গল্পটা সবচেয়ে পুরনো। ইহুদি, খ্রীষ্টান আর মুসলিম ধর্মে আমরা যারা বড় হয়েছি- তারা সবাই এই গল্পটা সত্যের মতন জানি।
আমরা জানি- সৃষ্টিকর্তা তার নিজের রূপে প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করলেন। আদমকে তিনি রাখলেন এক মনোরম স্বর্গোদ্যানে - যেখানে ছলছল বইতো দুধেল নদী, ফুল ফলে শোভামন্ডিত হয়ে থাকতো বৃক্ষ আর গুল্ম লতা, পাখিরা নিত্য আনন্দে অহর্নিশি গান গেয়ে চলতো মধুর মধুর সুরে। বাতাস ছিল সুরভিত, প্রাণদায়িনী। কিন্তু অপরূপ লাবণ্যময় এই মাধুকরী ঐশ্বর্য্যের অনন্ত ভোগসম্ভারেও আদমের মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এক বিষন্ন নিঃসঙ্গতায় তিনি পুড়ছিলেন - যদিও এই নিঃসঙ্গতাকে তিনি চিনতে পারছিলেন না। সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তাই শুধু তার এই নিঃসঙ্গতার কথা জানতেন, কারণ আদমের এই নিঃসঙ্গতাটাও ছিল তার সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তা কিছুদিন আদমকে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রনায় বিদ্ধ করলেন এবং একটা সময় এই নিঃসঙ্গতা থেকে তাকে মুক্তি দিতে মনস্থির করলেন। সৃষ্টিকর্তা আদমের পাজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন প্রথম মানবী- হাওয়াকে। আদমের একাকীত্বের যন্ত্রনা অবশেষে শেষ হলো। তিনি পেলেন হাওয়াকে। তারা দুজনে, যুগলবন্দী হয়ে স্বর্গোদ্যানে মনের আনন্দে বসবাস করতে লাগলেন। সেখানে তাদের ছিল অবাধ স্বাধীনতা। সৌন্দর্য্যে অতুলনীয় সুবিশাল সেই বাগানের যেখানে খুশি তারা যেতে পারতেন, খেতে পারতেন বাগানের সব সুস্বাদু ফল ফলাদি, পান করতে পারতেন প্রবাহমান দুধেল নদী থেকে আজলা ভরা সুপেয় পানীয়। সবকিছুই তারা করতে পারতেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও - তারা ছিলেন মানুষই। আর আমরাতো জানি মানুষের স্বাধীনতা মানে - সব স্বাধীনতা নয়। সুবিশাল বাগানের অজস্র বৈচিত্র্যময় আনন্দসম্ভারের ভেতরে মধ্যে শুধুমাত্র জ্ঞানবৃক্ষের গন্দম ফলটি ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু তখনও নিষিদ্ধ ধারণাটির ব্যাপকতা তাদের চিন্তায় ছিল না, জানার মধ্যেও ছিল না। তাই তাদের এই নিষিদ্ধ ব্যাপারটি ছিল শুধুই একটা নিষেধ। নিষেধ মানেই সীমাবদ্ধতা, আর সীমাবদ্ধতা মানেই সীমাকে অতিক্রম করার আগ্রহ। এটি তাদের প্রকৃতির মধ্যেই ছিল। তারা জানতেন না- নিষিদ্ধ ব্যাপারটিকে জানার আগ্রহ সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রকৃতির মধ্যেই সুপ্ত করে রেখেছিলেন। সেই প্রকৃতি - যার কারণে বাধা এবং নিষেধকে অতিক্রম করে মানুষ নিজেকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে আকাঙ্খা করে। নিষেধ অমান্য করে এবং বিদ্রোহ করে। সর্পবেশী শয়তান কেবলমাত্র মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই চিরন্তন প্রকৃতিকে জাগিয়ে তুলে স্রষ্টার বিরুদ্ধে মানুষের প্রথম দ্রোহকে সংগঠিত করার জন্য এগিয়ে এলো। সে এই কাজ করার বেছে নিল হাওয়াকে। সর্পবেশি শয়তান হাওয়ার মধ্যে জাগিয়ে দিল নারীর সেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন চিরন্তন কৌতূহল। সেই কৌতূহলের তাড়নায় তিনি পেড়ে আনলেন সেই নিষিদ্ধ ফল। প্রাকৃতিক মোহতে আদমকে আচ্ছন্ন করলেন - প্ররোচিত করলেন ঐ নিষিদ্ধ ফলটি খেতে। হাওয়াতে আচ্ছন্ন আদম সৃষ্টিকর্তার নিষেধ ভূলে গেলেন। আহার করলেন যা তাকে নিষেধ করা হয়েছিল। পরিশেষে সৃষ্টিকর্তার নিষেধ অমান্য করে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার অপরাধে আদম এবং হাওয়া স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে মর্ত্যে নেমে আসলেন-
এই ছিল মানুষের আদি পাপের গল্পটা। আমরা সবসময়ই দোষটা হাওয়ার, তাই ভাবি। হাওয়ার ঐ দুষ্টু বুদ্ধিই আদমের স্বর্গচ্যূতি ঘটিয়েছিল।
ঝুমি যেমন। ঝুমি না থাকলে আমার জীবনটাও অন্যরকম হতে পারতো। পৃথিবী এত তিক্ত আর যন্ত্রনাময় হতো না। আমার ফ্রিদাকে নিয়ে- আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে- ধ্যানমগ্ন একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া খুব কঠিন হতো না। পৃথিবীটাকে এত অপ্রিয় মনে হতো না।
