২০০৯। গ্রীষ্মের ছাঁতিফাটা গরমে হাসফাঁস করছে কলকাতা। আমরা আধো অন্ধকার আলোর মধ্যে ঘরময় বইয়ের স্তুপের ভেতরে বসে আছি। আমার চোখ কবি ও প্রাবন্ধিক তরুণ স্যানালের মুখের উপর স্থির। দু'কান - প্রাণভরে তার কথা শুনছে। কথা বলতে বলতেই- মাঝে মাঝে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে জানালার পাশে বেড়ে ওঠা রক্তজবা গাছটির পাতার ফাঁক গিলে আকাশের দিকে। ঝাকড়া চুলের মত বেড়ে ওঠা এই রক্তজবার চারাটি তিনি বয়ে এনেছিলেন সেই সূদুর পাবনা থেকে। যে মাটিতে এই রকত্জবা ঢাঙর হয়ে উঠেছে - সেই মাটিও কলকাতার নয়। সে মাটিও পাবনার মাটি। তার জন্মভূমির। তার কথার স্রোতে ফিরে ফিরে আসছিল দেশভাগের কথা। রাজনীতির কথা।সাহিত্যের কথা। কথার অনর্গল স্রোতের স্বাভাবিক প্রসঙ্গগুলো ছেড়ে হটাৎ তিনি বলে উঠলেন অন্যরকম একটি কথা। আকাশ- আকাশের গায়ে গাছ... সেখান থেকে দৃষ্টি নামিয়ে তিনি শিশুর সারল্যমাখা স্মিত হাসি মুখে জড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। তার দুইচোখে দুষ্টুমী খেলা করছিল। একটা অসহয়ায় বিষন্নতাও সেখানে ঝিলমিল করছিল।
বুড়ো বয়সে মানুষের কি লাগে জানো?
আমি উৎসুক তাকিয়ে থাকি।
একটা জানালা, একরত্তি আকাশ আর একটা গাছ। - এইটুকু হলেই তার চলে।
আমি হাসি। তিনি আবার কথায় ফিরে আসেন।
তার বলার ঢঙটা ছিল সুন্দর। খুব সুন্দর। সম্মোহনী। শব্দগুলো তার ভঙ্গীটা পুরো প্রকাশ করবে না- তবুও তার কথ্য শব্দগুলোর কিছু কিছু অংশ প্রায় সম্পাদনা ছাড়াই বিষয়ভিত্তিকভাবে এখানে রইলো। সম্পাদনা ছাড়া - এই কারণে যাতে, তার কথার ভাবটা যদি এতে ফোটে।
দেশভাগের স্মৃতি
আমি ১৯৪৭ সালে তৎকালীন রাজশাহী জেলার নওগার ট্রেনিং স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন আমার যথেষ্ট পরিণত বয়েস। ১৪ - ১৫ বছর বয়স। আমাদের ক্লাসে এক ছেলে পড়তো - তার নাম ইসমাইল চৌধুরী। মুসলিম ছেলে। তার বাবা ছিলেন কোর্টের মোক্তার। তারা যেই বাড়িতে থাকতো সেটা এখনও মনে পড়ছে। সেই খানে থাকতেই দেশটা ভাগ হলো। তো ভাগ হবার সময়ে মিছিল টিছিল হলো। পতাকা মিছিল। তো - পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ কি তাও লোকে ঠিক মতো জানে না। একটা বড় সবুজ কাগজ। তারপাশে সাদা কাগজ কেটে চাঁদ তারা তৈরী করে - সেটা সবুজের উপর লাগিয়ে দিলে- সেটাই মিছিলের পতাকা। ওরা তৈরী পতাকাটাই ভাবছে ফ্ল্যাগ, আর জাতীয় সঙ্গীত- কিছুই জানে না। তো এ স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে নিয়ে মিছিল টিছিল হলো কিন্তু কেউ সাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান দেয় নি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছে, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ বলেছে, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই বলেছে । ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাষ্ট এই ঘটনাটা ঘটল।
কিন্তু আমার বন্ধু ইসমাইল এই মিছিলে ছিল না। উপরন্তু তাকে ২ - ৩ দিন পাওয়াই যায় নি। তো তার বাবা মা আমাদের কয়েক বন্ধুকে ডেকে নিয়ে বললেন - তোমরা কি ওকে দেখেছো? এর পরে যেটা হলো নওগাতে উকিল পাড়া - সেই উকিল পাড়াতে একটা বড় গাছ, কামরাঙ্গা গাছ, তার বড় ডালে দড়ি বেধে আত্মহত্যা করেছিল ইসমাইল। শুধুমাত্র পচা গন্ধতে কাক এবং শকুন নামছিল বলে লোকজন গিয়ে দেখল একটা মৃতদেহ ঝুলছে। সে ইসমাইল। দেশভাগ আর ইসমাইলের মৃত্যু কেন?
