মরুযাত্রার গত পর্বে লিখেছিলাম মিশর ভ্রমনের মূল আকর্ষনটাই এর ইতিহাস, তাই এই পর্বে সেই ইতিহাস নিয়েই লিখব। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাটি করতেই বুঝলাম এত বিশাল বিষয় নিয়ে আলাদা একটা লেখা লেখার মত শক্তি বা ধৈর্য্য কোনটাই আমার নেই। ফলে একটুখানি লিখেই রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলাম আর বদলে যা করলাম, তা হলো এই লেখার মধ্যেই যতটা সম্ভব প্রাসঙ্গিক ইতিহাস আর তথ্য ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু তাতেও আরেক সমস্যা - লেখাটা ভ্রমনকাহিনি না হয়ে বিশ্বকোষ বা রোলিং র্যাম্বলিং পাহাড়ি বোল্ডার জাতীয় কিছু হয়ে গেল। কি হলো না হলো জানি না, তবে এটুকু বুঝলাম যে এর চেয়ে ভাল লেখার ক্ষমতা আমার আপাতত নাই। কি আর করা – লিখে যখন ফেলেইছি.... এখন আপনি এই বোল্ডারের তলায় চাপা পড়বেন কিনা সেটা আপনার বিবেচনা। আর হ্যাঁ, মিশরের ইতিহাস নিয়ে ঐ প্রায় শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়া অসমাপ্ত খসড়াটা এখানে পাবেন।
.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:._.:*~*:.
Amid the desert of a mystic land,
Like Sibyls waiting for a doom far-seen,
Apart in awful solitude they stand,
With Thought's unending caravan between.*
|
১.
দীর্ঘ এপ্রোচ রোডের দূর থেকে কি ছোটই না দেখাচ্ছিল পিরামিডগুলিকে। এই দেখার জন্য এদ্দুর এসেছি ? কিন্তু না, তারপর তারা বড় হতে শুরু করল। প্রায় আলাদিনের জ্বিনের তৈরি প্রাসাদের মত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। রাস্তায় একটা বাঁক নিতেই মরুভূমি দৃশ্যমান হয়। আর সেই সাথে হঠাৎ করেই গিজা-র সেই বিশ্ববিখ্যাত পিরামিড-ট্রিনিটি আমাদের দর্শন দেন – ধূসর মরুভূমি আর স্বচ্ছ সুনীল আকাশের পটভূমিতে নগ্ন, নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ ঔদ্ধত্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো মানুষের অমরত্ব-বাসনার জাদুঘর হয়ে।
কি আকর্ষণে জানি না, হাজার-হাজার বছর ধরেই দেশ-বিদেশের মানুষ এখানে ছুটে আসছে। একবারের জন্যে হলেও বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে সালাম ঠুকে গেছে। এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি বুড়াবুড়ি, মাঝবয়সী, তরুণ-তরুণী সব পদের, সব জাতের মানুষই আছে এখানে। কেউ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে, কেউ চপ্পল ফটফটিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে, কেউ ভেতরে ঢুকার ধান্ধায় আছে, কেউ বা আবার উট-খচ্চর নিয়ে ঘুরঘুর করা তথাকথিত ‘বেদুইন’-দের কাছে কিছু ডলার খসিয়ে ঐসব জন্তুর পিঠে চড়ে বেড়াচ্ছে।
ফারাও খুফু-র পিরামিড। গিজা।
খুফুর পিরামিডের সামনে আমি স্থির দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পরিবেশটা। দেখতে দেখতে ফিরে গেলাম হাজার বছর আগে। মনে পড়ে গেল, আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেখানেই আড়াই হাজার বছর (৪৫০ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে) আগে ‘ইতিহাসের জনক’ হিসেবে খ্যাত গ্রীক ঐতিহাসিক মহামতি হেরোডোটাস এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই পিরামিড দেখতে। তার চারশ’ বছর পরে এসেছিলেন ইতিহাসের বিখ্যাততম ডিক্টেটর, সেনাপতি, ও রানি ক্লিওপ্যাট্রার প্রথম রোমান বিজেতা-প্রেমিক জুলিয়াস সিজার। তারও প্রায় ১৯০০ বছর পরে এসেছিলেন আরেক ডিক্টেটর ও মহাসেনানায়ক নেপোলিয়ঁ বোনাপার্ত। ইতিহাসের আরো কত অগণিত রাজা-বাদশা-উজির-নাজির যে এই রাজাদের রাজার সমাধিসৌধে এসেছেন তার হিসেব আমার জানা নেই। শুধু বহমান সময় আর মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে কেমন জানি একটা নতুন বোধোদয় হয়। এই বিশাল প্রাচীনত্বের সামনে হঠাৎ করেই দু’-আড়াই হাজার বছর আগেকার হেরোডোটাস, সিজার আর নিজেকে একরকম সমসাময়িক মনে হতে থাকে। প্রাচীন এই গ্রীক আর রোমানরা এই একবিংশ শতাব্দীর আমার থেকে যতটা না প্রাচীন – এই পিরামিডগুলি অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের থেকে তার চেয়েও বেশি প্রাচীন ছিল যখন সেই দুই হাজার বছর আগেও তারা সেখানে গিয়েছিলেন। সময়ের কি অবিশ্বাস্য বিস্তার চোখের সামনে। কোথায় সেই হেরোডোটাস, কোথায় মহাঅহমিকাময় মহান সিজার আজ। অথচ তাঁদের মনের কোনে যে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ছিল, যে আকাঙ্ক্ষার গহীন-গোপন-অচেনা তাড়নায় তারা এবং আমরাও অনেকে পিরামিড দেখতে যাই – সেই আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতার অপূর্ব মূর্ত প্রতীক হয়ে কি জীবন্ত ভাবে আজো দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীন প্রস্তরস্তুপ।
ফারাও খুফু-র গ্রেট পিরামিড। গিজা।
গিজা কমপ্লেক্সের প্রধান তিনটির মধ্যে উচ্চতম পিরামিডটি হল “গ্রেট পিরামিড অফ গিজা” বলে খ্যাত প্রাচীন মিশরের রাজবংশীয়-যুগের পুরনো-রাজত্বের চতুর্থ রাজবংশের ফারাও খুফুর জন্য নির্মিত পিরামিডটি। ফারাও খুফুর উজির হেমিউনু এর স্থপতি। এই পিরামিডের আদি উচ্চতা ৪৮১ ফুট। এখনকার একটা ৪৮ তলা বিল্ডিং-এর সমান উচ্চতা বলা যেতে পারে হয়তো। পাদদেশের প্রতিটি পার্শ্ব ৭৫৬ ফুট দীর্ঘ। পিরামিডটির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ২৩ লক্ষ পাথরের ব্লক। বড় ব্লকগুলির ওজন ২৫ থেকে ৮০ টন পর্যন্ত। এগুলির একাংশ আনা হয়েছিল নীলনদ দিয়ে প্রায় ৬০০ মাইল দূরে আসওয়ান অঞ্চলের পাথরখনি থেকে – যেখানে মরুযাত্রার একপর্যায়ে আমি যাব। পিরামিডটার বাইরের দিক এককালে বাইরের-পাশ পালিশ করা সাদা চুনাপাথরের মসৃণ “কেসিং স্টোন” দিয়ে ঢাকা ছিল – যদিও কালের পরিক্রমায় (এবং ১৩০০ সালের এক ভূমিকম্পের কারনে) সেই শুভ্র-মসৃণ বহিঃগাত্র এখন আর নেই, টিকে আছে শুধু ধাপযুক্ত ভেতরের মূল কাঠামোটি।
পিরামিডের তীরে মরুজাহাজের ব্রিজে
এই পিরামিড এক হিসেবে মানব ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ের জন্য মানবনির্মিত সর্বোচ্চ স্থাপনা হিসেবে টিকে থাকার রেকর্ডের অধিকারী – প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে ! এই পিরামিডই আদি সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে প্রাচীনতমটি এবং সেইসাথে বর্তমানকাল পর্যন্ত টিকে থাকা একমাত্রটিও বটে। এর নির্মাণ সম্পন্ন হয় ২৫৬০ খৃষ্ট-পূর্বাব্দে। এখন থেকে প্রায় ৪,৫৭১ বছর আগে। এরপর খৃষ্টোত্তর ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত (মধ্যযুগে কিছু পুড়ে যাওয়া স্পায়ারওয়ালা চার্চের স্পায়ারগুলি বাদ দিলে) সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এটাই ছিল সর্বোচ্চ স্থাপনা। অন্যমতে খুফু পিরামিডের এই রেকর্ডের স্থায়িত্ব ৩৮০০ বছর বৃটেনের মধ্যযুগীয় লিঙ্কন ক্যাথেড্রালের স্পায়ার হিসেবে নিলে (যা আবার পুড়ে গিয়েছিল কিছুদিন পরে)। তা যাই হোক, ৩৮০০ বা ৪৫০০, এই রেকর্ডের ত্রিসীমানাতেও আর কেউ নেই। সময়ও ভয় পায় এদের। একটা আরব প্রবাদ আছে -- “সারা পৃথিবী ভয় পায় সময়কে, আর সময় ভয় পায় পিরামিডকে।”
গিজার পিরামিড রহস্যের উপর CNN-এর দারুন একটা সাম্প্রতিক রিপোর্ট
২.
