বেহালার ছড়ের টানে সন্ধ্যার রঙগুলো গড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো আকাশজুড়ে।
সুরটা শুরুতে মৃদু বাতাসের মত, একটু কাঁপ কাঁপা। নীমগাছের গাছের পাতাগুলোর মত ঝিরিঝিরি। বেশ লাগে। উড়তে মন চায়। কিন্তু উড়তে গেলে যেমন বুকের ভেতরে একটা কেমন দমবন্ধ করা অনুভূতি, খা খা, শূন্য শূন্য - চাপ দিয়ে ধরে। ঠিক তেমনি সুরটায় একটা মোচড় ওঠে। পৃথিবীর সমস্ত কিছু থমকে দাড়ায় - কাছে আসতে শুরু করে। আকাশে শেষসন্ধ্যার সপ্তবর্ণা রঙগুলোও একটা জায়গায় জঁমাট বাধতে শুরু করে। আর আকাশের বাকিটা জুড়ে আধার গড়িয়ে পড়তে থাকে। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে অবাক বিষ্ময়ে আমরা দেখি সেই জমাট বাধা রঙগুলো আরো ঘন হতে হতে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত জ্বলে উঠলো - প্রথমে মিটমিটিয়ে তারপর উজ্জ্বল হয়ে। তারার মত। তারাটির চারপাশে ছড়িয়ে অসীম শূন্যতা। অন্ধকারের। এই অন্ধকার যত প্রগাঢ় হয় কোত্থেকে এক এক করে অগুন্তি তারা ফুটতে শুরু করে। সব তারাগুলোর রঙ ঠিক একরকম নয়। খুব ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় কোনটা ইষৎ লাল বর্ণ ধারন করছে, কোনটা নীলচে আভায় মিটমিট করে জ্বলছে আর কোনটায় একটু হলুদ মিশে আছে। বেহালার শব্দটা আকাশ পেরিয়ে, ছায়াপথ পেরিয়ে প্রসারিত হতে হতে ব্রহ্মাণ্ডের মত বড় হতে থাকে। আর এই পরিপূর্ণ অসীমের কেন্দ্রে বসে আজফারভাই ধ্যানমগ্ন হয়ে বেহালায় সুর সঞ্চার করতে থাকেন। তার সুরের টানে নিজস্ব কেন্দ্রে স্থিত থাকতে না পেরে একটি তারা জোনাাকি পোকার মত উড়তে শুরু করে। নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে ছুটে চলা তারা দেখে পৃথিবীর মানুষ ইচ্ছের ফুলকি উড়ায়। আবার তারপর আবার। ছুটে চলা তারাগুলো এক এক করে নেমে আসতে ধাকে বেহালার আশ্চর্য্য বাদন শুনতে।
আজফারভাইয়ের কোনদিকে খেয়াল নেই। তিনি বাজিয়েই চলেন। তাকে মানুষ মনে হয় না। এক আশ্চর্য্য প্রতিমার মত লাগে তাকে। তারারা এক এক তার চারপাশে তারারা জমতে থাকে, একটা মেলার মতন। আমি সেই মেলায় আজফারভাইয়ের আশ্চর্য্য বেহালায় তন্ময় তারাদের মধ্যে ঘুরে বেড়াই।
তার বেহালা নিঃসৃত সুরের ধ্বনিরা একটু একটু করে কেমন একটা বিষন্নতার দিকে মোচড় নেয়। সুরের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা বিশ্বাস পতনের হাহাকার বেজে ওঠে। তারাদের চোখ ভিজে আসে।
টের পাই - একেকটা তারা একেকজন মানুষের মত।
ঐতো পাশাপাশি দুটো তারা। আব্রাহাম লিঙ্কন আর ভাদিমির ইলিচ লেনিন। দুজনের চোখেই মুক্তোর মত টলটলে জল। গম্ভীর বিষাদময় মুখে বসে আছেন যিশুখ্রীষ্ট। মানবজনমের সমস্তবেদনা যেন তার উপর ভর করেছে। তিনিতো নবী, তাই তার কান্না চোখে দেখা যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম তার বিরাট বিরাট চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। গৌতম বুদ্ধের চোখ বন্ধ। তার নিমগ্ন বন্ধ চোখে যেন পৃথিবীর ভূত, বর্তমান আর