জানতে পারা গেল - তার বাবাকে ইসমাইল একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে।
সেই চিঠি থেকে জানতে পারলাম সেই বহু আগে -
সে যখন জন্মেছিল, তার জন্মাবার কয়েকমাসের মধ্যে তার বাবা মা দুজনেই পদ্মার নোনা ইলিশ খেয়ে কলেরায় মারা যান। তার বাচ্চাটাকে রক্ষা করার কেউ ছিল না। যাকে ইসমাইল বাবা বলেছে ইসমাইলের আসল বাবা ছিলেন তার সহকর্মী। তিনি বাচ্চাটাকে নিয়ে ইসমাইলের আত্মীয় পরিজন অনেকের কাছে গেছেন। কিন্তু বাচ্চাটাকে কেউ রাখে নি। তখন বাচ্চাটিকে এরাই বড় করেছে। নাম দিয়েছে ইসমাইল - কিন্তু যেটা বলে সুন্নত এ খতনা সেটা দেন নি। ইসমাইল বড় হলো, তাকে কেউ কিছু বলে নি। কিন্তু দেশ যখন ভাগ হয়েছে - তখন তার বাবা ইসমাইলকে ঘটনাটা বলেন। তার সত্যিকারের যারা আত্মীয় তারা হিন্দুস্তানে চলে যাবেন। পরে যদি ইসমাইল বলে আমার আত্মীয় পরিজন থাকতে তোমরা বলো নি কেন- এই চিন্তা করে তিনি ইসমাইলকে তার বৃত্তান্তটা বললেন।
ইসমাইল মারা যাওয়ার আগে চিঠিটায় লিখেছে -
“তোমরা ঘটনাটা আগে বলনি কেন? বা তোমরা আমাকে মুসলমান করনি কেন? আমি যে দেশে জন্মেছি - যাদের বাবা মা জেনে বড় হয়েছি - সে দেশটাও আমার নয় -সেই বাবা মাও আমার নয়। শুনেছি যারা আমার আত্মীয় পরিজন- ঐ দেশে চলে যাবে। তাদের আমি আত্মীয় পরিজন বলে ভাবি না। সেই মাটির দেশ আমার নয়। কোনটা আমার দেশ আমি জানি না।”
১৪ - ১৫ বছরের ছেলেটা আত্মঘাতি হয়েছে।
এটা আমার দেশভাগের প্রথম ট্র্যাজেডি।
৯৬ সালে আমি যখন বাংলাদেশে গেলাম। তার আগে প্রফুল্ল চাকির ১০৮ তম জন্মবার্ষিকী হচ্ছে বগুড়া শহরে। প্রফুল্ল চাকির বাড়ি ছিল বগুড়া শহরের কাছে বিহার নামের একটা গ্রামে। প্রফুল্ল চাকি - ক্ষুদিরামের আগে শহীদ। তিনি আত্মহনন করেছিলেন। প্রফুল্ল চাকির আসল নামটা ছিল দিনেশ রায়। প্রফুল্ল চাকি তার গোপন পরিচয় ছিল। তার পরিচয় কেউ জানে না বলে কলকাতার পুলিশ মজফফরপুর শহরে তার গলাটা কেটে শরীরটাকে দাহ নয় - কবর দিয়ে মাথাটা নিয়ে এসছিল। কে এই লোকটা? পরে মাথাটা গড়িয়াহাটাতে যেখানে এখন গোয়েন্দা দপ্তর সেখানে কোন একটা পার্কে নাকি পুতে রেখেছিল। এখনও পর্যন্ত কলকাতা রহস্য যে কোথায় প্রফুল্ল চাকির মাথাটা আছে। আমি সেই প্রফুল্ল চাকির জন্মবার্ষিকীতে বগুড়া গেলাম। নওগা বগুড়া থেকে কাছে । আমি নওগা গিয়ে সেখানে ইসমাইলের বাবা মার খোজ করলাম। যেখানে ওর বাবা মা থাকতেন সেখানে অন্য বাড়ি - তাদের কথা কেউ জানে না। ইসমাইলকে কেউ মনেই রাখে নি। তার বাবা মা কে কেউ মনে রাখে নি।
