স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা আংশিক ব্ল্যাকআউটের কবলে পড়ে গেছে। কিছুতেই সেই অংশগুলো আর মনে করতে পারি না এখন। ভাবলাম স্থায়ীভাবে মস্তিষ্কের ব্যাড সেক্টরে পড়ে যাওয়ার আগেই কয়েকটা ঘটনাকে ডিজিটাল ডায়েরীতে টুকে রাখি ডিজিটাল বাংলাদেশের অ্যানালগ নাগরিক এই আমি! এটা তারই উদ্যোগ...
ডাল আমার খুব প্রিয় ছিলো। আমাকে ভাত খাওয়ানোর জন্য আমার মা অন্যকিছু রাঁধুক আর নাই রাঁধুক, ডাল অবশ্যই রাঁধতো। সেই ডাল দিয়ে প্রতিদিন চার/পাঁচ বেলা খাওয়া হতো আমার। নিজের হাতে না, মা মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। এই খাবার সময়গুলোর তেমন কিছুই আমার স্মৃতিতে অবশিষ্ট নেই। কেবল দুইটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া! এবং এই দুইটা ঘটনাই আমার বিকেলের খাবার সময়ের।
দুপুরে এক পশলা ঘুম দিয়ে উঠে খেলতে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখি মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে গ্রিল ধরে। ডাকছে আমাকে। আমি মাকে দেখেই খেলা রেখে বাসার দিকে ছুঁটে যাই। মা হাত বাড়িয়ে থাকে, আমি লাফ দিয়ে কোলে উঠে যাই খিলখিল করে হাসতে হাসতে। তারপর মা আমাকে শোবার ঘরের লাল টেবিলক্লথ পাতা টেবিলে বসিয়ে পাশ থেকে ডাল দিয়ে মাখা ভাতের বাসন তুলে নেয় হাতে। এবং এটা ফ্রেশ ভাত, সেটা বুঝানোর জন্য পাতের মাঝখানে কয়েকটা সাদাভাত রেখে দেয়। আমি এই সাদা, অমাখা ভাত দেখে রায় দেই— আমাকে পুরান ভাত খাওয়ানো হচ্ছে না! মা আমার মুখে ভাত তুলে দেয়, এটা সেটা বলতে বলতে। আমি টেবিলে বসে পা দোলাতে দোলাতে ভাত খাই আর রাজ্যের গল্প করি মায়ের সাথে। লালরঙা টেবিলক্লথের ডিজাইনটাও এই মুহূর্তে মনে আছে। হয়তো কিছুদিন পরেই রাক্ষুসে সব নিউরন এই স্মৃতিটুকু হজম করে ফেলবে হাজমোলা ছাড়াই।
দ্বিতীয় স্মৃতিটা বাড়িতে।
আমাদের বাড়িতে সবসময়েই নানা রকম ফল এবং সবজির গাছ গাছালিতে ভরপুর থাকতো। সেগুলোর জন্য বিশাল মাচাও তৈরী হতো উঠানের এক পাশে। মাচাভর্তি হয়তো অনেক কিছুর ফুলই ফুটতো। কিন্তু আমার স্মৃতিতে আছে কেবল সাদা ঝিঙে ফুল।
বাড়ির নিচেই একটা জমিতে শীতের সময়ে অল্প একটু জায়গায় কখনো কখনো মটরশুটির চাষ হতো। বাকি সময়ে জমিটা অনাবাদিই পড়ে থাকতো। সেখানে আমরা খেলতাম, হৈ হুল্লা করতাম। বিকেলে খেলার সময়ে মায়ের 'বাবু' ডাকটা কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড় লাগাতাম। মা দাঁড়িয়ে থাকতো হাত বাড়িয়ে কোলে নেয়ার জন্য। তারপর কোলে নিয়ে বিরাট সেই ঝিঙে মাচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতো। একটা একটা করে ঝিঙে ফুল তুলে, সেগুলোর গোঁড়ায় ধরে আমার কপালে ফোটাতো।
ফুলগুলো আমার কপালের সাথে লেগে অদ্ভূত সুন্দর একটা 'কটাশ' শব্দে বিস্ফোরিত হতো। আমি কোনো একটা কারণে এতে খুব মজা পেতাম। হাসতাম খিলখিল করে। আমার হাসিতে মা'ও হাসতো। আরও ফুল তুলে সেগুলো ফোটাতো, আমার কপালে। তারপর একটা গান গুনগুন করতে করতে আমাকে ভাত খাওয়াতে নিয়ে যেতো।