‘মেয়েরাই যত অনিষ্টের মূল। সেই শুরু থেকে- সৃষ্টির আদি থেকে।’- মেয়েদের উপর রাগ গরগর করে। এমনকি কল্পনার ফ্রিদাও মেয়ে বলে পার পায় না। ‘ ও যদি কল্পনার না হয়ে সত্যি হতো, তাহলেও ও - ঝুমির মতই এরকম হতো’- মনে হয় আমার। চলতি পথে কোন জুটি দেখলে ছেলেটা মেয়েটার হাতে কীভাবে নাকনী চুবানী খেতে যাচ্ছে - দৃশ্যগুলো কল্পনা করি। এই হাসি থাকবে না- ছেলেটার মুখের হাসি দেখে ভাবি। কিন্তু স্বান্তনা হিসেবে এটি খুবই দূর্বল। শেষ পর্যন্ত পছন্দ না করলেও - মেয়েদের আমার ভালই লাগে। এই কারণে ঝুমিকে অথবা ফ্রিদা কাউকে ভোলা হয় না, উপরন্তু খারাপ লাগাটা বাড়তেই থাকে।
কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তবু বের হই।
তেজগাঁও রেলষ্টেশনের আলো অন্ধকারে ভিড়ে যাই।
এককালে তেজগাঁও রেল ষ্টেশনটার খুব নামডাক থাকলেও এখন এটার প্রায় পরিত্যাক্ত অবস্থা। দুই একটা মালগাড়ি আর ছিন্নমূল লোকাল ট্রেনগুলোই হয়তো থামে। ষ্টেশনটা একটা জংশনের মত, অনেকগুলো ট্রেনলাইন এর উপর দিয়ে একেবেকে চলে গেছে। লাইনগুলোর উপর সবসময়ই লাল লাল দুচারটা ওয়াগন পড়ে পড়ে ঘুমোয়।
রেল লাইনগুলোর মাঝখানে শান বাঁধানো উচুঁ প্লাটফর্ম- সন্ধ্যা নামতেই সেখানে মানুষের ভীড় জমতে থাকে। জেঁকে বসা একলা বিকেলে সময় উড়ানোর ফন্দিতে - পকেট থেকে সিগারেট বের করে আমিও একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়েছি। দূরে সারি সারি গুমটি দোকানের উল্টো দিকে ফুটপাতে পলিথিনে মোড়া ঝুপড়ি ঘর মাথা নুইয়ে পড়ে আছে- তার আশেপাশে কয়েকটা নোংরা বাচ্চা ময়লার স্তুপের পাশে হাত পা ছড়িয়ে খেলা করছে। আরেকদিকে মুখ ফেরালে রেলক্রসিং রাস্তাটার উপর- রিকশা, কালো হলুদ ট্যাক্সি আর চকচকে গাড়ি গিট্টু পাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে গাড়িগুলোর স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে একটা কমনীয় মুখ খুঁজি কিন্তু তেমন উজ্জ্বল কোন মেয়ে চোখে পড়ে না। ময়লা হলুদ জামার একটা মেয়ে পাশ দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে গটগটিয়ে চলে যায়। একটুখানি শূন্যতা বুকের মধ্যে নড়াচড়া করে।
হটাৎ খেয়াল করি, আমার পাশে বসে লোকটা সেই কখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে লোকটা? আমিও চোখ ঘুরাই। রেল লাইনের ওপাশে আর একটা রেল রাস্তা - তারপর একটা ঝুপড়ির ঝাড়। তার পেছনে একটা বিরাট সাদা দালান দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য রড লাইটে ভেতরটা মোড়া। গার্মেন্টস সম্ভবত। আমি বুঝতে পারি না - ওই দালানের ভেতরে সে কী খুজছে। কৌতূহলের বশেই আমি আলাপ জমাই। কষ্টে - মানুষ খুব দ্রুত কাছে চলে আসে। এই লোকটাও তাই।
এই কথা সেই কথা ধরে আলাপটা জমে উঠতেই সে তার কষ্টের কথা বলতে শুরু করে। বনাবনি না হওয়ায় প্রায় এক বছর হলো তার বউ বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেছে। ঐ সাদা দালানবাড়ির গার্মেন্টসে সে কাজ করে। একটু পরে তার ছুটি হলে- বাচ্চাকে নিয়ে মেয়েটা এখান দিয়ে হেঁটে যাবে। তাদেরকে সে দূর থেকে শুধু একটু দেখবে- সেই জন্য সেই বিকেল থেকে সে বসে আছে। এইটুকু দেখা শেষ হলে- আবার পরদিন সকালে সে এখানে এসে আবার বসে থাকবে। তখন মেয়েটার কাজে যাওয়ার সময়। প্রতিদিন এই দুটো সময়ের জন্যই তার অপেক্ষা। এই অপেক্ষার সুতোয় তার সারাদিন বাঁধা পড়ে গেছে। কোন কাজে তার আর মন নেই। রাতে ঘুম আসে না। জীবনটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গরগর করে - গার্মেন্টসটার উপর সে রাগ ঝরায়।
‘ কেন - গার্মেন্টস আবার তার কী করলো?’- বলতেই সে ফেটে পড়ে। গার্মেন্টস না হলে কী তার বউ তাকে ফেলে একা একা বাঁচবার কথা ভাবতে পারতো। তাইতো- আমি ভাবি। হাঁটতে থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমিও তাই ভাবি - একটা কাজ না পেলে কী মেয়েটা তার নিজের মত বাঁচার কথা ভাবতে পারতো। এমন সময় ট্রেনটা আসে।
কুউউ ঝিক ঝিক। ঝিক ঝিক কুউউ।
ছোট্টবেলার মত ছড়া কাটতে কাটতে ট্রেনটা আসে। আমি ট্রেনটাকে দেখার জন্য চোখ ফেরাতেই চমকে উঠি।
মাইকেল জ্যাকসন!