আসলে দেশবিভাগটাই এই।
পরবর্তী যে জেনারেশন - তারা তাদের যা কিছু সম্পদটম্পদ ছিল সেটা কে নিয়ে এগিয়ে গেল। বেদনাটা কেউই ঠিক ভেতরে রাখে নি। বেদনাটা আমরা মনে রাখতে চাই না। বেদনাটা ভুলতে গিয়ে আমরা বেদনাটা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারি না।
শহীদুল্লাহ অনেক খোলামেলা মানুষ ছিলেন। যা দেখতেন বিচার করে সেইটিই নিতেন। যখন তিনি পালি ও সংস্কৃত পড়েন তখন ওখানকার ব্রাহ্মন পন্ডিতেরা কি রকম তার সাথে নিষ্ঠুর আচরন করেছিল। ব্রাহ্মনের বাইরে এই ভাষা জগতে কেউ বলবে না - বলাটাও পাপ। সেই সময় যিনি ওদের শিক্ষক, পন্ডিতমশাই তাকে ক্লাসের বাইরে বসতে দিয়েছিলেন। তিনি কিছুদিন পড়ে একটা বিশেষ শ্লোক পড়তে দিয়েছিলেন। সব ক্লাসের ছেলেদেরকে সাতদিন পরে তাকে দেখিয়ে এবং মুখে উচ্চারন করতে হবে। সাতদিন পর দেখা গেল শহীদুল্লাহ সাবেই একমাত্র সেটা সঠিক উচ্চারন করে বললেন।
- তুই কি করে বললি, ম্লেচ্ছ?
- আমি প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে গঙ্গা স্নান করতাম যা ব্রাহ্মণদের করার কথা। যখন খেতাম - সন্দভ লবণ দিয়ে আতপ চালের ভাত খেতাম, ঘি দিয়ে। সাতদিন এভাবে আমি চর্চা করেছি। এর ফলে আমার জিবটা পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল।সংস্কৃত উচ্চারনের জন্য
- আমি তোকে বলছি, এই ক্লাসে তুইই একমাত্র ব্রাহ্মণ। আর কেউ ব্রাহ্মন নয়। তুই আমার বাড়িতে যাবি। কালকে দুপুরে খেতে তোকে নেমতন্ন করছি।
তো শহীদুল্লাহ সাহেব সত্যি গেলেন। গিয়ে দেখলেন আগেকার দিনে খাবার যে কায়দা ছিল - সে কায়দায় দুটো আসন পাতা আছে। একটা আসন শহীদুল্লাহকে দেখিয়ে তিনি বললেন
-তুই এইটায় বোস - আমি এইটায় বসি। হাতটা ধুয়ে আয়।
ব্রাহ্মনের স্ত্রী দুজনকে থালায় করে খাবার দিয়ে বললেন
- বাবা আজকে আমার খুব পূণ্যের দিন। কারন আমাদেও পুত্র নেই – সবসময় আমাদেও দুজনকেই সবসময় খেতে হয়। আজকে আমি একটা পুত্র পেলাম।
তিনি তাকে এটা কি করে খেতে হয় ওটা কি করে খেতে এসব বলতে বলতে পুত্রের মত ছেলেটিকে খাওয়ালেন।
