বিসর্জন

অরফিয়াস এর ছবি
লিখেছেন অরফিয়াস (তারিখ: সোম, ২৬/০৯/২০১১ - ৯:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হালকা হালকা বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলগুলো দুলছে, আকাশেও সাদা সাদা মেঘ, বছরের এই সময়টা খুব ভালো লাগে হৈমন্তীর| মাটিতে শুয়ে আনমনে কি সুন্দর আকাশটা দেখা যায়, কখনো কখনো মেঘ দিয়ে কি সুন্দর হাতি-ঘোড়া, আরও কতকিছু যে তৈরী হয়ে যায়, সবাই কি তা বোঝে? যখন বিলের ধারে ঘুরঘুর করে তখন হঠাৎ কখনো একটা সাদা বক সাই করে উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে, আর ঠিক বিলের মাঝখানটায় টুক করে বসে খপ করে একটা মাছ ধরে নেয়| কত মজার মজার জিনিস দেখা যায় নদীর কাছের জঙ্গলটায়, যে না গেছে সে কি করে জানবে? একটা বড় গাছ অনেক দিন হলো ভেঙ্গে গেছে, অর্ধেকটা পাড় এর জল ছুইছুই, সেটার উপর বসে একলা একলা পা দোলাতে ভালই লাগে| হৈমন্তীর এই ভালো লাগা গুলো ওর মা বুঝলে তো|

মাকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ, সংসারের কাজ সামলাতে হিমশিম তো খেতেই হয়, তার উপরে এতগুলো মানুষের খাবার জোটাতে গেলে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়| মা তাই সকাল থেকেই হয়রান থাকে, আর ও সামনে গেলেই এটা ওটা কাজ ধরিয়ে দেবে, ও তাই সকাল বেলাতেই এক দৌড়ে নদীর পাড়| তার উপরে পূজো আসছে, গ্রামের বড় বাবুদের বাড়িতে হই হই ব্যাপার| অনেক বড় সামিয়ানা টানানো হয়েছে, রাত দিন কাজ চলছে, বড় বড় গাড়িতে বোঝাই করে জিনিস আসছে| ওরা ছোটরা দল বেঁধে দেখতে গেলে, গেটের দারোয়ানটা ঢুকতেই দিলনা| তাই তো বুদ্ধি করে ওরা পাশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিলো| ওদের চোখে বিশ্বাস হয়না, কত্তো বড় প্রতিমা, কি সুন্দর গায়ের রং| আর সবাই কি রকম দৌড়ে দৌড়ে সাজাচ্ছে| সে এক বিশাল ব্যাপার|

হৈমন্তীর মনে পরে, আগে এত অভাব ছিলনা ওদের| আসলে অভাব কি জিনিস মা কখনো বুঝতেই দেইনি| ওর দিদা বলতো, হেমন্তে জন্ম বলে ওর নাম রাখা হয়েছিল হৈমন্তী| আরও বলতো অনেক ধান কাটা হত তখন গ্রামে, কি সুন্দর মেলা চলতো| ওদের বাড়িতেও অনেক মজা হত| পুজোতে নাকি ওর বাবা সবার জন্য নতুন জামা আনতেন| ওকে বাড়িতে সবাই হেমু হেমু বলেই ডাকে| ওর মনে পরে, ওরা ছোটরা নতুন জামা পরে পুজোর দিন দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো| সাথে থাকতো মায়ের দেওয়া খুচরো টাকা, ওরা মাঝে মাঝে বাজি-পটকা কিনতো, কখনোবা খাবার জিনিস| তারপর সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যার সময় যখন বড় বাবুদের বাড়িতে আলো জ্বলতো তখন এক দৌড়ে ওখানে, বড় বড় প্রদীপের আলোয় প্রতিমার মুখটা কি সুন্দর লাগতো, দূর থেকে অবাক হয়ে দেখত ওরা| এভাবেই হই-হই, রই-রই করে পুজোর চারটা দিন পাড় হয়ে যেতো, টেরই পাওয়া যেতোনা| আর বিসর্জনের দিন নদীর পাড়, অনেক লোক, দূর্গা মায়ের বিদায়, মায়েদের চোখের জল, সেগুলো এখনো মনে পরে|

