আটটা মাস কাটিয়ে দিলাম আফ্রিকায়, সময় দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যায়। কদিন আগেও ছিলাম শ্যামলিমা মাখা সমতল একটা দেশে যেখানে শুধু মানুষ আর মানুষ; আজ ঘুম থেকে উঠলেই নিজেকে খুঁজে পাই বন্য সবুজ আর পার্বত্য একটা অঞ্চলে যেখানে মানুষের দেখা মেলাই ভার। দেশের নাম কোত দিভোয়ার( Côte d'Ivoire), ফরাসীদের কব্জায় ছিল দীর্ঘকাল যার কারণে এই ফরাসী নাম, ইংরেজরা দখল করতে না পারার দুঃখে নিজেদের দেওয়া নামেই ডাকে আইভরী কোস্ট, এককালে পৃথিবীর এ প্রান্ত হস্তীবহুল ছিল নাম দেখেই বোঝা যায়, সেই হাতিদের মূল্যবান দাঁত এখান থেকে চলে যেত ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু প্রান্তে। আজ মানুষের লোভ নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছে সেইসব অতিকায় প্রাণীদের অস্তিত্ব এ দেশ থেকে, এখন শেষ বংশধরদের কয়েকজন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় দেশের কয়েকটি সংরক্ষিত অরণ্যে ( যেমন 'তাই' )। আমি নাম দিয়েছি তার গজমোতির কূল।
আফ্রিকাকে গনিমতের মাল হিসেবে ভাগ করে নিয়েছিল মূলতঃ ইংরেজ আর ফরাসীরাই। ছিঁটেফোটাঁ, ঊচ্ছিট্টাংশ কিছু ভাগে পড়েছিল স্পেনীয়, জার্মান, ইতালীয়, পর্তুগীজদের পাতে। আজ ইউরোপের যে ঐশ্বর্য তার অনেকটাই এসেছে আফ্রিকা থেকে; শ্রম দিয়ে তার কাজ সহজ করে দিয়েছে কাল কাল মানুষেরা, বিনিময়ে পেয়েছে দাসের সম্মাণ। সেই আফ্রিকার মাটির গন্ধ আজ আমার নাকে, তার উদ্দাম বাতাস আমার চুল উড়িয়ে নিয়ে যায়, তার বৃষ্টির সন্ত্রাস আমায় ত্রস্ত করে, তার মোহনীয় চাঁদের আলো আর অগণন তারার ঝিকিমিকি আমায় এক মুহুর্তে ভুলিয়ে দেয় অর্থহীনতার যন্ত্রণা, একাকীত্বের বিষাদ। দূরের কোন পাহাড়ী গ্রাম থেকে যখন গভীর রাতে অদ্ভুত ছন্দে তাম্বুর বেজে ওঠে কিংবা রাতের নীরবতা অকস্মাৎ ভেঙ্গে দিয়ে গর্জে ওঠে শিকারী দোজোর গাদা বন্দুক আর পরমুহুর্তেই গুলিবিদ্ধ হরিণের করুণ আর্তনাদ পাহাড়ের গায়ে প্রাতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসে আমায় ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে, তখন রুমের সামনের আঙিয়ায় এসে দেখি সোনালু ফুলেদের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে অপরূপ চন্দ্রিমা।
নিবাস আমার পশ্চিমের পার্বত্য শহর মাঁ-তে( MAN)। এদেশের ছেষট্টীটি নৃ-গোষ্ঠীর একটি ইয়াকুবা সম্প্রদায়ের মানুষদের বাস এ অঞ্চলে। ইয়াকুবা নামের অর্থ ঐ ভাষায় " পাহাড়ের সন্তান "। কথিত আছে কান্দোপ্লো গ্রামের সর্দার নিজ মেয়ে মাঁ(MAN)-কে অত্র অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য স্বপ্নপ্রাপ্ত নির্দেশে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেন। সেই কৃষ্ণসুন্দরীর নামেই এ শহরের নাম, জানিনা এখনও রাত গভীর হলে শহরের শেষ বাতিটি নিভে যাবার পর শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় কিনা সেই হতভাগী মাঁ-র আত্মা।
কখনো খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গলে ঘরের বাইরে এসে দেখি সামনের বিশাল পাহাড়ের কোলে শিশুর মত ঘুমুচ্ছে একটুকরো মেঘ। এ স্বর্গীয় দৃশ্য। সে মেঘশিশু কখনো পথ ভুল করে ঢুকে পড়ে আমাদের সোনালু ফুলগাছের বাগানে। ও বাগানে কচি ঘাস-পাতা খেতে আসে একটা মৃগশাবক, জানিনা তার সাথেই বোধয় মেঘবালিকার যত সখ্য। কাছের গ্রামটির নাম কাসিয়াপ্লু, কয়েকবছর ধরে তার নতুন নাম হয়েছে রূপসী বাংলা।রূপসীর রূপের শেষ নেই, যেন তাকে পাহাড়া দেওয়ার জন্যই দুদিকে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে তঙ্কুই আর তুরে পাহাড়। শহরে যাওয়ার পথে দূর থেকে দেখা যায় দাঁত বের করে হাসছে মাঁ শহরের বিখ্যাত পাহাড় মাঁ'র দাঁত( La Dent de Man),
আর একদিকে দিনমান ঝরঝর করে ঝরছে সুন্দরী জলপ্রপাত কাস্কাদ।
মাঝে মাঝে দেড়শো মাইল দূরের শহর দালোয়ায় যেতে হয়, পথে আমাদের ক্লান্ত চোখকে শান্তি দেবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে অপরূপা সাসান্দ্রা হ্রদ।
তার বুকে ভেসে চলে ছোট ছোট ডিঙি, ধীবর তরুণ ছিপ ফেলে অপূর্ব দক্ষতায় একের পর এক তুলে আনে সিলুই আর তিলাপিয়া মাছ। উত্তরের শহর তুবার দিকে গেলে দেখি ছবির বইয়ের আফ্রিকান গ্রাম। গোল গোল সব মাটির ঘর, ছোট একটা দরজা; সেই অন্ধকারের ভেতর জমা থাকে ছোট ছোট সুখ-দুঃখের গল্পকথা, সদ্য তোলা ক্ষেতের ফসল, পাম মদের কলস, ঘামের গন্ধ।
আফ্রিকার বুকে পা রেখেছি এটার বিস্ময় আর নেই, নুড়ি-পাথর বিছানো পথে দলবেঁধে চাষীরা হাতে মাশেত নিয়ে ঘাসের অরণ্যে ঢুকে পড়তে দেখে অবাক হইনা আর, বিশেষ কায়দায় হাতমেলানো শিখে গেছি এখন, দুহাত তুলে পরিচিত ভঙ্গিমায় কাউকে সম্ভাষণ জানিয়ে ভাবিনা ওই লোকটা দূরের কেউ। দুপুরে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনটা হুহু করে উঠলে পাহাড়টার দিকে তাকাই, সোনালু গাছটাকে আফ্রিকার বলে মনেই হয়না তখন।
মন্তব্য
কবে যাবো পাহাড়ে ... আহারে ! আহারে !!!
যখন বাহারে বাহারে ফুটবে ফুল।
দারুণ
ধন্যবাদ।
ইয়েস আসলেই দারুনস। ছবি বর্ননা দুইটাই ভালো লাগলো।
-মেফিস্টো
ধন্যবাদ।
সাসান্দ্রা নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম, আপনার লেখা আর ছবিগুলো সে কথা মনে পড়িয়ে দিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সাসান্দ্রা আসলে কোত দিভোয়ার-এর অন্যতম দীর্ঘ একটি নদী। লেকটা তৈরী হয়েছে নদীর উপর একটা বাঁধ নির্মাণের ফলে। বর্ষায় পানিতে টইটম্বুর, আবার শুকনো মৌসুমে লেকের বিরাট একটা অংশ শুকিয়ে গেলে ওখানে ফসলের চাষ হয়। নদীটা শেষ হয়েছে আটলান্টিকে গিয়ে, যেখানটায় গিয়ে থেমেছে তার নামও সাসান্দ্রা। ধন্যবাদ।
ছবিগুলোর একটিতে বাংলাদেশের ক্ষুদে পতাকাকে খুঁজে পেয়ে কি আনন্দই না লাগলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
রোডটার নাম খেয়াল করেছেন? বাংলাদেশ রোড।
আরে, তাই তো! কি ভালোই না লাগছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ছবিগুলো আরেকটু বড় করে দিলে দেখতে আরাম লাগত বোধ হয়। ভালো লাগল।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
কম পিক্সেল এর কারনেই এমনটি হল, দেখি ফ্লিকারে ছবিগুলো আপলোড করে নেব। ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
লেখা, ফটোস্...সবকিছুই সুন্দর।
ধন্যবাদ। ঊচ্ছ্বলা থাকুন।
চমৎকার! খুব সাবলীল ভাবে পড়ে গেলাম, কোথাও একটিবারের জন্য আটকাতে হলোনা। একটা ছবি তৈরী হলো মনের ভেতর।
আহ, খুব যেতে ইচ্ছে করে। থাকতে ইচ্ছে করে। চমৎকার লাগলো, ধন্যবাদ।
facebook
সত্যি কথা বলব, থাকার জন্য আদর্শ এমন জায়গা নয় কোত দিভোয়ার, গৃহযুদ্ধে দেশের বেহাল অবস্থা। তারপর আবিদজান ছাড়া এখানে বলতে গেলে তেমন কোন শহরই নেই, বাকীগুলো সব আমাদের দেশের মহাসড়কের পাশের বাজারের মত। তবে আফ্রিকান মানুষের জীবনধারা কেমন দেখতে চাইলে আসতে পারেন, মানুষগুলো লাজুক, বন্ধুভাবাপন্ন, অভাবী হলেও মুখে লেগে থাকে হাসি, একটু অলস, একটু বোকা, একটু সরল। ভাল থাকুন।
সাসান্ড্রা, সান পেড্রো পর্যন্ত গিয়েছি কয়েকবার। অদ্ভূত সুন্দর জায়গা। কিন্তু নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকায় উত্তরের দিকে যাওয়া হয়নি কখনও। আপনার চোখ দিয়ে দেখে নিলাম। কোত দি'ভোয়া-কে নতুন করে দেখলাম।
ভালো থাকুন।
লেখা ও ছবি দুটোই দুর্দান্ত!
ভালো লেগেছে
...........................
Every Picture Tells a Story
নতুন মন্তব্য করুন