বাসার লোকেশন জানাতে গিয়ে তিনি আমাকে ফোনে বললেন, ...গলিতে ঢুকে যে-কাউকে ব্লাইন্ড বাপ্পীর বাসা কোনটা জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে। এমন সহজভাবে কথাটি তিনি বললেন, অথচ শুনে আমার মন কেমন করে উঠলো!
গলির ভেতরে ঢুকে দেখি ৬/৭ বছরের একটি শিশু খেলছে। তাকে বললাম, বাপ্পী ভাইয়ের বাসাটা চেন? সে আঙুল উঁচিয়ে বললো, ও-ই বাড়িটার দোতলায়।
দরজায় নক করতেই বাপ্পী নিজে দরজা খুললেন। তাঁর সাথে কয়েকবার আলাপ হয়েছে ফোনে। আজ প্রথম দেখা হলো। কথাবার্তায় তিনি খুব আন্তরিক আর সপ্রতিভ । কথার ফাঁকে স্ত্রীকে বললেন, ভক্তি, চা দাও তো...।
স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন ভক্তির সাথে তার বিয়ে হয়েছে পারিবারিকভাবে।
একটু পর ঘরে ঢুকলো সেই ছোট মেয়েটি, যে আমাকে বাসা চিনিয়ে দিয়েছিল। বাপ্পী বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে দৃষ্টি। আমি বললাম, ভারী মিষ্টি মেয়ের ভারী মিষ্টি নাম! এ-ই তো বাসা চিনিয়ে দিল আমাকে। তখন বলেনি, সে-যে আপনারই মেয়ে।
বাপ্পী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আর আশাবাদী এক মানুষ। সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। পরে আমেরিকায় গিয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা করেছেন। এখন শিশুদের দুটি প্রতিষ্ঠানে গান শেখান বিনা পারিশ্রমিকে। এক সময় পত্রিকায় রেডিও প্রোগ্রামের রিভিউ লিখতেন।
বাপ্পী আমাদের অফিসে ফোন করেছিলেন মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে। অনুরোধ করেছিলেন, এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন যেন আমাদের পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। সেই সূত্রে তার সাথে আমার যোগাযোগ। তার বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় আলাপ শেষ করে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা নিয়ে আমি উঠলাম। বাপ্পী বললেন, আমি চিনিয়ে দিতে পারবো। যেদিন যাবেন আমাকে জানাবেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, তিনি কী পারবেন!
পরদিন আবার গেলাম বাপ্পীর বাসায়। তিনি তৈরি। আমি তাকে নিয়ে যাব অথবা তিনি আমাকে নিয়ে যাবেন। তার মেয়ে দৃষ্টি বললো, বাবা আমিও যাব। দৃষ্টিও সঙ্গী হলো আমাদের। একটু পর খেলাঘর কর্মী রুবেল যোগ দিল আমাদের সাথে।
বাপ্পীর বাসার সিঁড়িটা একটু অন্ধকার। আমি দেখেশুনে ধীরে ধীরে নামছিলাম। আর বাপ্পী খুব দ্রুত নামছিলেন অভ্যস্ত পদক্ষেপে। সামনে দৃষ্টি হাত ধরে বাবাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সারাটা সময় দৃষ্টি তার বাবার হাত ধরে পথ দেখাচ্ছিল। হয়তো এভাবেই ৬/৭ বছরের কন্যাটি তার বাবার সত্যিকার চোখের আলো হয়ে উঠেছে!
যাত্রাপথে যখন যে এলাকা দিয়ে যাচ্ছি, সে-এলাকার নাম বলে দিচ্ছিলেন বাপ্পী। মনেই হচ্ছে না যে, তিনি দেখতে পান না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কীভাবে বুঝতে পারছেন আপনি! তিনি বললেন, আন্দাজ।
সেদিন সেখানে সব কাজ শেষ করতে অনেক সময় লেগে গেল। আমি ভেবেছিলাম, আমাদের ক্ষুদে সফরসঙ্গী দৃষ্টি বুঝি খুব বিরক্ত হবে এতক্ষণে। কিন্তু সে একটুও বিরক্ত নয়। বরং হাসিমুখেই বাবার হাত ধরে ঘুরছে। যেন বাবাকে আগলে রাখার দায়িত্ব তারই।
প্রকৃতি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রকৃতিই আবার এমন মিষ্টি কন্যা দৃষ্টিকে উপহার দেয়!