পরবর্তীকালে যখন কোন প্রশ্ন উঠেছে ভাষা নিয়ে – সংস্কার যেটা হয় মানুষ সেটা তৈরী করে পরিবেশের জন্য। আর আসলে মানুষ যেটা সত্যিকারের যেটা জানে সেটি উত্তীর্ণ হয়ে যায়। সেই ব্রাহ্মন ক্লাসে ছিলেন সংস্কারচ্ছন্ন। কিন্তু একটা উপযুক্ত ছাত্র পাওয়া যাওয়ার পরে তিনি সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলেন।
নলিনীকান্ত ভট্টশালী আসলে জ্ঞানে বুদ্ধিতে যিনি পন্ডিত মানুষের সাথে ব্রাহ্মনে কোন পার্থক্য নেই। তার কাছে শহিদুল্লাহ সাহেব ছিলেন ব্রাহ্মন আর শহিদুল্লাহ সাহেব এর কাছে নলিনীকান্ত ছিলেন বুজুর্গ।
অডিও ভিজ্যূয়াল এর যুগে লেখার ভবিষ্যত প্রসঙ্গে
সাধারন মানুষের একটা ভাষা আছে। শিক্ষিত পন্ডিতের একটা ভাষা আছে। লিখন রীতির একটা ভাষা আছে। লেভেষ্ট্রাউজ – বিখ্যাত নৃতত্ববীদ - তিনি বলতেন: লেখাটা হলো কমান্ড। যে লেখাটা পড়ে তিনি এক অদৃশ্য লোকের কমান্ডের ভেতর থাকে। তার রিঅ্যাক্ট করার কিছু নেই। কিন্তু যে লোকটা শোনে যে তৎক্ষনাৎ রিঅ্যাক্টও করতে পারে। ওর বক্তব্য সভ্যতা যত ডেভেলপ করবে তত শব্দের বাহূল্য কমে যাবে।
টিভি যে দেখছে বা শুনছে । সেটা যে দেখছে সে খুব ক্রিটিকালি ছবিটাকে ফেলে চলে যায়। টিভির কোন ছবিতো মনে থাকে না। কিন্তু তার কথাটা মনে থাকে। চোখের উপর ইমেজটা পড়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু ইম্প্রেসনটা পড়ে নি। ইমেজগুলো কিছু স্পেসেসেফিক জায়গাতে মনে পড়ে যায়, সব জায়গাতে না।
পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালী স্বত্ত্বা ও বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে
বাঙ্গালী জাতিসত্বা ,তার ভাষা সত্বা পেছনে কিন্তু শেকড়ে কিন্তু এই লোক সত্ত্বাটা আছে। এই লোক স্বতত্বাটা কিন্তু বিনষ্ট হয়ে গেলে জাতি স্বত্ত্বাটা ফিরিয়ে আনা যাবে না।
৮৯ সালে বাংলা একাডেমীতে গিয়েছি। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে কি অভিমত শামসুর রাহমান, মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান জানতে চাইছিলেন। আমি বলছিলাম -
সাহিত্যতো দুরকম। একটা সৃষ্টিশীল। গল্প, উপন্যাস, কবিতা যেগুলো মানুষের জীবন গড়ে। কবিতা আছে, চিত্রকলা আছে, চিত্রকলার সম্পর্কে আমাদের পুরনো জানাশোনাতো জয়নুল আবেদীন, তার পরবর্তী কালে সুলতানের ছবি ভাল লাগতো, কামরুল হাসানের ছবিতো লড়াই এর সময় খুবই পরিচিত হয়েছিল। আমাকে উনারা বারবার চাচ্ছিলেন আমি যেন কবিতা নিয়ে বলি। তো আমি কিছুতেই বলবো না। তবু জোর চলল।
তো আমি বললাম - বাংলাদেশের কবিতা আমি পছন্দ করি, আমার ভাল লাগে। এই কারনে আমি সমালোচনা করে বলতে পারবো না। লোকে যাকে ভালবাসে তার ভালমন্দ তফাৎ করতে পারে না। তবু শামসুর রাহমান বারবার বলতে লাগলেন বলুন না .. কি মনে হয় , কি মনে হয়।
আমি তোমাকে যেটা বলতে চাইছি - বিশেষ করে শব্দ সাহিত্য শব্দ শিল্প যেমন ধর পুতুল পুতি এগুলো ওয়ার্ড বা সিম্বল। একটা আইডল বা একটা ইমেজ- প্রত্যেকটা শব্দ। একজন কবি তিনি হলো সেই জায়গার আইডোলেটর। অন্যরা যেভাবে শব্দ ব্যবহার করেন কবিতো সেইভাবে শব্দ ব্যবহার করেন না। এখন যে পৌত্তলিক তার কাছে কিছু পৌরাণিক ইমেজ আছে। আমি ভারতীয় কবি, একজন ভারতীয় বাঙ্গালী কবি হিসেবে একটা উত্তরাধিকার আছে। পুরনো কাল হতে হতে আমি এখন জীবনানন্দ দাশের উত্তরাধিকার। তুমি বললে এখন হবে না। দেশ যখন ভাগ করেছিলে তখন তোমার কাছে কবি মনে হয়েছিল তোমাদেও ওকানে যে সমস্ত কবিরা ছিল - বেনজির আহমেদ .. তাদেও কে বড় কবি হিসেবে প্রচার করা হত। জীবনানন্দ না, বিষ্ণু দে ও না - এমনকি তোমাদেও দেশে রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে তুমি একটা আগ্রাসনের ভেতরে ছিলে। আক্রান্ত মানুষ হিসেবে বার বার খুজে খুজে তোমার ভাষাকে বের করেছো, ভাষা। কিন্তু ভাষার সঙ্গে অজস্র ইমেজ আছে যেগুলো রিলিজিয়াস ইমেজ হয়। হিন্দুরা নিয়েছে রামচন্দ্রকে, রিলিজিয়াস- একটা গডলাইক -সীতা, একটা এপিক হিরোইন- অর্জূন কর্ণ এরা সব হিরো হিরোইন – একটা জাতির এগুলো সব ইমেজ। ইলিয়াডে কে বের হচ্ছে , আগামেমনন হেলেন .. এরা ইউরোপীয় সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফরাসী পন্ডিত সাঁত্রে যখন মাছি লিখছেন তিনি কিন্তু অরেষ্ট্রিসকে নিচ্ছেন - পুরনো গ্রীক কাহিনীতে ফিরে যাচ্ছেন। আর তুমি - তোমাকে এমন জায়গায় ঠেলে আনা হয়েছে যেখানে তোমার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নাই। তোমার ঐতিহ্যকে টেনে ছিড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যে অংশটা তোমাকে ছিড়তে ছিড়তে যে কান্ডটা করেছে - ভারতবর্ষে যে উত্তরাধিকার তোমার , সেটাকেও বাতিল করে দিয়েছে। ফলে যে