চোখের ভুল নিশ্চয়ই। কিন্তু ওইতো সে। আমি জমে যাই।
মাইকেল জ্যাকসন।
একটা অপার্থিব অনুভূতিতে পৃথিবীটা ভরে উঠে। ফ্রিদার কল্পনায় হুটহাট রাত নেমে আসলে চাঁদের আলো মেখে যেরকম শিশুর মত হয়ে উঠতাম আমি সেই রকম দেখায় ওকে। নিষ্পাপ ফুলের মত।
ঠিক রেললাইনটার উপরে দাঁড়িয়ে আছে সে। একটা তারার আলো ওর উপর এসে পড়েছে । সেই আলোতে এই অন্ধকার, মরে যাওয়া রেলষ্টেশনের মিটমিটে আলোর ভেতরেও কেমন জ্বলজ্বল করছে ও ।
কুউ ঝিক ঝিক।
সর্বনাশ।
ট্রেনটা অনেক কাছে চলে এসেছে।
রেললাইনের ওপর থেকে সওে আসছে না কেন এখনও? আতংকে বুকের নিঃশ্বাসটা আর বের হতে পারে না। বুকের মধ্যেই জমে থাকে।
মাথা আর চোখ একসাথে কাজ করে আমার। হৃদপিন্ডের গতিটা তাল সামলাতে পারে না। দমবন্ধ লাগে।
আরে ওতো রেল লাইনের উপরে উঠে দাড়িয়েছে।
ট্রেনটা মাইকেলের গায়ের উপর এক্ষুণি হুমড়ি খেয়ে পড়বে। হায় হায় কী হবে এখন?
কুউ ঝিক ঝিক।
কুউ।
একটা আর্তনাদ হুইসেল হয়ে বেজে ওঠে। আমি শূন্য হয়ে যাই । ট্রেনটা চোখের উপর দিয়ে মাইকেলের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
যে ট্রেনটাকে আমি ভালসতাম, সব সময় মনের বাহন হয়ে আমাকে দ্বিগি¦দিক ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতো, সেই ট্রেনটাকেই আমার অসহ্য মনে হয়। শত্রুর মত।
উফ!
উফ।!
আঃ!!!
চোখের মধ্যে জল জমতে শুরু করে। সেই জলের ভেতর দিয়ে চারপাশের দৃশ্যগুলো অস্পষ্ট আর ঝাপসা হয়ে আসে। ঠিক এই সময় অত্যাশ্চর্য্য ঘটনাটা ঘটে।
ট্রেনটা তার উপর দিয়ে চলে যাবে- ঠিক সেই মুহূর্তে আরব্য রজনীর রূপকথার মত শূন্যে ভেসে ওঠে মাইকেল। প্রবাহমান বাতাসের মত ছুটন্ত ট্রেনটার মুখে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে উড়ে এপারে ভেসে আসে সে ।
কুউ ঝিক ঝিক। কুউউ ঝিকঝিক। কুউ ঝিকঝিক।
মাইকেলের চুমু নিয়ে ট্রেনটা চলে গেল।
উফ!
বুকের মধ্যে এতক্ষণ আটকে থাকা নিঃশ্বাস ছাড়া পেয়ে বাতাসে ওড়ে।
ভাবতেই বুক আবার জমে যায়।
:ইটস অ্যা গেইম
প্লাটফর্মে উঠতে উঠতে ও বলে।
আমি আর কোন কিছু দেখি না। মুগ্ধ বিষ্ময়ে বিবশ মানুষের মত তার কাছে যাই।
দুষ্টু বালকের মত ও উড়ে উড়ে চলছে।
আমি না, আমার ভেতর থেকে আর এক গভীর আমি তাকে ডেকে ওঠে।
: মাইকেল, মাইকেল।
ও ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালো। বাতাসে কাশ ফুলের দোলার মত ঘুরে তাকিয়ে আমার দিকে মিষ্টি করে হাসে মাইকেল। সেই হাসিতে আমার ভেতরের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত অপমান, সমস্ত বঞ্চনা ধূয়ে মুছে নিষ্পাপ একটা পৃথিবী জেগে ওঠে।
হটাৎ দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে মাথাটা ঝুলিয়ে অবিকল ক্রশবিদ্ধ যিশুর মত দাঁড়িয়ে পড়ে।
আমি অবাক চোখে তাকে দেখি।
- আমি তিনশ বছর ধরে ধ্যান করছি। জেসাসের মত।
মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করে মাইকেল।
ক্রশবিদ্ধ যিশুর ভঙ্গিমা থেকে গৌতম বুদ্ধের সুস্থির মূর্তির রূপ ধরে সে।
- বুদ্ধের মত
বুদ্ধের স্থৈর্য্যকে বজায় রেখেই এক অলৌকিক মুদ্রায় একটি বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে আমার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ মেলে বলে -
: একটি বৃক্ষকে জড়িয়ে আছি।
আমি অলৌকিক চোখে তাকে দেখতে থাকি।
চোখের পলকের মধ্যেই কথার সাথে সাথে কখনও সুস্থির স্থির গতি, সুস্থির অস্থির গতি, কখনও দ্রুত সঞ্চারনশীল কখনও স্থবির এবং পরিবর্তনশীল গতিতে পুরো শরীরকে এমনভাবে চালনা করে, এমন আজব আজব সব মুদ্রা রচনা করতে থাকে, আমার কেন জানি মনে হয়, মাইকেল জ্যাকসন বোধহয় মানুষ নয়- শয়তান। অথবা কোন কৌশলে শয়তানকে বন্দী করে তার জাদুকরী নৃত্যটা করায়ত্ব করেছে সে।
উন্মুক্ত আকাশের নিচে তেজগাঁও রেলষ্টেশনে তার অন্ধকার টিকেটঘর, দূরের বিল্ডিং এ জ্বলে ওঠা আলোর কারসাজি, তার উপরে চাঁদকে ঘিরে তারাভরা আকাশের নিচে পড়ে থাকা লাল লাল ওয়াগন, রেললাইন, ট্রেনের যাওয়া আসা, শান বাঁধানো প্লাটফর্ম, চারপাশের জনপদ আর তার মানুষকে নিয়ে মোহনীয় এক সেটে মাইকেল তার কথাময় নৃত্য দিয়ে মোহময় এক জগৎ তৈরী করতে শুরু করে। কখনও মৃদু শান্ত, কখনও শান্ত সুস্থির, কখনও সুস্থির উচ্চকিত, কখনও অস্থির মৃদু, কখনও অস্থির উচ্চকিত, কখনও অস্থির সুস্থির কণ্ঠে নেচে যায় সে ...
