কতো মানুষের মাথায় কতো চিন্তা বলক দিয়ে ওঠে। একেকজনের একেক দিকে খায়েশ। খায়েশের কি আর হিসাব নিকাশ নেওয়া চলে? আমাদের জহিরের খায়েশ ছিলো ধাঁধা। মর্জিমতো বাংলা লোকবুলির সমুদ্র সেঁচে তুলে আনা সুপাক ধাঁধা পেশ করতো সে। বাকি সবার হাঁসফাঁস হোত সেই সুপাক পরিপাক করতে গিয়ে। সে-ই একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলো, 'কোন জিনিস কাটলে বড়ো হয় বল।'
___________
লোকবুলির ধাঁধা, জন্ম প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে চলে আসছে অনেকটা কাল। আমাদের পাড়ায় বহুদিন আগে জন্ম নেয়া ছেলেটার কানেও এসেছিলো। কিন্তু ধাঁধাটা পরিবেশনকারী মানুষটা বহমান ঐতিহ্য পুরোপুরি অনুসরণ করেন নাই। তিনি ধাঁধা বলে দিয়েই পগারপার। উত্তর বলে দেবার দায় এমনি করে এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হয় নাই। তো, সেই থেকে ছেলেটা, ঐ এক উত্তর খুঁজে চলেছে। দিন যায়, বছর যায়, তার খোঁজ আর শেষ হয় না। শহীদুল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা হলে হয়ত জেনে নিতে পারতো। তারপর একদিন দেখা হয়েওছিলো। কিন্তু সামাজিকতার ধারালো ধার ধারতে গিয়ে প্রশ্নোত্তরের সূক্ষ্ম মেজাজের সুতো কাটা পড়েছিলো। হয়ে ওঠে নাই। তাকে আর কেউ জবাবটা দিয়ে দিতে পারে নাই। তার খোঁজাখুঁজি সেই থেকে নিস্ফল চলছে।
ছেলেটা, খুব বুদ্ধিবিলাসী এমনটা বলা যায় না। কী কাটলে বড়ো হয় সেটা বুদ্ধি খাটিয়ে হাসিল করারও হয়তো একটা রাস্তা বেরুতো; কিন্তু বুদ্ধির অন্যান্য ব্যবহার এইখানে খুব বেশি একটা খাটাখাটনি পেশ করতে পারলো না। আফসোস! তবুও সমস্যা নাই। দিন যত যায়, ছেলেও ততো বড়ো হয়। গতরে তাগত বাড়ে অনেক। সেই তাগত অবশ্যম্ভাবী পথে উত্তর খোঁজার নিরিখে নিয়োজিতও হয়ে পড়ে। ছেলে, অতঃপর বেড়ে উঠে হওয়া লোকটা, সামনে যা কিছু পায়, কেটে কেটে দ্যাখে কোনওটা বাড়ে কী না। সন্ধানে মিলায় বস্তু... বাকিটা দিয়ে তার আর দরকার নাই।
___________
তাগতওয়ালা মানুষটাকে এখন ব্রিগেডিয়ার আকমল নামে সবাই একবাক্যে চেনে। কঠোর পরিশ্রমী লোক। সেনাবাহিনীর সুশিক্ষার অবদান বৃথা যাবার না। আকমল সাহেব প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেও তাই এখনও যথেষ্ট দৃপ্ত। সব কাজ নিজের হাতে না করলে তার দিল খুশ হয় না। প্রতিদিন সকালে দু-পাঁচ মাইল দৌড়ানো, সঙ্গী হিসেবে এন্তার ব্যায়াম, তারপর ভারিক্কিচালের খানাপিনা সেরে দাপ্তরিক কাজের গুরুভার, কোনও কিছুতেই কাবু হওয়া নাই। শুধু কেন যেন, সকালে দৌড়ানোর রাস্তাটার পাশে যে ছোট পুকুরটা আছে, সেখানে কোনও একটা মাছ ঘাই দিয়ে উঠলেই তিনি থেমে দাঁড়ান।
আকমল সাহেবের জানার কথা না, এই পুকুরটা অতিসাধারণ গেঁয়ো নির্বিবাদী পুকুর না। এই পুকুরের ঘোলা পানির নিচে কতো রূপকথার প্রাণ খলবল করে বেড়ায়, ওপর থেকে দেখে সেটা বোঝা যায় না। তারপরেও, কোনও অর্বাচীন মাছ যদি হঠাৎ একদিন তার চলার পথের পাশে ঘোলা পানির উপরটায় ঘাই দিয়ে ওঠে, আকমল সাহেব থেমে দাঁড়ান। কিছু একটার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেন। মেলে না।
