তীর্থের কাক ১ তীর্থের কাক ২ তীর্থের কাক ৩
তীর্থের কাক ৪
তীর্থের কাক ৫
তীর্থেথের কাক৬+৭
তীর্থের কাক ৮
ধীরে ধীরে শীতটা কমলো নাকী গা সওয়া হয়ে গেল বুঝলাম না। কিন্তু বাইরে যেতে খুব একটা ভরসা পাই না। আমাদের আস্তানার সামনে উঁচু রাস্তাটা দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কালো পীচের উপড় সাই সাই গাড়ি চলে। আমরা জানালায় দাঁড়ি তাকিয়ে থাকি, খাঁচায় বন্ধী পাখির মতো। দেশের মানুষ চিন্তায় আছে কী হল, কেমন ভাবে কোথায় আছি তার খবর দিতে হবে। চিঠি লিখব কিন্তু কোথায় আছি তার ঠিকানাই তো জানি না। গ্রামের ধনী গৃহস্তের বাড়ির পায়খানর মতো হলুদ রং-এর টেলিফোন বুথ। অনেকেই দেখি ভাংতি পয়সা ফেলে সেখান থেকে ফোন করে। শামীমের কাছে কর্জ হয়েগেছে দশ মার্ক। আরো পাঁচ মার্ক দিয়ে শামীম বললো; যান ভাই দেশে একটা খবর দিয়ে আসেন। আমাদের এলাকায় কারো ফোন নেই। একলাখ পঁচিশ হাজার টাকা নাকী দালালকে দিতে হয়েছে। যিনি দালাল এবং আমার মধ্যে মধ্যস্থতা করেছেন তাঁর নামে আশি শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন বাবা। শতাংশ প্রতি এক হাজার টাকা মূল্য ধার্য হয়েছে। সেটাও নাকী আমরা বাড়ির মানুষ বলে বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশী মূল্য দিয়েছেন খরিদ্বার। বাকী পয়তাল্লিশ হাজার টাকা জার্মানে এসে রোজগার করে ছ’মাসের মধ্যে ফেরৎ দেব। এই লিখিত অঙ্গীকার করে এসেছি সেই দয়ালু চাচার কাছে। ঢাকা শহরে তাঁর বাসাতেই চেনা-জানার মধ্যে একটা ফোন আছে। নাম্বারটা মুখস্তই।
কিন্তু ফোনটা করি কি ভাবে?
শামীম চাচার কাছে স্টুটগার্ডে হরহামেশাই ফোন করে। দেশেও করেছে কয়েকবার। ডাবল জিরো, ডাবল এইট, জিরো টু। তারপর নাম্বার। বলে দিয়েও ও নিশ্চিৎ হতে পরল না সে। আমার সাথে এলো। পাঁচ মার্কের কয়েন ফেলে; ভাল আছি, নিরাপদে পৌঁছেছি, দেশে ফেরৎ পাঠানোর কোন সম্ভবনা আপাতত নেই। বলতে বলতে কখন পয়সা শেষ হয়ে গেল! টেরও পেলাম না।
সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। শামীমের চাচা আমীর আলী স্যার ওকে স্টুটগার্ডে নিজের কাছে নিয়ে রাখবেন কয়েক দিন। তার জন্য আবার কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি লাগে। তার সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। আজ বিকেলে পাঁচটার পরে কোন ট্রেনে তিনি আসবেন। আবার আজকেই ভাতিজাকে নিয়ে ফিরে যাবেন। বড় উৎসাহের সাথে তল্পি-তল্পা গুছিয়ে অপেক্ষা করছে বেচারা।
কেমন ঝলমলে রোদ উঠেছে। গা সওয়া হয়েগেছে শীতটা। একটু বাইরেটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে। পাছে পথ হাড়িয়ে ফিরতে বিলম্ব হয়! এই ভয়ে শামীম যেতে চাইল না। অগত্যা একাই বের হলাম।
আমাদের আস্তানার সামনের উঁচু রাস্তাটার নীচে কোন খাল-বিল-নদী নেই। এই রকম কিছু ভেবেছিলাম এই রাস্তা থেকে অন্যপাশের সমান্তরাল রাস্তাটায় যাওয়ার ব্রীজটা দেখে। কিন্তু ব্রীজের নীচে দেখলাম মন্থর গতিতে ট্রেন আসা যাওয়া করছে। আর ব্রীজের উপড় দিয়ে এপারের গাড়ি ওপাড়ে অথবা ওপারের গাড়ি এপারে যাতায়ত করছে। ব্রীজের পাশে রাস্তার মতই পায়ে চলার পথ। আসার সময় ঠিক চিনতে পারব এমন ভাবে মনে রাখার জন্য রাস্তা, ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছালী দেখে সামনের দিকে এগুচ্ছি। লোকজনের আনা-গোনা কম এমন একটা পথ ধরলাম। সাদা চামড়ার মানুষ দেখে ভয় পাই, নাকী কিছুই বুঝতে পারি না বলে এড়িয়ে যাই, ঠিক ঠাহর হচ্ছে না। সে জন্যই নির্জন পথের শেষে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। চোখের সামনে কালো পিচের মতো কালো মাটির বুক চিড়ে কিছু সবুজ পাতার অঙ্কুর। রোদটা আর একটু বেড়েছে। বাংলাদেশের মাঘের শীতে সকালের রোদ পোহানোর মতো লাগছে। কিন্তু শীতল একটু হাওয়া মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার আসছে। একবার ডান দিক থেকে তো পরের বার বাঁ দিক থেকে। কখন কোন দিক থেকে আসবে তার ঠিক নেই। এর পর কী হবে? কোথায় যাব? ভাবনা গুলো বাতাসের মতই বিচ্ছিন্ন ভাবে দোলা দিয়ে যাচ্ছে মনে।
