শূন্য একোরিয়ামের মধ্যে একটা আলো- ঘরের মধ্যে আর কোন আলো জ্বলে না। চল্লিশ পাওয়ারের টাংস্টেন বাল্বের হলুদ আলো একোরিয়ামটার স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের মধ্যে দই এর মত জঁমাট বেঁধে আছে। কিছুদিন আগেও ওখানে একজোড়া গোল্ডফিশ লেজ নেড়ে সাতরে বেড়াতো। যতেœর অভাবে দুটোই মরে গিয়েছে। প্রথমে একটা। নিঃসঙ্গতার যন্ত্রনায় অন্যটা। শূন্য একোরিয়ামটার দিকে তাকাই- নিঃসঙ্গ গোল্ডফিশটার শেষদিনগুলো ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে। একসময় গোল্ডফিসটা মরে ভেসে উঠে পাথরের মত ঘোলা চোখে আমার দিকে চেয়ে হাসে। ওর হাসিটা আমার নিয়তির মতন লাগে। যেন বলছে- আসছো না কেন? নিথর পানিতে আলো পড়ে ওকে আরো স্থির মনে হয়, এক টুকরো স্বচ্ছ পাথরের মত । আমি একোরিয়াম থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নি।
পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর পাথরের অনেকগুলো খেলনা বাড়িঘর, গাড়ি, সৈন্য সামন্তগুলো স্বপ্নের মত পড়ে থাকে। সেই কবে ঝুমি এসে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এখনও তেমনি আছে। টেবিল ঘড়িটাকে যুদ্ধত্রে মনে হয়। আহত এক পঙ্গু সৈনিকের মত সেকেন্ডের কাটাটা শরীরে হাচড়ে পাঁচড়ে রাইফেলটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগুনোর চেষ্টা করছে। সংসপ্তকের মত। আমার নিঃশ্বাসের মত। সরু চোখে ঘড়িটাকে ভাল করে আবার দেখি। আবার। একলা সেকেন্ডের কাটাটা লাফিয়ে লাফিয়ে দৌঁড়াচ্ছে, মিনিটের কাটাও নেই- ঘন্টার কাটাও নেই। ঘড়িটা থেকে মিনিট আর ঘন্টার কাটা ঘড়িটা থেকে খুলে ফেলে দিয়েছি। ওদের দেখলেই মনে হতো আমার জীবনে ঘন্টা আর মিনিটের কাটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এখনও জীবনটা যে থেমে নেই, সময়টা যে এগুচ্ছে মনে করার জন্য সেকেন্ডের কাটাটাই যথেষ্ট। ঘড়িটাকে যখনই দেখি একাকীত্বটা একটু কমে।
কিন্তু গোল্ডফিশটার চোখজোড়া খুব বেশি তাকিয়ে আছে । তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। ওর চোখগুলোর শূন্যদৃষ্টি আমার মগজের ভেতরে ঢুকে কোষে কোষে জমে থাকা স্মৃতি, কল্পনা আর চিন্তাগুলো কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে। মরার পরে এগুলোই ওর খাদ্য এখন। দিনে দিনে মাথার ভেতরটা মগজ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই শিউরে ওঠা কান্তি। ভাললাগে না কিছু।
খেলনা বাড়ি ঘর গুলো দেখে মনে পড়ে নদীপাড়ের বাড়িটা আর বানানো হলো না। ঝুমিও আসলো না। পাথরের বাড়িগুলো হাত দিয়ে ছুই। ঝুমি এসে দাঁড়ায় পাশে। শূন্যতাটা আরো বাড়ে। একোরিয়ামের ভেতরে মরা গোল্ডফিশটা আবার লেজ নেড়ে আমাকে ডাকে। আমার অস্থির লাগে। ভয় লাগে। ওই চোখজোড়া থেকে পালাতে ইচ্ছা হয়। আবার বাড়িঘরগুলো দেখি। আবার শূন্যতা। তখনই ভাবনাটা আসে মনে। অনেককাল পর আমি একটা কিছু নিয়ে মেতে উঠি।