- এই ব্রহ্মান্ডের কোন প্রলোভনই আমার ধ্যান ভাঙতে পারবে না।
আমি এবং বৃক্ষ। আমার শরীরে বৃক্ষ। বৃক্ষের শরীরে আমি। আমি এবং বৃক্ষ
এক শরীর। এক আত্মা।
হটাৎ একসময় বুঝতে পারি - বৃক্ষটা যেন নড়ে উঠল।
আমি তবু তাকে জড়িয়ে আছি।
আমি এবং বৃক্ষ।
হটাৎ শরীরে টের পেলাম বৃক্ষের শরীরে নারীদেহের উত্তাপ।
সে যেন আমার আমার বুকে নিঃশ্বাস ফেলছে।
আমি তখনও ধ্যানমগ্ন। আমি এবং একটি বৃক্ষ।
বৃক্ষের শাখা নরম হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
বৃক্ষের শরীরে কোমনীয়তার মোহনীয় নদী।
আমি ভাবি - আমি আর বৃক্ষ।
বৃক্ষ আর আমি।
বৃক্ষ নারীর ঠোঁট হয়ে আমার ঠোঁট ছোয়।
শাখাগুলো রক্তমাংসের কোমল হাত হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে।
ধ্যানের ভেতরেই দেখি গোটা একটি নারী মূর্তি আমাকে জড়িয়ে ধরছে।
আমার শরীর কেঁপে উঠল।
ওর আলিঙ্গন আমাকে জাগিয়ে তুললো।
ওর চুম্বন আমাকে আমার থেকে সরিয়ে নিয়ে আসলো।
আমি ধ্যানভঙ্গ হলাম।
অস্থির কামনায় আমি নতুন করে জেগে উঠলাম।
থরো থরো আমি ওকে জড়িয়ে ধরতেই
সেই কামনামদির নারীমূর্তি
শুউউউউ বাতাসে ঘূর্ণির মত
পাল্টে গেল।
আমি চমকে তাকে আলিঙ্গনমুক্ত করে তার মুখের দিকে তাকালাম।
সেই অনিন্দ্য সুন্দর নারীর মুখে শয়তানের মুখ দাঁত বের করে আছে!
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
অট্টহাসি দিয়ে শয়তান বললো ,
সাধু! - কোথায় গেল তোমার ৩০০ বছরের সাধনা।
হো হো হো হো হো হা হা হা হা হা
আমি শয়তানের দিকে চেয়ে তার চেয়েও জোর হাসিতে ফেটে পড়ে বললাম
শয়তান!
তাহলে এভাবেই!
হি হি হি হি হি হো হো হো হো
আমার ৩০০ বছরের সাধনা আজকে পূর্ণ হলো।
আমি ৩০০ বছর ধরে অপেক্ষা করছি
তুমি কোন রূপে এসে আমার সাধনা নষ্ট করবে-
এটা জানার জন্য।
আজকে জানলাম
তাহলে নারীর রুপ ধরেই তুমি আমার সাধনা নষ্ট করবে।
এই রূপ ধরেই আমাকে শিশুর সরলতা থেকে নির্বাসনে পাঠাবে।
আমার সাধনা আজ পূর্ণ হলো।
আমি তোমাকে জানলাম।
অবাক বিষ্ময়ে তাকে দেখি। চারপাশে ষ্টেশনজুড়ে নির্বাক মানুষগুলোর অনেকেই তার অলৌকিক শৈলীতে মুগ্ধ অবষন্নতায় শিশিরের মত টুপটাপ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারা বোধহয় দক্ষতার সৌন্দর্যকে চিনতে পেরে নিজের এলেবেলে জীবনকে আর সহ্য করতে পারে না। আমি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকি।
আমি মনে মনে আবার ঝুমির কথা ভাবি।
ঝুমির জন্যই তাহলে আমি আমার থেকে সরে এসেছি। আমার শৈশব থেকে। আমার থেকে। আমার কল্পনা থেকে।
নারীই হলো শয়তানের প্রতিমূর্তি। মনে মনে বলে উঠি।
মাইকেল জ্যাকসনের উপরে চাঁদ থেকে একটা আলোর কিরণ জমা হয়। সেই আলোর কিরণে গলে গিয়ে নিজেই একটা আলোক বিম্বে পরিণত হয় সে। আলোর বিম্বটা আমাকে জড়িয়ে ঘূর্ণির মত আবর্তিত হতে থাকে আর মধ্য থেকৈ একটা শিশুর কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে
তুমি শয়তান দেখতে চেয়েছিলে বলে
তুমি শয়তান দেখলে।
তুমি দেবী দেখতে চাইলে
তুমি দেবী দেখতে।
যে তোমার মধ্যে দেবতা খুজবে
সেও তোমাকে দেবতা দেখবে।
যে তোমার ভেতরে শয়তানকে খুজবে
সেও তোমার মুখে দেখবে শয়তানের প্রতিচ্ছবি।
নিঃশ্বাস ফেলার মত কথাগুলোর প্রতিধ্বনি তুলে আলোর বিম্বটা আমাকে ছেড়ে সোজা আকাশে উড়ে চলে একটা রেখার মত দেখায়। আমি সেখানে তাকিয়ে মাইকেলকে খুঁজি। কিন্তু মিটিমিটি তারা, হাস্যেজ্জ্বল চাঁদ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
একটা ঘোরের মধ্য থেকে আমি জেগে উঠি।
সেইতো।
একটা ছেলেকে তো একটা মেয়েই গড়ে তোলে- আবার ধ্বংশ করে সেই। সেতু আর শিমুলের কথা মনে করে - মনে মনে বলি আমি। আমি আবার আমার কথা ভাবি? এই জীবনে কত স্বপ্ন ছিল। ধ্যানী সাধকের মত মনের মধ্যে ইচ্ছে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। ঝুমি এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেল। ফ্রিদা থাকলে নিশ্চয় দেবীর মত আমাকে বাঁচাতো।
ঝুমির জীবনেও কী তাই?
