তীর্থের কাক ১ তীর্থের কাক ২ তীর্থের কাক ৩
তীর্থের কাক ৪
তীর্থের কাক ৫
তীর্থেথের কাক৬+৭
http://www.sachalayatan.com/node/41370
“সারে দুনিয়াকা ভোজ, হাম উঠাতে হ্যায়।” গ্রামের ছেলে আমি। মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশে এসেছেন। সেই লড়াই দেখতে গৌরীপুর বাজেরে গিয়ে হতাস হয়েছিলাম খুব। আমার মতোই ছোট্ট একটা বালকের কাছে এতো নামী-দামি একজন মোহাম্মদ আলী হেড়ে গেলেন! দাউদকান্দি থানায় মনেহয় তখন ঐ একটাই টেলিভিশন ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানে আটকে পরা বাঙ্গালী রফিক সাহেব, করাচী থেকে দেশে আশার সময় একটা কলের গান এনেছিলেন। মনে করতাম ঐ বাক্সের ভেতর ছোট ছোট মানুষ বসে গান বাজনা করে। যখন ভিসি আর এর নাম প্রথম শুনি, তখন ভাবতাম সেটা হীরের তৈরী কোন গহনা। কারণ বড় লোকের বিয়ে-সাদীতে যৌতুক হিসাবে যন্ত্রটার নাম শুনেছি। ডিগ্রী পড়তে ঢাকায় এসে প্রথম এক বড়লোক সহপাঠির বাসায় গিয়ে রঙ্গিন টিভিতে হিন্দিফিল্ম দেখলাম। তখন বুঝলাম ভিসিআর আসলে ছবি দেখার যন্ত্র। কালে ভাদ্রে দু’একটা ছবি ভিসিআর দেখেছি। পত্রিকার পাতায় দেখেই অমিতাভ বচ্চনকে চিনি। কিন্তু কোন ছবিতে কী চরিত্রে কোন গান করে কী ভাবে তিনি নেচেছেন তা আমার পক্ষে বলা বেশ কঠিন। সে কারণেই এই সাদা লোকটার অদ্ভূত অংগভঙ্গি আর গানের কথা বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু শামিম দেখি হাসতে হাসতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা।
কুলি ছবির গান মুখস্ত গাইছে লোকটা! শামিমের কথায় আমার টিউব লাইট ধীরে ধীরে মস্তিকে আলো ফেললো। অবাক হবারই কথা। চাপার দুটো সোনার দাঁত বের করে লোকটা আমাদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করছে। মাথার চুলটাও কাল। উচা-লম্বায় অমিতাভ বচ্চনের সমানই হবে। কিন্তু ভাষাটা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। না জানি জার্মান, না রুমানিয়ান। বেচারা অনন্দে অনেক কথাই বলল। হেমা মালিনী, শ্রী দেবী, রেখা ছাড়া আর তেমন কিছু বুঝলাম না।
মাইক্রো বাসের সমান ঘরে দু’টো দ্বিতল খাটের একটা আমি আর শামিম আর একটা রুমানিয়ান লোকটা আমাদের আসার আগেই একা দখল করেছে। ইউ সাইজের চারতলা বিল্ডিংটা বেশ বড়। উঠোন পুরোটাই কালো পীচে ঢাকা। জলে ভাসা পদ্মের মতো মাঝখানে একটা সবুজ বৃত্ত। সামনের দিকটা দেয়ালের মতো উঁচু রাস্তায় ঢাকা। যাওয়া আসার পথ ঐ ফটক। দাড়োয়ান বাবাজী না থাকলে যাতায়ত বন্ধ।
আমরা স্থায়ী ঘাটির সৈনিকের মতো বাক্স পেটরা সাজাতে ব্যাস্ত। পেছন থেকে লোকটা “এসেন, এসেন” বলছিল এতক্ষণ। এবার সামনে এসে মুখের কাছে হাত এনে খাওয়ার ভঙ্গি করতেই বুঝলাম; খাবার-দাবার নিয়ে কিছু বলতে চাইছে। নাস্তা এমন কিছু শক্ত-পোক্ত ছিলনা। কিন্তু এর মধ্যে বুঝে গেছি বারটার দিকেই এখানে দুপুরের খাবার খায়। খাবার খেতে যেতে হবে আবার অন্য একটা দালানে। একতালা বিল্ডংটার দিকেই হাত দিয়ে দেখাচ্ছে রুমানিয়ান লোকটা। আবার সব কাপড়-চোপড় পরতে হবে ভেবে একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম। কিন্তু উপায় কী। ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে গেলে তো আর খাবার পাব না। তাই লোকটার সাথে বের হলাম।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কয়েজন দেশী দেশী চেহারার তরুণ-যুবক দেখলাম। কথা-বার্তা শুনে মনে হলো সবাই ভারতীয়। আগে-পিছে দু’একজন কালো মানুষও দেখলাম আমাদের কাফেলায়। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেয়া পর্যন্ত সব রং-এর মানুষের কাফেলাটা বজায় ছিল। খাবার টেবিলে সবাই কাকতালীয় ভাবে নিজ-নিজ রংটাই বেছেনিল কেন যেন। আমরা বসে বুঝলাম যে; সরদার জীদের কবলে পড়েছি। শামিম তবুও কিছু বোঝে। আমি একেবারে কালা। একটা বড়-সড় মাংশের টুকরা ডুবে আছে রসমালাইয়ের নীচে। ছোট ছোট রসগোল্লার মতো মাংশের আশে-পাশে পড়ে আছে কিছু ব্যঙের ছাতা। মাংশটা শুয়রের হতে পারে এই চিন্তা তো আছেই। তার পাশের ব্যঙের ছাতা দেখে মন আর সায় দিচ্ছে না।
আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই সরদারজী বললে; এটা গরুর মাংশ। আর ব্যাংঙের ছাতাও এমন কিছু খারাপ সব্জি না। খেয়ে দেখ, ভালই লাগবে। একটা ছেলের সাথে কী নিয়ে যেন শামিম খুব মনোযোগ দিয়ে কথা বলছে! সে ভাষা আমি জানি না। ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান, জার্মানী ছাড়া আর তেমন কিছু বুঝলাম না। কিন্তু লক্ষ করলাম; কথার ফাকে ফাকে শামিম খাচ্ছে ঠিকই। বিসমিল্লাহ বলে আমিও শুরু করলাম।
ক্যান্টিন থেকে বেড় হওয়ার সময় খুব উঁচু গলায় অচেনা ভাষায় কথা শুনে ফিরে তাকালাম। রুমানিয়ান টেবিলের মোটা মতো একটা লোক সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার পরে একটা দুধের প্যাকেট কোনার ডাষ্টিবিনের ড্রামে ফেলে দিল। খাবার যারা দিচ্ছিলেন তাদের একজন বিরক্ত হয়ে কী কী বললেন বুঝলাম না। শুধু ডয়েচল্যাণ্ড শব্দটাই কানে ঢুকল। দুধের প্যাকেট জিনি ফেললেন; তাদের সাথে অল্প বয়সী একটি বালিকা। আর একটি সুন্দরী মহিলা। সম্ভবত তাঁর স্ত্রী। মহিলার কোলে একটি বাচ্চা। দুধের প্যাকেটটা সম্ভবত বাচ্চাটার জন্য দেয়া হয়েছিল। দেখে বোঝা যায় যে; পরিবারটি এক সময় বেশ ঐশর্যের মধ্যে দিন কাঁটিয়েছেন। সমাজতন্ত্রের পতনের সব দায়ীত্ব নিকোলাই চওসেস্কোর কাঁধে দিয়ে এনারা দেশান্তরী হয়েছেন। হয়তো ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে একটু আয়েসী জীবনে অভ্যস্ত। কাজেই এই সাধারণ দুধের প্যাকেট বাচ্চার খাদ্য হিসাবে পছন্দ হয় নি।
শামিমের সাথে ঐ ছেলেটার কী কথা হয়েছিল জানি না। কিন্তু আমরা ঘরে ঢুকার সময় ছেলেটা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল; দুই জার্মানের মতো দুই পাকিস্তানও কোনদিন এক হবে। পরিস্কার না বুঝলেও অনুমান যা করেছিলাম, সেটাই সঠিক বলে জানাল শামিম। কথাটা বলে অতর্কীতে আক্রমন এবং তার পর পলায়নের মতো একটা হাসি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল পাকিস্তানীটা। আমরা দু’জনেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
চলবে...
