সাহিত্য রচনা বরাবরই আমার আয়ত্বের বাইরে ছিলো, আছে এবং থাকবে। হাসান মামুনের "এলান কোয়াটারমেইন ও আয়েশা" পোস্টে অনুবাদ, পরিভাষা হেন তেন নিয়ে বিরাট পণ্ডিতি দেখানোর পর মনে হলো, উনি তো তাও সাহস করেছেন একটা উপন্যাসের অনুবাদ শুরু করার। আর আমি শুধুই বুলি কপচাচ্ছি, কখনো তো এক লাইন লিখেও দেখলাম না। কি আছে জীবনে, আমিও শুরু করে দিলাম। ভুল অবশ্যই অজস্র আছে। আপনাদের চাঁছাছোলা মন্তব্য আশা করছি। ক্রমশঃ শুধরে নেব।
--------মধ্য প্রজন্ম
এলান শেখালো শিকারের কলাকৌশল
আমি, এলান কোয়টারমেইন, এতদিনে আপনাদেরকে আমার ঘটনাবহুল জীবনের অন্যতম অদ্ভুতুড়ে এক অভিযানের গল্প শোনাতে যাচ্ছি। আমার পথচলাটা কখনই একঘেয়েমী বা গতানুগতিক গন্ডীর মধ্যে আটকে না থাকলেও এটা তার মধ্যে একটা বিশিষ্ট স্থান নিয়ে আছে।
এ অভিযানের ঘটনাগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বলতে হয় “কালো কেন্ডাহ” জাতির সাথে যুদ্ধ এবং তদের হস্তীদেবতা জানা’র মৃত্যুর কথা। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, এই প্রাণীটা কি শুধুই একটা দানবীয় বন্য পশু ছিলো নাকি ছিলো তার চাইতেও বেশি কিছু। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অভাবনীয়, বলা যায় অসম্ভব মনে হয়। তবে ভবিষ্যতের পাঠকদের হাতেই এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম।
জাদুর কিছু ভঙ্গীমা সাদা কেন্ডাহ’দের ধর্মবিশ্বাস আর আচরণের জন্য খানিকটা বদলে নেয়ার সামর্থ্যও তার ছিলো। এই জাদু জিনিষটা নিয়ে আমার একটাই কথা বলার আছেঃ আদৌ যদি এর কোন অস্তিত্ব থেকে থাকে, কোনভাবেই তা অভ্রান্ত নয়। একটা ঘটনা দিয়েই আমি বোঝাচ্ছিঃ হারুত ও মারুত ভবিষ্যতবাণী পেয়েছিলো, যে আমি এবং শুধু আমিই জানা’কে মারতে পারবো। আর এতে প্রভাবিত হয়েই তারা আমাকে কেন্ডাহল্যান্ডে আমন্ত্রন জানিয়েছিলো। যদিও শেষে দেখা গেল, জানা আমাকেই প্রায় মেরে ফেলেছিলো আর সে মরলো হ্যান্সের হাতে।
যাহোক এবার গল্পে ফিরে আসি।
“হোলি ফ্লাওয়ার” নামের কাহিনীতে আমি স্ক্রূপ নামে এক যুবকের সাথে আমার ইংল্যান্ডে আসার কথা বলেছিলাম। ইংল্যান্ডে আসার একটা কারণ ছিল, শিকারের সময়ে ঘটা এক দুর্ঘটনার পর আমি তার নিরাপদে ঘরে ফেরার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। আর দ্বিতীয়ত, আমার এক বন্ধুর হয়ে অনন্য এবং অতুলনীয় একটা অর্কিড বিক্রি করার ব্যবস্থা করাটাও দরকার ছিলো। আমার এই বন্ধুটি, যাকে সাদা মানুষ ব্রাদার জন বলে চেনে আর কালোরা ডাকে “ডগিটা”, সবার মাঝে পাগলা বলেই পরিচিত। কিন্তু মানুষটা পাগল ত নয়ই বরং এতটাই প্রকৃতিস্থ, যে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মরিয়া হয়ে যেই অসম্ভবের খোঁজ সে করে যাচ্ছিলো, পরিশেষে আমার সামান্য সাহায্য নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে তাতে সফলও হয়েছিলো। যাইহোক, এ সবই আমি “হোলি ফ্লাওয়ার” গল্পে বলেছি। আমার ইংল্যান্ডে আসার কারণ বোঝাতেই এটুকুর অবতারণা।