ঘেউ ঘেউ শব্দে পাশ ফিরতে দেখলাম গোটা তিনেক কুকুর। ভেবা-চেখা খাওয়া ভাবটা ভয়ে পরিনত করতে; কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ বাড়িয়ে দিল আমাকে ঘিরে। কী করব বুঝে উঠার আগেই সামনের পা দু’টো বেঞ্চে ঠেকিয়ে ভাল্লুকের মতো বড় একটা কালো কুকুর আমার ঠোটের কাছে মুখ এনে ধমকে পরিনত করল ঘেউ ঘেউ। অন্যপাড়ার কুকুর নিজেদের পাড়ায় এলে যে ভাবে চতুর্দিক থেকে ঘিড়ে ধরে নেড়ী কুকুর; আমাকে সে ভাবেই ধরেছে ওরা। গাট্টা-গুট্টা আরো দু’টো যোগ দিল ওদের সাথে। আগে-পিছে-ডানে-বাঁয়ে ওরা ঘিরে রেখেছে আমাকে। ভাল্লুকের মতো কালো কুকুরটা ঘেউ করার সময় মুখটা চট করে একটু উপড়ের দিকে তোলে। প্রশ্নবোধক কিছু বলার সময় আমরা যেভাবে মুখটা একটু উঁচু করি ঠিক তেমন। কেন এখানে এসেছি, কী চাই, এমনই ভঙ্গি। ভাষাটা কেবল ঘেউ। লাল জিহ্বাটা মুখ থেকে বের হয়ে ঝুলে আছে বিঘত খানেক। লালা ঝড়ছে মুখের দু’দিক থেকে। ডানে-বামের কুকুর গুলোর দিকে আর তাকাতে পারলাম না। কালো কুকুরটা ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে সম্মোহন করে রেখেছে আমাকে। অনেক চেষ্টায় মুখ থেকে হেল্প শব্দটা বের হল। ধমকের সুরে পাশ থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠ বলল; শান্ত হও, এরা তোমায় কিছুই করবে না।
মহিলা ডাকলেন; পিটার, থমাস আরো কী যেন নাম। বাকীটা বুঝলাম না। কিন্তু কুকুরগুলো ফেরি গেল। যাক বাবা প্রাণে বাঁচলাম।
দেখতে দেখতে কুকুরের মিছিলটা মহিলাকে ঘিড়ে ঘেউ ঘেউ শ্লোগানে মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে। ধীরে ধীরে আস্তানার পথ চেনার চেষ্টা করছি আমি। শহরের কাছা-কাছি লোকজনের চলাচলা একটু বাড়ল মনে হয়। শামীমের কাছে কর্জগুলে করেছিলাম সিগারেট কেনার জন্য। রাস্তার ধারে অনেক জায়গায় বড় সাইজের সিগারেট বক্স লাগানো। চার মার্ক বাক্সে ফেলে নির্দৃষ্ট ব্র্যাণ্ডের হাতল ধরে টান দিলেই বের হয় সিগারেট। কিন্তু দিয়াশলাই বা লাইটারের কোন বক্স পেলাম না। তাই এদিক ওদিক তাকাই কোন ধূমপায়ী লোক দেখলে আগুন চাই। অনেকক্ষণ কাউকে ধূমপান করতে দেখলাম না। কিন্তু কুকুরগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পর থেকেই পেয়ে বসেছে নেশাটা। দেখতে দেখতে আস্তানার কাছের ব্রীজটাতে চলে এলাম। ত্রিশোর্ধ মহিলা তাঁর বয়সী লোকটাকে দু’হাতে জড়িয়ে তাঁর ঠোটে ঝুলে আছে যেন! আশে-পাশের লোকজন কোন কেয়ারই করছে না। লোকজনেরও যেন; ঐ যুগলের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নাই। তাদের পিছনে ফেলে আমি এসে দাঁড়াম ব্রীজটার উপড়। কতগুলো লাইন যে আছে ট্রেন চলার জন্য তা গুনে দেখার কোন উপায় নেই। আমাদের কমলাপুর রেলষ্টেশনের মতো কয়েকটার জায়গা হবে এখানে অনায়াসেই। জালের মতো ঢেকে রেখেছে বৈদ্যুতিক তার রেল লাইনের উপড়টা। অবাক বিষ্ময় নিয়ে তাই দেখছি আর লোকজনের যাতায়তের দিকে চোখ রাখছি যদি কোন ধূমপায়ী দয়া করে পদধূলি দেন।