ঝুমির কাছেও আমি কী তাহলে একটা শয়তানের প্রতিচ্ছবি হয়ে তার নিজস্ব জীবনের স্বপ্নগুলো পাল্টে দিয়েছি?
হয়তো তাই।
ঝুমির কথা ভাবি, ঝুমির সাথে আমি কেন জড়িয়েছিলাম?
ও ও আমাকে প্রশ্নটা করেছিল... তুমি কেন আমাকে ভালবাসো?
আমি ওকে বলতে পারিনি, ঠিক কেন আমি ওকে ভালবেসেছিলাম। আমি বলতে পারি নি, আমি ওকে ফ্রিদা বলে ভুল করেছিলাম।
বলেছিলাম- তোমার মধ্যে যে তুমি সেই তোমাকে ভালবাসি। তখন বলার মধ্যে একটা আরোপিত ব্যাপার ছিল। একটু কেতাবী, একটু মনভুলানো, আর একটু যেন দাম্ভিক। ঝুমি কথাটা বিশ্বাস করে নি। ওর কাছে মনে হয়েছিল -এমনি এমনি আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি। আমি ওকে ঠিক ভালবাসিনি। হৃদয়শূন্য আততায়ী আবেগের বশে আমি ভেসে গেছি। এই ভালবাসার মধ্যে ও ছিল না। ও ঠিক বোঝাতে চাইছে- আমি ঠিক বুঝি নি। অথবা বুঝতে চাই নি। শুধু ওর অবিশ্বাস একটা কষ্ট হয়ে মাছেদের মত মনের মধ্যে সাতার কেটে বেড়ায়। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে একটা অস্পষ্টতার কারণে কোন কিছুই বলি নি। ও- ও কিছু বলে নি। কিন্তু এতদিন পর এর আশ্চর্য্য জাদুকরের জাদুর কাঠিতে সেই প্রশ্ন ঝুপ করে আমার অতল থেকে উঠে আসে।
আমি ঝুমির অতলে ডুবে যাই।
ভাবি। ওর মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতা ছিল। কিন্তু নিষ্ঠুরতাটা কাছে টানতো। সেই প্রথম দিনের কথা মনে হয়।
তোমার কী ভাললাগে?
আমাকে।!
সেই নিজেকে ভালবাসার বাইরে সে কখনও যায় নি। ওর অঙ্গীকারটা ছিল ওর নিজেরই জন্য।
নিজেকে ভালবাসার মধ্যে ডুবে থাকার ভেতরে একটা আগুন ছিল। আকাশ, মাটি এবং জল একসাথে সবজায়গায় আমিত্বময় এই আগুনটা সে ছড়িয়ে দিতে চাইতো। ঈশ্বরের মতন। ওকে যারা ভালবাসতো তারা তার ভেতরের এই ঈশ্বরটাকে ছুতে গিয়ে পুড়ে দগ্ধ হতো। এই পোঁড়া যন্ত্রনাটা একটা নেশার মতন। ছুটে পালাবার বদলে আরো পুড়তে ইচ্ছা করে।
একদিনের কথা মনে পড়ে।
ওর উপর রাগ করে ভাতের থালা ফেলে দিয়েছিলাম। ও শুধু চোখ তুলে নিরবে আমার দিকে তাকিয়েছিল। কী আশ্চর্য্য ঠান্ডা, হীম ঝরানো চোখ। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি চোখে চোখ রাখতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়াই। বুকের মধ্যে কী আশ্চর্য কান্না দলা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে। আমি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ওর চোখের সামনে গোটা জীবন ব্যর্থ মনে হয়। আমি শেষ পর্যন্ত কেদেই ফেলি। কান্নাটা ওকে নরম করে না। ওর শান্ত স্বরে শান্ত সমুদ্র ঢেউ ভাঙে। বলে আমি বাবাকে দেখেছি মার উপর রেগে গেলে সবসময় খাবার থালা ছুড়ে মারে। কী বোঝাতে চাও আসলে তোমরা?