মন্তব্য
পুতুল ভাই, আছি আছি ।
ধন্যবাদ কল্যান।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
একটানে সবকয়টি পর্ব শেষ করলাম। পরের পর্বগুলার জন্য অপেক্ষা করছি।
অট: আমার এক প্রাক্তন বন্ধুর সাথে আপনার জীবনীর শুরুর অংশটার বেশ মিল পেলাম। ওই বন্ধু অবশ্য ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলো গলাকাটা পাসপোর্ট আর নকল সিল সহ। বিমানবন্দরে পৌঁছে চিৎকার করে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে বলেছিলো ওর দালাল। করেছিলোও তাই, তারপর কিছুদিন কোন এক মানবাধিকার সংস্থার হেফাজতে থেকে দেশে ফিরতে হয়েছিলো ওকে।
love the life you live. live the life you love.
ধন্যবাদ তারাপ কোয়াস,
তখন (১৯৯১-১৯৯২) সবাই এভাবেই এসেছিলাম। অনেকে থেকেও গেছি, কোন ভাবে।
১৯৯৩ থেকে আজাইলাম আইন পরিবর্তিত হয়েছে। যোগ হয়েছে অনেক অভিনব ধারা।
লিগ্যাল ভিসা নিয়ে আসতে হবে।
নিজ দেশ থেকে সরাসরি জার্মান বা ফ্রান্সে আসতে হবে। ভায়া হয়ে আসলে সে দেশে (যে ধেশে ট্রান্জিট ছিল)
ফেরৎ পাঠানো হবে।
আমরা যখন এসেছি তখন একটা সীমিত জায়গায় চলাফেরা আর কাজের অনুমতি ছিল। '৯৩ পরে বিমান বন্দরেই (একরকম জেল) থাকার ব্যাবস্থা, এজাইলাম মামলার নিস্পত্বি করে ফিরতি প্লেনে নিজ দেশে ফেরৎ পাঠাত।
আপনার বন্ধু হয়তো এধরণের ঝামালেয় পড়েছিল। যার জন্য তাকে যেতে হয়েছে।
অনেকের ধারণা বোকা বা অলস পোলাপান বলেই এদের ফেরৎ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ঘটনা তা নয়। আমাদের ভাগ্যভাল যে আগে এসেছিলাম, তাই থেকে যেতে পেরেছি।
পরের পর্বগুলুতে তার কিছু বিবরণ পাবেন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়ছি।
ডাংকে গুরু।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়েছি ভাইয়া............. সাথে আছি.......................
ধন্যবাদ জনাব।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল, খুব, খুব ভালো লাগছে। তোমার এই ভ্রমনকাহিনী বা আত্মজীবনী যাই বলো না কেন, এটার জন্য তীর্থের কাকের মতোই অপেক্ষা করছি। তোমার সততায় রীতিমতো বাক-হারা।
--------------------------------------------------------------------------------
পুতুল, খুব, খুব ভালো লাগছে। তোমার এই ভ্রমনকাহিনী বা আত্মজীবনী যাই বলো না কেন, এটার জন্য তীর্থের কাকের মতোই অপেক্ষা করছি। তোমার সততায় রীতিমতো বাক-হারা।
--------------------------------------------------------------------------------
ধন্যবাদ ভাবী,
খুব উৎসাহ পেলাম আপনার মন্তব্যে। ভাল থুকুন সব সময়।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
_____________________
Give Her Freedom!
অনেক দিন পর এরকম চমৎকার লেখা পড়ে ভীষণ রকম মুগ্ধ হলাম।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আপনার সুন্দর মন্তব্যে আমিও মুগ্ধ। অনেক ধন্যবাদ আশালতা। ভাল থাকবেন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন