আসলে'ত' মানেই উচ্চারণেও 'ত' হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, যেমনটি ওপরেই বলা হয়েছে, কখনো কখনো ত-য়ের উচ্চারণ হয় 'ৎ'-য়ের মতো। যেমন, উচিত, অতীত। আবার কখনো কখনো তার উচ্চারণ হয় 'তো'-র মতো। যেমন, কত, যত, বিরত, শত [উচ্চারণ হয় কতো, যতো, বিরতো, শতো]। তাই লিখতে গিয়ে কিছুটা সতর্কতা তো অবশ্যই কাম্য।
বস্তুত ৎ আর ত্ সমার্থক। অর্থাৎ ত-য়ের সাথে হসন্ত যুক্ত হলে (উচ্চারণ এবং লিখিত রূপ উভয় ক্ষেত্রেই) তা খণ্ড-ত (ৎ)। নচেৎ পূর্ণ-ত লেখাটাই দস্তুর।
মোদ্দা কথা এই, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলাতেও বর্ণ সর্বাঙ্গীণভাবে ধ্বনি-সংবাদী বা উচ্চারণানুগ নয়। 'ত'-য়ের বেলাতেও ঠিক এমনটিই ঘটেছে। তাই পূর্ণ-ত আর খণ্ড-ত (ৎ) যথাযথভাবে লেখার (অর্থাৎ 'ত'-য়ের নিচে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হসন্ত প্রদান বা বর্জন করার) উপায় খুব সহজ নয়। তবে নিচের নিয়মগুলো, সাথে কিছু উদাহরণ আত্মস্থ করে নিলে 'ত' নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা করছি।
১. শব্দের শেষে কৃৎ, চিৎ, জিৎ, অৎ, বৎ, সাৎ থাকলে-
-কৃৎ : সুকৃৎ, পথিকৃৎ
-চিৎ : কিঞ্চিৎ, ক্বচিৎ
-জিৎ : ইন্দ্রজিৎ, বিশ্বজিৎ, রণজিৎ, সত্যজিৎ
-অৎ : জগৎ, তৎ, মহৎ, বৃহৎ, চলৎ, ভবিষ্যৎ, কিয়ৎ,
-সাৎ : আত্মসাৎ, ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ
-বৎ : পুত্রবৎ, বিষবৎ, জলবৎ, তাবৎ, যাবৎ, পূর্ববৎ
২. কিছু কিছু তৎসম (বাংলায় ব্যবহৃত অবিকৃত সংস্কৃত) শব্দে-
ক. শব্দের শেষে : সাক্ষাৎ, হঠাৎ, যুগপৎ, শরৎ, সৎ, দৈবাৎ, নচেৎ, ক্ষুৎ, তড়িৎ, অর্থাৎ, অকস্মাৎ, ছুঁৎ, যকৃৎ, সংবিৎ, মৃৎ ইত্যাদি।
খ. শব্দের মধ্যাংশে : মৎস্য, কুৎসা, বৎসর, সৎকার, বীভৎস, সাক্ষাৎকার, তাৎক্ষণিক, ফুৎকার, কুৎসিত, তৎপর, চিৎকার, চমৎকার, চিকিৎসা, উৎস, অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি।
৩. উৎ উপসর্গ যোগে শব্দ তৈরি হলে (যেগুলোতে সন্ধির ফলে দ্ বাদ পড়ে যায়)-
উৎসুক, উৎখাত, উৎফুল্ল, উৎসব, উৎসাহ, উৎকর্ষ, উৎকট, উৎপাত, উৎপীড়ন ইত্যাদি।
৪. সন্ধির ক্ষেত্রে পূর্বপদের শেষে যদি দ্ থাকে আর পরে ক, খ, ত, থ, প, ফ, স এই ৭টি বর্ণ থাকে তা হলে দ্ স্থলে ৎ হয়। যেমন :
ক : তদ্ + কালীন = তৎকালীন, আপদ্ + কাল = আপৎকাল, যদ্ + কালে = যৎকালে