ভবিষ্যত সুরের মূর্ছনায় জেগে উঠছে। আর চে গুয়েভারার স্বপ্নালু চোখজোড়া আরও স্বপ্নাতুর হয়ে উঠেছে। সক্রেটিসের মুখটা গম্ভীর, পাথরে খোদাই করা মূর্তির মত। স্যার আইজাক নিউটন একটা আপেল হাতে কি জানি ভাবছেন। তিনি যেন আর এখানে নেই। ডারউইনকে দেখে মনে হয় তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছেন। ঋষির মত। তিনি বসেছেন রবীন্দ্রনাথের পাশে। রবীন্দ্রনাথের আরেক পাশে কনফুসিয়াস। সত্যজিৎ রায় বেহালার শব্দের টানে কোথায় জানি হারিয়ে গেছেন। লিউর্নাদো দ্য ভিঞ্চি কোত্থেকে একটা ইজেল জোগাড় করে তুলিতে টান দিয়ে চলেছেন। তার তুলির আচড়ে শূূন্য ক্যঅনভাসে আজফারভাইয়ের মুখ ফুটে উঠছে। মোনালিসার চেয়েও সুন্দর আর রহস্যময় মনে হয় ছবির আজফারভাইকে। একটু দূরে দেখি মহাত্মা গান্ধী- মাও সেতুং আর একজন অচেনা চীনে মানুষকে নিয়ে বসে আছেন। কে জানি ফিসফিসিয়ে বলে - সান যু। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর কোলে মাথা রেখে বসে আছেন যেন তিনি তার সন্তান। দুজনের চোখই অশ্রুুসিক্ত।
আজফারভাইয়ের বেহালার সুরটা একটু একটু করে আর্তনাদের দিকে মোড় নেয়। তার সাথে সাথে তারাগুলো জোঁনাকীর মত জ্বলে নিভে উঠতে শুরু করে। একটা কষ্ট যেন দুমড়ে মুচড়ে নিচ্ছে সবকিছু। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমারও একটু একটু কান্না পায়। মনে হয় পৃথিবীটা যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে। ইস্রাফিল দাড়িয়ে আছে - এক্ষুনি সিঙায় ফু দিয়ে উঠবে। আশ্চর্য্য- ঠিক তক্ষুনি জমতে থাকা আর্তনাদটা হটাৎ বিষ্ফোরিত হয়ে ফেটে পড়ে, তারাগুলো উজ্জ্বল দ্যূতি বিকিরন করে নি¯প্রভ হয়ে পড়ে। বেহালার ধ্বনিটা ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসে। একসময় মনে হয় থেমে যাবে বুঝি সবকিছু। কিন্তু পুরোপুরি নীরব হয়ে যায় না কিছু- বেহালাটা বাজতে থাকে। কিন্তু মুল সুরটা যেন থেমে গেছে। যা বাজছে তা একটা সঙ্গতের মত। বেজে চলে কিন্তু আচ্ছন্ন করে না। একটা গুনগুন শব্দ ওঠে, প্রথমে ফিসফিসিয়ে- তারপর গুঞ্জরিয়ে। আমি অবাক হয়ে দেখি - তারাগুলো কথা বলতে শুরু করেছে। কথা, কান্না অথবা স্বপ্ন।
আমি টুকরো টুকরো কথার মধ্যে ঘুরতে থাকি।
আব্রাহাম লিঙ্কনের গলা শুনতে পাই, ‘সাম্য- ভার্তৃত্ব - স্বাধীনতা, ভিত্তিটাই আর থাকলো না’। লেনিন মাথা নাড়েন। তাকে স্মৃতির বিষন্নতা পেয়ে বসে- ‘আমি সবসময় সমান মানুষের স্বপ্ন দেখতাম। আর ওরা আমাকে দেবতা বানিয়ে সব ধ্বংস করে ফেললো’। যিশু এসে বললেন, ‘আমি এসেছিলাম দেবালয়ের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়ে মানুষের শরীরটাকেই দেবালয় বানাতে, আর আমার নামে একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আমাকেও বন্দী করলো, পিতা ঈশ্বরকেও বন্দী করলো, ক্রুশবিদ্ধ মানুষের রক্তের নদীতে আমাদের ভাসিয়ে দিল...’। বলেই যিশু নীরব হয়ে কোথায় জানি চলে গেলেন। কাজী নজরুল ইসলাম অভিমান ঝরান- ‘কেউ আর নিজেকে বিদ্রোহী করে না’। সক্রেটিসকে দেখলাম প্লেটোকে খুজছেন। কিন্তু কোথাও প্লেটো নেই। তার হতাশা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে - ‘এই সময়ে কোন প্লেটোকে দেখছি না, সবাই দেখি সক্রেটিস। কেউ বুঝলো না প্লেটো ছাড়া সক্রেটিস হয় না’। সান যু মাও সেতুংয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন- ‘শত্র“কে ভাল করে তুমি বুঝতে পারলেই দেখবে যুদ্ধ জয়ের অসংখ্য কৌশল আছে। কথাটা কেউ বুঝলো না’। গান্ধী শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন- ‘হায় মানুষ!’। সত্যজিৎ রায় গম্ভীর গলায় আপেল হাতে নিউটনকে বললেন, ‘ছবির জন্ম হয় চিন্তায়। ওরা চিন্তাটাকে বাদ দিয়ে ছবিটা বানাতে চেষ্টা করছে’। চে গুয়েভারা গৌতম বুদ্ধের কাছে গেলেন। বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন চোখের পাপড়িদ্বয় উন্মোলিত হয়ে চে'কে দেখে। ‘প্রভূ- কর্মই মুক্তি, কর্মই নির্বান এটা ভুলে গেছে মানুষ। রোমান্টিকতার মধ্যেই দায়িত্বকে পালন করতে চায়। মানুষ শুধু আমার রোমান্টিকতায় ডুবে কল্পনার বিপ্লবী হওয়াকেই বড় করে দেখলো। ফিদেল যে একা একটা যুদ্ধকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে গেল -ওর থেকে শিক্ষাটা নিতে পারলো না।’- মৃদু সহাস্য বদনে গৌতম আবার চোখের পাপড়িদুটো বন্ধ করলেন। কনফুসিয়াস রবীন্দ্রনাথকে বললেন - ‘বাল্যশিক্ষাটা ভাল করে শিখলো না কেউ’। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে কান্না মেশানো থাকে। বঙ্গবন্ধু সজল চোখে নেতাজীকে বলছেন- আমি ভুল বলেছিলাম। বাঙ্গালীরা স্বাধীন হওয়ার পর কবিগুরুর কথাটাকে ভুল ভেবেছিলাম। তিনিই সত্য দেখেছিলেন- বিধাতা সত্যিই বাঙ্গালীদের বাঙ্গালী করে রেখেছেন। মানুষ করেন নি।’
লিউনার্দো দা ভিঞ্চি তার আঁকার জগতে চলে গিয়েছিলেন। বাজনাটাযে থেমে গেছে তিনি তা খেয়ালই করেন নি। ছবিটার শেষ কয়েকটা টান বোধহয় বাকি ছিল। সেটা দেয়ার জন্য আজফারভাইকে খোঁজ করেন। আজফার ভাই বেহালাবাদন শেষ করে কোথায় যে চলে গেছেন। ছবিটা মোনালিসার মতই অসমাপ্ত রেখে তিনি তারা হয়ে ছুটতে শুরু করেন। চারপাশে তাকিয়ে দেখি অজস্্র তারা জোঁনাকীর মত জ্বলতে জ্বলতে ছুটে চলেছে। কেউ নেই। আজফার ভাইয়ের ছবিটা মনের মধ্যে নিয়ে আজফারভাইকে খুঁজে বেড়াই।
হটাৎ হটাৎ তার অলৌকিক বাজনা মনের মধ্যে শুনতে পাই। একটা শূন্যতা বুকের মধ্যে বড় হয়। আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে ফ্রিদার কথা মনে পড়ে, ঝুমির কথা মনে পড়ে। আবার কখনও কখনও তারাদের দিকে তাকিয়ে ঝুমি বা ফ্রিদা কারও কথা মনে পড়ে না, আমারই কথা মনে হয়। তখন তারাদের মধ্যে আজফার ভাইয়ের বেহালা শুনতে আসা সেইসব তারাদের মুখ খুঁজি। এভাবে দিনের পরে দিন যায়। আজফারভাই সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে আসে। নতুন শব্দ যোগ হয়, নতুন দৃশ্য যোগ হয়। মনের মধ্যে সেই বেহালার শূন্যতার সাথে হাজারো খাপছাড়া শব্দ আর দৃশ্য যোগ হয়। তবু শূন্যতাটাই শুধু বেড়ে উঠতে থাকে।