খেলনা বাড়িগুলো একোরিয়ামের জলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে একটা শহর বানাই। সৈন্য সামন্ত- গাড়িগুলো বসিয়ে বসিয়ে শহরটাকে জীবন্ত করে তুলি । কিন্তু শহরের সাধারন মানুষেরা কেউ বাইরে নেই। সবাই যেন ঘরের মধ্যে লুকিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় খালি সৈন্য। সৈন্য আর সৈন্য। যুদ্ধের কথা মনে হয়। শহরে বাড়িগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোর কথা ভাবি। এই বাড়িগুলোর ভেতরে ... আটকে থাকা মানুষের মধ্যে আমাকে দেখি। সহ্য হয় না। রাগ হয়। শেষ পর্যন্ত একোরিয়ামের মধ্যে দুহাত ডুবিয়ে অনেক অনেকণ ধরে এক প্রবল আক্রোশে হাতদুটো ছুড়তে থাকি। শহরটা ভেঙেচুড়ে ধূলিষ্যাৎ হয়ে যায়।
সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে ছেড়ে দেই। ছাই মাটিতে পড়তে থাকে। তাকিয়ে থাকলেও চোখজোড়া কিছু দেখে না। সেকেন্ডের কাটাটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। কোন সময় দেয়না। জীবনের মতই। চলছে। কিন্তু কোন অর্থ নেই। মরে যাই... চোখ বন্ধ করে ভাবি। ভাবনাটা হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়। প্রথমে মাথায়। তারপরে পুরো শরীরে। ঠাণ্ডা একটা হাত। বরফের মত। আমি ভয় পেয়ে চোখ খুলি। তাকিয়ে দেখি লাস্ট বেঞ্চি।
আবুল হাসানের কবিতা থেকে নিজের নামটা নিয়েছিল লাস্ট বেঞ্চি। নাম জিজ্ঞেস করলেই হাসতে হাসতে বলতো- “লাস্ট বেঞ্চি। - আপনাদের পাখিটা আমি সত্য ডালে বসাতে পারবো না, প্লিজ।”
ভাল ছাত্র ছিল- ফার্ষ্ট কাসটা ছিল গলায় বাঁধা। কবিতার বই বের করেছিল একটা- কবিতাপ্রিয় উজ্জ্বল মেয়েদের ওর কবিতা আবৃত্তি করতেও শুনেছি। কবি হিসেবেও স্বার্থক। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। সামনে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত ওর জন্য কনে সেজে বসে ছিল। মেয়েরা ওর প্রেমে পড়ার জন্য লাইন দিয়ে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকত। এই রকম একটা ছেলে কেন যে গলায় দড়ি দিয়ে মরলো - আমরা কেউ মাথা খুটেও বের করতে পারি নি। ওর দিকে তাকিয়ে ওকে দেখতে পাই। বরফের মতো ঠাণ্ডা শরীর - সিলিং থেকে ঝুলছে আর বাতাসে একটু একটু কাপছে।
বহুকাল জমে থাকা প্রশ্নটা ছুড়ে দেই।
: মরলি কেন তুই? এত উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যত ছিল তোর সামনে।
লাস্ট বেঞ্চি অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে
: হাঃ হাঃ হাঃ - ভবিষ্যত - অ্যা ... হাঃ হাঃ হাঃ ভবিষ্যত বলতে কী বুঝিস তুই-অ্যা ...
আমি কোন কিছু বলতে পারি না। ওর গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে।
লাস্ট বেঞ্চি : ভবিষ্যত একটা বেলুনের মতো। জীবন ভর ফুলিয়ে যাবি - একটা সময় ফটাস করে ফেটে যাবে - আর - তারপরেই সব শেষ। হাঃ হাঃ হাঃ...
আমি ওর দিকে তাকাই। ওর চোখে একটা তীব্র কৌতুক নেচে ওঠে।
লাস্ট বেঞ্চি : হাঃ হাঃ হাঃ!
আমি : হাসছিস কেন?
লাস্ট বেঞ্চি : বুঝে দেখ তাহলে।
আমি : কী?