এদেশে থাকার সময় আমি বেশ কিছুদিন স্ক্রুপের সাথে, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে ওর বাগদত্তা ও তার আত্মীয়দের সাথে এসেক্সের একটা সুন্দর বাড়িতে ছিলাম। (আসল নাম বলাটা এড়াতে চাইছি তাই এসেক্স বললাম। জায়গাটা এসেক্সের আশেপাশেরই কোন এক কাউন্টিতে ।) সে সময় আমাকে ওখানকার একটা চমৎকার দর্শনীয় জায়গা দেখাতে নেয়া হয়েছিল। সেটা মূলতঃ ছিলো ইটের খিলানযুক্ত সিংহদুয়ারওয়ালা এক বিষ্ময়কর পুরনো দুর্গ। অভাবনীয় রকমের পুনঃসংস্কার করে দুর্গটাকে এক আধুনিক ও বিলাসবহুল প্রাসাদে পরিণত করা হয়েছে। ধরা যাক এর নাম “রেগনাল” (র তে য'্ফলা দিতে পারছিনা) যা ওই একই নামের এক ব্যারনের সম্পত্তি
এই লর্ড রেগনাল সম্পর্কে আমি আগেও অনেক শুনেছি। সবাই বলে তিনি নাকি অসাধারণ মেধাবী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি নাকি অসামান্য সুদর্শন; বিরাট পন্ডিত - তিনি অক্সফোর্ড থেকে ডাবল ফার্স্ট করেছেন; নিপুণ ক্রীড়াবিদ - ইউনিভার্সিটি নৌকাবাইচে অক্সফোর্ড টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন; হাউস অব লর্ডসে সম্ভাবনাময় বক্তা হিসাবে এর মধ্যেই বেশ পরিচিতি পেয়েছেন; একজন ভাল শিকারী - যিনি ভারতবর্ষে বাঘসহ যত বড় বড় প্রাণী আছে, সবই শিকার করেছেন; একজন কবি – যিনি ছদ্মনামে একটা কবিতার বই ছাপিয়েও সাফল্য পেয়েছেন; সেনাবাহিনী ছাড়ার আগে ভাল যোদ্ধা হিসাবেও তাঁর নাম ছিলো; এবং সবশেষে তিনি বিপুল বৈভবের মালিক, পৈত্রিক সম্পত্তি ছাড়াও যার আছে অনেকগুলো কয়লাখনি ও উত্তর ইংল্যান্ডে আস্ত একটা শহরের মালিকানা।
“হা ঈশ্বর!” তালিকা শেষ হলে আমি বললাম, “এ লোক তো মনে হয় পুরো এক বাক্স সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। আশা করি দুয়েকটা তার গলায় আটকে থাকে নি। তবে প্রেমের ভাগ্য বোধহয় তার অত ভালো না।”
“এই ব্যাপারটাতেই তিনি সবথেকে বেশি সৌভাগ্যবান,” স্ক্রুপের বাগদত্তা, মিস ম্যানার্স-যার সাথে এতক্ষন কথা বলছিলাম-জানালো, “আমি শুনেছি, তিনি এমন এক ভদ্রমহিলাকে পেয়েছেন যিনি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দরী, মনোহরা ও বুদ্ধিমতী। তাঁরা দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোওবাসেন”
“হা ঈশ্বর!” আমি ফের বললাম, “নিয়তি না জানি লর্ড রেগনাল আর তার নিখুঁত প্রেয়সীর জন্য কি খেলাটাই ঠিক করে রেখেছে?”