মূহূর্তে তুমি এগুলো ভূলে যাও - এতগুলো তোমার সম্পদচ্যূত হয়ে তুমি যেখানে দাড়িয়ে আছো- যাদের সেই সম্পদটা আছে তাদের সঙ্গে তো তোমার তুলনা করতে পারবে না। মুশকিলটা হচ্ছে তোমাকে এইসব সম্পদ ফিরে পেতে হবে এবং আরো নতুন সম্পদ যুক্ত করতে হবে- যেটা পশ্চিম বঙ্গে নাই পূর্ববঙ্গে আছে। এটা কি? লোক জীবনের যে মহিমা- তার জীবনচারণ। পশ্চিমবঙ্গে জসিমউদ্দিনের মত কোন কবি নেই। কিন্তু পূর্ব বাংলায় ছিলেন। আসলে সোজন বাদিয়ার ঘাটই বলো আর নক্শী কাথার মাঠই বলো সেখানে তুমি তোমার ফোক আইডিন্টিটি খুজে পাবে। আর ফোক আইডেন্টিটির পাশাপাশি অসংখ্য ষ্টোরিজ আছে। এগুলো যোগ হতে পারে। আমি শামসুর রাহমানকে শুধু বললাম - তোমাদের কবিতা ম্যাচিউরিটি পাচ্ছে। শামসুর রাহমান বোধহয় মানতে পারেনি, একটু কষ্ট পেয়েছিল।
লোক জীবনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে যেটি পশ্চিমবঙ্গে নাই। পশ্চিমবঙ্গে সবসময় আদ্দেক লিটারেচার হয়। যারা লিখেছেন এখানে তাদের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র হয়ে তারাশঙ্কর হয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় – যারা উচ্চ হিন্দু শ্রেণীর চোখ থেকে লিখছেন। কিন্তু বাংলাদেশে যারা লিখছেন , ওয়ালিউল্লাহর লাল সালুর কথাই ধরা যাক - সেখানে ওয়ালিউল্লাহ যেভাবে নিম্নবিত্তের কথা দেখাচ্ছেন শরৎচন্দ্র কিন্তু সেভাবে নিম্নবর্গকে দেখাতে পারেননি। আখতারুজ্জামান যখন খোয়াবনামা লেখে তখন পুরো সোসাইটিটা উঠে আসে। ওয়ারিশ -শওকত আলীর, ওখানে বিরাট একটা সময় দেখা যাচ্ছে। শওকত আলীর ই আরেকটি উপন্যাস উত্তরের ক্ষেপ, অর্থাৎ ডিপরুটের নিচে যে লোকটা গাড়ি চালায় তাকে নিয়ে তৈরী উপন্যাস - এ বাংলা ও বাংলা একটা নতুন ব্যাপর। নাসরিন জাহানের উড়–ক্কু – চমৎকার একটা উপন্যাস। বাংলাদেশে উপন্যাসের ভবিষ্যতটা দারুন ভাল। কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা খালি কবিতার কথা বলেন।
আবার দেশ বিভাজন
রোটি বেটি চোটি তে মিল না হলে কখনও হয় না।
তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো তুমি গোটা কলকাতা শহরটা ঘুরে দেখবে - কোথায় উঠেছো?
মীর্জা গালিব ষ্ট্রিটে-
মীর্জা গালিব ষ্ট্রিটে আছো কেন? এটা মুসলিম পাড়া। তুমি কলেজ ষ্ট্রিটে কিংবা হামার ষ্ট্রিটে আসো না কেন?