একদিন খবর আসে। হুট করেই। আজফারভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বলিস কি? বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ অনুভূতিটা হামাগুড়ি দেয়। আজফারভাইকে দেখতে ছুটে যাই। পৃথিবীর সবকিছু অন্যরকম লাগে। এমনকি আজফারভাইয়ের ঘরটাও।
বেহালাটা অনাদরে পড়ে আছে। বগুদিন সেটায় হাত পড়েছে মনে হয় না। আজফার ভাইয়ের পুরো ঘরটাই বইয়ে মোড়া। ঐ বইগুলো থেকেই আমরা তারাদের চিনতে শিখেছিলাম। আমাদের স্বপ্নের মত ছিল সেসব বই। সেই প্রিয় বইগুলোতে মাকড়সারা ঝুল বুনেছে। ঘরময় ধুলো আর ধুলো। মনে এই এই ঘওে কারো পা পড়েনি অনেকদিন। কেউ আসে নি। কিন্তু চোখের সামনে ঐ যে আজফারভাই। এই ঘরময় ধুলো আর নোংরার মধ্যে আজফারভাই বুদ হয়ে বসে আছেন। কথা বলতে সাহস হয় না। অপেক্ষা করি। আজফারভাই শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন। আজফার ভাইকে কেমন বোকা বোকা লাগে দেখতে। আমিও চুপচাপ বসে থাকি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলে উঠি -
: কী ভাবছেন আজফার ভাই?
: ভাবছি ভাবছি ভাবছি ...আজফার ভাইয়ের গলা খাদে নেমে আসে।
কেউ নেই কেউ নেই - সামনে কেউ নেই, যে ছিল সেও নেই। পাপ। পাপ।
কিছু বুঝতে পারি না। এই শব্দ দিয়ে কী বুঝাতে চাইছে আজফারভাই।
: গান্ধী নেহেরু জিন্নাহ জিন্নাহ বঙ্গবন্ধু... বঙ্গবন্ধু, মার্কস লেনিন ভাবছি ভাবছি
: কী?
: স্পিরিচুয়াল লীডার, ফাংশনাল লিডার। কেন যে গোলমাল হয়ে যায়।
আজফারভাই বিড় বিড় করে। কী বলছেন আজফার ভাই- বলে উঠি।
জিজ্ঞাসার উত্তরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, চোখের দৃষ্টিতে একটা ঘোলাটে ছায়া খেলা করে। অস্বোস্তিতে কেবল নড়ে চড়ে উঠি। কোন কথা বলতে পারি না। একটা নীরবতা দুপুর উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। হটাৎ ইদুরের কুটকুট শব্দের মত আজফার ভাইয়ের গলা ভেসে আসে।
: আমার যা করা উচিৎ তা করি না- খালি এইটা এইটা ভাবি - ভাবনা -ইটস ট্রু, ইটস আ কনটেনিউয়াস প্রোসেস।
আজফারভাই বিড়বিড় করে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার গলা চড়তে শুরু করে। কথাগুলোর মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই কিন্তু কোথাও যেন একটা পরম্পরাও আছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। খালি হতবুদ্ধি হয়ে আজফারভাইয়ের কথাগুলো শুনে যাই।
: কী - ভাবতেছি ? আমরাতো সবাই ভাবছি - তুমি তো ভাবতেছোই - কিন্তু কট্টুক করলা- ১% - কেন? আমি যা ভাবি চারপাশ বলে ১০০% ভুল - এই কারণে আমি কিছু করতে পারি না। না করার পেছনে ৫০% আমি দায়ী না। আর অর্ধেক আমি দায়ী - অর্ধেক কেন ? আমি তো সময়কে অস্বীকার করতে পারি না - সময়কে অস্বীকার করতে পারি না। বিচার চাই... বিচার চাই। ৭১ এ যে যুদ্ধশিশুটি জন্মালো জ্ঞান হবার পর থেকে- যদি সে বিচার চেয়ে চেয়ে বড় হয় তাহলে তারই বিচার আগে করা উচিৎ।
আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়।
: কেন?
