে গেলে বাসায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়েছিলাম। গতকালই তো।
মাঝখানে কেবল একটা স্বপ্ন।
তারপরই অফিস। তাহলে!
বড়কর্তারই ভূল। আমি টগবগিয়ে উঠি।-
: না - এসেছি তো।
: তাহলে কোথায় ছিলে সারাদিন ..
ঠিক এই সময়েই ঘটনাটা ঘটে। হঠাৎ বড় কর্তার পকেট থেকে একটা পাখি বের হয়ে জানালা গলে উড়ে যায়। তারপর আর একটা। ছোট্ট একটা কালো সাদায় মেশানো পাখি। মাথার কাছে হালকা একটা নীল রঙের ছোপ। মাছরাঙা নাকি? আমি বোকার মতো চেয়ে থাকি। বড়কর্তা ঝমঝমিয়ে ওঠেন।
: কি হলো - এভাবে চুপ করে আছো কেন ..
: পাখি
: পাখি- মানে
বড়কর্তার মুখ ঝুলে পড়ে।
: পাখি -আপনার পকেটে...
ঠিক এই সময়ে একটা পাখি বের হয়ে এলো। এবারেরটা হলুদ। আমি উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে উঠি..
: এই এই যে উড়ে গেল ...
বড়কর্তার এক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব মুখটা দেখতে পাই। তারপরেই অবশ্য অন্য চেহারা। ঠাস বুনুনের একটা গাম্ভীর্য্যরে তকমা মুখে এটে গমগমে গলায় সাতদিনের ছুটি নিতে বলেই গটগট করে চলে গেলেন। শূন্য চোখে আমি তার যাওয়া দেখছিলাম। যতটুকু সময় তাকে দেখা গিয়েছিল ততটুকু সময় তিনি একবারের জন্য কোনদিকে তাকান নি।
আমার মাথায় তখন আর কিছু কাজ করছিল না।
বড় কর্তা এর আগে রুস্তম নামে একটা ছেলেকে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় তার জন্য বরখাস্তের ড্রাফট তৈরী করতে বলেছিলেন। আমি জানি না আমার বরখাস্তের ড্রাফটটা এবার কে তৈরী করবে। কিন্তু যেই করুক সে আমাকে মুক্তি দিয়ে যায়।
মানুষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সবকিছু করে। ঝুমি আমার সব উদ্দেশ্য নিয়ে চলে গেছে। ৩০ বছর পেরিয়ে যাওয়া বন্ধুর মুখ মনে হয়। মানুষের কথা মনে হয়। সবাই চাকরী কিংবা ক্যারিয়ারেই আছে। ঝুমিকে পেলে হয়তো এই চাকরীটাও খুব খারাপ লাগতো না। কিন্তু চাকরীটা জীবনের উদ্দেশ্য করতে ইচ্ছে করেনি। আবার মেয়েটা মাথায় কড়া নাড়ে।
মেয়েটা বললো আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে .. সে বললো না আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে ...
ও কি তাহলে জানে জীবনের মানে কী? ক্যারিয়ারটা বাদ দিয়ে জীবনের বাকিটুকু?
এবার আমার জন্যই মন খারাপ হয়ে যায়। জীবন কিংবা ক্যারিয়ার কোনটারই মানে খুঁজে পাই না। আমি বাঁচবো কী করে? চারপাশে তাকাই। কি নিশ্চিন্তে ছুটে চলছে সবাই। এমনকি বাচ্চাগুলো পর্যন্ত। এখন মায়ের কোল আর কোল নেই, ওখান থেকেই বাচ্চাগুলোর ক্যারিয়ার শুরু হয়ে যায়। মেলাতে পারি না চারপাশের সাথে। পাগল পাগল লাগে। মনে ভয় ধরে। আজফার ভাইয়ের কথা মনে হয়। আমি কি আজফার ভাই হয়ে যাচ্ছি?
--- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---- ---
*১: ৩০ বছর সরকারী চাকরীর বয়স সীমা
*২: ৭০ এর ঘূর্ণিঝড়: ১৯৭০ সালে বালাদেশ, সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দশ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি এবং ভয়াবহ ধ্বংশযজ্ঞ ঘটে গেলেও পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাষকবর্গ সামান্যতমও পাশে এসে দাঁড়ায় নি। পূর্ব পাকিস্তানের এরকম দূর্ভোগে পশ্চিম পাকিস্তানের উদাসিনতা এ অঞ্ঝলের মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের পাশাপাশি এই বোধও তৈরী করে তারা আসলে এক দেশের হলেও আলাদা। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আসলে কোন বন্ধন নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন প্রয়োজনে এই দশ লাখের সাথে আরো দশ লাখ যোগ করে হলেও স্বাধীনতা আনতে হবে।
মন্তব্য
অনেক ভাল লেগেছে। আপনার সাথে বসে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে।
শিরোনামের বিষয় ঠিক বুঝতে পারিনি 'এ ও সে ও : ০৬' - : ০৬ কেন?
এটা এ ও সে ও নামের একটা ধারাবাহিক... এটা ৬ নম্বর পর্ব... একটু খেয়াল করলে উপরের দিকে সিরিজের অন্য লেখাগুলোর নামের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।
.
সিগারেট, বাদামের খোসা, অফুরন্ত শব্দের স্রোত
ভাগ্যটা ভাল থাকলে চায়ের কাপটা পাশে।
আসলেই...
আড্ডায় একা একা লাগে না
বেচে আছি টের পাই...
পৃথিবীটা বড় মনে হয়...
সময়টা উড়ে উড়ে
বেশ ভাল একটা সময় দিয়ে যায়...
আড্ডাশ্রম, হুম
আসলেই মন্দ নয়...
karnajoy@gmail.com
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভাল লাগল|
আচ্ছা সচলেই ২-৩ বছর আগে আপনিই পকেট থেকে পাখি বেরিয়ে উড়ে যাবার ব্যপারটা কোনও একটা লেখায় লিখেছিলেন না?
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
অনেক আগে... ঠিকটাই ধরেছেন...
ছোট ছোট কয়েকটা চিত্রকল্প অক্ষরে সাজিয়ে সাজিয়ে লিখেছিলাম...
এই পর্বের মূল শিরোনামেই আরেকটি ছোট পোষ্ট ছিল সম্ভবত- ২০০৮ এর দিকে। আমি ঠিক নিশ্চিত না- সময়টা সম্পর্কে। সেখানে মেয়েটাকে নিয়ে ভাবনাটা লিখেছিলাম অল্প পরিসরে... বিচ্ছিন্ন করে...
মেয়েটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল।
লেখাটির জন্য
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অসাধারণ! অসাধারণ!!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
অসাধারণ একটা লেখা। পড়া শেষ করেও কিছুক্ষণ শুধু বিমূঢ় হয়ে তাকিয়েই ছিলাম লেখাটার দিকে...
এই সিরিজ আরো আবাদি হোক, দারুন মুগ্ধতা নিয়ে পড়ে যাই - শব্দেরা ভীড়াবদ্ধ মানুষের মত মানুষের কথা বলে যায় আর তার হাত ধরে ভেসে আসে নৈঃশব্দের বিষাদময় গান। খুব ভালো লাগছে সিরিজ, চলুক!
সুন্দর।
এই পোষ্টটিতে অনেক দেরী করে মন্তব্য করলাম। কারন এরই মধ্যে অনেকবার পড়লাম। আপনার বর্ণনার ধারার সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মিল অনেক। যে মিলটা সবচেয়ে বেশি করে নজরে এলো, সেটা হলো আতশী কাঁচ ফেলে ফেলে খুব গভীর দৃষ্টিতে জীবনের অস্থি-মজ্জা-মাংশকে দেখে নেবার প্রবণতা। সেখানে স্ফুটন-পচন কোনটিই দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। এই জটিল বীক্ষণের কিছু কিছু হয়ত সময়ে, কিছু কিছু অসময়ে। কিছু কিছু স্বস্তি-প্রদায়ক কিছু কিছু অস্বস্তিকর। কিন্তু মনে হলো, প্রতিটিকেই আপনি তুলে ধরেছেন পাঠককে কিছু না কিছু নতুন অভিজ্ঞানে সিক্ত করবার জন্য। এমন আরো লেখা চাই।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
এইখানে মূল পোস্ট থেকে কিছু কপি করা যায় না কেন?
কপি করতে পারলে সুমন ভাই যে অংশটুকু কোট করেছেন ততটুকুই কোট করতাম।
অল্প কটা বাক্য দিয়ে কি চমতকার স্বপ্নজাল তৈরী হয়েছে!
বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমি মাঝে মাঝেই এইরকম দৃশ্য দেখি। জেগে জেগেই
অনেক ভাল লেগেছে লেখাটা। ক্যারিয়ারহীন মেয়েগুলোর জন্য কেন জানিনা আজকাল আর তেমন দুঃখ টুক্ষ হয় না বড্ড চিন্তা হয়। ভয় হয় ভীষন।
কবিতাটির জন্য আবারো
facebook
নতুন মন্তব্য করুন