ঘোর কাটিয়ে আমি আস্তে আস্তে এগুতে শুরু করলাম। গিজা মালভূমির এই সমাধিনগর, এই বিখ্যাততম পিরামিড-ট্রিনিটি কায়রো শহর থেকে প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুভূমির ভেতর (তবে আমি কায়রোর গিজা ডিস্ট্রিক্টের যে বহুতল ভবনের ১৮/১৯ তলায় থাকতাম তার বারান্দা থেকে খুফুর পিরামিডের ঊর্ধ্বাংশ ঝাপসা দেখা যেত)। এখানে প্রধানত তিনটি পিরামিড – ফারাও খুফুর সর্বোচ্চ পিরামিড, ফারাও খাফ্রের পিরামিড আর ফারাও মেনকাউরের পিরামিড। আর আছে ‘সোলার বোট মিউজিয়াম’, আর সেই বিখ্যাত “গ্রেট স্ফিংক্স”। এছাড়াও কিছু দূরে নাকি বৃহত্তর কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবেই আছে আরো কিছু ছোট পিরামিড ও বিভিন্নরকম প্রাচীন সৌধ, স্থাপনা ইত্যাদি। তবে সেগুলি আমার দেখার সুযোগ হয়নি – কিম্বা মনে নেই।
খুফুর বিখ্যাত পিরামিডের কথা আগেই বলেছি – সুদীর্ঘকাল এটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা ছিল। এই পিরামিডের সাথে অনেক রহস্যও জড়িত আছে। যারা ডিস্কাভারি ইত্যাদিতে পিরামিড নিয়ে নানারকম ডকুমেন্টারি দেখেছেন তারা সেসব ভালই জানেন। এইসব পিরামিডের নির্মাণকৌশল এখনো এক বিশাল রহস্য – এই একবিংশ শতাব্দীর সর্বাধুনিক কম্পিউটার ও অন্যান্য টেকনোলজি সত্বেও। একাধিক তত্ত্ব আছে, কিন্তু কোনটাই এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞমহলে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কোন আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াই এত সহস্র বছর আগে, ইতিহাসের সেই ঊষালগ্নে এত বিশাল, জটিল, প্রায় অকল্পনীয় এক কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করার অতুলনীয় মানবিক কীর্তি যুগে যুগে মানুষকে আকর্ষণ করেছে, রহস্যতাড়িত করেছে।
কিন্তু আমাকে আরো বেশি রহস্যতাড়িত বা কৌতুহলতাড়িত করে এইসব পিরামিডের সাথে জড়িত নানারকম রহস্যময় বা ব্যতিক্রমী ঘটনা ও কাণ্ডকারখানা। যেমন ধরুন, এইসব পিরামিডে ফারাওদের সাথে সাথে অতুলনীয় ধনসম্পদও সমাহিত করা হত পারলৌকিক জীবনে তাঁদের কাজে লাগবে বলে। কিন্তু চোরায় না শুনে ধর্মের কাহিনি। সেই বহু সহস্র বছর আগে ফারাওদের সময় থেকেই পিরামিডের ধনসম্পত্তি চুরি হয়ে আসছে (ইন্ডিয়ানা জোন্স তো এই সেদিনকার ছোকরা!)। সত্যি কথা বলতে কি, ইতিহাসের সর্বপ্রথম নথিবদ্ধ চুরির মামলা কয়েক সহস্র বছর আগে সেই প্রাচীন মিশরেরই এক পিরামিড চোরের বিরুদ্ধে! ব্যাটা ইতিহাসের প্রথম চোর ! সেই চোর এবং চুরি সম্পর্কে হিরোগ্লিফেক্সে লিপিবদ্ধ বিবরণের প্যাপিরাসও আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এই চোরদের ঠেকাতে আবার পিরামিডের ডিজাইনাররাও নানারকম কূটকৌশল অবলম্বন করতেন – পিরামিডের ভেতর নানারকম ফাঁদ, রহস্যময় বা বিভ্রান্তিকর টানেল, দীর্ঘ কানাগলি, গুপ্তকক্ষ, নকল-ডিকয়-ডুপ্লিকেট-ট্রিপ্লিকেট সমাধিকক্ষ -কত কিছুই না তারা বানিয়ে রাখতেন। অনেক চোর, ডাকাত, বিজেতা-লুটেরা বিদেশি আক্রমণকারী এতে প্রতারিতও হয়েছে। এই কাণ্ড খুফুর পিরামিডেও ঘটেছে। এর ভেতরেও আছে রহস্যময় টানেল, নকল সমাধিকক্ষ (ছবির “কুইন্স চেম্বার” দ্রঃ), ইত্যাদি।
প্রাচীন মিশরের “মধ্যবর্তী রাজতন্ত্রের” (২০৫৫ খৃঃপূঃ – ১৬৫০ খৃঃপূঃ) যুগেই নিশিকুটুম্বের অনুপ্রবেশ ঘটেছে খুফুর পিরামিডে। তারপরে আরো বহুবার। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস পর্যন্ত মিশরে গিয়ে সেই মহান চৌর্যবৃত্তির কাহিনি শুনে এসেছেন। তবে হেরোডোটাস যাওয়ার আগেই হয়তো ভেতরের ধনসম্পদ সব হাওয়া হয়ে গেছে।
পিরামিড ডাকাতির উপর ডিস্কাভারির ভিডিও ক্লিপ
খুফুর পিরামিডে সবচেয়ে বিখ্যাত অনুপ্রবেশকারী লুটেরা হচ্ছেন সম্ভবত আরব্য উপন্যাসখ্যাত খলিফা হারুন আল-রশিদের সুযোগ্য পুত্র খলিফা আব্দুল্লাহ আল মামুন। ৮২০ খৃষ্টাব্দে তিনি খুফুর পিরামিডে ঢুকেন। তবে অনেক খাটা-খাটুনি খোঁড়াখুঁড়ির পরেও, এমনকি “কিংস চেম্বার” ও “কুইন্স চেম্বার” (ছবি দ্রঃ) পর্যন্ত পৌঁছেও বেচারার ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তার অনেক আগেই সম্ভবত....! না-পাওয়ার রাগের ঠেলায় মামুন সাহেব এই পিরামিডের অনেক ক্ষতিসাধন করেন। (আমি এই কিংস-চেম্বার পর্যন্ত গিয়েছি উপরের প্রবেশপথ দিয়ে। প্রবেশমুখের ছবি দ্রঃ)।
ফারাও খুফু-র পিরামিডের জ্ঞাত নকশা।
আধুনিককালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর ভেতরে এমনকি মমিটাও পাওয়া যায়নি (মামুনও এটা পাননি) – গুপ্তধন দূরে থাকুক। শুধুই ঢাকনাবিহীন খালি স্যাকোফ্যাগাস। তবে এই নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে – মমি আর মণিমাণিক্য আসলেই লুট হয়ে গেছে নাকি আরো গহীন-গোপন কোন অনাবিষ্কৃত কুঠুরিতে লুকানো আছে যা এত হাজার বছর ধরেও চোরেরা কিম্বা প্রত্নতাত্ত্বিকরা সন্ধান পাননি – তা নিয়ে খানিকটা দোটানা আছে।
ফারাও খাফ্রে-র পিরামিড। গিজা।
আমি খুফুকে ছাড়িয়ে খাফ্রের পিরামিডের দিকে এগোই এবার। এটাও প্রায় ৪০-৪৫ তলা ভবনের সমান হবে বোধহয়। আদি উচ্চতা ৪৭১ ফুট, বর্তমানে ৪৪৮। এর চূড়ায় মসৃণ ‘কেসিং স্টোনের’ একটুখানি অবশেষ এখনো রয়ে গেছে (ছবি দ্রঃ)। খাফ্রে ফারাও খুফুর সন্তান। এর পিরামিডটা এখানে ২য় সর্বোচ্চ এবং একটু উঁচু ভূমিতে নির্মিত বলে আরো বড় দেখায় অনেকসময়।
এই লেখায় যদিও আমি এখানকার প্রধান তিনটি পিরামিড মিলেই গিজা পিরামিড কমপ্লেক্স বলছি, আসলে এখানকার প্রতিটি পিরামিডেরই নিজস্ব একটা কমপ্লেক্স ছিল। এই কমপ্লেক্সে মূল পিরামিড ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকত, এখনো যার কিছু অবশেষ রয়ে গেছে।
ফারাও খাফ্রে-র পিরামিড। গিজা।
এই পিরামিডগুলি সবসময় এখনকার মত এমন নিঃসঙ্গ চেহারার ছিল না। হলদে-ধূসর শূন্য মরুভূমির ধূ ধূ বালুর মধ্যে তাদের এই রুক্ষ নিঃসঙ্গ ঔদ্ধত্য মোলায়েম হয়ে যেত পিরামিডকে ঘিরে থাকা সীমানাপ্রাচীর, সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে পিরামিডের পাদদেশ ঘিরে থাকা চুনাপাথরের সাদা মসৃণ স্ল্যাবে ঢাকা উন্মুক্ত টেরাস , সেই টেরাসের মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘ কজওয়ের মাধ্যমে পিরামিডের সাথে সংযুক্ত বহু মূর্তি, ভাস্কর্য, আর কলাম শোভিত সংশ্লিষ্ট ফারাওর স্মৃতিতে নিবেদিত বিশাল স্মৃতিমন্দির। আশেপাশে ঘিরে থাকত কিছু খুদে গৌণ পিরামিড ও মন্দির। থাকত এবং আছে স্ফিংক্স। গাছপালা থাকত কিনা জানি না, তবে আমার কেন জানি সন্দেহ হয় গাছপালা আর জলাশয়ের ব্যবস্থাও থাকত – কৃত্রিম প্রচেষ্টায় হলেও। কিম্বা তা না থাকলেও নীল বেশি দূরে নয়। আর সবকিছুর মাঝে শ্বেতশুভ্র মসৃণ বহিঃগাত্র নিয়ে স্বর্নোজ্জ্বল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত সেই অভ্রভেদী মূল পিরামিড। কারো কারো মতে খুফুর পিরামিডের চূড়া (capstone) ছিল সোনায় মোড়া। এই সোনার চূড়া নিয়ে অনেক কাহিনি আছে (
১,
২)। আর হ্যাঁ, নিশ্চয়ই থাকত বিশাল একদল পুরোহিত বাহিনী স্মৃতিমন্দিরের পরিচর্যা আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য। এবার চিন্তা করুন দৃশ্যটা আর তুলনা করুন এখনকার সাথে!
স্বর্নশৃঙ্গ খুফুর পিরামিড। কাল্পনিক।
কি ছিল আর কি আছে ভাবতে ভাবতে আমি যেন প্রাচীন মিশরেই চলে গেছিলাম। ঘোর কাটতেই বর্তমানে ফিরে এলাম আর মনে পড়ে গেল আরো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে দেখার।
পিরামিড-ট্রিনিটির মধ্যে তৃতীয় অর্থাৎ ফারাও মেনকাউরের পিরামিডটা স্মৃতিতে আসছে না। সুতরাং এটা বাদ দেই এখানে। তবে এর সাথে জড়িত একটা মজাদার কাহিনি না বললেই নয়। এই পিরামিড ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল – এটুকু মিশরে থাকতেই কারো মুখে শুনেছিলাম। কিন্তু এই লেখাটা লিখতে গিয়ে ইন্টারনেটে সেই ধ্বংস-প্রয়াসের চমৎকার একটা বিবরণ পেয়ে গেলাম যা পড়ে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিনা (তবে হাসার পক্ষেই মন সায় দিচ্ছে!)। কাহিনিটা এইরকম –
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইতিহাসখ্যাত গাজী সালাউদ্দিনের পুত্র আল-মালেক আল-আজিজ ওসমান বিন ইউসুফ পিরামিডগুলি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। মালেক তার ধ্বংস মিশনের বউনি করেন মেনকাউরের পিরামিড দিয়ে। কিন্তু অতি শিগ্গির মালেক বাহিনী আবিষ্কার করলেন যে একটা পিরামিড ধ্বংস করা আরেকটা পিরামিড বানানোর চেয়ে কোন অংশেই কম ব্যয়বহুল না। তারপরও আট মাস ধরে তারা ধনুর্ভঙ্গ পণ করে তাদের চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ক্লান্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেও, দিনে একটা বা দু’টার বেশি পাথর সরাতে সক্ষম হননি। তাদের কেউ গোঁজ ঠুসে বা লিভার দিয়ে পাথরগুলি সরাতে চেষ্টা করেন, আবার কেউবা দড়ি ব্যবহার করে সেই পাথর টেনে নামানোর চেষ্টা করেন। বিশাল পাথরের ব্লকগুলি যখন অনেক উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ত তখন সোজা বালুর অনেক গভীরে সেঁধিয়ে যেত। সেই সেঁধোনো দৈত্যাকৃতির পাথরগুলি বালুর তলা থেকে বের করে আনতেও আবার তাদের জান কয়লা করতে হত। পরে গোঁজ ঠুকে এই পাথরগুলি কয়েক টুকরো করে কোন বাহনে তুলে মালভূমির নিকটস্থ ঢালের গোড়ায় নিয়ে ফেলা হত। কিন্তু এত কষ্ট করেও কোনই কেষ্ট মেলেনি এই পিরামিড-জেহাদী বলদদের। মাটির সাথে মেশানো তো দূরে থাকুক, বরং লেজ গুঁটিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজেদেরই মাটির সাথে মিশে যেতে হয়েছে। অকাজের কাজ যা হয়েছে তা হলো, তারা পিরামিডটার উত্তরদিকের গায়ে একটা বড় খাঁড়া ফাটল সৃষ্টি করে এর চেহারাটাই কেবল বিকৃত করে দিতে পেরেছে – এর বেশি কিছুই আর করতে পারে নাই এই অকম্মার ধাঁড়িগুলা। [সূত্র]
এর পরে যদ্দুর মনে পড়ে গিজা কমপ্লেক্সে আমার তালিকায় ছিল স্ফিংক্স আর সোলার বোট মিউজিয়াম। আর ও হ্যাঁ, গা-ছমছম করা মমিতাড়িত ভৌতিক সুড়ঙ্গ দিয়ে খুফুর পিরামিডের রহস্যময় গহীন-গোপন গর্ভে পিরামিডের হৃৎপিণ্ড “কিংস চেম্বার”, তথা ফারাওর মমির গোপন-শবকক্ষে ঢোকাটাও ছিল। এটা কি করে বাদ যায় বলুন! সেই পিচ্চিকাল থেকে এই স্বপ্নটা পুষে রেখেছি যে মনে মনে!
কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৪র্থ খণ্ডে আপাদমস্তক কালো-আলখাল্লা আর কালো মুখোশে ঢাকা নায়ক, দস্যু-বিজ্ঞানী কুয়াশা লাস্যময়ী বেলি ড্যান্সার দীবা ফারাহ্-কে উদ্ধার করতে ভিলেন নাসেরকে পিরামিডের ভিতর কল্পনার স্নায়ুতন্ত্রে রোমাঞ্চ ছলকানো জাগ্রত-মমিতাড়িত ভুতুড়ে সুড়ঙ্গ আর রহস্যময় কানাগলি দিয়ে তাড়া করে বেড়ায়। সেই কাহিনি পড়তে পড়তে কতবার যে পিরামিডের সেই সুড়ঙ্গ থেকে সুড়ঙ্গে, কানাগলি থেকে কানাগলি, প্রকোষ্ঠ থেকে প্রকোষ্ঠে ঘুরে বেড়িয়েছি মনে মনে, শিহরিত হতে হতে। এখন সত্যি সত্যি, সশরীরে সেই কল্পনার রোমাঞ্চতীর্থের বাস্তব পুণ্যভূমিতে এসে একটিবার সেসব দর্শন না করে কিভাবে ফিরে যাই বলুন। ....ছেলেমানুষি ? হোক না... একটু ছেলেমানুষি জিন্দাবাদ!
ফারাও খুফু-র পিরামিডের প্রবেশমুখ
পিরামিডের অতল গহবরে গুপ্তকক্ষের পথে
৩.
Grim and vast,
In hermit loneliness, it sits and broods
Above the Nubian desert. Its dull eyes,
Stony and lidless, stare across the sands;
And the colossal, parted, marble lips
Are marble-mute and marble-cold, as when
The gnawing chisel of the sculptor wrought
Their curving outlines; and they answer not
The immemorial question: "What art thou? *
|
না, কেউ নিশ্চিত ভাবে জানেনা এই গ্রেট স্ফিংক্সের আসল পরিচয়। স্ফিংক্স নামটা পর্যন্ত গ্রিক, আদি মিশরীয় নয়। স্ফিংক্সের নির্মাতারা একে কি নামে ডাকত এখন আর তা জানা যায় না। তবে নির্মানের অন্তত হাজার বছর পরে এর মিশরী নাম ছিল “হোর-এম-আখেত” বা “রে-হোরাখ্তি”, অর্থাৎ ‘দিগন্তের হোরাসদেবতা’। কোন কোন পণ্ডিতের অনুমান প্রাচীন মিশরের প্রথম যুগে স্ফিংক্স তাদের সুর্যোপাসনার কেন্দ্র ছিল এবং পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ১৪শ খৃঃপূর্বাব্দের ফারাও থুতমোসের যুগ থেকে, এটা এই ‘দিগন্তের হোরাসদেবতা’-নামক দেবতা আতুমের জীবন্ত অবতাররূপী ফারাওর প্রতীকে পরিনত হয়। কিন্তু এগুলি মনে হয় অনুমানের বেশি কিছু না।
খাফ্রে-র পিরামিড থেকে ঘুরতে ঘুরতে আমি গিজার গ্রেট স্ফিংক্সের চত্বরে চলে আসলাম। খাফ্রে-র কমপ্লেক্সেরই একটা অংশ বলে মনে করা হয় একে। ভিডিওতে স্ফিংক্সের পেছনে খাফ্রের পিরামিডটা দেখতে পাবেন।
স্ফিংক্স
ম্যান ইন ব্ল্যাক উইথ স্ফিংক্স
আমার স্ফিংক্স ভিডিও ক্লিপ
হিংস্র ভঙ্গিতে মরুভূমির বালু আঁকড়ে গুঁড়ি মেরে বসা সিংহের দেহে মানুষের মাথাওয়ালা এক বিশাল মূর্তি এই স্ফিংক্স। কালের অনন্ত-উষর মরুতে ক্ষণস্থায়ী অর্বাচীন মানুষের দু’দিনের ছেলেখেলার দিকে যেন পরম তাচ্ছিল্যভরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্ফিংক্সের আরবি নাম হচ্ছে ‘আবু আল-হোওল’, যার অর্থ ‘আতঙ্কের বাপ্’ বা ‘বাপ্রে বাপ, কি ভয়ঙ্কর!’ - জাতীয় কিছু। এমনকি এর গ্রিক নাম ‘স্ফিংক্স’-টাও এমন কিছু স্বস্তিদায়ক না। এর অর্থ হচ্ছে – ‘ফাঁসুড়ে’। যদিও প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে ইনি একজন দেবতা ছিলেন। কারো কারো কাছে স্ফিংক্সকে এক হিংস্র, ক্রুর, পিশাচ জাতীয় প্রাণী মনে হয়েছে, আবার কারো কাছে এক ত্রিকালজ্ঞ, মহাজ্ঞানী দার্শনিক বা ঋষি।
যুগে যুগে স্ফিংক্স তাঁর দর্শনার্থীদের নানারূপে দর্শন দিয়েছেন, বিমূঢ় করেছেন, রহস্যতাড়িত করেছেন, মুগ্ধ করেছেন।
২৪১ ফুট লম্বা, ২০ ফুট চওড়া, আর প্রায় ৬৭ ফুট উঁচু এই গ্রেট স্ফিংক্স বিশ্বের বৃহত্তম মনোলিথ (অখণ্ড পাথরে তৈরি) মূর্তি এবং প্রাচীনতম স্মারক ভাষ্কর্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রচলিত মতটি হচ্ছে এই স্ফিংক্স ফারাও খাফ্রের রাজত্বের সময় তৈরি। অর্থাৎ ২৫৫৮-২৫৩২ খৃষ্ট পূর্বাব্দের দিকে – অন্যভাবে বললে এখন থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে। আর স্ফিংক্সের মুখটাও নাকি ফারাও খাফ্রের আদলে তৈরি। তবে এনিয়ে কিছু রহস্য রয়েই গেছে। প্রাচীন মিশরে পিরামিডের ভেতরের দেয়ালে, মন্দিরের গায়ে সহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম, মীথ, দেবদেবী, রাজারাজড়া, ইতিহাস, সমসাময়িক প্রসঙ্গ সহ বহু বিষয়ে বহু কিছু লেখা বা ইঙ্গিত আছে। অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে এই স্ফিংক্সের নির্মান, নির্মাতা বা এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে এর নির্মানকালীন বা কাছাকাছি সময়ের কোন সূত্রেই কোন উল্লেখ নেই। অন্তত এখনো পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ফলে এর আসল ইতিহাসও কারো সঠিক জানা নেই। যার ফলে প্রান্তিক মত পোষনকারীরা, যার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক বা ভূতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে গাঁজাতাত্ত্বিকরাও আছেন - স্ফিংক্সের বয়স ৫ থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর পর্যন্তও অনুমান করে থাকেন।
স্ফিংক্সের প্রসঙ্গ শেষ করি এর দাঁড়ি আর নাক দিয়ে। ছবি লক্ষ্য করলে দেখবেন স্ফিংক্সের মুখ মানুষের মত, কিন্তু এর নাক নেই। দাঁড়িও নেই – যা একসময় ছিল। প্রায় সোয়া তিন ফুট চওড়া নাকটা কাটা হয়েছিল ছেনি আর শাবল জাতীয় কিছু দিয়ে, যার দাগ এখনো স্ফিংক্সের মুখে রয়ে গেছে। ১৫শ শতকের মিশরীয় ঐতিহাসিক আল-মাকরিজির মতে ১৩৭৮ সালে এক মূর্তিবিদ্বেষী ধর্মান্ধ মোল্লা মোঃ সায়েম আল-দাহ্র এই নাকটা ধ্বংস করেন। ভালো ফসলের আশায় গরিব চাষীদের এই স্ফিংক্সের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য দিতে দেখে তিনি নাকি এতই খেপে যান যে স্ফিংক্স ব্যাটার নাক না ফাটানো পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তখনকার মুসলিম শাসকদের এইসব নাক ফাটাফাটি পছন্দ হয়নি এবং ভ্যান্ডালিজমের দায়ে সায়েমের ফাঁসি হয়ে যায়। স্ফিংক্সের নাসিকা-কর্তন নিয়ে অবশ্য আরো কাহিনি আছে – যার মধ্যে এমনকি মহানেপো নেপোলিয়নের কামানের গোলায় এটা ধ্বংস হয়েছে এমন কাহিনিও আছে।
রাজা রানি
স্ফিংক্সের থুতনির দাঁড়িটাও এখন আর নেই। এই দাঁড়ি হচ্ছে তখনকার ফারাওদের একটি রাজানুষ্ঠানিক নকল দাঁড়ি। তুতানখামুনের মমির মুখোশ থেকে শুরু করে আরো অনেক ফারাওর ছবি আর মূর্তিতে এই লম্বাটে দাঁড়িটা দেখা যায়। এটা তাঁদের রিগালিয়ার অংশ। এই দাঁড়ি ছিল স্ফিংক্সের থুতনিতেও। তবে স্ফিংক্সের দাঁড়িটা বোধহয় কোন নাপিত বা মোল্লা কাটেনি – অন্য কোন কারনে ভেঙে পড়ে গেছিল। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারনা এই দাঁড়ি স্ফিংক্সের অরিজিনাল অংশ ছিল না – বরং পরবর্তীকালের সংযোজন ছিল। ফলে ভেঙ্গে গেলেও তেমন কোন ক্ষতচিহ্ন নেই স্ফিংক্সের মুখে।
৪.
নূহ নবীর কিস্তি দেখার সুযোগ না হলেও ফারাও খুফুর কিস্তি দেখাটা ভাগ্যে ছিল। গিজা কমপ্লেক্সে ঘুরতে ঘুরতে শুনলাম এখানে নাকি সেই ফারাওনিক যুগের একটা বিশাল নৌকা বা জাহাজ খুফুর পিরামিডের পাদদেশের কাছে মাটির নীচে প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেই নৌকাটাকে রিস্টোর করে এখন বিশেষ ভাবে তার জন্যে বানানো একটা ‘মিউজিয়ামে’ এই কমপ্লেক্সেই রাখা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সাড়ে চার হাজার বছর আগেকার সেই মনমাঝির নৌকা দেখতে।
খুফুর সূর্যতরী - ১
খুফুর সূর্যতরী - ২
খুফুর কিস্তিকে এখনকার বিচারে হয়তো একটা বড় নৌকা বলতে হয়, তবে সেযুগের বিচারে এটাকে মনে হয় একটা ‘জাহাজ’ই বলা যায়। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে (২৫০০ খৃঃপূঃ) নির্মিত এই কিস্তি প্রাচীনকালের প্রায় অক্ষতভাবে টিকে থাকা বৃহত্তম ও প্রাচীনতম নৌযান। অনেকের ভাষায় “দারুশিল্পের একটি মাস্টারপিস” এই নৌযান পানিতে ছেড়ে দিলে এখনো নাকি ভাসবে। ১৪৩ ফুট লম্বা আর প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত এই কিস্তি ফারাও খুফুর জন্য বানানো হয়েছিল বলেই বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে এর আসল ব্যবহার কি ছিল তা নিয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারনা এই নৌকাটা আসলে সত্যি সত্যি নদ-নদীতে ভাসানোর বা চালানোর জন্যে তৈরি করা হয়নি। বানানো হয়েছিল রিচুয়ালিস্টিক ব্যবহারের জন্য। প্রাচীন মিশরে “সূর্যতরী” বা “সৌর তরী” নামে পরিচিত নৌকাগুলি সেই উদ্দেশ্যেই বানানো হত, যার অনেকগুলির ধ্বংসাবশেষ মিশরের অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এঁদের ধারনা খুফুর কিস্তিও সেরকম। এই নৌকার আসল উদ্দিষ্ট ব্যবহার ছিল মৃত ফারাও পূনর্জীবনলাভের পর সূর্য দেবতা ‘রা’-এর সাথে এতে চড়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। সুতরাং এই নৌকা সত্যি সত্যি পার্থিব জগতের বাস্তব ব্যবহারের জন্য বানানো হয়নি। সমস্যা হল, এই নৌকার গায়ে এটা পানিতে ব্যবহারের কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। ফলে কোন কোন বিশেষজ্ঞ অনুমান করেন এটা ফারাওর সংরক্ষিত মৃতদেহ মেম্ফিস (সেকালের রাজধানী) থেকে গিজায় আনার অন্ত্যেষ্টিযাত্রায় ব্যবহৃত বজরা ছিল, কিম্বা খুফু নিজেই এটা ব্যবহার করতেন মিশরের বিভিন্ন পবিত্র স্থানে তীর্থযাত্রায় যাওয়ার জন্য এবং পরে এটা তার পিরামিডের পাশেই মাটিচাপা দেয়া হয় তাঁর পারলৌকিক ব্যবহারের জন্য। সে যাই হোক, খুফুর কিস্তি দেখার মতই একটা জিনিষ বটে।
৫.
আমার গিজার পিরামিড দর্শন ঘটে মিশরে পৌঁছুনোর প্রথম হপ্তাতেই। কিন্তু এর পরের পিরামিডযাত্রায় বেরুতে বেরুতে মাসখানেকের উপর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে নীলনদ দিয়ে আরো অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সেই পানিতে ভাসতে ভাসতে আরব্য রজনী না হলেও, অনেক আরব্য দিবস আর সন্ধ্যা পার করেছি। উত্তরে ভূমধ্যসাগর পারে ক্লিওপ্যাট্রার আলেকজান্ড্রিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিনপ্রান্তে সুদূর সুদান বর্ডার সংলগ্ন মরুঘাঁটি আবু সিম্বেল ঘুরে আসা হয়েছে – যেখানে সেই বিখ্যাত পাহাড় খুদে বানানো দৈত্যাকৃতির মূর্তিওয়ালা মন্দিরগুলি আছে। এছাড়াও আরো অনেক ঘোরা হয়েছে। এই অবস্থায় মনে হল, এত ঘুরেও এখনো পর্যন্ত মাত্র তিনটি পিরামিড দেখেছি। সুতরাং এবার তাহলে আরেক দফা হয়ে যাক।
আমার টুরিস্ট ম্যাপের দিকে তাকাতে দেখলাম গিজার পিরামিডগুলি ছাড়িয়ে একটু দক্ষিন-পূর্ব দিকে বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে, নীলনদের পশ্চিম পারের সমান্তরালে এক সারিতে অনেকগুলি পিরামিড ছড়িয়ে আছে। বেশ ইন্ট্রিগিং লাগল, কারন কায়রোতে বসে এগুলির কথা খুব একটা শুনিনি। সেজন্যে আরো বেশি যেতে ইচ্ছে করছিল। এগুলি কায়রো থেকে শুরু করে অন্তত প্রাচীন ক্রকোডপোলিস, অর্থাৎ আধুনিক আল-ফাইয়্যুম গভর্নোরেটের আল-লাহুন পর্যন্ত বিস্তৃত। কায়রো থেকে অন্তত ১০০ মাইল পর্যন্ত। আরো থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু আমার ম্যাপটা নেহাতই সাদামাটা টুরিস্ট ম্যাপ – সবচেয়ে পপুলার সীমিতসংখ্যক কিছু সাইট ছাড়া অন্যকিছুর তেমন উল্লেখ নেই।
যাইহোক, মনে হল গাড়িতে গেলে এগুলি একদিনের একটা ডে-ট্রিপেই সারা যাবে। ম্যাপে পাশ দিয়ে যাওয়া সোজা হাইওয়েও দেখতে পাচ্ছি। তখন অবশ্য বুঝিনি আমার ম্যাপোলব্ধি আর বাস্তবতার মধ্যে কতটুকু ফারাক থাকতে পারে। তো যেমন ভাবা তেমনি কাজ, আবারো বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমেই আবু-সির। তবে এটার কথা এখন আর মনে নেই। আদৌ এখানে থেমেছিলাম কিনা তাও মনে পড়ছে না। তবে এটুকু বলা যেতে পারে – এটা গিজা থেকে শুরু করে আরো দক্ষিনে সাক্কারা পর্যন্ত মরুভূমির মধ্যে সুবিস্তৃত একটা ‘পিরামিড বেল্টের’ অংশ। এই পিরামিড বেল্ট আসলে প্রাচীন মিশরের রাজধানী মেম্ফিসের অধীনে ‘পুরনো রাজতন্ত্রের’ (২৬৮৬ খৃষ্ট-পূর্বাব্দ – ২১৮১ খৃঃপূঃ) সময়ে বিভিন্ন রাজবংশের ফারাও আর অভিজাতদের সমাধিসৌধ-কমপ্লেক্স নির্মানের জন্য পছন্দের একটা অঞ্চল হয়ে দাঁড়ায়। একটা স্পটে এইসব পিরামিড আর অন্যান্য অভিজাতদের সমাধিসৌধর জন্য উপযুক্ত স্থান ভরাট হয়ে গেলে তখন তারা বেশ কিছু দূরে আরেকটা উপযুক্ত জায়গা বেছে নিতেন মনে হয়। এইভাবেই অন্তত ১০-১৫ (?) মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গিজা ৪র্থ রাজবংশের রাজা-রাজড়াদের পিরামিডসহ বিভিন্ন ধরনের সৌধে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে ৫ম রাজবংশের রাজন্যরা এই আবু-সিরকে বেছে নেন।
জোসারের স্টেপ পিরামিড। সাক্কারা। ইন্টারনেট
আবু-সিরের পরে আসে সাক্কারা। কায়রো থেকে ২০-৩০ মাইল দূরে হবে বোধহয়। সাক্কারা হচ্ছে প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত রাজধানী মেম্ফিসের একটা সমাধিপুরী। সাক্কারা বিশাল জায়গা জুড়ে নানা ধরনের অনেক পিরামিড, ‘মাস্তাবা’ আর সমাধি-সংশ্লিষ্ট সৌধ আর স্থাপনায় ভরা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এক তুলনারহিত স্বর্নখনি। এখানে একটা জিনিষ বোঝা দরকার যে, প্রাচীন মিশরের এসব সমাধিপুরীগুলি স্রেফ পিরামিড-সর্বস্ব সমাধিপুরী অর্থাৎ বড়মাপের একটা কবরস্থান ছিল না – এগুলি রীতিমত একেকটি শহর ছিল – পিরামিড, বিশাল সব মূর্তিশোভিত স্মৃতিমন্দির (দরগা?), নানারকম সৌধ-কমপ্লেক্স, পুরুতপাণ্ডা, শ্রমিক-বসতি, হাসপাতাল, নির্মানসামগ্রী নির্মান কারখানা, বেকারি থেকে শুরু করে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত বিরাট এক জনসংখ্যাকে সাপোর্ট দেয়ার উপযোগী দস্তুরমত একটা জনবহুল পারলৌকিক-নগরী বলা যেতে পারে এগুলিকে। মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের ফারাও জাহি হাওয়াসের মতে, সাক্কারায় বহু নিদর্শন আবিষ্কার ও উৎখননের পরেও এখনো ৭০% অনাবিষ্কৃত বা মাটির তলায় রয়ে গেছে। তাছাড়া সম্প্রতি নাসা-র স্যটেলাইটের সহযোগিতায় সাক্কারার মরুভূমির নীচে আস্ত প্রাচীন নগরী পাওয়া গেছে – এবং কারো কারো ধারনা মরুভূমির বালুর নীচে এরকম নগরী আরো পাওয়া যাবে, এমনকি একটার নীচে আরেকটা – বিভিন্ন যুগের নগরী, পরতে পরতে।
তবে আমার স্মৃতির পাতায় এখান থেকে আছে শুধু একটা নিদর্শনই – ফারাও জোসারের পিরামিড, যা স্টেপ পিরামিড হিসেবেও বিশ্ববিখ্যাত। এই পিরামিডকেই মিশরের প্রাচীনতম বা প্রথম “পিরামিড” হিসেবে গণ্য করা হয় এখনো। এটাকে অবশ্য প্রোটো-পিরামিডও বলা যায়। সেইসাথে এটা পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃহদায়তন কাটা-পাথরের স্থাপনা ও সৌধও বটে।
জোসারের স্টেপ পিরামিড। সাক্কারা।
গাছের গুঁড়ির মত কলামের বারান্দা। স্টেপ পিরামিড।
স্টেপ পিরামিডের বাইরে ভূগর্ভস্থ কপ্লেক্স
স্টেপ পিরামিডের কাছে মিউজিয়াম
জোসারের স্টেপ পিরামিড। এরিয়েল ভিউ।ইন্টারনেট
স্টেপ পিরামিডের আদি উচ্চতা ২০৩ ফুট (=২০ তলা ভবন?), আর এর বেইস হচ্ছে ৩৫৮ X ৪১০ ফুট। এই পিরামিড খৃঃ পূর্ব ২৭শ শতাব্দীতে, অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৪৭০০ বছর আগে প্রাচীন মিশরের ‘পুরনো রাজতন্ত্রের’ ৩য় রাজবংশের (২৬৬৭ – ২৬৪৮ খৃঃপূঃ) রাজা জোসারের উজির ইমহোটেপের স্থাপত্যে ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়। এই ইমহোটেপ ইতিহাসের এক অসামান্য বহুমুখী প্রতিভা আর বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁকে মানব ইতিহাসের প্রথম স্থপতি, প্রকৌশলী, আর চিকিৎসক হিসেবে গণ্য করা হয়। ইমহোটেপ সেই বিরল সংখ্যক মরনশীলদের অন্যতম যাকে ঈশ্বররূপী ফারাওর মূর্তির অংশ হিসেবে বিধৃত করা হয়েছে।
স্টেপ পিরামিড অন্য বিখ্যাত পিরামিডগুলির মত “ট্রু পিরামিড” না, বরং দেখতে ধাপযুক্ত। সেজন্যেই এর অন্য নাম ‘স্টেপ পিরামিড’। আসলে এটা যখন নির্মান করা হয় তখনো মিশরীয়দের ট্রু-পিরামিড নির্মানকৌশল আয়ত্ত হয়নি। ফলে এটা নির্মান করা হয়েছে মিশরের পিরামিডপূর্ব-যুগের সমাধি-নির্মানকৌশল ‘মাস্তাবা’-কে ব্যবহার করে। এই মাস্তাবা দেখতে অনেকটা একটা আয়তকার উলটানো বাটির মত। অন্যভাবে বললে, মাস্তাবা একটা আয়তকার, বাইরের দিকে খানিকটা ঢালু হওয়া পার্শ্ব আর সমতল ছাদ-বিশিষ্ট সমাধিসৌধ। ফারাও জোসারের পিরামিড একটার উপরে আরেকটা সাজানো উপরের দিকে ক্রমশ ছোট হতে থাকা ছয়টি মাস্তাবা দিয়ে তৈরি বলা যেতে পারে। পিরামিডটার বাইরের দিক পালিশ করা সাদা চুনাপাথরে ঢাকা ছিল গোড়াতে।
স্টেপ পিরামিড শুধু একটা পিরামিডই না, এটা একটা বিশাল সমাধি-কমপ্লেক্সের কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মীয় রীতিসম্মত নানা স্থাপনা আর অলঙ্করনে ঘেরা একটা বিশাল চত্বরের মাঝখানে অবস্থিত ছিল এই পিরামিড, যার পুরোপুরি না হলেও কিছু অবশেষ এখনো রয়ে গেছে। পুরো কমপ্লেক্সটা আবার প্রায় সাড়ে চৌত্রিশ ফুট উঁচু চুনাপাথরের দেয়ালে ঘেরা। কমপ্লেক্সের ভেতর আরো ছিল সিড়ি, প্ল্যাটফর্ম, টেরাস, মূর্তি, দেয়ালচিত্র, বেদি ইত্যাদি শোভিত বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় আচার ও সৎকার সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্দির, একাধিক চত্বর, কমপ্লেক্সের প্রধান প্রবেশমুখ থেকে পিরামিডের একপাশ পর্যন্ত ছাদে ঢাকা আর গাছের গুড়ি বা প্যাপিরাস গাছের কাণ্ডের মত ডিজাইন করা (ছবি দ্রঃ) কলামশোভিত বারান্দা, ইত্যাদি। পিরামিডের নীচে আছে ভূগর্ভস্থ এক ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ গোলকধাঁধাময় সুড়ঙ্গপথযুক্ত হলঘর, কক্ষ আর প্রকোষ্ঠের পারলৌকিক-কমপ্লেক্স। এর কিছু অংশ আবার দারুনভাবে সাজানো ছিল। এসবের উদ্দেশ্য একটাই – ফারাওর পরজীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা। অনেকে মনে করেন পুরো পিরামিড-কমপ্লেক্সের নকশা বা পরিকল্পনার পিছনে ফারাওর নিজের পার্থিব রাজ্য বা রাজধানীর একটা আদর্শায়িত মানসচিত্র কাজ করেছে – যাতে করে মৃত্যুর পরেও তিনি এই সমাধি-কমপ্লেক্সের মাধ্যমে সেই আদর্শায়িত মানসচিত্রের মানচিত্রের রাজত্ব সঙ্গে করে পরজগতে নিয়ে যেতে পারেন।
ফারাও জোসারের স্টেপ পিরামিড কমপ্লেক্স - তখন এবং এখনঃ ফ্ল্যাশস্লাইড
অনেক কিছুই আছে এই কমপ্লেক্সে, তাড়াহুড়ো আর প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হওয়ার কারনে যার সব আমার দেখা হয়নি বা এখন মনে পড়ছে না। পিরামিডের ভূগর্ভস্থ পারলৌকিক সুড়ঙ্গ-কমপ্লেক্সটাও আসলে আমার দেখা হয়নি – তবে মাটির উপরের কমপ্লেক্স থেকে বেরোতেই দেখি প্রবেশপথের বাইরে এককোনায় আরেকটা নতুন ভূগর্ভস্থ কম্পপ্লেক্স পাওয়া গেছে। এটাতে নাকি এখনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ চলছে এবং সর্বসাধারনের জন্য উম্মুক্ত হয়নি। তবে এক টাউট গাইডের পাল্লায় পড়ে এটার অংশবিশেষ দেখার সুযোগ হল। ইজিপ্টে আসলে বেশির ভাগ পিরামিডের ভেতরেই বোধহয় টুরিস্টদের ঢুকতে দেয়া হয় না, আর যে অল্প কয়েকটার ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় সেগুলিরও সবচেয়ে রহস্যজনক বা গহীন অংশগুলিতে যেতে দেয়া হয় না। আর হ্যাঁ, ভেতরে ক্যামেরা একেবারেই নিষিদ্ধ (তবে শুনেছি কেউ কেউ নাকি ঘুষটুশ দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে যায়)।
স্টেপ পিরামিডের ভূঃগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের সদ্য আবিষ্কৃত একটি অংশের উপর চমৎকার ভিডিও ক্লিপ
সাক্কারা ছাড়ার আগে এখানে পাওয়া গেছে এমন আরো একটা বস্তুর কথা না বললেই নয়। এটা হল সাক্কারার পাখি।
‘সাক্কারার পাখি’ আসলে ২২০০ বছর (২০০ খৃঃপূঃ) আগে সিকামুর-ফিগ কাঠের তৈরি বাজপাখির একটা ছোট্ট প্রাচীন প্রত্নমডেল, যা এই এলাকার একটা সমাধিসৌধ খননের সময় পাওয়া গেছে। এর ডানার বিস্তার ৭.১ ইঞ্চি, আর ওজন ৩৯.১২ গ্রাম।
সাক্কারার পাখি।ইন্টারনেট
এই পাখির মডেলটার আসল কাজ কি ছিল সে ব্যাপারে কেউ এখনো নিশ্চিত না। গতানুগতিক আন্দাজগুলি হচ্ছে – এটা সেকালের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত একটা উপকরণমাত্র, এটা শিকারে ব্যবহৃত এক ধরনের বুমেরাং, এটা একধরনের ওয়েদার-ভেইন বা হাওয়া-মোরগ, কিম্বা এমনকি এটা স্রেফ বাচ্চাদের একটা খেলনা ছিল।
তো এত বিরাট বিরাট পিরামিড আর সৌধ-ফৌধ থাকতে এই পিচ্চি এক টুকরা খেলনার মত তুচ্ছ একটা জিনিষের এত কি গুরুত্ব ?
এখান থেকেই আসলে মজার শুরু। তার কারন এই পাখিটা দেখে অনেকে আবার এটাও অনুমান করেন যে এই মডেলটা বানানোর বহু শত বছর আগে থেকেই, অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য সবার বহু আগেই আকাশে ওড়ার মূলসূত্র প্রাচীণ মিশরীয়দের জানা ছিল। এমনকি সেই হাজার হাজার বছর আগেই তারা উড়তে জানতো – নিদেনপক্ষে গ্লাইডিং। এমন ভাবার কারন হচ্ছে, তাদের দাবি মতে এই মডেলটার নাকি আশ্চর্য রকম এ্যারোডাইনামিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ডানার এ্যারোডাইনামিক-লিফট সক্ষম গঠন, এর দেহকাণ্ডের গঠন, এর পাখির-মত-নয় উল্লম্ব টেইলপ্লেইন এবং তাদের দাবি মতে ভেঙে যাওয়া আনুভূমিক টেইলপ্লেইন – ইত্যাদি এই অনুমানকেই সমর্থন করে। তাদের মতে এত কিছু বিষয় যারা জানে না তাদের পক্ষে কাকতালীয় ভাবে এত কিছু মিলিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক। মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ খলিল মেসিহা মনে করেন, এই কাঠের পাখিটা সেই যুগের একটা আসল এবং বৃহৎ উড়নক্ষম মনোপ্লেনেরই অতিক্ষুদ্র সংস্করন মাত্র। যেটা খুঁজলে হয়তো এখনো পাওয়া যেতে পারে। প্রাচীন মিশরীয়দের নিজেদের বড় বড় প্রযুক্তির অতিক্ষুদ্র মডেল বানিয়ে সমাধিতে রাখার অভ্যাস ছিল।
সাক্কারা পাখি-রহস্যের উপর হিস্টরি চ্যানেলের একটা ভিডিও ক্লিপ
তবে মূলধারার প্রত্নতত্ত্ববিদরা এটা কোন প্লেন বা গ্লাইডারের মডেল, এই তত্ত্ব এখনো গ্রহণ করেননি এবং কেউ কেউ এসবকে ভন দানিকেনের গালগপ্পের মতই ছদ্মপ্রত্নতত্ত্ব মনে করেন। তবে কাহিনিটা মজার – সেটা বোধহয় তারাও অস্বীকার করবেন না। হিস্টরি চ্যানেলের সংশ্লিষ্ট ভিডিওটা দেখুন এবং আপনি নিজেই নিজের মনস্থির করুন !
৬.
সাক্কারার স্টেপ পিরামিড থেকে বেরিয়ে টাউট-বাটপারদের এড়িয়ে (এইটা আরেক অভিজ্ঞতা!) আমার পরবর্তী গন্তব্য হলো – দাশুরের ‘রেড পিরামিড’ আর ‘বেন্ট পিরামিড’।
রেড পিরামিড। দাশুর।
দাশুর সাক্কারার স্টেপ পিরামিড থেকে ১০-১৫ কিলোমিটারের মত হবে মনে হয়। প্রায় চোখের পলকে চলে আসলাম। মিশরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে এই হাইওয়েগুলি কোন কোন ক্ষেত্রে এতই ধূ ধূ ফাঁকা, দীর্ঘ, জনবসতিহীন, জনমানবহীন, আর যানবাহনহীন যে প্রথম দর্শনে আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের অনভ্যস্ত মানুষের গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়ে উঠে। একটু যেন দিশেহারা লাগে। হঠাৎ করে মনে হয় অন্য গ্রহে চলে এসেছি। এদেশে মানুষের কন্সেন্ট্রেশন মূলত শহরগুলিকে কেন্দ্র করে – আর একটা শহর থেকে আরেকটা শহরের মাঝখানে অনেক সময়ই বিরাট বিরাট কাকপক্ষীহীন মরুভূমি পড়ে রয়েছে। আর সেই মরুভূমির বুক চিরে চলে গেছে সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গ হাইওয়ে। আমার সংক্ষিপ্ত সফরসঙ্গী এক দেশী ভাই একবার এমন এক মরুভূমির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঠাট্টা করেই মন্তব্য করেছিলেন – এরকম একটা মরুভূমির মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ২-৪ কোটি লোক এনে ছেড়ে দিলে মিশরীয়রা টেরটিও পাবে না (কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান হবে)। ঠাট্টাই।। অথচ, আরেকবার ইনিই কায়রো ফেরার পথে ম্যাপ দেখে দেখে এসে মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ জন, বসতি ও বাহনহীন এবং মোবাইলের আওতা বহির্ভূত ১০০-১৫০ মাইল দীর্ঘ একটা অচেনা রাস্তা/হাইওয়ের ফালির মুখে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোটে গাড়ি নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে অস্বীকার করেছিলেন –যে পথে গিয়েছিলাম সেই পথেই ফিরতে চেয়েছিলেন চারগুন দূরত্ব জেনেও। তার ভয় ছিল যে এতই নির্জন সেই রাস্তা আর তার ভিন্গ্রহের মত মরুভূমিময় চারপাশ, যে রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে আমাদের শকুনের খাদ্য হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। বলাই বাহুল্য, আমাদের মত জনঘনজলবন্যাশাসিত গাদাগাদি দেশের মানুষের মস্তিষ্কে এইসব একটানা শত শত মাইলব্যাপী অবিশ্বাস্য শুন্যতা নানারকম অপ্রত্যাশিত বা অভাবিতপূর্ব রাসায়নিক বিক্রিয়ার উদ্ভব ঘটায়। অনেকটা জলের মাছ ডাঙায় এনে ছেড়ে দেয়ার মত বোধহয়। এত শুন্যতা সহ্য হয় না। মাছের মতই খাবি খেতে থাকি। তবে সেটা মনে হয় কারো জন্য ভীতিকর, কারো জন্য মজার। আমার ভাগ্য আমার জন্য দ্বিতীয়টাই বরাদ্দ ছিল।
রেড পিরামিডের প্রবেশমুখের পথে। দাশুর।
যাইহোক, সাক্কারা থেকে দাশুরের ‘রেড পিরামিডে’ এসে পৌঁছুলাম। দাশুর মেম্ফিসের আরেকটা রাজকীয় সমাধিপুরী। এখানে বেশ কিছু পিরামিড আছে – তার মধ্যে ‘রেড পিরামিড’ আর ‘বেন্ট পিরামিড’ সবচেয়ে বড় আর প্রাচীন। দু’টি পিরামিডই এখন থেকে ৪,৬২৪ বছর আর ৪,৬০০ বছর আগের সময়কালের মধ্যে ‘পুরনো রাজতন্ত্রের’ ফারাও খুফুর পিতা ফারাও স্নোফ্রু-র রাজত্বকালে (২৬১৩ খৃঃ পূঃ -২৫৮৯ খৃঃ পূঃ) নির্মিত।
রাজবংশ-লতিকা
পুরনো রাজতন্ত্র
৩য় রাজবংশ (সব সনতারিখ খৃষ্ট পূর্ব অব্দে)
-
জানাখ্ত ২৬৪৯-২৬৩০
-
জোসার ২৬৩০-২৬১১
-
সেখেম্খেত ২৬১১-২৬০৩
-
খাবা ২৬০৩-২৫৯৯
-
হুনি ২৫৯৯-২৫৭৫
৪র্থ রাজবংশ
-
স্নোফ্রু ২৫৭৫-২৫৫১
-
খুফু ২৫৫১-২৫২৮
-
কাওয়াব
-
জেদেফ্রে ২৫২৮-২৫২০
-
খাফ্রে ২৫২০-২৪৯৪
-
বাকারে
-
মেনকাউরে ২৪৯০-২৪৭২
-
শেপ্সেস্কাফ ২৪৭২-২৪৬৭
-
জেদেফ্প্তাহ
খুফু আর খাফ্রের পরে রেড পিরামিড মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম আর দাশুরের বৃহত্তম পিরামিড, এবং সেইসাথে তার নিজের যুগে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মানবনির্মিত স্থাপনা (৩৪১ ফুট। = ৩০ তলা?)। রেড পিরামিড, যা বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে “বাদুড় পিরামিড” নামে পরিচিত, সমতল (অর্থাৎ অবক্র) গাত্র-বিশিষ্ট প্রকৃত পিরামিড নির্মানের ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রথম সফল প্রয়াস। এই পিরামিডের রেড নামকরনের পিছনে কারন হল - এর গায়ের লালচে-সোনালী আভা। কিন্তু এই রঙ এই পিরামিডের আসল রঙ না – অন্য প্রধান পিরামিডগুলির মত এটাও তুরা অঞ্চলের চুনাপাথরের সাদা পালিশ করা ত্বকপ্রস্তরে ঢাকা ছিল। মধ্যযুগে এই সাদা চুনাপাথরের কেসিংস্টোন বা ত্বকপ্রস্তরগুলি ভেঙে কায়রোতে বাড়িঘর বানানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
রেড পিরামিড। দাশুর।
রেড পিরামিডের ১ কিলোমিটার দক্ষিনে এই এলাকার অন্য প্রধান পিরামিড রম্বসসদৃশ ‘বেন্ট পিরামিড’-টা এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় – মরুভূমির খোলা বিস্তৃতিতে মাঝখানে আর কিছুই নেই। বেন্ট পিরামিডের খ্যাতি আর বৈশিষ্ট্য হল এটা উপরের দিকে উঠতে উঠতে হঠাৎ করেই মাঝপথে নাটকীয় ভাবে ভিতরের দিকে বেঁকে গেছে (ছবি দ্রঃ) – ৫৪ থেকে একলাফে ৪৩ ডিগ্রী। এটা একটা নিখুঁত পিরামিড না।
এই বিজন মরুপ্রান্তরে রেড পিরামিডের পাশে দাঁড়িয়ে দূরে বেন্ট পিরামিডটা দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। চর্মচক্ষেই উম্মোচিত হল এক বিশাল প্রাচীণ পরীক্ষাগার – মিদুম থেকে, নিদেনপক্ষে এই দাশুর থেকে সাক্কারা হয়ে সেই গিজা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ধূ ধূ মরুভূমির উপর বিরাট ব্যবধানে, কিন্তু প্রায় সারি দিয়ে নির্মিত পিরামিডগুলি আক্ষরিক অর্থেই অতুলনীয় মানব প্রতিভা, উদ্ভাবনশীলতা, প্রচেষ্টা আর কর্মযজ্ঞ-দক্ষতার এক অনুপম ট্রায়াল-এণ্ড-এরর ভিত্তিক বিবর্তনের জ্বলজ্যান্ত সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
বেন্ট পিরামিড। দাশুর।
মিশরে আসার বহুকাল আগে থেকেই এইসব পিরামিড নির্মানরহস্য নিয়ে কত তত্ত্বকাহিনিই না পড়ে এসেছি। বাজার চলতি উড়ন্ত সসার, বার্মুডা-ট্রায়াঙ্গল বা ভন দানিকেন টাইপের সিউডোসায়েন্টিফিক বা সিউডোইজিপ্টোলজিকাল গালগপ্প পড়ে বহু লোক এখনো বিশ্বাস করে পিরামিড বোধহয় এলিয়েনরা বানিয়ে গেছে। কিম্বা তাদের বুদ্ধিতে তৈরি হয়েছে। কিম্বা ফারাওরা এলিয়েন ছিলেন। কিম্বা এটা বাইবেলের ইশ্বরের কোন মিরাকল। ইন্টারনেট ঘাটতে গিয়ে দেখেছি ইউটিউব থেকে শুরু করে অজস্র ব্লগ, মেসেজবোর্ড, ফোরাম, ওয়েবসাইট, বইপত্র এধরনের লেখালেখি, মন্তব্য আর বিশ্বাসে সয়লাব হয়ে রয়েছে। পিরামিড যে মানুষই বানিয়েছে ইতিহাসের সেই উষালগ্নে, বিশেষ করে পশ্চিমের এক শ্রেণির লোকের মধ্যে এ ব্যাপারে যেন গভীর অবিশ্বাস রয়েছে মনে হয়। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ! কিন্তু আস্তে আস্তে উপলব্ধি করেছি (এটা আমার ব্যক্তিগত মত) এবং এই ধারণায় পৌঁছেছি যে এইসব কিম্ভূতুড়ে তত্ত্বগুলি আসলে পশ্চিমা মানসে একাংশের সুপ্ত বর্ণবাদেরই একটা ভিন্নতর প্রকাশ। তারা কেন যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না বা মেনে নিতে বা সহ্য করতে পারেন না যে, এমন সব অতুলনীয় কীর্তি অশ্বেতকায়দের পক্ষে অর্জন বা স্থাপন করা সম্ভব; বিশেষ করে যা তাদের পূর্বপুরুষরা পারেননি সেসময়। এমনকি যখন রোম-গ্রীস কোন কিছুরই কোন অস্তিত্ত্বই ছিল না, হয়তো তেমন কোন সভ্য ইউরোপিয় শ্বেতকায় জাতিও ছিল না - তারো প্রায় দেড়-দুই সহস্র বছর আগে এগুলি অর্জিত হয়ে গেছে আফ্রিকায় – অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিপক্কতা, ব্যবসা-বানিজ্য, জনপ্রশাসন, দীর্ঘমেয়াদী গণযোজন ও সাংগঠনিক ক্ষমতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের একাধিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রকৌশলবিদ্যা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিতে আশ্চর্য সূর্যোদয় ঘটে গেছে। যা সম্ভব করে তুলেছে এমন সব অতুলনীয় প্রকল্পগুলিকে - যখন তাদের অনেকের পূর্বপুরুষেরই হয়তো... কোন উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ত্বই ছিল না - যে কথাটা এরা কিছুতেই তাদের সুপ্ত বর্ণবাদী ইউরোকেন্দ্রিক অবচেতনে মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু সরাসরি এখন সেটা প্রকাশও করতে পারেন না হয়তো। এর ফলেই আমদানি হয় এলিয়েন তত্ত্বের! কিম্বা বাইবেল তত্ত্বের। যাতে করে অশ্বেতকায় বা অইউরোপীয়দের এ রকম কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায়। অবশ্য এলিয়েন তত্ত্ব ছাড়াও আরো অনেকগুলি তত্ত্ব আছে যার মূল উদ্দেশ্য একই। যেমন নিজেরাই কৃতিত্ব দাবী করা। কথিত আছে, নেপোলিয়নের সাথে আসা ফরাসীরা নাকি প্রথম প্রথম দাবি করতো পিরামিড ইত্যাদি আসলে প্রাচীণকালে ফরাসীরাই বানিয়েছে – কারন ফরাসিরা ছাড়া এমন জিনিষ আর কারো পক্ষে বানানো সম্ভব না। এই তাদের যুক্তি। আদি মিশরীয়রা আসলে কে ছিল এই নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টিকারী তত্ত্ব হাজির করে যতটা সম্ভব নিজেদের পাতে ঝোল টেনে নেয়া বা যতটা সম্ভব আফ্রো-এশীয়দের ডিসক্রেডিট করার চেষ্টাও এই ধরনের কৌশলের মধ্যে অন্যতম। অবশ্য ইদানীং পশ্চিমাদের সাথে পাল্লা দিতে এই ঝগড়ায় অন্যরাও যোগ দিয়েছে -- এটাও উল্লেখ করা উচিত এখানে।
যাই হোক, এসব বিরাট ক্যাঁচাল আর এগুলি পশ্চিমে এখন আর মেইনস্ট্রীম ভিউ-ও না, কিন্তু তারপরও এর যে একটা ভাল মার্কেট বা রিসেপ্টিভ শ্রেণী আছে তা ইন্টারনেট ঘাটলেই বোঝা যায় – এইসব নিয়ে কামড়াকামড়ি-খেয়োখেয়ির কোন অন্ত নাই সেখানে।
বেন্ট পিরামিড। দাশুর।
তো, যে প্রসঙ্গে উপরে এত গুলি কথা উঠল তা হল দাশুরে রেড পিরামিডের পাশে দাঁড়িয়ে দূরে বেঁকে যাওয়া বেন্ট পিরামিড দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে থেকে হঠাৎ একটা পর্দা সরে যাওয়া। মরুপ্রান্তরে একটা বিশাল ওপেন-এয়ার প্রাচীণ পরীক্ষাগার উম্মোচিত হওয়া। ব্যাপারটা আর কিছুই না – গিজা থেকে দক্ষিনে আসতে আসতে আমি লক্ষ্য করলাম পিরামিডগুলি তাদের গঠনে বা নির্মানকৌশলে একদিনে বা হঠাৎ করেই পারফেকশনে পৌঁছেনি। আস্তে আস্তে তাদের বিবর্তন ঘটেছে। এটা কারো পক্ষেই লক্ষ্য না করে উপায় নেই। তাদের অন্তত ৫-৬টি প্রজন্মের ফারাওর ১০০-১৫০ বছরব্যাপী রাজত্বকালে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা আর ট্রায়াল-এণ্ড-এররের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ট্রু-পিরামিড হয়ে ওঠার জন্য। আসলে শুরু হয়েছে আরো অনেক আগে যখন সমাধি-সৌধগুলি ছিল ‘মাস্তাবা’। সেগুলি এই হিসাব থেকে নাহয় বাদই গেল। শুরুটা ধরলাম সেই মাস্তাবা ব্যবহার করে তৈরি সাক্কারায় ৩য় রাজবংশের ২য় ফারাও জোসারের ধাপযুক্ত স্টেপ পিরামিড - যা আসলে একটা প্রোটো পিরামিড। সাক্কারা হয়ে আসার সময় যেটা আমি দেখেছি। এই জোসারের এক উচ্চপদস্থ অমাত্য ছিলেন ‘হুনি’। এই হুনি পরবর্তীকালে একই রাজবংশের পঞ্চম ও শেষ ফারাও হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণ করেন (২৫৯৯ – ২৫৭৫ খৃঃ পূঃ)। উপরে বংশলতিকা দেখুন। ইনি দাশুর থেকে আরো প্রায় ৩৮ মাইল দক্ষিনে মিদুম-এ নিজের জন্য একটা স্টেপ পিরামিড নির্মান শুরু করেন যা শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়। হুনির উত্তরসূরী ও সম্ভবত জামাতা ৪র্থ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নৃপতি ফারাও স্নোফ্রু এই অসমাপ্ত স্টেপ পিরামিডটা নিজের নামে অধিগ্রহণ করে নেন এবং সমাপ্ত করেন – তবে স্টেপের বদলে ট্রু-পিরামিডের আদলে -- ‘ধাপ’-গুলিকে চুনাপাথরের আবরনী পাথরে ভরাট করে পিরামিডটার পার্শ্বগাত্রকে সমান ও মসৃন করার মাধ্যমে।
মিদুম পিরামিড। মিদুম। ইন্টারনেট
কিন্তু এই পিরামিড অক্ষত দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি -- স্নোফ্রু-র রাজত্বকালেই এটা ধ্বসে পড়ে আংশিক ভাবে। এটা ধ্বসে যাওয়ার ফলেই ফারাও স্নোফ্রু-কে মনে হয় পিরামিড ম্যানিয়ায় পেয়ে বসে এবং ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ – এই নীতি অবলম্বন করেই মনে হয় তিনি নিজের জন্য একের পর এক পিরামিড বানাতে শুরু করেন। এইভাবে দান-দান তিন দান করে তিনি শেষ পর্যন্ত তার নির্মিত ৩য় পিরামিড ‘রেড পিরামিডে’ এসে একটা সফলভাবে দণ্ডায়মান, বৃহদায়তন ও নিখুঁত অর্থাৎ ‘ট্রু-পিরামিড’ নির্মানে সফল হন।
সাক্কারার জোসার দিয়ে শুরু। তারপরে মিদুম। মিদুমে ধ্বসে পড়লে স্নোফ্রুর উত্তরমুখী যাত্রা – দাশুরে। দাশুরে প্রথমে ‘বেন্ট পিরামিড’। কিন্তু না, বেন্ট পিরামিড বেশি খাড়া হয়ে গেলে (মাটি থেকে ৫৫ ডিগ্রী এ্যঙ্গেলে) পিরামিডটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় মাঝপথে এর নতি বা ঢালের কোন কমিয়ে (৪৩ ডিগ্রী) দিতে হয়, ফলে পিরামিডটা বেঁকে যায়। ভেতরে কাঠের বিশাল বীম, কলাম ইত্যাদিও পাওয়া গেছে সাপোর্ট হিসেবে। অবশেষে আরো ১ কিলোমিটার উত্তরে, যেখানে আমি এখন দাঁড়িয়ে, সেখানে ৪৩ ডিগ্রী এঙ্গেলেই রেড পিরামিড নির্মান করে স্নোফ্রুর সাফল্য লাভ।
দাশুরে দাঁড়িয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পিরামিডের এই পিরামিড হয়ে ওঠা -- চোখের সামনে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইতিহাসের উষালগ্নে মানুষের সৃষ্টিসাধনার অর্জন দেখে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি মাথায় এই হাস্যকর প্রশ্ন না এসে পারে না যে, সম্ভবত আলোর কাছাকাছি গতিতে মহাশুন্যে মিলিওন মিলিওন আলোকবর্ষ-মাইল পাড়ি দিয়ে আসা, ইন্টারগ্যলাক্টিক স্পেস-ট্রাভেল করার মত অকল্পনীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিক্ষমতা সম্পন্ন, এবং একবিংশ শতাব্দীর মানুষের চেয়েও লক্ষগুন উন্নত সভ্যতার এবং প্র্যাক্টিকালি প্রায় ‘দেবতার’ সমকক্ষ একটা এলিয়েন জাতির মহাবুদ্ধিমান প্রাণীর সামান্য একটা কয়েক শ’ ফুট উঁচু পিরামিড - এক দফায় নির্ভুল ভাবে বানানোর ক্ষমতা নাই ? ১৫০ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা লাগবে কেন তাদের, তাদের তো প্রায় এক ফুঃ-এই এসব বানাতে পারার কথা! এই জায়গাতে এসেই মনে হয় ‘এলিয়েন’-তত্ত্বের চাপার পিরামিড ধ্বসে পড়ে। তাদের একজন চাপাবাজির স্নোফ্রু দরকার এখন। তাতেও অবশ্য কাজ হবে না।
যাইহোক, মানুষের কথাতেই ফিরে আসি। ফারাও স্নোফ্রু-র রাজত্বকালেই বৃহদায়তন পিরামিডের স্থাপত্য, ভিশন ও নির্মানকৌশলে সবচেয়ে বড় বিবর্তন ঘটে এক নিরীক্ষামূলক ট্রানজিশনাল যুগের মধ্য দিয়ে। স্টেপ পিরামিড ট্রু-পিরামিড হয়ে উঠে। এবং শেষমেশ এই নিরীক্ষা আর বিবর্তনের সরাসরি ফসল হিসেবেই অর্জিত হয় মিশরীয় ‘পুরনো রাজতন্ত্রের’ রাজসিকতা ও জৌলুসের শীর্ষনমুনা, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে এক নম্বর – গিজায় স্নোফ্রুর পুত্র ফারাও খুফুর সর্বোচ্চ পিরামিড। মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই এই উত্তরন সম্পন্ন হয়।
খুফু আর এই রেড পিরামিড দুটোর ভেতরেই ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তবে ভেতরে ক্যামেরা নেয়া নিষিদ্ধ হওয়ার কারনে কোন ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। তখন নীতিতে বাঁধলেও, এখন মাঝেমধ্যে আফসোস হয় কেন দ্বাররক্ষীদের হাতের তালুতে একটুখানি তৈলপ্রয়োগ করলাম না। তবে এই লেখায় ভেতরে বেশ কিছুটা ঢোকার পর প্রবেশমুখ থেকে তোলা একটা ছবি দিলাম। এই ছবিটা খুফু না রেড পিরামিডের এখন আর মনে নেই –তবে পরেরটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যারা পিরামিডের ভেতরের কিছু চোরাই ভিডিও দেখতে চান তারা
এখানে,
এখানে এবং
এখানে দেখতে পারেন।
৭.
দাশুর থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে আমার সর্বশেষ গন্তব্য ছিল মিশরের প্রাচীণ রাজধানী মেম্ফিসের অন্তর্গত বর্তমানকালের গ্রাম মিত রাহিনার কাছে একটা বিশেষ মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে তাদের বিখ্যাততম ফারাও ২য় র্যামসেস-এর (রাজ. ১২৭৯-১২১৩ খৃঃপূঃ) এক প্রকাণ্ড শায়িত মূর্তি।
ফারাও ২য় র্যামসেসের বিশাল মূর্তি। মেম্ফিস।
ফারাও ২য় র্যামসেসের বিশাল মূর্তি। মেম্ফিস।
এই পা-ভাঙ্গা লাইমস্টোনের দৈত্যাকৃতি মূর্তিটা পা ছাড়াই প্রায় ৩৪ ফুট লম্বা। ১৮২০ সালে মেম্ফিসে ‘দেবতা প্টাহ্’-র মন্দিরের প্রবেশমুখের কাছে মাটির নীচে ২য় র্যামসেসের এই বিশাল মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। এই মূর্তি গোড়াতে এক জোড়ায় নির্মিত হয়েছিল এবং মূর্তি দু’টি দেবতা প্টাহ্র মন্দিরের প্রবেশমুখের দুপাশে দাঁড়ানো অবস্থায় শোভিত হত। দৃশ্যটা কল্পনাতেও রীতিমত দর্শনীয় আর রোমাঞ্চকর। জোড়ার অন্যটাও পাওয়া গেছে এবং চুড়ান্ত ভাবে দু’টি মূর্তিই গিজার কাছে নির্মানাধীন নতুন “গ্র্যাণ্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের” প্রবেশমুখে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আমার ফারাও ২য় র্যামসেসের মূর্তির ভিডিও। মেম্ফিস।
এই অপূর্ব সুন্দর প্রস্তরমূর্তিটা পা-ভাঙা হলেও এর মূল সৌন্দর্য শুধু এর বিশালত্বে নয়, সেই সাথে এই বিশালত্বের মধ্যেও এর মানবদেহ গঠনের জটিল ও সুক্ষ ফর্মগুলির নিখুঁত ডিটেইলিং-এ। পাথর নিয়ে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে কাজ করছেন
এমন একজন ভাষ্করের মন্তব্য এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না (অনুবাদের ঝামেলায় আর গেলাম না) : --
“The essence of this great statue lies in the many square yards of carved surface. Faced with a task of such magnitude, a cold sweat would form on the brow of any modern worker in stone. I scrutinized a ten-foot-long portion of the royal leg. Along its entire length no flaw distracted from the grace and power of the sinewy, kingly stride, and I knew something of the difficulty with which such perfect surfaces could only be achieved.
Among the many problems presented by this stone, it likes to chip unpredictably to the terror of the sculptor who would shape it. The stone was familiar to me. I had worked on a small piece of similar but softer material the year before, and the twenty years' experience that went into my small sculpture provided an insight into the true greatness of the colossus before me.
I had spent countless hours vainly trying to grind out by machine the countless ripples that had formed in the carving process - on a much smaller expanse of softer stone. Only after much experimentation with various abrasives and finally with different rhythms of sanding was I able to produce the smooth surfaces essential to the overall impact of the work. Even on the small scale the effort involved was enormous.
When modern, mechanized marble yards cut, smooth and polish stone the size of the Ramesses, the shapes are either flat or they are featureless columns. It is done with power tools the size of houses and even then the work is painstaking, time-consuming and risky. Here, the ancients achieved perfection with hand-held stones and crushed abrasives applied to sticks. And the shapes wrought were the complex, subtle forms of the human anatomy.
How these master carvers achieved perfect surfaces on this scale with simple tools was beyond my comprehension. My own twenty years' experience provided no clue. But clearly this was not the work of slaves. This forty-foot length of stone could only have been brought to life through the sensitive hand and watchful eye of a master sculptor, and with a great deal of loving care.
Unlike so many works on a herculean scale, this Ramesses allowed for no imprecision in areas the sculptors knew could not be seen. The hidden places were equally finely finished. There were no technical concessions to the many near-insuperable problems that had to be faced. Looking at the supreme craftsmanship that went into the body's hidden recesses as well as its conspicuous visible areas, it was clear to me that all involved in making this image had the integrity and wisdom worthy of the god the great king was meant to represent. ” (
সূত্র)
৮.
এবার কায়রো ফেরার পালা। ফিরে নীলনদের বুকে বজরার উপর হাওয়া খেতে খেতে এত-এত পাথরের মনুমেন্ট দেখার ক্লান্তি কফি আর আপেল ফ্লেভারের শীষা হাতে নিয়ে, আয়েশ করে বসে একটু বেলিড্যান্স দেখে কাটিয়ে নিতে হবে। চাঙা হয়ে পরে পোর্ট সৈয়দ, সুয়েজ, দামিয়েতা, ভূমধ্যসাগর, নীলনদের মোহনা, রেড সী, আইন সুখ্না, জাফার্না, শার্ম আল-শেখ – এসবের দিকে রওনা দিব। আলেক্সান্দ্রিয়াটাও আরেকবার ঘুরে আসতে পারি। সবশেষে লুক্সোর, আসওয়ান আর আবু সিম্বেল।
তবে এবার লেখার মধ্যে কায়রো ফেরার পথে একটা প্রশ্ন মাথায় জাগল -- আমার এই সিরিজটা কি কিছু হচ্ছে ? পাঠকদের বিরক্ত করছি নাতো? সিরিজটা এখানেই শেষ করে দিলে ভাল হয়?
-->
মাউসওভার= পজ্; মাউসরিমুভ= রিজিউম, ক্লিক= প্লে, এক্সপান্ড বা রিজিউম
নীলনদ ভ্রমন এ্যানিমেটেড স্লাইডশো
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন অনলাইন, অফলাইন, আইলাইন, ইয়ারলাইন, ও মনলাইন সূত্র;
ছবিঃ ১. ফটোশপে সদ্য হাতেখড়ি হওয়ায় বাচ্চাদের খাতা জুড়ে আঁকিবুঁকি করার মতই কিছু ছবির উপর কাঁচাহাতে একটু রংচং করার লোভ সামলাতে পারিনি। আশা করি এতে অভিজ্ঞরা বিরক্ত হবেন না। ২. এইপর্বে বেশির ভাগই আমার ছবি, অল্প কয়েকটা ছাড়া। তবে ২টি বাদে (স্ফিংক্স ও র্যামসেসের ভিডিও) আর সব ভিডিও, এ্যানিমেশন, নকশা, ইলাস্ট্রেশন, ম্যাপ ইত্যাদি ইন্টারনেট থেকে ধার করা। ৩. বিনানুমতিতে পাব্লিক ফোরামে প্রকাশ করলাম বিধায় আমার সফরসঙ্গীদের ছবিগুলি একটু বদলে দিলাম। এর ফলে কিছু ছবি ইষৎ দৃষ্টিকটু হয়ে গেলেও, এটাই যথার্থ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। ৪. উপরে মূল লেখায় উদ্ধৃত দু'টি ইংরেজি কবিতার মধ্যে প্রথমটা - John Bannister Tabb, আর পরেরটা Andrew Downing-এর লেখা।
মন্তব্য
পোস্ট আরেকটু ছোট হলে ভাল হত। লোড হতে প্রচুর সময় নিচ্ছে।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
হ্যাঁ, সেটা আমিও টের পেয়েছি। কি আর করা, ছোঁড়া ঢিল হাতে ফিরে আসে না। যাইহোক, তবু মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সকাল বেলা এ কি পড়লাম, শুভেচ্ছা রইল.ধন্যবাদ
যারা ইতিমধ্যে ইজিপ্ট দেখে এসেছে, তাদের জন্য আমার নিখাঁদ হিংসা
পিরামিডের ফটোস্ দেখে হিংসার জ্বালা বেড়ে গেল দাউদাউ
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অসাধারন !!!
প্রথমে মনে হচ্ছিল অত বড় পোস্ট কতক্ষণে পড়ব, পড়তে পড়তে গিয়ে কখন যে মিশর চলে গেলাম
ছবি বা ভিডিওগুলি ঠিকমত না আসলে একটু কষ্ট করে পেজটা রিফ্রেশ করে নিন।
ব্যাপক তথ্যভাণ্ডার, । কিছু কিছু ছবি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, পরের পোস্টে একটু নজর দিয়েন।
facebook
কিছু কিছু ছবি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না মানে কি ছবিগুলি পুরোপুরি লোড হয়ে দৃশ্যমান হলেও এর কোয়ালিটি খারাপ বা এর মধ্যকার দৃশ্যবস্তু অস্পষ্ট বা বিকৃত ? এটাই যদি হয় তবে মনে হয় এটা আমার ইচ্ছাকৃত প্রয়াসের ফল। এক্ষেত্রে ৩ নং ফুটনোটটা দেখতে পারেন ব্যাখ্যার জন্য।
আর ছবি লোডই না হয় ঠিকমত কিম্বা সম্পূর্ণ বা আংশিক অদৃশ্য থাকে - তবে সেটা সম্ভবত পোস্টের কোন ত্রুটি নয় (অতিরিক্ত রিসোর্স খেকো হওয়া ছাড়া) এবং সম্ভবত আপনার প্রান্তে নেটস্পীডের কারনেই এমন হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য সুইডেনে তো এমন হওয়ার কথা না! যাই হোক, এরকম কিছু হয়ে থাকলে পেজটা রিফ্রেশ করে পুরো পোস্টটা লোড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে সমস্যা দূর হয়ে যাওয়ার কথা।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
****************************************
সম্ভবত কারো ব্লগে এটাই দীর্ঘতম সময় কাটলো আজ...
এই লেখাটা ছাড়াও ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম আপনার অণু গল্প আর অন্য লেখার জগতে...
আপনার লেখাগুলো দীর্ঘ .... এবং খুবই ছোট
এই দুই পরিসরেই দারুণ ঘোরাফেরা করে।
একটা বিষয় মনে হলো-
আপনি খুব সিরিয়াস...
জীবনে এবং কাজে...
এবং স্পষ্ট...
যে কারণে চিন্তার সাথে মেলবন্ধন.দেখার। আর তাতে যোগ ঘটেছে পরিশ্রমের...
আমার ভাল লেগেছে আপনার জগৎটাকে...
দারুণ আপনার পৃথিবী...
আপনার সহৃদয়, কাব্যময়, চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!!
****************************************
গতকাল পড়তে পড়তে হয়রান হয়ে গেছিলাম... আজ শেষ করলাম... ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
স্যরি টু হয়রান য়ু!
আসলে লেখাটা কয়েক ভাগে দেয়া উচিত ছিল মনে হয়। তারপরেও পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার ধৈর্য্যশক্তি সত্যি প্রশংসার যোগ্য।
নতুন মন্তব্য করুন