কিন্তু সব কিছু ঠিক থাকলেও, ওদের বাড়িটা ঠিক নেই, এখন আর আগের মতো পুজোয় নতুন জামা আসেনা, মায়ের হাতের নাড়ু মোয়া এখন আর চোখে দেখা হয়না, বাবার চোখটা ওদের সামনে আসলেই কেমন যেনো ছল ছল করে| বড় ভাই কাজের খোঁজে শহরে গেছে, ও পুজোতে বাড়ি আসেনা| এখন আগের মতো বাড়িতে রান্না হয়না, কখনো কখনো ওর খাওয়া হয়না, আর পুজোর সময়টা বাড়িতে সবাই কেমন যেনো মনমরা হয়ে থাকে| ছোট ভাই গুলো পুজোর আগ দিয়ে অনেক চেচায়, আবদার করে, তারপর এক সময় নিজেরাই ক্ষান্ত দেয়| আগে দল বেঁধে খেলতো, ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু ওর বন্ধুগুলো বাবা-মার সাথে একে একে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলো| ওর নিজের বুদ্ধিতে কুলোয়না, কেনইবা সবাই পরিচিত জায়গা ছেড়ে, আপন মানুষ ছেড়ে, অন্য অচেনা জায়গায় যায়| তাইতো এখন পুজোতে একা একাই ঘুরতে হয়|

দেখতে দেখতে এবারের পূজোও চলে এলো, বড় বাবুদের বাড়িতে সবাই এসেছে| দামি দামি, বড় বড় গাড়িতে করে অনেক লোকজন| ওর মতো অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে মেয়েও এসেছে দেখলো| সবার হাসি খুশি চেহারা দেখলে মজাই লাগে| ষষ্ঠীর দিন থেকে ঢাকের বাদ্য শুরু হয়, বাতাসে কি সুন্দর ঘ্রাণ, ধুপের ধোঁয়ায় দেখাই যায়না কিছু| ও মাঝে মাঝেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসে, ভিতরে কত্তো আয়োজন, আর সব থেকে মজার কথা হলো, প্রতিমার সামনে কি সুন্দর করে সাজানো খাবারের থালা| সুন্দর গন্ধে এভাবেই পেট ভরে যায়| বাড়িতে আসে সন্ধ্যার পরে, মা দেখতে পেয়েই আচ্ছা করে কান মলে দিলো| সারাদিন ঘুরে বেড়ালে কি চলে, বাড়ির কাজটাও দেখতে হবে যে| হেমুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো, একে তো পুজোর সময়, সারাদিন পেটে কিছুই পরেনি, তার উপরে এরকম করলে কেমন লাগে? আর ও করবেই বা কি, বাড়িতে থাকলেই মন খারাপ হয়ে যায়, অভাব জিনিসটা এখন বেশ ভালই বুঝতে পারে ও| তা থেকে নদীর ধারের জঙ্গলের ওর প্রিয় জায়গাটাতেই ভালো, আকাশ দেখেই কি রকম সময় কেটে যায়|

দেখতে দেখতে এক এক করে, সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর দিন গুলো চলে যায়, আগের মতো ঘোরা হয়না, তবুও বাবুদের বাড়ির পুজোর আয়োজন চোখে পরে| নতুন জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় সবাই, চার পাশে দোকান সাজিয়ে বসে অনেকে| হেমু ঘুরে ঘুরে সব দেখে, কিন্তু আধ পেট খেয়ে কি এসব দেখে মন ভরে?

দশমীর দিন, দেবীর বিদায়ের প্রস্তুতিতে সবাই ব্যাস্ত| সকাল বেলাতে মায়ের কাছে একগাদা বকা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ, দশমীর দিনটাতে এভাবেই মন খারাপ থাকে, চারিদিকের হৈচৈ আজকেই শেষ হয়ে যাবে, এসব ভেবে হেমুর মন আরও খারাপ হয়ে যায়| খিদে ভুলে থাকার এই কটাদিন নেহায়েত মন্দ ছিলনা, সবার উপর অভিমান হয় খুব, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে একা|

বাবুদের বাড়ির প্রতিমা নিয়ে শেষ বিকেলে নদীর ধারে আসে সবাই, মায়ের বিদায়ের ক্ষণে মন খারাপ সবারই| দেখতে দেখতে প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যায়, মাটির প্রতিমা জলে ভেসে যেতে থাকে দূরে| বিসর্জন শেষে একে একে বাড়ির দিকে ফেরে সবাই| সন্ধ্যা হয়, অন্য দিনের চেয়ে সন্ধ্যার আলোটা বেশি গম্ভীর, হঠাৎ নিরব হয়ে যাওয়া পুজোর বাড়ি থেকে বিদায় নেয় সবাই| মন্ডপে টিমটিম করে জলতে থাকা শেষ প্রদীপের আলোটা শুধু মনে করিয়ে দিতে থাকে মাত্রই অতীত হয়ে যাওয়া জীবনের গল্পটা|