আজফার ভাই চোখ তুলে তাকান। তার চোখ দেখে তার পুরনো ছায়া মনে হয়। একটু সংলগ্ন- একটু অসংলগ্ন।
: দেশের স্বার্থে।
: কেন?
: ৭১ এর বিচার চাইছে তো?
: হ্যা, চাইছে।
: বুদ্ধিবৃত্তির পর থেকে যে শুধু চেয়েই আসছে এতদিন, চাইতে চাইতে ওর চরিত্র এমন রূপ নিয়েছে যে- ওর চাইতে এরই বিচার বেশি করা দরকার।
: কেন?
: চেয়ে আসছে যে। আমি চেয়ে আসছি যে। আমার বুদ্ধিবৃত্তির পর থেকে। আমার বিচার আগে করতে হবে।
: যে বিচার চাইছে - তার বিচার কেন করতে হবে?
: আজকে যদি আমি কথা বলি আমি রাষ্ট্রদ্রোহী হবো।
: কেন?
: এই দেশে সবাই পচে কেন? কেউ ভাল থাকে না ক্যান? এই দেশে চে গুয়েভারা জন্মালেও লম্পট হয়ে যেত।
হটাতই আজফারভাই হু হু হু হু করে কেদে ওঠেন। আমরা আজফারভাইয়ের সামনে স্থানুর মত বসে থাকি। এরকম পরিস্থিতিতে ঠিক কী করতে হয় - বুঝতে পারি না। কান্না কিংবা হাসি কোনটাই চিরকাল চলতে পারে না। আমি অপেক্ষা করি। একসময় আজফারভাইয়ের কান্নাও থেমে আসে। কিন্তু তার কথার মধ্যে কান্নার রেশটা রয়েই যায়।
: সেক্ষেত্রে আমি যা চাই তা করলে লোকে আমাকে পাগল বলবে - তাহলে পাগল হলো কে ? আমি - না তুমি ? আমরা এইরকম গল্প শুনেছি না নেতা বললেন - ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে। পেছন থেকে কেউ কেউ চিতকার করে বলে- কিসের ত্রিশ লাখ- তিন লাখও হবে না। যুদ্ধতো একটা রম্য রচনা, না ? আসলে আমরা সবাই পাগল - না না. . .. কেন - কারণ আমি পাগল। কেন পাগল - কেন পাগল.. কেন পাগল... কারণ পাগল... আমি আমার সময়ে থাকি না। আমি পাগল কারন সবার সত্য আমার মিথ্যা। সবার মিথ্যা আমার সত্য। সত্যাসত্য... মিথ্যামিথ্যি.. সত্যামিথ্যি....... পাগল.. পাগল...
আজফারভাই এলামেলো কথার মধ্যে টুপ করে দেলওয়ারকাকা হাজির হয়ে যান।
বুঝলি রে তুই যখন পারফেকশনের কথা বলবি মানুষ তখন তোকে কী বলবে জানিস? হয় পাগল, না হয় সিজোফ্রেনিক না হয় ডিপ্রেশনে ভুগছে। শুধু এই দেশে না। মনে হয় সব দেশে। সব সময়।
সেই একই কথা। দুই জন মানুষ। একই সময়।
দেলওয়ার কাকা। আজফারভাইদেরই কাছাকাছি বয়স হবে। বাবা আর ভাই এর মাঝামাঝি একটা গোলমেলে বয়স। বাবাকে ভাই বলতেন বলে আমাদের কাছে দেলওয়ার ছিলেন কাকা। অসুখী অতৃপ্ত অস্থির একজন মানুষ। তার বাবা যখন মারা যান তখন তার মার বয়স এখনকার উচ্ছ্বল তরুণীদের সমান। যদিও ঐ বয়সেই দুই সন্তানের জননী হয়ে গেছেন। অল্প বয়সের একজন মেয়ে যদি বিধাব হয়ে যায়- এই সমাজে কত যে ঝঞ্ঝাট ঝামেলা তাকে পোহাতে হয়- তার কতটুকুই বা আমরা জানি। বড়দের কাছে শুনেছি- ছেলেবেলার এইসব জটিল সামাজিক টানাপোড়েনে দেলওয়ার কাকা একটু আধা পাগলা হয়ে গিয়েছিলেন। সমাজের উপর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। কিসের এক চাপা রাগে গনগন করতেন সবসময়। বিয়ে করেছিলেন আর বিয়ের পর এক এক করে তিন কন্যার জন্ম দিলেও রাগটা তার একটুও কমেনি।
তার মেয়েরা বড় যখন বড় হলো- তিনি গো ধরলেন - কোন বিদ্যালয়ে তিনি তাদের পাঠাবেন না। তিনি নিজেই তাদের শিক্ষা দেবেন। এই নিয়ে কাকীর সাথে প্রতি রাতেই বাধত। তখন দেলওয়ার কাকার সে কি চিতকার। কাকীও কি কম যায়। আমাদের পড়ার টেবিল, টেলিভিশনে ইংরেজী মুভির সিরিজ তাদের ঝগড়ার তুমুল শব্দে উড়ে পালাতো।
: ওদের পড়াশোনা করতে হবে না,
দেলোয়ার কাকা রাগলে গলাটা একদম অন্যরকম লাগে।
: তাহলে কী রিকশা চালাবে?-
কাকীর রিনরিনে গলার আওয়াজটা প্রবল হয়ে ওঠে। দুজনে পালা কওে পাল্লা দেয়া কথার ফুলঝুরিতে আমরা ভেসে যেতে থাকি-
: মেয়েদের দেখেছিস- রাস্তায় ইট ভাঙতে, রাত দিন রাস্তায় বসে ইট ভাঙছে। আমার মেয়েরা ইট ভাঙবে না। দরকার হলে রিকশা চালাবে। ছুটতে শিখবে। এক জায়গায় বসে থাকবে না।
: রিকশা চালাবে, এ্যা- এত সোজা... কাকীর গলায় ব্যাঙ্গ আর বিদ্রুপ ঝরঝন করে বাজতে থাকে।
: এত সোজা - জীবন এতই সোজা। পেপারে দেখিসনি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ছেলেকে মেরে ম্যানহলে ফেলে রাখছে। আর কটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার মেয়েকে পড়াবো? যেখানে অভিভাবকত্ব নাই সেখানে আমার মেয়েদেরকে পাঠাবো?
: হ্যা পড়াতে হবে। সবাই পড়ায়।
: আমি ওদের মধ্যে একটা সুন্দর ঈশ্বর দিয়ে যেতে চাই আর কিচ্ছু চাই না। আমি বাচ্চাদের শুধু অহংকারটা দিয়ে যেতে চাই। ওরা ত্যাগ করে বড় হতে শিখবে। নিজের ব্যক্তিত্ব বিক্রি করার শিক্ষা আমি ওদের নিতে দেবো না। কোন সভ্যদেশে দাসত্ব করার জন্য পড়াশোনা করে না। এই দেশে কেউ প্রচ্ছদ বুঝে, প্রকাশক বুঝে, ভূমিকা বুঝে, অলংকরন বুঝে, তুই বুঝিস ? জানিস শিক্ষা কী - সভ্যতা কী? জানবি কী করে? নোট বই পড়ে শিক্ষিত হয়েছিস- শিক্ষা বুঝবি কী?
: আমি চলে যাবো। পাগলের সাথে সংসার করা সম্ভব না আমার পক্ষে ।
: বল বল। আর কী বলবি....উন্মাদ পাগল না হয় উন্মাদ শয়তান। আর কোন ডেজিগনেশন জানিস নাকি তুই? তোর সোসাইটির ঐ কচ্ছপ ইনটেলেকচুয়ালদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর, আরও কিছু ডেজিগনেশন জানিয়ে দেবে।
: যাবোই তো। ওদের কাছেই যাবো।
: দাঁড়িয়ে আছিস কেন, যা না। ওদের কাছেই যা। কোন মানুষের কাছে যাস না। ওরা তোকে ঘেষতে দেবে না। এত গন্ধ তোর শরীরে। মনের গন্ধ মাংস পর্যন্ত পৌছায় জানিস তো, নাকি সেটাও জানিস না?
: আমি ওদের নিয়ে চলে যাবো
: ভুলে গেছিস! এটা তোর বাচ্চা। কসম খেয়ে বলতে পারবি এটা তোর এক্সপেক্টেড চাইল্ড? এ্যা। যা না- চলে যাবি যা। ওরা তোর একটা কথাও শুনতে চায় না।
: আমি কোর্টে যাবো। মামলা করবো।
কাকীর কান্নার দমকে গলা জড়িয়ে আসতো। বিড়বিড় করে কী বলতো ঠিকমত বোঝা যেত না। বা বললেও কাকা শুনতো বলে মনে হতো না। তাকে তখন বলার তোড়ে পেয়েছে।
: আমি পিতা। যার তিনটা সন্তান আছে - সোসাইটির জাজমেন্ট লাগে না ওর। ওরাই সবচেয়ে বড় বিচারক। ওরাই বলতে পারবে আমি কতটা লোভী, কতটা পাপী, কতটা নিষ্ঠুর - নির্দয় - আমি কতটা নিষ্পাপ নির্মোহ । তুই কোন মামলার ভয় দেখাস? তুই নিজে কী জানিস? একটা ডিপ্লোমেটিক প্রসটিটিউট। সিম্পলি। নিজেকে বিক্রি করা ছ্ড়াা যার আর কোন অস্তিত্ব নাই।
: আমি চললাম।
: চলে যা। ভেবেছিস ভয় দেখিয়ে বশ করবি। তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। তুই খালি আমার তিন বাচ্চার মা, এ ছাড়া আর কোন ইমোশনাল এটাচমেন্ট নাই। মদ না খেলেতো তোর কাছে যেতেও পারি না।
হটাত করে সব শুনশান হয়ে যেত। যেন পাশের বাড়ির টিভিতে সিনেমা হচ্ছিল- কারেন্টটা চলে গেল হুট করে। কাকী কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তাহলে? পরদিন থেকে কোন আওয়াজ নেই বাড়িটাতে। শুধু রাত নামলে একটা ঘরে নিঃসঙ্গ আলো জ্বলে ওঠে। কয়েকদিন বাদে দেখা গেল দেলওয়ার কাকা তিন মেয়েকে নিয়ে বাক্স পেটরা নিয়ে ফিরছেন।
: কোথায় গিয়েছেছিলেন কাকা ?
প্রশ্নের উত্তরে দেলওয়ার কাকার হাসি ঝরে পরে।
: এইতো প্লেনে করে ঘুরলাম। কয়েকদিন ফাইভষ্টার হোটেলে মেয়েদের নিয়ে থাকলাম।
: তাই! অবাক হয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকাই। তিন বালিকার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।
: কেন জানো?
: কেন কাকা?
: কোন spoiled পলিটিশিয়ান আর ভূঁইফোড় বিজনেসম্যানের পোলা যেন ওদের কোন মোহতে ফেলতে না পারে। ওরা মেয়েতো...
বলেই দেওয়ার কাকা বড় বড় চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কি আশ্চর্য্য।
তার কান দুলছে। যেন দুটি তালপাখা একসাথে মার্চপাস্ট করছে। শুধু কি কান। নাকও। নাকের ফুটো দুটোও সমুদ্রের ঢেউএর মতো বিরাট হয়ে ফুসে উঠছে আর ভঙা ঢেউ এর মত এলিয়ে পড়ছে। ভুরু দটি প্রজাপতির মত। নাচছে। কিন্তু চোখ দুটি ভয়ংকারভাবে স্থির। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা ভয়ে কেপে উঠি।কিন্তু পা দটি যেন অবশ হয়ে পাথর হয়ে গেছে। দেলোয়ার কাকা একবারে আমাদের চোখের উপরে চোখ এনে বললেন
‘ আমার নাক, কানটা কুকুরের মত। কী করে হলো - জানো?