এখানে একটা ঘেটো পলিটিক্সআছে।
এখানকার স্পেসিফিক বস্তিতে মুসলমান থাকে। স্পেসিফিক বস্তিতে হিন্দু থাকে।
এই আমাদের পাড়ার ভেতরে যত বাড়ি আছে তুমি খুব কদাচিৎ বাড়িতে মুসলমান ভাড়াটে পাবে। ভাড়া দেবে না। তোমার সঙ্গে গল্প করবে, চা বিস্কিট খাওয়াবে - এসব হবে। তার কাছে মনে হবে এ লোকটা এখানে এসে গরু খাবে। সে কিন্তু সেক্যূলার লোক। তার কোন সংস্কার নেই। কিন্তু কোন জায়গায় ঠেকে আছে।
অর্থাৎ দেশটা বিভাজন যখন হয়েছিল - মুসলিম যারা আশরাফ তারা আন্দোলনটা করেছিল। গরীব দুঃখীদের দুঃখটা ধরেছিল। আর এই দেশে পশ্চিমবঙ্গটা যখন আমরা রাখলাম তখন আন্দোলনটা হয়েছিল হিন্দুরা কোথায় যাবে? হিন্দু বলতে জমিদার অধ্যাপক ব্যরিষ্টার উকিল ইত্যাদি। আর যারা নিম্নবিত্ত মানুষ তারাও এল - তারা এল দন্ডকারণ্যে।
এই বিভেদটা রয়ে গেছে। ধর্মের ভেতরে অর্থনীতিটাও কাজ করেছে প্রবলভাবে। আমরা তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। চিন্তায়। যাপনে। রাজনীতিতে। সংস্কৃতিতে।
বাংলাভাষা
১৯৫৬ সালে আইনষ্টাইন মারা যান। সত্যেন বোস সায়েন্স কলেজে একটা বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি একটা ইংরেজী শব্দও ব্যবহার করেন নি।
আদতে আমরা আমাদের প্রতিশব্দটা ব্যবহার করিনা। আমরা বিদেশী ভাষার শব্দগুলো নিত্য ব্যবহার করি।
বাংলাভাষার একটা নিজস্ব শ্রেষ্ঠতা আছে । ইংরেজী শব্দ বা অন্য শব্দ এগুলো হলো যে ..আমরা যে দৃশ্যমান পৃথিবী দেখি গাছ, ফুল, লতা পাতা হাত পা বিশেষ্য - এই বিশেষ্য গুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ইংরেজী ভাষা, ফরাসী জার্মান, আর বাংলা ভাষাটা আদতে ক্রিয়াকে বেশি মর্যাদা দিয়েছে। এটা হলো ব্যকরণগতভাবে কৃদন্ত শব্দের বাহুল্য আছে আর ওদের তদ্ধিতান্ত শব্দের বাহুল্য আছে। ফলে দেখা যাচ্ছে চিন্তার দিকটা হলো সভ্যতার যদি স্তর বলো - একটা স্তরে যখন প্রকৃতিগতভাবে মানুষ ছিল – তখন বিশেষ্যর ভূমিকাই বেশি ছিল। যখন সে আরও বিকষিত হয়েছে তখন তার নানা কাজ এসছে, একশন এসছে, ভার্ব এসছে, ফলে ক্রিয়া ভিত্তিক জগতের যে ভাষাগত নির্মান, যে স্ফেয়ার - সেই অর্থে বাংলা ভাষাটা ইউরোপীয় ভাষা থেকে অনেক এডভান্সড।
তোমাদের ওখানে একজন - কলিম খান এই নিয়ে কিছু কাজ করেছে।
বাংলা ভাষার - অতীতে ঠিক এইরকম ছিল না।
একসময় গুপ্তরা এসছিলেন। তারা সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিলেন।
তারপর সংস্কৃতের পাশে অবহট্ট ঢুকেছে।
প্রাকৃতও এসছিল।
আসলে সংস্কৃত ভেঙ্গে যে অবহট্ট - কার্যত সেই ভাষাটাই পরবর্তীকালে বদলাতে থাকে। পাঠান আর মোগলেদের সময় ফার্সী তার সাথে যুক্ত হয়েছে। ফলে ভাষার ভেতরে আমরা ফার্সীকে বাংলাকরন করেছি। ফার্সী ভাষাও বাংলাকরন করা হয়েছিল। ফলে ফারসী ভার্বকেও বাংলা ভার্ব হিসেবে প্রকাশ করেছি আবার বাংলা ভার্বকেও ফার্সী ভাষায় প্রকাশ করেছি। এরপরে ইংরেজী এসছে। ইংরেজী শব্দকেও বাংলায় নিয়ে নিয়েছি। যেমন : জাদরেল - জেনারেল থেকে নিজেরা তৈরী করে নিয়েছি এরকম ফিরিঙ্গি গোরা - গোরা মানে ফর্সা লোক। এরকম অনেক শব্দ আমরা করে নিয়েছি। ফলে শব্দ সম্ভার বাঙ্গালীর ইংরেজদের থেকে বেশি। আমাদের শব্দ সম্ভার দেড় কোটিরও বেশি। আমরা এত শব্দ ব্যবহার করি নিজেরাই জানি না। অনেকে বলে একই শব্দের এত প্রতিশব্দ আছে এটা ঠিক না। মানে পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক না। কিন্তু এটা ঠিক না। মানুষ বা জাতি যে ভাষায় কথা বলতে চায় সেটি স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে তার দীর্ঘদিনের যাপনের মধ্য দিয়ে, পরিবেশের মধ্য দিয়ে ... আমরা সেই প্র্যাকটিসটা হারিয়ে ফেলতে পারি... তাতে যেটা হবে আমরা পেছন দিকে চলে যাবো ...