হায় প্রকৃতি, মিষ্টি কন্যার মুখখানি কখনো দেখতে দেয় নি বাবাকে!
মন্তব্য
পোস্ট শিরোনাম জীবনানন্দকে মনে করিয়ে দেয়---
'কেউ নেই স্তব্ধতায়, তবুও হৃদয়ে দীপ্তি আছে।'
আর পোস্টটা মন খারাপ করিয়ে দেয়.....।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথী, ...এই সবকিছু ঘিরেই জীবন চলে যায়।
ধন্যবাদ তোমাকে, লেখাটা পড়ার জন্য।
আপনি দারুন লাকি যে এরকম একটি সুন্দর, আলোকিত মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছেন।
খুব মনকাড়া লেখা
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ধন্যবাদ, উচ্ছলা।
লেখাটা আপনার মন কেড়েছে জেনে ভালো লাগলো।
ছিমছাম পোস্ট, খুব সুন্দর এবং ভেতরে কষ্ট জাগানিয়া একটা অনুভব ছড়িয়ে আছে লেখাটায় !
অভিনন্দন, এমন সহজ সাবলীল সজীব লেখা উপহার দেয়ার জন্য। সাথে অবশ্যই ধন্যবাদ !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রণদা, আপনার এই অনুপ্রেরণা মনে থাকবে আমার।
অনেক ধন্যবাদ, দাদা।
বাপ্পীকে সালাম, তাঁর অসাধারন মনবলের খানিকটা ভাগ আমাদের দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আসলেই মনোবল মানুষকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ধন্যবাদ, কল্যাণ।
হুম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুম...
ধন্যবাদ, নজরুল ভাই।
মন ছুঁয়ে গেল ... বিশেষত শেষ লাইন টি ...
ধন্যবাদ, আপনাকে।
কে যেনো একজন বলেছিলো,
বাপ্পী ভাইকে শ্রদ্ধা জানালাম। আর আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম এমন একজন আলোকোজ্জল অন্তরের অধিকারী মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ধন্যবাদ, রাতঃস্মরণীয়।
বাপ্পীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগলো লেখাটি।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
তাসনীম ভাই, লেখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা।
***
..................
মন খারাপ আবার মন ভালো করা লেখা
বাপ্পী ভাই আর দৃষ্টির জন্য শুভকামনা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ, ত্রিমাত্রিক কবি।
লেখাটা ভালো লাগল।
কৌস্তুভ, আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা কত ভাল আছি! তবুও কত অভিযোগ!
ঠিক বলেছেন, রাজকন্যা।
কত ভাল আছি তারপর ও কত অভিযোগ আমাদের।
ভালো লাগল।
ধন্যবাদ, সাবিহা সনি।
ধন্যবাদ
খুব আবেগ মেশানো লেখা, জীবন এমনই, তারপরও বাপ্পী ভাইদের মত মানুষেরা আমাদের অনবরত প্রেরণা যোগায় সামনে এগিয়ে যাবার জন্য, হাল না ছাড়ার জন্য।
facebook
তারেক অণু, বাপ্পীর মত মানুষেরাই জানিয়ে দেন জীবনে পরাজয় না মানার মন্ত্র।
বাপ্পী ভাই আর তার শিশুর জন্য অনন্ত শুভেচ্ছা আর আপনাকে বাপ্পী ভাইয়ের সাথে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য সাধুবাদ জানাই। শুভেচ্ছা,
ধন্যবাদ, তানিম এহসান। শুভেচ্ছা আপনাকেও।
পথ কখনো পায়নি পথের দিশা তবু পথই এনে দেয় সীমাহীন গতি।
চোখ নিজে নিজেকে দেখেছি এমন কি পাশা পাশি বসিবার উপায় হলেও দেখিবার উপায় নেই উভয়ের উভয় কে....... প্রকৃতি বড্ড খেয়ালি।
পোষ্টের জন্য কৃতজ্ঞতা।
ধন্যবাদ, প্রখর-রোদ্দুর।
আপু ভিতরে কোথায় যেন বেশ খানিকটা নাড়া দিয়ে গেলো আপনার লিখাটা ।
ধন্যবাদ, বন্দনা।
ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ, রু।
নতুন মন্তব্য করুন