আমি কাদি। বিড়বিড় করে বলি - আমি ওরকম না। রাগের মাথায় করে ফেলেছি। ও বলে... রাগের ভেতরে মানুষকে চেনা যায়। ভেতরটা বেরিয়ে আসে। আমি আরও কাদি। অবিরাম কান্নার মধ্যে ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাই। নিজেকে শূন্য আর রিক্ত মনে হয়। বড্ড ছোট মনে হয়। ও শেষ পর্যন্ত বলে ঠিক আছে- কিন্তু আসলে কিছুই ঠিক ছিল না। মনের মধ্যে সবকিছুই ধরে রেখে দেয় সে। এক আশ্চর্য ‘আমিত্ব’ সবসময় ওর মধ্যে থেকে ঠিকরে বের হতে থাকে। রাগও। ওর রাগটা কখনও ফেটে বের হতো না। মুখের শান্ত ভঙ্গিতে, চোখের নীরব তারায়, কন্ঠস্বরের উত্থানপতনহীন তরঙ্গে ওর রাগ বোঝা যেত। তখন আর তার সাথে কথা বলা যেত না। ভাস্কর্যের মতো। ছবির মত। হৃদয়হীন যুক্তির ছুরি চালাতে ওর জুড়ি ছিল না। কিন্তু এটাই সে ছিল। এই ওকেই আমি ভালবাসতাম। জোয়ারের মত ফুলে ফেপে ওঠা একটা অনুভূতি ওর জন্য আছড়ে পড়তো। এতদিন পরে এখন আমি বুঝতে পারি ওর আমিত্ব’টাকেই আমি ভালবাসতাম। আর ওকে ভালবেসে যাওয়াটাই আমার আমিত্ব হয়ে দাড়িয়েছিল। সেই সময় আলাদাভাবে আর আমাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। ঝুমির কাছে দিন দিন হয়ে উঠছিলাম এক অস্তিত্বহীন একঘেয়ে প্রতিচ্ছবির মত। আর কি এক ঘোরে আমার মধ্যে ‘আমার আমাকে’ হত্যা করে প্রত্যেক মুহূর্তে নিজের মধ্যে জন্ম দিচ্ছিলাম - ‘ঝুমির আমি’। আমিত্ববিহীন সেই ‘ঝুমির আমি’র মধ্যে ঝুমি ওর জন্য একবাটি কান্না ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায়নি। একঘেয়ে, ক্লান্তিকর একটা বোঝা। তাই শেষ পর্যন্ত ঝুমি চলে গেছে। ‘ঝুমির আমি’ - কেবল নিঃসঙ্গ একাকী ঘুরে বেড়ায়। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, রিক্ত। তার আর এখন ঝুমির কাছে দেবতা হওয়া সম্ভব না। আমি বুঝতে পারি ঝুমি হারিয়ে গেছে।
একাকীত্বের কষ্ট জেঁকে বসে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়? লক্ষ্যবিহীন, আশাবিহীন, স্বপ্নবিহীন। বিভ্রান্তির মাকড়সা মাথার মধ্যে ঝুল বুনতে থাকে। সবকিছুতে কুয়াশা ছড়ায়। আমিও নিজেকে সেই কুয়াশায় হারিয়ে ফেলি। কুয়াশায় ডুবে যাওয়ার এই বিভ্রান্তির শুরু যেন আমার জন্ম থেকেই। নিয়তির মতন।
স্কুলে থাকতে মেট্রিক পরীক্ষার আগে ফর্ম পূরণ করতে হয়। ওখানে জন্মতারিখ বসানোর সময় স্যাররাই জন্মতারিখ সাল এমনভাবে দিয়ে দেন যে সবচেয়ে কম বয়সে মেট্রিকটা দিয়ে দেয়া যায়। তাতে চাকরীর জন্য বয়সের যে ব্যাপার থাকে সেখানে এক বা দুই বছরের সুবিধা পাওয়া যাবে। সেই ফরম পূরণের দিনটায় কী একটা ডামাডোলের মত অবস্থা। সেই ডামাডোলের মধ্যেই অন্য একটা তারিখে আমার জন্ম হয়ে যায়। এখন আমার জন্ম কবে? সার্টিফিকেটের তারিখটা নাকি যেদিন আমি আমার জন্ম বলে জানি সেটা? সভ্যতার এই পৃথিবী দলিলে বিশ্বাস করে। সেই হিসেবে পৃথিবী যা আমাকে জানে, আমি জানি- তা মিথ্যা। আমি যা জানি পৃথিবী জানে - তা মিথ্যা।
আমি একসাথে দুটো মিথ্যা আর দুটো সত্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
আমি যেখানে ঘুরে বেড়াই সেই জায়গাটাও আমার নিজের মতই বিভ্রান্তিময়।
আনুভাই স্মৃতি থেকে উঁকি মারে।
আনুভাই এমনিতে কর্পোরেট চাকরী করেন। কিন্তু কর্পোরেট ফিটফাট বাবুদের মত মোটেই নন। কর্পোরেটদের সাজানো ফিটফাট মসৃন বেশভুষার মাঝখানে তাকে মনে হয় সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে একজন গ্রাম থেকে উঠে আসা কালচেহারার চাষাভূষো মানুষ, আপনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই সময়ে চলে যাবেন - চাষা তখনও গালি হয় নি, চাষারা তখনও আমাদের বাপ দাদার দল, আপনার মনে পড়বে ভাসানীর চেহারা , আপনার চোখে ভেসে উঠবে শেখ মুজির সোফায় পা তুলে ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর পাসে বসে আছেন - হাস্যোজ্বল একটা ছবি। তারা যেন ইতিহাসের স্মৃতি থেকে আনুভাই এর উপর ভর করে কর্পোরেট চেহারার সাহেব সুতরো সবাইকে খুচিয়ে যাচ্ছেন
আচ্ছা এই যে -তুই , তুইই ক - বাংলাদেশের জন্ম কবে - ক ..