প : ক্ষুধ্ + পিপাসা = ক্ষুৎপিপাসা, তদ্ + পর = তৎপর, হৃদ্ + পিণ্ড = হৃৎপিণ্ড
স : এতদ্ + সঙ্গে = এতৎসঙ্গে, হৃদ + স্পন্দন = হৃৎস্পন্দন, তদ্ + সম = তৎসম
১. অতীতে করা হয়ে গেছে এই অর্থে বিশেষণ পদের শেষ অক্ষর সাধারণত ত হয়।
যেমন : অনূদিত = যা অনুবাদ করা হয়েছে
আগত = যে বা যা এসে গেছে
পালিত = যা বা যাকে পালন করা হয়েছে
গীত = যা গাওয়া হয়েছে
ক্রীত = যা কেনা হয়েছে
এ জাতীয় আরও কিছু শব্দ : হৃত, স্নাত, সংবর্ধিত, তাড়িত, জিত, জাত, কৃত, উদ্ভূত, আমন্ত্রিত, বঞ্চিত, বিকৃত, গ্রস্ত, ভক্ষিত, ব্যবহৃত, বিবাহিত, রচিত, লিখিত, শোষিত, সমাহিত, আনীত ইত্যাদি।
২. ত দিয়ে লিখতে হয় এমন কিছু বাংলা শব্দের তালিকা : অতীত, অদ্ভুত, অমৃত, অস্ত, আদত, আদালত, আপাত, আয়ত, ইতস্তত, ইস্পাত, উচিত, উদ্যত, উদ্ধত, উপস্থিত, একমত, একান্ত, এত, কত, কতল, কপোত, কাত, কাতর, কিম্ভূত, কিসমত, কৃত (কৃতবিদ্য ব্যক্তি), কৃতকার্য, কেতন, কেতাব, ক্রমাগত, ক্ষত, খত [উচ্চারণ ৎ, অর্থ চিঠি], খতম, খতিয়ান, খয়রাত, খাত, খাতা, খুঁত, খেত/ক্ষেত, খ্যাত, গণিত, গত, গতর, ঘৃত, চকিত, চলিত, চিন্তিত, চিরায়ত, চেতন, চ্যুত, জনিত, জমায়েত, জহরত, জাত, জীবিত, জোতদার, জাকাত, তত, তল, তাঁত, তাকত, তারতম্য, তেজারত, ত্বরিত, থতমত, থুতনি, দফতর/দপ্তর, দস্তখত, দাঁত, দূত, দেহাত [পাড়াগাঁ], দোতলা, দ্রুত, ধাত, ধৈবত, নত, নতুন, নহবত, নাগাদ, নিশ্চিত, নিহত, নূতন/নতুন, নহবত, নাতজামাই, নাপিত, নিতম্ব, নিপাত, নিভৃত, নির্ঘাত, পদাঘাত, পরাজিত, পরিণত, পরিমিত, পরিহিত, পর্বত, পলাতক, পাটাতন, পাতলা, পিতল, পীড়িত, পূজিত, পূত [পবিত্র], পুত [পুত্র], প্রকৃত, প্রণীত, প্রখ্যাত, প্রভূত, প্রসূত, প্রাত, প্রীত, প্রেত, ফলত [ফলে], ফেরত, ফুরসত, বজ্জাত, বঞ্চিত, বাঞ্ছিত, বরাত, বসত, বিকৃত, ক্ষত, বিচলিত, বিজিত, বিতণ্ডা, বিতরণ, বিদূরিত, বিনত, বিপরীত, বিবৃত, বিব্রত, বিরত, বিলেত, বিস্তৃত, বিস্ফারিত, বিস্ফোরিত, বিস্মিত, বিস্মৃত, বেজাত, বেত, বেতন, বেতার, বেহাত, ব্যাঘাত, ব্যাপৃত, ব্যাহত, ব্রত, ভাত, ভাবিত [চিন্তিত], ভীত, ভুত, ভৌত, মজবুত, মজুত, মত, মতলব, মাতব্বর, মুহূর্ত, মৃত, যত, রঞ্জিত, রাত, শত, শীত, শ্রুত, সতত, সমাগত, সম্মত, সংঘাত, সাত, স্থগিত, হাওলাত, হাত, হিকমত ইত্যাদি।
১. ৎ-য়ের সঙ্গে যেকোনো -কার চিহ্ন (া, ,ি ী, ু, ূ, ৃ, ,ে, ৈ, ো, ৌ) যোগ হলে ৎ পাল্টে গিয়ে ত হয়ে যায়।
যেমন : ভবিষ্যৎ, কিন্তু ভবিষ্যতে, ভবিষ্যতের
সাক্ষাৎ, কিন্তু সাক্ষাতে, সাক্ষাতের
শরৎ, কিন্তু শরতে, শরতের
জগৎ, কিন্তু জগতে, জগতের, জাগতিক
স্বরবর্ণ কিংবা গ্ ঘ্ / দ্ ধ্ / ব্ ভ্ / কিংবা য্ র্ ব্ বর্ণের পূর্বে ৎ থাকলে তা পাল্টে দ্ হয়ে যায়। উদাহরণ :
ৎ + স্বরবর্ণ
সৎ + আনন্দ = সদানন্দ
সৎ + ইচ্ছা = সদিচ্ছা
পশ্চাৎ + অপসারণ = পশ্চাদপসরণ
সৎ + উত্তর = সদুত্তর
কিঞ্চিৎ + অধিক = কিঞ্চিদধিক
ৎ + গ
উৎ + গম = উদ্গম
সৎ + গতি = সদ্গতি
উৎ + গম = উদ্গম
ৎ + ঘ
উৎ + ঘাটন = উদ্ঘাটন
ৎ + দ
সৎ + ভাব = সদ্ভাব
জীবৎ + দশা = জীবদ্দশা
ৎ + ব
তৎ + দ্বারা = তদ্দ্বারা
উৎ + বাহু = উদ্বাহু
ৎ + ভ
পশ্চাৎ + ভাগ = পশ্চাদ্ভাগ
উৎ + ভ্রান্ত = উদ্ভ্রান্ত
সৎ + ভাব = সদ্ভাব
ৎ + য
উৎ + যাপন = উদ্ যাপন
(চলবে...)
সহায়ক গ্রন্থ :
১. হায়াৎ মামুদ (বাংলা লেখার নিয়মকানুন, মে, ২০১০)
২. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
পূর্ববর্তী পর্ব :
বানানায়তন- ১ | ই-কার বনাম ঈ-কার |
বানানায়তন- ২ | ও কি মায়া কি স্বপনছায়া, ও কি ছলনা |
বানানায়তন- ৩ | হ্রস্ব স্বর না দীর্ঘ স্বর—বর্ণমালা এবং বানান সংস্কার প্রসঙ্গে জরুরি কিছু কথা |
বানানায়তন- ৪ | ‘অনুস্বার’ বনাম ‘ঙ’, সাথে ‘এ’ বনাম ‘অ্যা’ |
বানানায়তন- ৫ | দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ |
বানানায়তন- ৬ | বাংলার তিন ‘শ’—দন্ত্য-স, মূর্ধন্য-ষ আর তালব্য-শ |
বানানায়তন- ৭ | বাংলা হরফ বনাম রোমান হরফ—জ বনাম J, Z, G |
বানানায়তন- ৮ | পাঠ্যবইয়ে বাংলা একাডেমীর বানানরীতি মেনে চলতে হবে |
বানানায়তন- ৯ | ব-য় শূন্য ‘র’ বনাম ড-য় শূন্য ‘ড়’ |
বানানায়তন- ১০ | কখন কি লিখব, কখন কী লিখব |
বানানায়তন- ১১ | সংস্কৃত বানানরীতি বনাম বাংলা বানানরীতি |
বানানায়তন- ১২ | বাংলা ভাষার ব্যাকরণ কবে তৈরি হবে? |
বানানায়তন- ১৩ | বাংলা ভাষায় বাঙালিয়ানা কতটুকু? |
বানানায়তন- ১৪ | বাংলা ভাষা এল কোথায় থেকে |
বানানায়তন- ১৫ | বিনির্মাণের ভাষা, বাংলা ব্যাকরণের ভিন্নপাঠ |
বানানায়তন- ১৬ | স্পেস নিয়ে ভাবনা / আর না আর না |
বানানায়তন- ১৭ | উ-কার বনাম ঊ-কার |
----------------------------
কুটুমবাড়ি
----------------------------
মন্তব্য
বহু দিন পর আপনার পোস্ট পেলাম। কাজের পোস্ট । নিজেকে আরেকটু ঝালিয়ে নিলাম......