তবে নিয়মনিষ্ঠ ব্রিগেডিয়ার বলে কথা। এই অনিশ্চিত থমকে দাঁড়ানো-টারানো তার একেবারেই আর বরদাস্ত্ হয় না। আজ সকালে তাই তিনি হেস্তনেস্ত করার জন্য পুকুরে সটান নেমে পড়লেন। কেউ তাকে ডাকে নাই, পুকুরের নিচে লুকিয়ে থাকা কোনও রূপকথার চরিত্র তার স্বপ্নে হানাও দেয় নাই। তবুও, সেই ঘোলা পানিতে নিজেই তিনি নেমে পড়লেন। যোদ্ধা মানুষ কি না, পুকুরে মাছের ঘাইকে শত্রু বানিয়ে আজকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবেন।
আকমল সাহেবের যুদ্ধের তরিকা সাকুল্যে একটা। কেটে ফেলো। ভাবলেন এই শত্রুকেও কেটে দেখতে হবে। জলপাই ছোপ দেওয়া সামরিক ইস্যু বেলচা নিয়ে বিপুল বিক্রমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুকুরটাকে নিজের হাতে কেটে ফেলার তাগিদে। অগভীর ঘোলা পানি তাই আরও গভীর পুকুরের পানি হয়ে উঠতে থাকে। শিগগিরই পানি নাক ছুঁই ছুঁই হয়ে ওঠে। ব্রিগেডিয়ার হাল ছাড়েন না। অক্সিজেনের নল দাঁতের ফাঁকে চেপে ধরে তিনি ডুব দেন। এই জলপাই বেলচা নিয়ে যুদ্ধের শেষ তিনি আজ দেখেই ছাড়বেন। তিনি কাটতে থাকেন। শেষ হয় না। গভীর করে কাটলে গভীরতার আড়ালে ঘোলা পানি হারিয়ে যাবে, তার এই দুরাশা আলোর মুখ দেখতে পায় না। তিনি কাটতে থাকেন। অক্সিজেন চিরদিনের জন্য না, এই সত্যিটা তার মাথায় খেলে না। তিনি আরও গভীর করে পুকুরটাকে কেটে ফেলতে চান। রূপকথার লুকোনো প্রাণগুলো কাদামাটির নিচে থেকে মন্ত্র আউড়ে যেন আরও পানি বের করে আনে। পৃথিবীর বুকের ভেতর কতো পানি মিশে আছে ব্রিগেডিয়ার সেটা জানেন না। তিনি কাটতে থাকেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, অতলে হারিয়ে যাবার আগেও তিনি কাটছিলেন। তার কাজ সমাপ্তি পায় নাই। পুকুর কাটলে সেটা শেষ হয় না।
___________
ব্রিগেডিয়ার অতি বুঝদার আদমি। পূর্ণবয়স্ক মানুষ। তবে তিনি জানতেন না, বরঙ ছোট একটা ছেলে হয়ে, বুকের ভেতর নিঃশর্ত বিশ্বাস পোষ মানিয়ে, পুকুরে পা ভিজিয়ে তিনি যদি রূপকথার ঐ প্রাণগুলোকে ডাক দিতেন, জোছনা রাতে তারা বেরিয়ে এসে তাকে এনে দিতে পারতো একটা রূপকথার রাজ্য।
আফসোস, একটা ছোট্ট ছেলে হয়ে যেটা বোঝার কথা ছিলো, সেটা আজও তিনি বুঝলেন না।
__________
অন্যকেউ
মন্তব্য
হালকা একটা বিষয় নিয়ে গল্পটা ভালই বানিয়েছেন।
প্রৌঢ়ভাবনা
দুঃখিত। অতোটা হালকা না। বোঝাতে পারি নাই এটা আমারই ব্যর্থতা।
এই গল্পের ভেতরে কি আরো একটা গল্প লুকিয়ে আছে যা আমি খুঁজে পাইনি?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নাহ। কীইবা আর লুকাবো? সরকার পেটোয়া বাহিনী দিয়ে আমাদের পরিচিত পুকুর কেটে ফেলতে চায় তো; কাটলে তো আর পুকুর ছোট হয় না.. বরঙ শাহবাগের মোড়ে ছোট জনসভায় ভিড় বাড়তে থাকে।
পড়তে ভালই লেগেছে।
পিতার গিবদ নাতো?
আরে না; পিতার গিবদ না। জাতীয় আপার পেটোয়াতৃপ্ত মোটা মাথার গীবত। রাতমজুরের পরে আসিফ... এইভাবে কী করতে পারবে ভাবছে ওরা কে জানে!
রূপক একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে বোধ হয়।
নতুন মন্তব্য করুন