সবাই আচমকা একটা ভাবনার মধ্যে পড়ে তখন। খালি রতন গিটার নিয়ে টুংটাং বাজিয়ে যায়। ও একটা এ্যালবাম বের করবে। সারক্ষণ সে আছে - তার পৃথিবীতে।
এই মাসুদ কও, মাসুদ চুপ। মনু আমতা আমতা করে উঠবে, সুজা নখ খুটতে থাকবে, নিপ্পন কোন তারিখটা বলবে বুঝতে পারবে না, চন্দন প্রথমে বলার ঝুকিটা নিতে চায় না। তারু ভাই অবধারিতভাবে যা মনে আসে তাই দিয়ে শুরু করবে - কত ১৬ তারিখ। ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস - ঐ দিনে বাংলাদেশের জন্ম? না, না পিপলু চেঁচিয়ে ওঠে - ২৬ মার্চ, নাকি ২৭... সে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মুশফিক সুর তোলে ১৭ ই এপ্রিল- রাষ্ট্র বিজ্ঞান বইতে লেখা আছে সরকার ছাড়া রাষ্ট্র হয় না- সেই হিসেবে ১৭ তারিখেই দেশের জন্ম ... ৭ই মার্চ -তারেক গম্ভীর স্বরে বলে । অদ্ভুত কাণ্ড। ঠিক কেউই নিশ্চিত হতে পারে না বাংলাদেশের জন্মটা কবে। । রিপনটা মৃদু স্বরে বলে- আপনে কন ...। ও এরকমই, সবকিছুই অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ লোক।
আমি কমু ক্যান? আমি প্রশ্ন করছি। তোমরা উত্তর দিবা - আনুভাই মুখ টিপে টিপে হাসে। শিপলুর প্যাকেটটার শেষ সিগারেট নিয়ে আলমগীর ধরায়। আস্তে করে অনেকক্ষণ টান দিয়ে বুক পর্যন্ত ধোঁয়া নিয়ে ভুস করে ছেড়ে দিয়ে খুব সিরিয়াস ঢঙে বলে-
আচ্ছা বলতো, আমাদের জাতীয় ফুলে গন্ধ নাই কেন?
নির্বাক চিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় চারদিক সাদাটে অন্ধকার হয়ে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য।
সেই সাদাটে অন্ধকার আমাকে ঘিরে থাকে।
সেই সাদাটে অন্ধকারের মধ্যে হটাৎ বিমানের শব্দ ভেসে আসে। প্রচণ্ড শব্দ। কানে তালা লেগে যায়। যুদ্ধ বিমান হবে সম্ভবত- ওরাই এত শব্দ করে উড়ে। আওয়াজটার তীব্রতার মধ্যেই প্রচণ্ড একটা শক্তি টের পাওয়া যায়। দেশ টিকে থাকার জন্য এই শক্তি। কিন্তু যেই দেশে জনগণ নিজেই দূর্বল, একটা নিষ্পেষিত হতাশার প্রতিবিম্ব- শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে সেই দেশটা টিকে থাকতে পারবে? শুধু যন্ত্রতো আর যুদ্ধ করতে পারবে না। তার পেছনে মানুষ চাই। কোন দেশ যদি তার মানুষকে অন্ন দিতে না পারে, সুস্বাস্থ্য দিতে না পারে, শিক্ষা দিতে না পারে, সন্মান দিতে না পারে, স্বপ্ন দিতে না পারে, দেশের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা দিতে না পারে তাহলে সেই মানুষ কি - সেই দেশকে ভালবাসতে পারবে? পাড়ার বাহাউদ্দিন ভাই একবার অনুযোগ করছিল, শধু বেঁচে থাকার জন্যই সবকিছু এত কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে দেশটাকে আর ভালবাসতে পারছি না। বিজ্ঞাপনের জ্বলজ্বলে পণ্যগুলো আর আর্মিরাই শুধু দেশকে ভালবাসে। কিন্তু শুধু সুশৃঙ্খল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী কী পারে দেশকে মুক্ত রাখতে? তাই যদি পারতো তাহলে ৭১ কী? পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রবলে তো অনেকগুনে শক্তিশালী ছিল। ওরাতো পারলো না। এটাতো ঘটা ঘটনাই। দেখা ঘটনা। তাহলে কী করে একই ঘটনা ঘটতে থাকে?
মায়ের শব্দগুলো মনে পড়ে আবার। সেই কথাগুলো। কথাগুলো বলতে বলতে মা যেন আবার জ্বলতে নিভতে শুরু করে।
: এই যে যুদ্ধ - কখনও যুদ্ধ ভুলে যাব না। যুদ্ধকে ভুলে যেতে হয় না। যুদ্ধ ভুলে গেলে কেন যুদ্ধ হয় এটা আমরা ভুলে যাব। তখন বারবার যুদ্ধের কারণ ফিরে আসবে। বারবার যুদ্ধ শুরু হবে। যুদ্ধ থামবে তারপর আবার শুরু হবে - তারপর আবার- আবার বারবার ...
তার এই নেভা আর জ্বলা দেখে আবার বুঝতে পারি - তার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে।
কষ্টের মধ্যে আনুভাই আবার উঁকি দেয়।
আমগো হিস্টরী কেম্যুন ছোট হয়্যা গ্যাছে- এই যে সাওতাল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ,- কয়বছর আগের কাহিনী মিঞা .. এখনও খুজলে ঐ সময় বাইচ্যা থাকা লোক খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু মনে হয়না কত হাজার বছরের কাহিনী।
একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে খুব। টিভিতে দেখেছিলাম, কবে যে- সেই কোন ছোট্টকালে সেটা মনে নেই। শুধূ দৃশ্য আর ধ্বনিটা এখনও কানে আর চোখে লাফিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী পরাজয় মেনে তার থাবা গুটিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে ট্রাকে ট্রাকে ছুটে আসছে- নিজের মাটিতে। হাতের রাইফেল - পতাকার মত আকাশে উড়ছে। চলমান ছবির সাথে সাথে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান বেজে চলেছে। গানের তিনটি শব্দই শুধু মাথার মধ্যে গুণগুণ করে বেজ চলে। আয় আয়... বন্যার বেগে আয়...।'- ওরা আসছে। আনন্দে মাতাল হয়ে। উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে। মুক্তিযোদ্ধার মুখগুলোতে আনন্দের রেখাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে যায়। ওদের দেখতে দেখতে এখনকার কথা ভাসে। আশ্চর্য্য একটা কষ্ট মগজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হু হু কান্না আসে। জীবনকে উৎসর্গ করে ছিনিয়ে আনা ওদের মুখের হাসিটাকে খুব প্রতারিত মনে হয়।
মানুষ। আমার মানুষ - ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিভিত্তিক। নদীমার্তৃক এই দেশ, মাটি, জল, মাছ আর সে।
এই ৮০ ভাগ মানুষ ঘুমায় জাগে। আবার ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। এই তো ওর কাজ। কী করবে সে?