এতগুলো দরকারী পোস্ট, আপনার হাচলত্বপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় রইলাম..........
ভালো থাকবেন....
_____________________
Give Her Freedom!
আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না। ধন্যবাদ দেয়া থেকে বিরত থাকলাম তাই।
এই রে, পেয়েছি। এই পোস্টটা আমার জন্যই দেওয়া হয়েছে মনে হচ্ছে
অনেক ধন্যবাদ পোস্টদাতাকে
বন্দনা, এই পোস্ট শুধু আপনার জন্যই নয়, আমার নিজের জন্যও বটে!
ধন্যবাদ।
ওয়েল্কাম ব্যাক! এদ্দিন কই ছিলেন ?
আচ্ছা, 'একটি' আর 'একটা' নিয়ে একটা সমস্যায় ভুগতেছি। একটু পরামর্শ দেন। একই লেখায় কি 'একটি' এবং 'একটা' - এই দুই বানানই ব্যবহার করা যাবে ?
আমি যদ্দুর বুঝি 'একটি' সাধু অথবা আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে লেখায় ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে 'একটা' একবারেই কথ্য বানান এবং কথ্য বা অনানুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে লেখায় ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু দুইয়ের মিশ্রন কাম্য নয়। কিন্তু আমার সমস্যা হলো, একই লেখাতে (চলিত রীতিতে) প্রসঙ্গভেদে আমার এই দুই বানানই চলে আসে - কখনো 'একটি' লাগসই মনে হয়, কখনো 'একটা' লিখতে ভাল লাগে। এতে আসলেই কোন অসুবিধা আছে ? পড়তে খারাপ লাগবে ?
****************************************
যাবে। যখন যেটা লাগসই মনে হয় ব্যবহার করতে পারেন। এতে আসলেই কোনো অসুবিধা নেই এবং পড়তেও খারাপ লাগবে না।
সে যা-ই হোক, ফিরে এসেই আপনার মন্তব্য পেয়ে আনন্দ হোল খুব। কেমন আছেন?
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
মন্তব্যের জন্য ধইন্যা, সাথে সচলাভিনন্দন গ্রহণ করুন
পাইছি, এই রকম একটা কিছুইতো খুঁজতেছিলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনার নামের সাথে ঐ F যোগ করা কেন? ওটা কি সিম্বলিক টাইপের কিছু?
এতদিন কই ছিলেন?
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অফলাইনে। তবে আবারও অনলাইনে আসতে পেরে খুশি খুশি লাগছে।
অট : ফিরে আসার পর থেকে আমার অভ্র কি-বোর্ড আগের মতো কাজ করছে না। তাই মাউস দিয়ে টাইপ করতে হচ্ছে। ক্যাম্নে কী?
এত বড় বিরতি নিলে কিভাবে হবে? এখন ঝটপট পোস্ট দিতে থাকেন।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ওই তো! মিনিটে দু-চারটির বেশি শব্দ টাইপ করতে পারছি না। ঝটপট পোস্ট কীভাবে দেই
কাজের পোস্ট। আগেও কিছু পড়েছি, সবগুলো পড়ে ফেলা লাগবে
ধন্যবাদ, রিশাদ ময়ূখ। পড়া শেষ করে ফিডব্যাক জানালে খুবই খুশি হব
উফ, পড়া শেষ হলে বুঝলাম, এতদিন ধরে কত রাশি রাশি ভুলের পাহাড় রেখে এসেছি! আপনার সবকটি পোষ্ট কঠিন ও দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
রোমেল ভাই, এ মিছে বিনয়টুকু না করলেই কি নয়? ভুল তো আমরা সবাই কমবেশি করি, তাই না? আপনি শতায়ু হোন, আপনার হাতে বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে।
আপনার মন্তব্যে সব সময়ই অনুপ্রাণিত হই, আজও হলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ওয়েল্কাম ব্যাক!
ঠিক ঠিক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বানান ডরাই
সেরেছে! ওটা যে আমারও মনের কথা, ভাইডি। দুজনের ফিলিংস এমন কমন পড়ে গেল কী করে তা-ই ভাবছি।
নতুন মন্তব্য করুন