হঠাৎ সব আলো নিভে যায় । কেউ যেন একটা অন্ধকার পর্দা দিয়ে চারদিক ঢেকে দিয়েছে। নিকষ কালো। কিছু বুঝতে পারার আগেই হটাৎ একটা ঘন্টার শব্দ বেজে ওঠে। ঢং ঢং ঢং ঢং। একটা দুইটা তারা ফুটতে শুরু করে। তারার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলে বোঝা যায় এটা আসলে একটা মঞ্চ। মঞ্চের এককোনে লাস্ট বেঞ্চি মন্ত্রী বেশে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার ঘুম পায়। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসে। মন্ত্রী ঝিমুতে ঝিমুতেই একবার কানখাড়া করে ঘোষণাটা শুনে তারপর আবার ঘুমিয়ে যায়।
প্রদর্শনী! প্রদর্শনী!! নার্সিসাস শিল্প প্রদর্শনী!!!
নিজেকে প্রদর্শনের এক অপূর্ব নতুন যুগের সূচনালগ্নে আপনি স্বাগতম। আপনার যা খুশি তাই নিয়ে চলে আসুন। আপনার ছেঁড়া জুতোর মধ্যে ছিটিয়ে নিন দু চিমটে লবণ, আর দেখুন কী অদ্ভুত এক শিল্পকলার নিদর্শন আপনি তৈরী করে ফেললেন। অথবা এতে যদি আপনার মন না ভরে - আপনার টেবিলের ন্যাকড়ায় ভাতের আঠায় লাগিয়ে দিন না - আপনার চোখের পাতা থেকে খুলে আনা একটি পাপড়ি। অথবা একটি ভ্রু। আপনি নিশ্চিত জানুন - আপনার এই শিল্পটি গোটা পৃথিবীতে আগে কেউ ভাবে নি। আপনিই একক আপনিই অদ্বিতীয়। অদ্বিতীয়দের এই শিল্প প্রদর্শনীতে আপনিও আপনার শিল্প দ্রব্যটি নিয়ে চলে আসুন। এই শিল্প প্রদর্শনীতে কেউ কারো জন্য অপো করে না। কেউ কাউকে দেখে না। কারো শিল্প অন্য কারও জন্য নয় শুধু নিজের জন্য। আপনার সৃষ্টি আপনারই জন্য। প্রদর্শনীতে আসুন এবং নিজেকে নিজেই দেখুন। নিজেকে নিজেই মুগ্ধ করুন।
মন্ত্রীর মুখে একটা পরিতৃপ্তির ভাব ফুটে ওঠে। প্রদর্শনীর ঘোষণা দূরে মিলিয়ে যায়। মন্ত্রীর ঘুম ঘুম ভাবটা আরও গাড় হয়ে আসে।
মহামান্য মহরাজা এখন আপনাদের সামনে হাজির হচ্ছেন - হুশিয়ার, সাবধান
রাজার আগমনী বার্তা বেজে ওঠে। মন্ত্রী লাফিয়ে উঠে ঠিকঠাক সোজা এটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। যেন অনাদিকাল ধরে সে এইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। রাজা মঞ্চে আসেন। মন্ত্রী রাজাকে স্বাগত জানাতে কুর্ণিশ করে। রাজাকে দেখে তাকে ঠিক রাজা মনে হয় না। একটা কর্পোরেট হাউজের প্রধান কর্তার সাথেই তার মিল বেশি। রাজাটাও দেখি লাস্ট বেঞ্চি। ডাবল পার্টে একটিং করছে। আমি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকি। মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন
রাজা : প্রদর্শনীর আয়োজন ব্যবস্থাপত্র কী সম্পন্ন?
মন্ত্রী : নিরুদ্রপে সকলি নিস্পন্ন, মহারাজ।
রাজা: পরাধূনিককালের এই বার্তা পৌঁছে দাও এখনি, আমার রাজ্যে সকলি শিল্পী, সকলি
স্বাধীন-
মন্ত্রী : চিন্তা এবং প্রকাশে বল্গাবিহীন।
রাজা: হ্যা, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সকলি হতে হবে বিবেচনাবিহীন-
মন্ত্রী : সকলি স্বাধীন।
রাজা : পাথরের মত চোখ অন্ধ ফুটবলার-
মন্ত্রী : ল্যহীন শটে দিয়ে দাও গোল, সবদিকেই আছে বার।
রাজা : সিংহ আর শেয়াল-
মন্ত্রী : সকলি সমান।
রাজা : কারও কথা কেহ যেন নাহি শোনে-
মন্ত্রী : সবাই যেন কেবলি বলে।
রাজা : হ্যা মনে করিয়ে দাও, সবাই স্বাধীন।
মন্ত্রী : একতাবিহীন।
রাজা : সবাই রাজা-
মন্ত্রী : ভাবনার মজা।
রাজা : আর রাজদণ্ড-
মন্ত্রী : শুধুই আপনার হাতে, পুরোটাই- অখণ্ড ।
রাজা এক মুহূর্ত থমকে কিছু একটা ভাবেন। চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমোদিত কণ্ঠে চারদিক পুলকিত হয়ে ওঠে।
রাজা : ডিকশনারি থেকে “একতা” শব্দটা কেটে দিলে কেমন হয় বলোতো?
মন্ত্রী : যার নাই অস্তিত্ব, সে থাকবে কেন? মুছে দিন, বাদ দিয়ে দিন।
হটাৎ রাজা থমকে যান। নাক টেনে বাতাসে কিসের একটা গন্ধ শুকেন। গন্ধ শুকে শুকে মন্ত্রীর জামার কাছে নাক নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেন। মন্ত্রীর দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। ভ্রু জোড়া একটু কুঁচকে আসে।
বললে রাজা, “ মন্ত্রী তোমার জামায় এ কিসের গন্ধ?”
মন্ত্রী বলে, “ এসেন্স দিছি- গন্ধটা কী স্যার, মন্দ?”
লাস্ট বেঞ্চি সত্যিই দুর্দান্ত অভিনয় করছে। এই অভিনয়টা নিজের চোখে দেখলে সত্যজিৎ রায় ’হিরক রাজার দেশে’র সবগুলো রোল নিশ্চিত তাকে দিয়ে করাতেন। লাস্ট বেঞ্চি এখানে যেমন - একসঙ্গে সবকটা রোলেই অভিনয় করছে। আমি চারপাশে তাকাই। শত শত দর্শকের রুদ্ধশ্বাস চোখ ওর দিকে চেয়ে আছে। পিনপতন নিঃস্তব্ধতার ভেতরে ওর কণ্ঠস্বর গমগম করে। কিন্তু হটাৎ এক মুহূর্তে, তার আগে বোঝাও যায় না - সে তার পার্ট ছেড়ে দর্শকের দিকে মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু আর সব দর্শক তখন বেমালুম উধাও, শূন্য হলঘরে একলা আমি বসে আছি। সে চিৎকার করে,
লাস্ট বেঞ্চি : সুকুমার রায়কে চেন?
আমি মাথা নাড়ি।
লাস্ট বেঞ্চি : সুকুমারের বয়স কত- বল?
গোল গোল চশমা পড়ে কোটপ্যান্ট পড়া একটা সাদাকালো চেহারার তরুনের ছবি চোখে ভাসে।
্আমি : সাতাশ আটাশ।
লাস্ট বেঞ্চি : সুকান্ত?
আমি : একুশ বোধহয়।
লাস্ট বেঞ্চি : তাহলে বুঝলিতো-
আমি কিছুই বুঝতে পারি না। লাস্ট বেঞ্চি আমার দিকে মাথাটা ঝুকিয়ে এনে চোখের একবারে সামনে চোখটা এনে বলে
লাস্ট বেঞ্চি : সেই কবেকার সুকান্ত , সুকুমারের বয়স তোর চাইতেও কম। হাঃ হাঃ হাঃ বেচে থাকার ভবিষ্যত মানেই তো, বুড়ো হয়ে ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া।
আমি : কিন্তু বেঁচে থাকাতো খালি নিজের জন্য নয়। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য-
লাস্ট বেঞ্চি ভ্রু কুচকে এমন ভাবে তাকায় যেন আমি একটা আকাটমূর্খ। ওর দৃষ্টির সামনে আমার কেমন অস্বস্তি হয়।
লাস্ট বেঞ্চি : একজন মানুষ-আর আরেকজন মানুষ- এই দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক বলতে পারিস?
আমি : অনেক স¤পর্কই হতে পারে।
লাস্ট বেঞ্চি : সে সম্পর্কের মূল্য কতটুকু?