যারা এই দেশ চালায়- প্রতি মূহূর্তেই বুঝতে পারি যাদের হাতে ক্ষমতা, সবসময় বলছে- জনগণই আমাদের শক্তি। আদৌ কী তাই? জনগন যদি শক্তি হয় তাহলে জনগণ জীবন জীবিকার শক্তি। সতি সত্যি কী তা?
শুধুমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দূর্ভিক্ষ পিড়ীত দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথায় মুধুমাত্র নিজের শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ এমন দাসত্ব করে?
আজফার ভাইয়ের পাগলামোটা খুব সুন্দর মনে হয়। গুড়ো গুড়ো করে ফেলতে ইচ্ছে করে - ভদ্রতা, সভ্যতা, ভব্যতা সব। সৌধ, অঙ্গীকার, আলিঙ্গন সব। প্রকৃতির ধর্মতো এই প্রয়োজন আইন মানে না। যখন ৮০ ভাগ মানুষের প্রয়োজন মেটে না- কী করবে সে?
অন্ধকার । অন্ধকার। এই অন্ধকারটা ভাল লাগে না। অন্ধকারের মত। ভয় লাগে। অন্ধকারে মাকে আঁকড়ে ধরি। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যেতে চাই।
জোৎস্নারাতে পৃথিবীর বুকে পরীরা নেমে আসে, তোমার মত মিষ্টি চেহারার ছোট্ট বাবুসোনাদের ওরা উড়িয়ে তারাদের দেশে নিয়ে যায়। ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা বলেন।
ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মনে হত এই বুঝি ডানা মেলা পরী এসে মায়ের বুক থেকে ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে যাবে। অনেকক্ষণ মায়ের বুকের ওমে সাহস ফিরে আসে। মায়ের বুকের মধ্যে আরো ঘন হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করি, তারার দেশটা কোথায় মা? - আকাশে, মায়ের গলা এত আদরমাখা!। কেমন দেশ ওটা মা? বাবুসোনা মাকে আরো জড়িয়ে ধরে বলে।
মার গলায় স্বপ্ন মাখা থাকে- আলোর দেশ ওটা। আমাদের দেশের মত?... মায়ের উত্তর শোনার আগেই ছোট্ট বাবুসোনা ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের উত্তর শোনা হয় না।
মায়ের উত্তরটা অন্ধকার হয়ে এখন ফিরে আসে।
আমার চারদিকে তাকিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ঝুমি যেমন পালাতে চেয়েছিল। খোকাভাই যেমন পালিয়ে গেল। ফ্রিদা যেমন হারিয়ে গেল।
ভাবতে থাকি কোথায় যাবো। যাওয়ার জায়গাটা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। পালানোর জায়গাগুলো সব তাতানো রোদে পুড়ছে। শূন্য মনে হয় সবকিছু।
প্রাপ্তিবিহীন আমার যত শূন্যতা দেশের শূন্যতার সাথে মিলে ঢেউ তোলে। সবকিছু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধ হয়। জীবনানন্দের মত। লাশকাটা ঘরের ঠান্ডা বাতাস শরীর জুড়ে একটু পরপর বয়ে যায়। ঝুমির কথা মনে পড়ে। ফ্রিদার কথা মনে হয়। দেশটার কথা মনে আসে। আমার কষ্ট হয়। আমি চোখ তুলে সামনে তাকাই। মৃত্যু সেখানে জীবনের জন্য একটা প্রকান্ড- ‘না’ ঝুলিয়ে বসে থাকে। জীবনের ধ্যান ভাঙানো শয়তান অথবা দেবতার মত লাগে ওর মুখটা।
মন্তব্য
অনেক অনেক ঘটনা, অনেক অনেক সমান্তরাল জীবন, এক সুতোতে বাঁধা।
facebook
সহমত অণু ভাইয়ার সাথে।
লিখা ভালো লেগেছে,মনে হচ্ছিলো যেনো একটা পর একটা দৃশ্যপট চোখের সামনে চলে আসছে।
মাঝখানে অনেকদিন ভেবেছি আপনি বুঝি আর লিখবেন না। কিন্তু ফিরে এলেন আপনি দুর্দান্তভাবে। চলুক
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অসাধারণ কথার বাঁধুনি, আমাকে মোহাবিষ্ট করে।
অন্তর্ভেদী নিগূঢ় পর্যবেক্ষন!
ইস্পাতের আবরণে স্ফটিকস্বচ্ছ রূপক!
দুর্দান্ত উপমা!
পুরো লেখা জুড়ে এমন আরো অনেক স্বাতী নক্ষত্রের ঝিলিমিলি! বড় হিংসে হয়!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
হা। আমাদের জীবনের কথাই তো। এভাবেই ঘটনা আর কথার সমাহারে গাঁথা একটা জীবন। ভীষণ এলোমেলো, কিন্তু নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ।
খুব ভাল লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন