তীর্থের কাক ১ তীর্থের কাক ২ তীর্থের কাক ৩
তীর্থের কাক ৪
তীর্থের কাক ৫
অ অ ক খ বর্ণ গুলোর নীচে “মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলাভাষা” লেখা ছাই রং-এর টি-শার্টাই এতক্ষণ গায়েছিল। একটা ঘরের সামনে পাতা কয়েতটা চেয়ারের দু’টো দখল করে আছি আমরা দুই বাঙ্গাল। শীত যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। পেছনের দরজা খুলে কেউ যাচ্ছে কেউ আসছে। প্রতিবার দরজাটা খুললেই মাঘ মাসের শীতের মতো ঠাণ্ডার ঝাপটা সহ্য করা একটু কঠিন। দেশ থেকে আনা একটাই টালের সুয়েটার ছিল সাথে। সেটাই গায়ে দিলাম। কিন্তু কোন লাভ হল না। শীত যেন ক্রমে বেড়েই চলেছে! এর মধ্যে ডাক পড়ল। ছবি তোলা হল ডানে, বামে ও মুখোমুখি করে। পাঁচ আঙ্গুলের টিপসই নেয়া হল। আমাদের দেশে সাধারণত মূর্খরাই টিপসই দেয়। ব্যপারটা একটু অপমান জনক মনে হল। আমি কী এতই মূর্খ যে দস্তখত দিতে পারব না! নাকী এখানে সইও জার্মান ভাষায় দিতে হয়।
কিন্তু ক্ষোভ দেখানোর সময় পেলাম না। দরজা খুলে পরের ঘরের নম্বরটা দেখিয়ে বলল; আগে বাড়ো।
পরের ঘরের মাঝ বয়সী মহিলা একটা পলিথিনের বস্তা হাতে দিয়ে বলল; এখান থেকে শুরু করো: প্রথমে মোজা, তার পর জাঙ্গিয়া-গেঞ্জি-সার্ট-পুলোভার-প্যান্ট-জ্যাকেট-জুতা। সব কিছু একটা করে নিতে পার। সমস্যা হল সাইজ নিয়ে। মহিলা S দেখে নিতে বললেন সব। জুতার সাইজ দেশের মাপেই লাগল। নতুন জামা কাপড় আমার ভাগ্য কদাচিৎ জুটেছে। এখন এই অপ্রত্যাশিত নতুন জামাজুতা পেয়ে মনটা ভাল হয়ে গেল।
A বিল্ডিং-এর প্রথম ঘরটার নম্বর ১। সেখানেই আপাততঃ গন্তব্য। সূর্যের ত্যাজ অনেক কমেছে এর মধ্যে। ঠাণ্ডা বাতাস মনে হয় কান কেটে নিচ্ছে। হেঁটে যেতে যেতে হাত-পা-নাক-কান সব জমে যাবে। দৌড় দিলাম ঝেড়ে। পঞ্চাশ মিটারও হবে না এইটুকু পথ এসেই শীতে হাতের আঙ্গুলে চাবিটা ঠিকমত ধরতে পারছি না। আঙ্গুলে কোন বোধ নেই। শ্যামলা ধরনের আমার বয়সী একটা ছেলে ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল। ১ নম্বর ঘরের দরজা খোলাই পেলাম। ভেতরে আমাদের মা-চাচীদের বয়সী দু’জন মহিলা। একজনের পরনে আবার শাড়ি। শাড়ির উপরে সামনের দিকটা কোর্টের মতো খোলে এমন একটা পুলওভার। শীতের ঢাকায় অনেক অভিজাত মহিলাকে এই পোষাকে দেখেছি। মাথার বিঘত খানেক উপড়ে ছাদ। অনেকটা আমাদের দেশের মিনি বাসের মতো। ঘরের পরিসর একটা বাসের চেয়ে খুব বেশী বড় না। দরজার ডান দিকে একটা দ্বিতল খাট। তার সাথে কোণা করে এল সাইজে সাজনো আরো দু’টি এমন খাট পাতা। আমাদের জন্য দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেটা এতক্ষণ আমাদের পেছনেই ছিল। এবার শাড়ি পরা মহিলাটির পাশে গিয়ে বসে মাথাটা সামনের দিকে এগিয়ে রাখল। কারণ সোজা হয়ে বসলে উপরের খাটের তলায় ঠেকবে মাথা। বুঝলাম পাশের দু’টো খাট ওদের দখলে। আমাকে নীচে থাকার কথা বলে শামিম ওপরের খাটে রাখল ব্যাগ।
সন্ধ্যা না হতেই রাতের আঁধার। ব্যাপারটা পূর্বভাস না দিয়েই ঘটে গেল। পাঁচটা বেজে গেছে। দুপুরের খাবারটা বাদ গেছে। এখন নাকী রাতের খাবার খেতে যেতে হবে। ক্ষিধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। কিন্তু শীতের কথা ভেবে ক্ষিধা কিছুটা দমে গেল। কারণ খাবার দেয়া হবে আরেক বিল্ডিং-এ। এই তো পঞ্চাশ মিটারের মতো দূর হবে। ছেলেটা শ্রীলংকার। দেখে মনে হচ্ছে এখানকার নিয়ম নীতির সাথে কিছুটা পরিচয় আছে। কিন্তু ইরেজী জানে না এক বর্ণও। মহিলা দু’জন আমার মতো হাতুড়ি-বাটাল পেটানো ইংরেজীতে পেরেক মেরে পরিস্থিতি বোধগম্য করে দিলেন।
কোন মাফলার বা শীতের টুপির কথা দেশে মনেই আসেনি। মার্চের শুরুতে বসন্তের বাহার। শীতের দিন বাংলাদেশ এবারের মতো অতীত কাল। আর শীতের এমন শক্তির কথা কল্পনা করাও এতদিন কঠিনছিল। জাম্প ক্যাডস আর নায়লনের মোজা পরা না পরা সমান। মোটা জিন্সটা মনে হয় পরনে নেই। শামিমের বুদ্ধিতে প্রথমে পাতলা প্যান্ট, তারপর জিন্স, তার উপর আজকের পাওয়া নতুন জিন্সের প্যান্টা পরলাম। দেশ থেকে আনা এবং নতুন পাওয়া দুটো পুলোভার। তার উপর নতুন জিন্সের জ্যাকেট। প্রথম দশ গজ কোন রকমে গেলাম ঠিকই। কিন্তু পরে আর ভদ্রতা রক্ষা করতে পারলাম না। দিলাম ঝেড়ে দৌড়। পেছনে মহিলা দু’জন আমার দৌড় দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলেন না।
৭
খসখসে কাগজের লেপে মাথাটা মুরে রাতটা কাটালাম। সকালে ডেকে তুললো দু’জন লোক। রাতের কাগজের লেপ-কাথা নিয়ে ভেজা নেকড়ায় ঘরটা মুছে তাঁরা চলে গেল। কাল রাতের খাবারের সাথে পাওয়া প্যাকেটটা খুললাম শ্রীলংকানদের দেখাদেখি। ছোট্ট একটা টাওয়াল সাথে মিনি সাইজের টুথপেষ্ট, ব্রাস, সেম্পো, সাবান, দাড়ি কামানোর ওয়ান টাইম রেজার। দেশথেকে আনা ফেদার ব্লেড আর দু’দিকে ধারা ওয়ালা ব্লেড ঢুকানোর রেজারটার জন্য মায়া হলো। উইজডম টুথব্রাসের ঘসা মাড়ি আর এখন সহ্য করে না! বেসিনের পানির কলে একটাই হাতল। ডানে ঘুরালে গরম আর বাঁয়ে ঘুড়ালে ঠাণ্ডা জল।
সকাল সাতটা বাজে কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। চাল ধোয়া পানির মতো, ভাতের ফেনের মতো, ঘোলা জলের মতো, ফসল তোলা মটরশুটির পোড়ানো নাড়ার ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় সামনে দশ হাতও দেখা যায় না। আমাবশ্যার রাতে অনেক দূরের নক্ষত্রের মতো কিংবা পথের ধারের ঝোপে মিটিমিটি জ্বলা জোনাকীর মতো; এখানে ওখানে বিজলিবাতির অস্তিত্ব। অন্তরে তুসের অনলের মতো না আছে আলো না তাপ, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আছে। কী এক অদ্ভূত কারণে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
সেই কালো রুটি-বাটার-জেলী-কফি। এসি বাসের সামনে লাইন। সাদাকালো ছবি তোলা দু’ভাজ করা কাগজ জমা দিয়ে বাসে উঠি। সাদা-কালো-হলুদ সব রঙ্গের মানুষে ভর্তি বাস। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেন কোন গভীর সমস্যার সমাধান নিয়ে ব্যস্ত!
বিশাল বিরাট লোহার গেটের সামনে দাড়ালো বাস। চালক নেমে কী বললেন আর কী কাগজ দেখালেন তা ঈশ্বরই জানেন। দারোয়ান নবাবী হালে গেট খুলে দিলেন। দারোয়ানের চেয়ে ড্রাইভারের পদবী বড় সেটাই জানতাম। কিন্তু এখানে তার কোন আলামত পেলাম না। সৌহাদূপূর্ণ করমর্দন দেখে বরং মনে হলো এক গায়ের দুই বাসিন্দার নিত্য আসা যাওয়ার কুশল বিনিময়।
মন্তব্য
পুতুল ভাই লেগে আছি। তবে এবার আপনি সাঁটে মেরে দিলেন। এইটা কি সুবিচার হল বলেন?
ধন্যবাদ কল্যান,
একটু ধৈর্য ধরুন মহারাজ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
হেহ হেহ পুতুল ভাই, এই জিনিসটা তো ধরতে পারি নাই আজো, বেটা এত পিছলা, খালি ছিলিপ কাটে। কত যে ঝাড়িঝুড়ি খাই এই জন্যে। তাওতো আপনি কত আদর করে বললেন। তবে বড় ভাই কইছেন তাই একবার ট্রাই করেই দেখি ।
আরে নাহ্, একটু মজা করলাম আর কী।
আমার লেখা পড়তে আগ্রহ তো আমাকেই বরং সম্মানিত করে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
বাস্তব জীবন আসলে মজারু হয় না। সেটা হয় শুধুই নির্মম বাস্তব।
চালিয়ে যান, সাথে আছি।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
নির্মম তো বটেই পাগল মান,
নির্মমতাকেই তাচ্ছিল্য করে বেঁচে থাকার চেষ্টা আর কী।
দুঃখকে মজা হিসাবে দেখলে অনেকটাই হাল্কা লাগে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
বাহ্ খুব ভালো লাগলো দুটো পর্ব। যধারীতি চমৎকার সাবলীল ঢঙে একটানে পড়ে ফেললাম।
সাথে আছি ভাইয়া.......
ধইন্যাপতা ভাইয়া।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পেটে খিদা বেসি মনে হইল জানি " আরে শেষ?" কিন্তু এত সাবলিল ভাবে কেম নে লি খেন?
ধন্যবাদ ড্যানিয়েল,
খুব বড় করে দেইনা পাঠকের ধৈর্য্যের কথা ভেবে।
সাবলিল আর পারি কৈ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন