পড়াশোনা থেকে শুরু করে আমরা কখন কি খাবো না খাবো, ঠান্ডা না গরম পানিতে রোজ কখন স্নান করবো, সেগুলো ও মামার ঠিক করে দেয়া ছিলো। ওনার যন্ত্রণাতে আমরা শুক্রবারের দুপুরে মে তেরে দুশমন দুশমন কি তেরা গানের সাথে শ্রী-দেবীর সেই বিখ্যাত সাপের নাচুনী দেখতে পাশের বাসায় যেতে পারতামনা। বাধ্যতামূলক ভাবে মূলা, করলার মত আর ও বিবিধ ও অখাদ্য খেতে হোত ওই মামার জন্যই। মামার সাথে মামদোবাজি করা আমার কর্ম ছিলনা, খেতে যখন হবেই চুপচাপ পানি দিয়ে সেই অখাদ্য দুর্গন্ধযুক্ত মূলা গিলে প্যারাসিটামল ঔষধের মত পেটে চালান করে দিতাম। মাবাবার হোস্টেলে থাকা আমরা বোনেরা সবসময়ই মামার এই বিজাতীয় রেগিং এর উপর থাকতাম।
বাবা কোনদিনই আমাদের পড়ালেখা দেখভাল করতেন না। সারাবছর কে কি পড়লো, না পড়লোনা উনার সেই ব্যাপারে খুব একটা মাথাব্যথা ছিলনা, কেবল বছর শেষে রেজাল্ট কার্ডের উপর ছিলো উনার অখণ্ড মনোযোগ। রেজাল্ট দেখার ব্যাপারে উনার মেলা ভুগিচুগি ছিলো। প্রথমে দেখতেন আমার নাম্বার, তারপর আগের টার্ম এর নাম্বার এর চেয়ে সেটা বেশি না কম তা দেখতেন, তারপর দেখতেন সর্বোচ্চ নাম্বার এর সাথে আমার নাম্বার এর পার্থক্য কত। উনার এই ধরনের ইউনিক স্টাইলের কারণে আমার বোনেরা রেজাল্ট কার্ডে উনার সাইন নিতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যেতো। এই সমস্যাতে অবশ্য আমাকে খুব একটা পড়তে হয়নি। তো বাবার বর্তমানেই সমস্ত দায়িত্ব ছিলো মামার হাতে, সেই সূত্রে ব্যাপক ক্ষমতা ও। আমার পড়াশোনার হাতে খড়ি ও আমার ছোট মামার হাতেই। উনি অনেক যত্ন করে আমাকে সব ধরে ধরে শিখিয়েছেন। বাসার সবাই ওনাকে বাঘের মত ভয় পেতো, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম আমি। আপুরা যখন পড়া করতো আমি তখন আক্ষরিক অর্থেই উনার কাঁধে উঠে বসে থাকতাম।
খুব সকালে উঠে নামায আর কুরান পড়া শেষ করে সবাইকে নিয়ে মামা পড়াতে বসতেন। তখন আমাদের সকালের নাস্তা ছিলো মায়ের হাতে বেলা পাতলা রুটি আর চিকন করে কাটা আলুর ভাজি। পড়তে বসার সময় যখন সকালের নাস্তা আসতো, মামাই আমাকে নাস্তা খাইয়ে দিতেন। কিভাবে রুটি ছিঁড়ে তার মাঝে আলু ভরে পানির খিলির মত করে খেতে হয় সেটা মামার কাছেই শেখা। আমরা বোনেরা যেখানে পড়তে বসতাম, ওখানে কোন সিলিং ফ্যান ছিলোনা, মাথার উপর একটা টেবিল ফ্যান ভনভন করে অবিরত ঘুরে যেতো। সেই ফ্যানের মত এমন ফ্যান আমি এই জীবনে আর কখনও দেখিনি। টিভিতে কি একটা যেনো এড দেখাতো, ফ্যানের বাতাসে পর্দাসহ মানুষ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ওই এডখানা যারা বিশ্বাস যান নাই, তাদের কে ও আমার কথা বিশ্বাস করতেই হবে। তো এই ভুবন ভোলানো পাখার নিচে বসলে ঘুম অবধারিত ছিলো। ফলে খুব সকালে উঠা মামা ও একটু পরেই ঘুমে কাটা মুরগীর মত ঝুরতে থাকতেন। আপুরা তখন শয়তানী বাধরামি শুরু করে দিতো। তবে একটু পরই মামা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে যেতেন আর ব্যাপক ধামকি দিতেন। অই ফ্যানটা যতদিন ছিল আমরা নানাবিধ সুযোগসুবিধা ভোগ করেছি! এমনকি আরবি পড়াতে আসা হুজুর ও ঘুমিয়ে পড়তেন মোহময়ী সেই ফ্যানের হাওয়ায় আর বলতেন তোদের বাসায় আসলেই এত ঘুম পায় কেন। ফলে আমাদের নিট আরবি পড়ার সময় অনেকটাই কমে যেতো!