বড় হতে হতে দেখলাম মা তার অনুভূতিগুলো কখনোই প্রকাশ করে না সামনে। যতোটা কঠোরতা দেখায়, আড়ালে ততোটাই হাহাকার করে। যখন ঢাকায় থাকতাম, বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে রিক্সা নেয়া পর্যন্ত সাথে সাথে আসতো মা। দাঁড়িয়ে থাকতো ততোক্ষণ, যতোক্ষণ আমাকে বহনকারী রিক্সাটা দেখা যায়। দেশ ছেড়ে যখন যাই, যাওয়ার সময়েও বকা দিতে ছাড়েনি। কিন্তু পৌঁছে যখন ফোন করেছি, জেনেছি বিছানার ওপর ফেলে আসা আমার পরনের জামা কাপড় বুকের সাথে চেপে ধরে মায়ের সেকি কান্না! ঈদে-পার্বণে, কারণে অকারণে যখনই ফোন করেছি, 'হ্যালো' বলেই ডুকরে উঠেছে প্রতিবার।
কালকে হঠাৎ করেই নিজের অজান্তে গুনগুন করছিলাম এই গানটা।
আর তখনই নিজেকে আবিষ্কার করছিলাম এক নাদুস নুদুস বাবুর শরীরের ভেতর। যে কিনা খেলা ছেড়ে মায়ের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে খিলখিল করে হাসতে হাসতে...
মন্তব্য
আপ্নেও লেখা দিলেন!!!
সব মায়েরাই এমন মনে হয়, তবে খেলার সময় আম্মা ডাকলে যাইতামনা আমি
কী মায়াময়, কী অপূর্ব!!! আহারে!!!
আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ, আমি শৈশব ভুলে গেছি!!!
কি যে ভাল লাগল.........
গুড।
এইবার ভাবীরে ইতালি থেকে জার্মানিতে নিয়া আসেন।
খালি ভাবীরে? আমি তো চিন্তা কর্তাছি ভাবীর ফোরটিন জেনারেশনরে কোলে কৈরা নিয়া আসুম। এতো মানুষ, পাঞ্জায় না কুলাইলে নিজেই তাগো কোলে উইঠা ইতালির রাহে রওনা হৈয়া যামু! কী আছে জীবনে!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
পিচ্চিকালের কথা মনে পড়ে গেল।
গানটার জন্য অনেক ধন্যবাদ..
অনেকদিন পর গানটা শুনে .. গানের কথাগুলো শুনে
কার জন্য ...
মায়ের জন্য, নাকি আমারই জন্য?
নাকি মায়ের সাথে আমার লুকিয়ে থাকা সম্পর্কটার জন্য?
ঠিক জানি না ...
স্রেফ কান্না পেল।
তবু ধন্যবাদ।
একেবারে ফ্রাঙ্কলি বলি, আপনার কিছু কথা আমার ভালো লাগতো না একসময়। কিন্তু আপনার কৌতুক বাচনভঙ্গিতে আমি মুগ্ধ হয়েছি বহুবার। কিন্তু আপনার কোন পোষ্টে বা আমি বলি না কিছুই।
কিন্তু আজ বলি -
লেখাটা পড়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আপনার বর্ণনার সব কটা ঘটনাই আমার সাথে ঘটেছে। আজ এই মুহূর্তে আমি আমার বাসায় আছি, মা নিজের হাতেই একটু আগে আমাকে খাইয়ে দিলেন। আর কিছু বলতে পারবো না, কষ্ট হয়। জীবনের কত বছর যে স্নেহ-মমতার আঁচল ছেড়ে বেঘোরে কাটালাম।
ভালো থাকবেন।
ডাকঘর | ছবিঘর
আপনার জন্য এই গানটা রেখে গেলাম
মা
ডাকঘর | ছবিঘর
অপূর্ব
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
খুব ভাল লাগলো লেখাটি।
মাকে নিয়ে কোনো লেখাই আসলে কখনো পরিপূ্র্ণ হয়না। মায়ের কথা কতটাই বা আপনি লিখতে পারবেন! তবে মায়ের কথা একটুখানি লিখলেই আমরা অনেকখানি বুঝতে পারি। খালাম্মা ভালো থাকুন সবসময়।
অট. আমাগো ভাতিজা/ভাতিঝিদের যে মায়ের মমতা থেকে বঞ্চিত করতেছেন সেটা কী ঠিক হচ্ছে, বলেন!!!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধুগোদা' এত সুন্দর করে লিখেছেন! মনে হল চোখের সামনে দেখতে পাইলাম সব। অসাধারন লেখা, তয় পড়ে মনটা খারাপ হল কেন যে!