একদিন সেটা জানবো এটাই বোধহয় ভবিতব্য ছিলো।
তো যেভাবে তা ঘটলো, পরদিন সকালে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, আমি রেগনাল দুর্গের বিস্ময়গুলো দেখতে চাই কি না, বললাম “হ্যাঁ”। বস্তুত, সম্ভব হলে আমি স্বয়ং লর্ড রেগনালকেই দেখতে চাচ্ছিলাম। তাঁর এসমস্ত উৎকর্ষমন্ডিত অর্জনগুলোর কথা শুনতে শুনতে আমার কল্পনা ভালোভাবেই পাখা মেলছিলো। আসলে এই রকম প্রবাদপ্রতিম মানুষকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য তো আমার মত এক দরিদ্র কলোনিস্টের কখনোই হয় না। নিষ্ঠুর শয়তানোচিত মানুষ তো অজস্র দেখলাম, কিন্তু দেবদুত তাও আবার পুরুষ, কদ্যপি না। তাছাড়া, শ্রদ্ধেয়া মিস হোমস, যিনি রেগনালের বাগদত্তা এবং তাঁর চাইতেও বেশিমাত্রায় দেবদুতপ্রতিম, তাঁকে এক ঝলক দেখার ইচ্ছা তো ছিলোই। তাই আমি বললাম যে এই দুর্গ দেখার চেয়ে বেশি আনন্দ আমি আর কিছুতেই পাবোনা।
সেই মোতাবেক আমরা সেই ডিসেম্বরের হিমশিতল বাতাস ভেঙ্গে সেদিকে রওনা হলাম। দুর্গের কাছে পৌঁছে স্ক্রপ জানতে পারলো লর্ড রেগনাল (যার সাথে তার খুব ভালো চিন-পরিচয় ছিলো) পার্কের মধ্যে কোথাও শিকারে গেছেন। সে বললো যে তার বন্ধুকে সে নিজেই দুর্গটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে। তো মিস ম্যানার্স সহ আমরা তিন জন ঘোড়ার গাড়িতে করে দুর্গে পৌঁছলাম। দেউড়ির দারোয়ান আমাদেরকে দুর্গের মূল দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে মিঃ স্যাভেজ নামে একজনের হাতে ছেড়ে দিলো আর ফিসফিসিয়ে বললো যে এলোকই হচ্ছে লর্ডের ব্যক্তিগত সহকারী।
এই নামটা আমার আজো মনে আছে, কারণ নামের সাথে এতটা অমিল আমি আর কোন লোকের চেহারায় কখনো দেখিনি। সত্যি বলতে কি, তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একজন ছদ্মবাশী ডিউক। (মানে, আমার কল্পনার ডিউকরা যেমন হয় আরকি, যেহেতু আমি জীবনে কখনো কোন আসল ডিউক দেখিনি।) সে একটা নিখুঁত প্রভাতী ছাঁটের টেইলকোট পরা ছিলো। তার আচরণ ছিলো চমৎকার, ভদ্র, কিন্তু সামান্য উদ্ধত অহমের মিশেলে একটু হয়তো বিদ্রুপাত্মকও ছিলো। উন্নত নাসা আর বাজ পাখির মত চোখ মিলে সে দেখতে বেশ সুদর্শন। সামান্য টাকের আভাষ গোটা চেহারার উপরে একটা বাড়তি প্রভাব ফেলেছিলো। বয়স তার ছিলো পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি, আর যেভাবে সে আমার হ্যাট এবং ওয়াকিং স্টিক নিয়ে নিলো তাতে তার চারিত্রীক দৃঢ়তাও প্রকাশ পেল। হয়ত আমাকে দেখে তার কিম্ভুত কিসিমের কোন লোক মনে হয়েছিলো, ভেবেছিলো লাঠিটা দিয়ে আমি কোন মূল্যবান ছবি বা অন্য কিছুতে খোঁচা লাগিয়ে দেব। আমার সন্দেহ না জাগিয়ে শুধু লাঠিটা কিভাবে নেয়া যায় ভেবে না পেয়ে বরং সে দুটোই নিয়েছিলো।