আমার ঝুমির কথা মনে পড়ে। সম্পর্কের কী মানে আছে বুঝতে পারি না।
আমি কথা বলি না। ওর কথায় ফুলঝুরি ঝরে পড়তে থাকে।
একটু বাঁচার আশায় গ্রাম থেকে ছুটে আসা বানভাসী কৃষকটা -কয়েকদিনের অনাহারে - বিনা চিকিৎসায় ব্যস্ত রাস্তায় দিন দুপুরে অজ্ঞান হয় গেল । হয়তো একটু পরেই ও মরে যাবে। ধুলো মাখা রাস্তায় পড়ে আছে। পাশ দিয়ে - মানুষ জন দিব্যি হেঁটে চলে যাচ্ছে। যেন একটা ঝরা পাতা পড়ে আছে। দেখেছিস?
একটা ছেলে - দেশে কিছু করতে না পেরে বিদেশ যাবে বলে আদম ব্যাপারীর হাতে সর্বস্ব খুয়ালো। বাড়িতে বউ - ছেলে, চাকরীর খোজে শহরে এসে পেটের দায়ে ছিনতাইকারী হয়ে গেল - তাকে আগুনে পুড়তে দেখেছিস? আমি - তুই, আমরা ভদ্রলোক নীতিবানরা, সবাই তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছি - দেখেছিস? তুই কী পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতায় পাত্র চাই - পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনগুলো খেয়াল করেছিস?
কলেজের বাংলা শিক ইমাম স্যারের কথা মনে হয়। নকল চুলের বাবরী দুলিয়ে কাসে এসে সবার দিকে তাকিয়ে সম্ভাসন জানাচ্ছেন- কী খবর তোমাদের। পড়াশোনা করছোতো নাকি মেয়েদের পেছনেই সময় ফুঁকছো। লাভ নেই, বুঝলে লাভ নেই। পেপার খুলে পাত্র চাই বিজ্ঞাপনটা দেখ তাহলে বুঝবে - কোথায় যেতে হবে। এরকম ফাঁকি দিলে বউও কপালে জুটবে না, হ্যা।
লাস্ট বেঞ্চি তখনও সমানে বকেই যাচ্ছে।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী সুশ্রী, সুন্দরী-সুদর্শন সুঠামদেহী, দীর্ঘাঙ্গী এগুলোর বাইরে কোন বিজ্ঞাপন দেখেছিস - সৎ, সাহসী, জ্ঞানী এরকম কাউকে চাই। এগুলোর কোন মূল্যই নেই এখন।
লেখাপড়া করে যে - গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে,
লেখাপড়া করেনা যে - গাড়ি চাপা পড়ে সে।
লেখাপড়া হলো - গাড়ি হাকানোর জন্য, মানুষকে চাপা দেয়ার জন্য। সবকিছুর মূলে অর্থ - উপযোগিতা - utility না থাকলে তফাৎ যাও। পৃথিবীতে তোর কোন প্রয়োজন নেই। ভাই হিসেবে না - সন্তান হিসেবে না - বাবা হিসেবে না - বন্ধু হিসেবে না - প্রেমিক হিসেবে না। কোন হিসেবেই না। মানুষ বলে কিছু নেই। আছে শুধু পন্য। তুই- সেটাও একটা পন্য ছাড়া কিছু না।
লাস্ট বেঞ্চির কথাগুলো ছুরির ফলার মত চকচক করে। তার খোচায় স্মৃতির ভেতর থেকে ঘ্যাচ করে ঝকঝকে কালো রঙের গাড়িটা চোখের সামনে এসে ব্রেক করে।
আমি চমকে ...
মন্তব্য
শ্বাসরুদ্ধকর। অসাধারণ, একই সাথে গল্প এবং নাটকের বিমূর্ত যুগলবন্দীর ফর্মুলাটা ব্যাপক। বাদল সরকারের সেই বিখ্যাত নাটক "এবং ইন্দ্রজিৎ" -এর কথা মনে করিয়ে দিলেন।
কলম কথা বলুক দাদা, প্রতিবাদের কথা। আপনার এই বর্ণনায় সিস্টেমের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠা প্রতিবাদ প্রকট।
ডাকঘর | ছবিঘর
ডিকশনারী থেকে একতা শব্দটা উঠেই গেছে...
লেখা খুব ভালো লেগেছে।
তীক্ষ্ণ এবং ভালো লাগল
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
facebook
লেখাটা ভালো লাগলো
নতুন মন্তব্য করুন