শৈশবে আমার ও প্রিয় খাদ্য ছিলো ডালভাত নাহয় দুধভাত।
ইদানীং পৃথিবী অনুভব করে, একটা সূর্যে চলছেনা আর
এতো পাপ, অন্ধকার
ডজনখানেক সূর্য দরকার।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমার আম্মু এখনও উঠতে বসতে কারনে-অকারনে আমাকে গালি দেয়। গালি দিয়ে নিজেই হাউহাউ করে কান্নাকাটি করে আর হুকুম করে, "কোলে আয় শয়তান...তুই আমাকে এত জ্বালাস কেন? তোর জন্য তো কবরে গিয়েও শান্তি নাই। আমি মরে গেলে তোকে কে দেখবে...এ.এ.এ. "
এত বকা খাওয়ার পরও এই ভদ্রমহিলার প্রতি আমার এই সর্বগ্রাসী মায়া আসে কোথ্থেকে, বুঝতে পারি না
ভাই শেষের দিকে এসে চোখ পানি চলে আসছে।আমিও আমার মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে...
, স্মৃতিকাতরতায় জড়ানো
facebook
মন খারাপ ইমো আরো কয়েকটা দরকার আমাদের, একটাতে চলছেনা!
বাহ ...
খুব মায়াময়।
আম্মা আমাকে ভাত গোল্লা বানিয়ে খাওয়াতেন। ওগুলোকে কাকের ডিম, উট পাখির ডিম, ঘোড়ার ডিমসহ বিভিন্ন প্রাণীর ডিম বলতে হতো।
আহ...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
মনে পড়ল, আমাকেও এভাবে খাওয়াতো............
হা হা হা! মিলে গেছে!!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
সচলে এই সব লেখা ব্যান করা দরকার
তুমি মন খারাপ করা কিছু লিখবানা, মন খারাপ হইলেওনা। বইসা থাকি তোমার কাছ থিকা মজার কিছু পড়ার জন্য।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
মায়াময় মা।
দিনগুলি যে কই হারালো!
আমার ছোট বেলার ভাত খাওয়া সংক্রান্ত স্মৃতির সাথে জড়িত হলো আব্বা। মানে আম্মাই খাওয়াতো, কিন্তু বেশি ইন্টারেস্টিং ছিলো যখন হঠাৎ হঠাৎ আব্বা খাওয়াতো। আব্বার ভাত মাখানো ছিলো ঘন ডাল দিয়ে, অল্প ঝোল থাকবে, বেশ একটু মাখা মাখা, কেন যেন এই স্বাদটা আমি আর কারও ভাত মাখানোতে এখনো খুঁজে পাই নাই, আর নিজেও শত চেষ্টা করেও ঐরকম করতে পারি না! কিন্তু আব্বা ভাত খাওয়ায় দেয়ার অর্থ ছিলো আসলে তুমুল সব গল্প! এইসব গল্প কখনো শেষ হতো না, মোটামুটি শেষ হয়ে আসলে আব্বা তার থেকে ইন্সট্যান্ট আরও বানাতে থাকতো, সেটা টারজানের অ্যাডভেঞ্চার থেকে শুরু করে আলাউদ্দীনের স্পেশাল আশ্চর্য প্রদীপ হতে পারে, আবার একটা পিচ্চি ছেলের রাগ করে না খেয়ে ঘুমায়ে যাওয়ার পরে ঘুম ভেঙে নিজেকে পিঁপড়া হয়ে যাওয়া আবিষ্কার করেও হতে পারে! এখনো অনেক গল্প মনে আছে।
রঙিন ভাই, আরও ধরেন গিয়ে হপ্তাখানেক আছে হাতে, চাচীকে জ্বালাতন বন্ধ করেন, নিজে আর কত ভাত খাবেন? এইবার আমাদের সব্বাইকে একটা দাওয়াত দেন। দরকার লাগলে বলেন, আমরা ব্যবস্থা করতেছি, ভালোমন্দ দাওয়াত খাওয়ার জন্যে খাটাখাটনি করতে অনেক সচলকেই রেডি পাবেন, খালি আওয়াজ দিয়ে দেখেন!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
হয় দেশ থেকে ঘুরে আসেন, নাহলে মাকে কিছুদিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে রাখেন।
এরকম লেখা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে ইচ্ছা করে না।
নতুন মন্তব্য করুন