পরবর্তীতে এই স্যামুয়েল স্যাভেজ আমাকে বলেছিলো যে আমার ধারণাই সঠিক ছিলো। আমার তথাকথিত গতানুগতিকতা থেকে আলাদা পোশাক দেখে সে আমাকে পত্র-পত্রিকায় পড়া সেই সব ভয়ংকর জাতের একজন, স্পষ্ট কথায়, একজন “হ্যানার্কিস্ট” ভেবেছিলো। তার উচ্চারণ যেমন ছিলো আমি তেমনই লিখলাম। এই একটা অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে পেয়েছিলাম – তাহলো, তার এইচ’এর অনিশ্চয়তা। এই আপাতঃ ত্রুটিহীন এবং সুশিক্ষিত লোকটি আসলে তার এহেন সমস্যাটির কারণেই বরবাদ হয়ে গ্যাছে। পরপর তিনটা “এইচ” তার ঠিক থাকলেও চতুর্থটা ছিল একেবারেই দৃষ্টিকটু। হয় তা একেবারেই অনুপস্থিত থাকত নয়তো অযাচিতভাবে চলে আসতো। কথার কারুকার্য সে ভালোই জানতো, রেগনালের ছবিগুলোর বর্ণনার সময় তার অলঙ্কৃত এবং চটকদার কথাগুলো শুনলে, গিবন সাহেবের মত লেখকও হয়তো একটু লজ্জা পেতেন। ্কিন্তু তার এই হঠাৎ হঠাৎ এইচে’র আগমন আর নির্গমন যেন পেছন থেকে আচমকা ছুঁড়ে মারা এক বালতি হিম-শিতল জল। তার বংশগতি নিয়ে কোনকিছুই আমি জানতে পারিনি। এ ব্যাপারটাতে সে সবসময় নিশ্চুপ থাকত, হয়তো এ নিয়ে সে নিজেই ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলো। কিন্তু আমার কল্পনায় আসে, কোন এক আর্ল বা নরমান রক্তের কেউ যদি কখনো কোন সুন্দরী গ্রাম্য ককনী পরিচারীকাকে বিয়ে করতো, তাদের মিলিত বৈশিষ্টের সন্তানটির মাঝে এই স্যামুয়েল স্যাভেজের ছায়া পাওয়া যেত। এটুকু বাদে সে একজন নিতান্তই চমৎকার ও বিশ্বস্ত মানুষ এবং তার প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধাও আছে। ...............
(আপনারা চাইলে চলবে......)
মন্তব্য
সাধু উদ্যোগ... চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ নজু ভাই
চলুক।
বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠলো
পড়তে ভালো লাগছে। চালিয়ে যান।
চলুক
(গুড়) মিঠা অতি মিঠা
চমৎকার
নজু ভাই, হিমু ভাই, শাওন, পাঠক, শাব্দিক, হাসান মামুন, রিশাদ_ময়ূখ - উৎসাহ দেয়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সবাই যখন বলছেন, অবশ্যই চলবে।
আপনাদের কারো ভালো লাগছে, কেউ গুড় দিচ্ছেন, কেউ পপ্পন নিয়ে বসছেন - কিন্তু পড়তে গেলে আমার নিজের কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, হেনরী সাহেবের লেখার অনুবাদ না, এটা ডেল কার্নেগীর বইয়ের অনুবাদ। একেবারেই কাঠখোট্টা। অথচ মূল বইটা পড়ার সময় কত্তো মজা পাই।
যাই হোক, চেষ্টা চালিয়ে যাবো, একটু রস ঢোকানোর।
কঠিন পরিশ্রমের কাজে হাত দিয়েছেন। তাই প্রথমেই সাধুবাদ জানাই। চলুক বিরতিহীন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল ভাই। পরিশ্রম একটু হলেও, শেষপর্যন্ত যদি যেতে পারি, আর ভালোভাবে রস-টস সহ অনুবাদ করতে পারি, ছেলেপেলেরা কত আনন্দ পাবে?
তবে সেদিন তো দূর অস্ত। এখনও তো ডেল কার্ণেগী ভাবটাই ছাড়াতে পারলাম না।
উদ্যোগে সাধুবাদ,অ্যালান আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্রগুলির একটা,এইটুক পড়ে মনে হইলো বিনয়ের অংশটা ভালোই হইসে,বাকি দেখার আশায় থাকলাম।
নতুন মন্তব্য করুন