সূর্যটা তখন ডুবছে... তরুণ স্যানাল ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন-
মন্তব্য
অসাধারণ একটা উপস্থাপনা। দাদা পরের পর্ব আসুক শীগগির
ডাকঘর | ছবিঘর
কথা অমৃত সমান - ২ এর অপেক্ষাতে .............
অনেক কৃতজ্ঞতা।
ইতিহাস এই রুপে পরিবেশিত হলে কে আর অন্য পাতে যায়???
আলোচনাটা তাড়াহুড়োয় পড়লাম, খুব ইন্টারেস্টিং। ফিরে এসে আবার পড়ব।
কয়েক বার পড়লাম, উপলব্ধি করার জন্য আবারো পড়বো। খুব ভালো লেগেছে। পরের পর্বের অপেক্ষায়।
লেখাটা খুব ভাল লাগলো। ইসমাইলের ঘটনায় ১৪-১৫ বছরের একটা ছেলের চিন্তায় কেন এমন হতে পারে সেটা ভেবে পেলামনা।
তবে লেখায় দুবার শামসুর রাহমান এর নাম এসেছে, দুবার দুই রকম ভুল বানানে। অনুগ্রহ করে সম্পাদনা করে শুদ্ধ করে নেবেন।
আমার কাছে এটি একদম অস্বাভাবিক মনে হয় নি সাফি।
সাধারণত এই বয়সেই ছেলেমেয়েরা একটু আবেগপ্রবণ হয়। আমরা দেখবো এই বয়সেই একটা মেয়ে মায়ের বকুনী শুনে আত্মহত্যা করে। কিংবা একটি ছেলে - খুব সাধারন কারণে গৃহত্যাগী হয়।
আর ইসমাইলের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা তো আরো ভয়ানক।
সে জানলো, তার বাবা - তার আসল বাবা নয়।
সে জানলো, তার মা- তার মা নয়।
সে জানলো তার ধর্ম তার নয়।
তার বয়স যদি বেশি হতো- তাহলে সে কোন কিছুতে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারতো- কিন্তু বয়সের কারণেই সে সেটা পারলো না।
আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আমার ঐ বয়সটাকেই খুব স্বাভাবিক লেগেছে আমার কাছে।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সাফি। বানান- বিশেষ করে বিশেষ্য পদের বানান ভূল দূরূহমার্জনার বিষয়। আমি এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
এই ভূলটুকু ধরিয়ে দেবার জন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা...
ধন্যবাদ কর্ণজয়। তবে আরো দু জায়গায় ঠিক করা প্রয়োজন -
ঠিক করলাম- লজ্জ্বার সাথে-
আমাকে সংশোধনের সুযোগ দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা...
রাতেই পড়েছিলাম একবার... এখন আবার পড়লাম... দারুণ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আগেই পড়েছিলাম, অভ্র না থাকায় মন্তব্য করা হয় নি। আপনার অন্যতম সেরা রচনা
facebook
নতুন মন্তব্য করুন