সেদিন আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেনি হৈমন্তী, অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি কোথাও| হন্যে হয়ে খুঁজেছিলো সবাই, মা কেঁদেছিলেন খুব| শেষমেষ অনেক পরে মাঝনদীতে ওর নিথর দেহ খুঁজে পেয়েছিলো নৌকার মাঝিরা, কেও বুঝতে পারেনি কি করে মারা গেলো হেমু, মা-বাবা শোকে স্তব্দ হয়ে গেলেন, গ্রামের লোকেরা ভাবলো বিসর্জন দেখতে গিয়ে জলে পরে গিয়েছিলো হয়তো, এত ভিড়ের মাঝে কেও দেখতে পায়নি|

কিন্তু কেও বুঝলোনা অনেক না বলা অভিমান আর পেটে খিদে নিয়ে, এই ছোট্ট মেয়েটা দশমীর দিন দেবীর বিসর্জনের সাথে সাথে নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিয়ে দিলো| অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের বার্তা নিয়ে দেবী এলেও সেটা হৈমন্তীর জীবনে পৌঁছেনি, বরং বাস্তব জীবনের কোলাহল আর প্রতিমুহুর্তের বেঁচে থাকার আকুতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াটাই অনেক সহজ মনে হয়েছিল ওর| কেও বুঝলোনা- খেয়ে না খেয়ে, বেঁচে থাকার যুদ্ধে, কখনো কখনো দেবীর জয় হয়না|

[গত বুধবার সোনাবরু নামের মেয়েটির নাকি জন্মদিন ছিল, কিন্তু বাড়িতে ভাত খেতে না পেয়ে, ক্ষিদের জালায় ১৩ বছরের ছোট মেয়েটি আত্মহত্যা করে|
তোকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারলামনা, দুবেলা ভালো করে খেয়ে অন্যদের মতো হাসি খুশি ভাবে জীবন কাটাতে পারলিনা, অভিমান করে তাই জন্মদিনটাকেই বেছে নিলি চলে যাওয়ার জন্য| এটা আমাদের ব্যার্থতা, আর এই লজ্জা সাথে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকবো| তোর জন্যে এই লেখা|
http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=25-09-2011&type=gold&data=Politics&pub_no=652&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&news_id=190376]


মন্তব্য

 অহর্নিশি এর ছবি

আমরা এখনো আমাদের নেতা নেত্রী আর দল নিয়ে ভাবতেই ভালবাসি। শিক্ষা আমাদের বিবেক এর ঘুম ভাংগাইতে পারে নি। আমাদের আত্না বিক্রি করে দিয়েছি।

আপনার গল্প আমাদের বিবেকের ঘুম ভাংগুক। মানুষগুলা মানুষ হোক।

অরফিয়াস এর ছবি

আমাদের বিবেকের ঘুম যে কবে ভাঙবে তা নিয়ে চিন্তিত... মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

তানিম এহসান এর ছবি

..........................

অরফিয়াস এর ছবি

_____________ মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

উচ্ছলা এর ছবি

জীবন থেকে নেয়া গল্পটা আত্মা ছুঁয়ে গেল।

অরফিয়াস এর ছবি

এরকম অনেক সত্যি আমাদের নজরের বাইরে থেকে যায়, বাস্তবটা ভয়ংকর...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

অরফিয়াস এর ছবি

এরকম অনেক সত্যি আমাদের নজরের বাইরে থেকে যায়, বাস্তবটা ভয়ংকর...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

তারেক অণু এর ছবি

মন খারাপ , মর্মস্পর্শী

কল্যাণF এর ছবি

মন খারাপ

অরফিয়াস এর ছবি

মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

........................... মন খারাপ

সব যেন ব্যথার মতো বাজে...................


_____________________
Give Her Freedom!

অরফিয়াস এর ছবি

দুঃস্বপ্ন ... মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গল্পের শুরুটায় মনে খটকা লেগেছিল যে শরতের শুভ্র-সাদা কাশবনে লীন হয়ে থাকা মেয়েটির নাম হৈমন্তী কেন? তখনও তো বুঝতে পারিনি যে পাতা ঝরানোর গান গাইতে যে এসেছে সে তো হেমন্তেরই, আর হেমন্ত তো বিসর্জনেরই ঋতু!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অরফিয়াস এর ছবি

ঝরা পাতাদের গল্প .. মন খারাপ

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।