আমরা মাথা নাড়ি।
মা আর বোনকে পাহারা দিতে গিয়ে...’- বলেই অট্টহাসি দিয়ে আমাদের অবাক চোখের সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। মেয়েরা মাকে পেয়ে আহ্লাদে ডগোমগো। আর মা গলা ছেড়ে কাঁদছেন। দেলওয়ার কাকা বোকার মত পায়চারী করছেন আর বলছেন - ‘আহহা কাদছো কেন? এত কান্নার কী হলো? আমরা কত মজা করেছি, মাকে বলো তোমরা।’ মেয়েদের ঠেলা দিয়ে দেলওয়ার কাকা হৈহৈ করে চেচিয়ে উঠলেন। যেমনটা সবসময়ই তিনি করেন।
দেলওয়ার কাকার মত এরকম পাগলাটে হয়ে যাবে নাকি আজফারভাই?
আজফারভাইয়ের জন্য আমার ভয় লাগে।
চিৎকার করে আজফার ভাই হাত ছুড়তে থাকেন - ‘আমি পাগল তাই পাগল - কেন পাগল? কেনর কিছু নাই, কেনর কোন মানে নাই তাইনা ... সব কুত্তার বাচ্চা সুস্থ - আমি পাগল - আমি ওদের পুছি না -আমি পাগল...’...
আজফারভাই উত্তেজিত হতে হতে সূর্যের মতন গরম হয়ে ওঠেন। হটাত কেউ যেন সূর্যের মাথায় এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিল। আজফারভাই ঘুমিয়ে পড়ার মত শান্ত হয়ে যান। কয়েক মুহূর্ত থমকে - চোখ জোড়া মেঝের উপর নিবদ্ধ করে ঝিম মেরে পড়ে থাকেন। অপেক্ষা করি। এভাবে কিছুক্ষণ চলে গেলে একসময় মনে হয় সবকিছু ঠিক হয়ে আসছে। ঠিক তখনই চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করেন
আমি বলি তোমারে ... আমার কার্যকলাপ তোমাদের কাছে সহজ সরল পাগলামো - আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি - আমি তোমাদের কাছে এসব কথা - বলতে চাই নাই - আর বলবোও না- আর কখনোই বলবো না - দয়া করে আমাকে মাপ কইরে দিয়েন - আমি আমার কাজ অনুযায়ী আমার কাজের ফল নিয়া যাবো- আল্লা তুমি আমারে মাফ করো - এই অসহ্য সুস্থদের হাত থেকে আমারে রক্ষা করো- আমারে বাঁচাও...
সুস্থ মানুষ ভেবে আজফার ভাই আমাকে বের করে দিয়েছিলেন। সুস্থ মানুষের বিষন্ন মন নিয়ে ফিরে আসি। এর কয়েকদিন পর আজফারভাইয়ের পাগলামিটা নাকি আরও বেড়ে যায়। তিনি মানুষ দেখলেই আক্রমন করতেন। শেষপর্যন্ত বন্ধুরা ধরে বেঁধে তাকে কোন একটা মেন্টাল হাসপাতালে রেখে এসেছিল।
আজফার ভাই কেন পাগল হলো? কে এর জন্য দায়ী? মাঝে মধ্যে ভাবি। একবার মনে হয় তার কী দরকার ছিল এইসব পাগলামী করার? কত কিছুই তো সবাই মেনে নিচ্ছে। সবাইতো চলছে। আবার মনে হয়... কিছু ভাবতে পারি না। সবকিছু থমকে থাকে।
আকাশ দিয়ে শুধু একটা প্লেন উড়ে যায়। উড়ে যেতে যেতে একসময় আকাশে দূর তারার মত জ্বলজ্বল করতে লাগলো। বিন্দু একটা আলো শুধু। তারপর মৃত নক্ষত্রের মত হারিয়ে গেল। প্লেনের মানুষগুলোর কথা মনে হয়। আকাশের মধ্যে বসে আছে ওরা, কি অদ্ভুত না?
মন্তব্য
আপনার লেখার মোটিভ ভাল লেগেছে।
তবে গল্প বা যে কোন কিছুতেই বোধকরি একটা ছন্দের প্রয়োজন আছে যা পাঠককে ধরে রাখবে।
কিছু কিছু লাইন মনে গেথে যায়। চে আর ফিদেল নিয়ে আপনার নিজস্ব উপলব্ধি ভাল লাগল।
facebook
নতুন মন্তব্য করুন