চলুন আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেই মামাজানের একটা উদ্ভট স্বভাবের সাথে। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর ওই একি প্রশ্নে উনার কাছে পরীক্ষা দেয়া লাগতো। তখন আমি পড়ি নার্সারিতে। পরীক্ষা দিয়ে এসে সেদিন ও নিয়ম করে উনার কাছে পরীক্ষা দিতে বসেছি। উনার পরীক্ষায় আমি বেশ কয়েকটা ভুল করলাম। উনি প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করে সেদিন আমাকে ভীষণ মার দিলেন। সেই মারের মত এমন ভয়ঙ্কর মার আমি আর জীবনে কখনো খাইনি, বলা চলে ওটাই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ মার। আমার মাবাবা কখনো মামার উপর কথা বলতেন না, সেদিন ও বলেননি। কিন্তু পাশের বাসার আন্টির আমার জন্য খুব মন খারাপ হোল। উনি আমাকে বললেন চল তোর স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। আমাকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে টিচারদের কনভিন্স করে উনি আমার এক্সাম এর শীট দেখে নিলেন। বাসায় এসে মামাকে ভীষণ করে ঝেড়ে দিলেন আমার মারার জন্য। মামাকে ডেকে বললেন, মেয়ে তো আপনার কাছে ভুল করলে ও এক্সামে ঠিক উত্তরটাই লিখে আসছে, বেহুদায় মেয়েটারে এমন পিটুনি দিলেন। এমন শক্ত পিটুনি কেউ এত ছোট্ট মানুষকে দেয়, মিয়া আপনি মানুষ না। আমার মামার থমথমে চেহারা ছিল তখন দেখার মত। কিছুই বললেন না। বিকেলে আমাকে বললেন চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি। উনার সাথে বের হলাম। আমাকে হাটতে দিলোনা, কোলে করে বাইরে নিয়ে গেলো, কনফেকশনারীর দোকান থেকে কেক কিনে দিলো। আমি ও খেতে খেতে সকালের মারের কথা ভুলে গেলাম। মামার সাথে আমার এই একটাই ভয়ঙ্কর বিশ্রী স্মৃতি। মামার ভালোবাসার প্রকাশটা প্রবল ছিলোনা, তারপর ও আমি কেমন করে যেন ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম। এতদিন পর ও কেন যেন এই মারের কথাটাই মনে পড়ে বেশি।
ছোটবেলায় টুটকাফুটকা জ্বর হলে মামাই আমাদের ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতেন। একটু হেঁটেই আমি বলতাম আর হাটতে পারবোনা, কোলে নেন মামা। উনি বলতেন, ‘না হেটেই যেতে হবে’। যাবার সময় হেঁটে গেলেও নাছোড়বান্দা আমি আসার সময় ঠিকই কোলে উঠে বাসায় আসতাম। এটুকুতে ও কোন সমস্যা ছিলোনা, সমস্যা শুরু হোত যখন জ্বরের মাঝে জোরজবস্তি আমাকে স্নান করতে পাঠানো হোত। বড় হবার পর বুঝেছি যদি ও জ্বরের মাঝে স্নান করা শরীরের জন্য বেশ ভালো, কিন্তু সেই ছোটবেলায় কে আর অতশত বুঝতে চাইতো! একবার হোল কি, টিউবওয়েলের হাতল নিয়ে বাঁদরামি করতে গিয়ে আমার বাঁ পাশের ভ্রুতে হাতলের বাড়ি খেয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেললাম। সেবার ও মামাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন যথারীতি। ভ্রুতে এমন বিশ্রী করে কেটেছিলাম যে স্টিচ দিতে হয়েছিল সাথে এটি-এস নেয়া লেগেছিলো। সেই কাটা দাগই আজকে আমার পাসপোর্টের আইডেন্টিফিকেশন হিসেবে ব্যাবহার করে যাচ্ছি! তো স্টিচ দেয়ার সময় আর এটি-এস নেবার সময় আমি ষাঁড়ের মত চিৎকার করছিলাম আর বলছিলাম আমি কিছুতেই ইনজেকশন নিবোনা। আমার পাষাণ মামা তখন আমাকে বলে কিনা কাটার সময় মনে ছিলোনা, এখন আর চিৎকার করে কেন্দে কেটে কোন লাভ নেই মনি। আমার চিৎকার কান্নাকাটির তোয়াক্কা না করে আমাকে কোরবানীর গরুর মত চেপে ধরে ইনজেকশন দিয়ে আনলো। ইনজেকশন তো দিলোই আবার বাসায় ফেরার সময় ও হাটিয়ে আনতে চাইলে কার মেজাজ ঠিক থাকে।
তো এই মামা যখন চলে গেলেন তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে, ঈদের চাঁদ উঠলে ও এত আনন্দ হয়না বুঝি। মামা ও নাই, রোজকার রুটিন ও মেনে চলা লাগবেনা। ইচ্ছে মত টিভি দেখা যাবে। ততদিনে বাসায় ফিলিপ্স এর সাদা কালো টিভি চলে এসেছে, পাশের বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখার প্রয়োজন ও ফুরিয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক মাসে মামা যখনি ঢাকায় আসতেন, আবার আমাদের পড়াশোনার পিছনে পরে যেতেন। এই ভদ্রলোক এত পড়তে কেন যে ভালোবাসেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আজ ও। আমার তখন এমন কাহিল অবস্থা, মামা যে কদিন ঢাকায় থাকতেন, আমার অঙ্ক আর বিজ্ঞানের সিলেবাস শেষ করে দিতে চাইতেন সেই কয়দিনে। শুধু কি তাই, এক একটা অঙ্ক কয়্টা নিয়মে সলভ করা যায় সেটা ও আমাকে শিখতে হোত। এই অবস্থা চলেছিলো মোটামুটি আমার মেট্রিকের আগ পর্যন্ত। তারপরই মামার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম।
মামা চেয়েছিলেন বেতের উপর রেখে আমাদেরকে শক্তপোক্ত করে গড়ে তুলতে। তো সেই মামারই এখন ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা ঢঙ্গি মেয়ে আছে। সেই মেয়ে আবার ভীষণই মা-নাওটা, তাই মেয়ের একটু মনোযোগ পাবার জন্য মামা কি না করেন। উনার সেই বেতের উপর পোলাপান মানুষ করার আদর্শ ও গোল্লায় গেছে নিজের মেয়ের পাল্লায় পড়ে। জ্বরের মাঝে স্নান করা, বাধ্যতামূলকভাবে করলা, মূলা খাওয়া এসব ও দেখলাম কই হারিয়ে গেছে। আমার বাঘ মামা ও আজকে নিজের মেয়ের কাছে বিড়াল হয়ে গেছে। উনার ঢঙ্গি মেয়ে যখন আমাদেরই সামনে উনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় আমরা তখন মনে মনে হাসতে গিয়ে বিষম খেতে থাকি। আজকালকার পোলাপানগুলা ও সেরম ধেনে মরিচ। মা বাবাকে সারাক্ষণই দৌড়ের উপর না রাখলেই না যেন। আর মাবাবারা ও পারেন বটে ধেড়ে ধেড়ে পোলাপানের পিছনে কাঁঠালের আঠার মত লেগে থাকেন। এদের দূরন্তপানার কাছে আমরা তো এক্কেবারেই যাকে বলে দুধভাত। নিজের বালিকাবেলার দিকে তাকালে নিজেকে এখন লক্ষীসোনা চাঁদের কণা টাইপের বালিকাই মনে হয়।
মন্তব্য
আপনাদের ফ্যানটা ধার নিতে চাই। মিটিংয়ের আগে অ্যাডভাইসারের ঘরে রেখে আসব...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আর সেই উপায় নেইগো কৌস্তুভদা, থাকলে আমিই সেটা আমার মিটিং রুমে লাগিয়ে দিতাম । সেই ফ্যান কি আর এদ্দিন বেঁচে আছেগো, গ্রিজ আর বেয়ারিং বদল করে আর কয়দিন চলে।
সাদাকালো ফিলিপস্ টিভির আমলের মেয়েরা কত্ত লক্ষী এই দলে আমিও আছি আর এখনকার এলসিডি-মেয়েরা (আমার ছোটবোন) চরম ফিচেল। কী সব আপত্তিজনক এসএমএস করে ওদের ছেলে-বন্ধুগুলাকে!
মামা কাহিনী খুব মজা। চানাচুরের মতো
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
আপনার লক্ষী মেয়ের গল্পতো পড়ে এলুম ।
হুমম ! এখন বুঝতে পারছি, মামার ভাগনিটা এমন সরল-সোজা-সাপ্টা হলো কী করে !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রণদা আমাকে দেখি একগাদা বিশেষন দিয়ে দিলেন।
ইসসস...বাঘের মত একটা মামার এ কেমন করুণ রূপান্তর!!
দিন বদলেছে, মামা ও তাই বদলে গেছে।
ভালো লাগলো... কিছু স্মৃতিও মনে পড়লো...
ধন্যবাদ কর্ণদা। সবারই এমন কিছু না কিছু থাকে বোধহয়।
ভালো লিখেছেন, পড়ে মজা পেলাম। ধন্যবাদ।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
আপনাকে ও অনেক ধন্যবাদ রাতঃদা।
দিন বদলাইছে না!
ভালো লাগা অনেক অনেক।
অনেক অনেক ধন্যবাদ মানিক ভাই।
মজার
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ কবিকে।
ভাল লেগেছে। পড়ে মনে হল, আমি আমার দুই মামাকে কত ভালবাসি, এমন কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি রয়েছে মনের আকাশে নক্ষত্র হয়ে। সুযোগ পেলে লিখব।
ধন্যবাদ ব্যাঙের ছাতা। লিখে ফেলুন চটপট।
আহারে বাঘ মামা
ধন্যবাদ ইস্কান্দর বরকন্দাজ ভাই।
খুব মজা পাইছি।
ধন্যবাদ তাপসদা।
ছোটবেলায় আমার বড়মামার শাসনটাও ঠিক এরকমই ছিল। এখন কেবলই স্মৃতি। লেখাটা পড়তে পড়তে বড়মামাকে মিস করছি খুব!
আমার বড়মামা ও শাসন করতেন, কিন্তু উনার কোমল মনটাই আমার কাছে আগে ধরা দিতো। আমার দেখা অসাধারন একজন মানুষ ।
facebook
ধন্যবাদ অণু ভাই।
কিছু মনে করবেন না, আপনার মামা কোন কত সালের দিকে গৌরনদীতে চাকুরী করতেন? আমার বাড়ি বরিশালে। বরিশালের দই বিখ্যাত, কিন্তু সেটাতো মহিষের না!
মনে করবো কেন ভাইয়া, মামা ৯১ কি ৯২ এর দিকে বরিশাল ছিলেন। আর উনার ভাষ্যমতে ওটা ছিলো মহিষের দই, আমার যাচাই করার সুযোগ হয়নি।
বাড়ীতে গেলেও মুরুব্বীদের সাথে কম কথা বলতাম দেখে আমার মেজমামা দুঃখ করতেন দূরে দূরে থাকি দেখে আর বলতেন - ভাইগ্না, দুইটা মা মিলে একটা মামা হয়!
ইস খুব ভালো বলেছেন তো তানিম ভাই, দুইটা মা মিলে মামা।
আমার অভিজ্ঞতার থেকে সম্পুর্ণ বিপরীত। আমার মামাদের পুরা আউলা মাথা। মামা বাড়ি আমাদের জন্য আসলেই মধুর হাঁড়ি। আর আজকালকার ভাগ্নি নিয়ে কী বলব? চার বছরের ভাগ্নি আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরায়।
নতুন মন্তব্য করুন