কোট-টাই পরা লোকটা জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ব্রীজের অন্য পাশ থেকে আমার দিকেই এগুচ্ছেন। এক্সিউজ মী শব্দটা মনে মনে বলে নেই একবার। এইটা বলেই আগুন চাইব। আমার বিবেচনায় (এখানে দিক চিনি না এখনও) উত্তর দিকে মুখ করে ছিলাম আমি। ধূমপায়ী লোকটা দেখে তিনি যে দিক থেকে আসছেন সেদিকে ফিরলাম। এখন দেখি ডান এবং বাঁ দিক থেকেও এগিয়ে আসছেন একজন করে ধূমপায়ী। কিছুটা ফাপরে পড়ে গেলাম। কার কাছে আগুন চাই! সিদ্ধান্ত নিলাম কোর্ট-টাই পড়া ভদ্র লোকটার কাছেই চাইব আগুন। আমি ব্রীজের রেলিং থেকে এক পা এগিয়েছি ভদ্রলোকের দিকে। কিন্তু তিনি যেন রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠতে পারেন, সে জায়গাটুকু রেখেছি। একদম আমার সামনে, গাড়ি চলার পথ থেকেই তিনি হাতের সিগারেট ফেললেন ফুটপাতে। সিগারেটটার ঠিক উপড়েই তাঁর প্রথম পাটা পড়ল ফুটপাতে। পেছনের পাটা ফুটপাতে তুলতে কী যেন বললেন আমাকে। এর মধ্যে ডান-বামের অন্য দুজনও আমার প্রায় গা ঘেষেই হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে পিষে ফেললেন পা দিয়ে। পেছনে ব্রীজের রেলিং। ডানে-বাঁয়ে দু’জন। সামনের ভদ্রলোক পরিচ্ছন্ন ইংরেজীতে সূধালেন; ডু ইউ স্পিক ইংলিশ?
ইংলিশ ঠিক জানি না। কিন্তু এখানে অন্য উপায় নেই। ইয়েস-নট- ভেরি-গুড কেই কাজে গালিয়ে ইয়েসটা ব্যবহার করে ফেললাম। হলিউডের সিনামার হিরোরা যেভাবে এফবিআই বলে একটা ধাতব মেডেল ভিলেনের সামনে ধরে, অনেকটা এই কায়দায়ই কী একটা চোখের সামনে ধরে বললেন; পুলিশ। পরিচয় পত্র দেখাও। নিজের খোমা লাগানো একটা কাগজ দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। খুব দরকারী মনে করে সেটা আস্তানায় রেখে এসেছি। তাই দেখাতে পারলাম না। কিন্তু সব পকেটে হাত ঢুকিয়ে পকেটের ভেতরের থলেটা দেখাতে হলো। সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলেন। একদম সদর ঘাটের মতো ফাঁকা পকেট দেখে সন্দেহ বাড়ল মনে হয়। এর মধ্যে একটা গাড়িও এসে থেমেছে আমাদের পাশে। থাক কোথায়? জবাবে’ দেখিয়ে দিলাম আস্তানাটা। এবার বলল; গাড়িতে উঠ। এইবার ঠেলা সামলায় কে!
আমার সাথে তিনজন সাদা চামড়ার লোক দেখে শামীম একটু ঘাবড়ে গেল। সেটাই স্বাভাবিক। দুই দরজার একটা আলমারীতে ভাগাভাগি করে কাপড়-চোপড় রেখেছি আমরা। তন্ন তন্ন করে সব খুলে দেখল পুলিশ। তল্যাশি শেষে ক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরছিলেন দেখে জানতে চাইলাম; এই তল্যাশির হেতু কী!
শহরে অবৈধ মাদক দ্রব্যের খবর পেয়েছি আমরা।
চলবে...
মন্তব্য
ওহহহ পুতুল ভাই কুত্তাগুলাতো আপনার কলিজার পানি শুকাইয়া দিছিলো মনে হয়। দেখেন আমি কিন্তু আপনার পোস্টে একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে লেগে আছি। ভাল লাগতেছে পড়তে, চলুক চলুক
অন্দাজ করতে পারেছেন ঠিকই কল্যান।
সে যে কী বিভৎস ভয়, কাউকে কখনো বলে বোঝাতে পারব না।
পড়তে ভাল লাগছে শুনে খুসি হলাম।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
রোমাঞ্চকর লাগলো এপর্বটা............চলুক..........
আপনার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো।
_____________________
Give Her Freedom!
দুঃখের কথা ভুলি কেমনে। এখানে স্মৃতির কোন বাহাদুরী নেইরে ভাই, কষ্টের কথা বলে মনে আছে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
তারপর কি হলো!
ছোটবেলায় কে না বলেছে এই তিনটি শব্দ দাদু-দিদা-বাবা-মা’র কাছে গল্প শোনার সময়!)
তার পরের ঘটনা পরবর্তী পর্বে কবি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন