এক/
বুবুর ফ্রকটার রং ছিল লাল আর আমারটা নীল। জামাদুটো মা নিজ হাতেই সেলাই করেছিলেন। ওটা পরলে বাবা ডাকতেন ‘লাল পরি-নীল পরি’। ভেলভেটের ফ্রকটার ঘের এতোটাই ছিল যে দুই পাক ঘুরে ফুলিয়ে টুপ করে বসে পড়লে গোল তাবুর মধ্যে শুধু মাথাটাই দেখা দিত। যে বয়সে প্রিয় শব্দটার অর্থ ঠিকঠাক বুঝে ওঠার কথা নয়, সে বয়সে ঐ নীল জামাটা ছিল আমার সবচেয়ে “পিয়”। মনে পড়ে ওই নীল জামাটা পরেই প্রথমবারের মত স্কুলে পা রেখেছিলাম ভর্তি হবার জন্য।
আর স্কুল ড্রেসটার রং ও নীল। আকাশী নীল।
দুই/
খেলার বন্ধু মুক্তির বাবা বিমানে কাজ করতেন সম্ভবতঃ। ইল্লি দিল্লি করে বেড়াতেন আর এক মাত্র মেয়ের জন্য সারা দুনিয়া থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলনা নিয়ে আসতেন। আমাদেরকে তা সে ছুঁয়ে দেখতেও দিতোনা।
একবার দেখি তার কোলে গোলাপি রঙের ইয়া এক পুতুল। কোথায় যেন সে টিপ দেয় আর অম্নি পুতুল গান গাইতে শুরু করে। খলখল করে হাসে-চেঁচিয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় তোলে। মুক্তি সেটা কোলে নেওয়া তো দূর, শত অনুরোধে একটু ছুঁতেও দিল না।
বাড়ি ফিরে বাবার কাছে আবদার জানালাম সেই পুতুলের। বাবা একবার ‘আচ্ছা’ বলে নিজের কাজে লেগে গেলেন। এক দিন দুদিন করে সপ্তাহ পার হতেই আবার ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলাম।কথা বার্তা ছাড়াই বাবা টেনে এক চড় মেরে আমার গোলগাল গোলাপী মুখটা নীল করে দিলেন।
ক্লাস টু’তে পড়ি তখন। ওদিনের পর থেকে পুতুল ছুঁয়েও দেখিনি আর শৈশবে। বাবার কাছেও আর কোনো জিনিসের জন্য আবদার করিনি বা প্রয়োজনের পেন্সিল্টাও চাইনি। আর ওটাই বাবার হাতে প্রথম ও শেষ মার খাওয়া।
১৪ তম জন্মদিনে একটা বেশ বড়সড় প্যাকেট হাতে বাবার এক বন্ধু হাজির বাড়িতে। আলাপ পরিচয়ের পর ভদ্রোলোক বললেন, ‘আপনার ছোট মেয়েটিকে ডাকুন। ওর বাবা ওর জন্য একটা জনিস পাঠিয়েছে’।
এলাম।
ভদ্রোলোকের চোখ রসগোল্লার মত হতে দেখে আমি, মা দুজনেই অবাক। তার চেয়ে বোধ করি উনি বেশি অবাক। সাড়ে পাঁচ ফুটি এই মেয়ে ছোট মেয়ে হয় কি করে?!
‘তুমিই ছোট মেয়ে নাকি?’
‘জ্বী’ বলতেই তিনি আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন।
‘এটা তোমার। খোলো তো দেখি’
খুললাম।
সেই ছোট্টবেলার পুতুলটা!! (বুঝলাম আমি সেই পুতুলের কথা ভুলে গেলেও বাবা ভোলেননি) শুধু পরনে তার নীল ভেলভেটের জামা! বক্সের ভেতরে ভাঁজ করা গোলাপী ফিনফিনে মূল পোশাকটাও আছে। তার পাশে ভাঁজ করা আকাশী রং এর কাগজে লেখা বাবার চিঠি।
আর, পাতায় পাতায় সুগন্ধি জড়ানো একটা তালাচাবি দেওয়া ডায়রি! এও ভীষন নীল রঙের।
তিন/
ক্লাস ফোরে প্রথম যে প্রেম পত্রটি হাতে এসেছিল তার রং ও ছিল গাঁড় নীল
চার/
খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে হয়ে গেল। বিয়ে নিয়ে বা বিয়ে আনুসঙ্গিক কোনো চিন্তা ভাবনা করতে শেখার আগেই দেখি আমার পরনে বিয়ের শাড়ি। শাড়িটার রং ময়ুর কন্ঠি। এখানে ওখানে নীল নীল পাথর বসানো…
বিয়ের পর প্রথম ঈদ। কর্তা শাড়ি কিনে নিয়ে এলেন। নীল জামদানি ;(
পাঁচ/
এতো দিনে অনেকেই জেনে গেছে আমার পছন্দের রঙ নীল। শুভাশুভ যে কোনো দিনে কিছু উপহার পেলে দিন শেষে দেখতে পেতাম, অর্ধেকের বেশি জিনিসপত্রের রং-ই নীল।
ছয়/
প্রথম সন্তানের জন্মের পর তোলা শত শত ছবিগুলো ওয়াশ করার পর অবাক হয়ে দেখি আমার পরনের পোশাকটা নীল-সাদা। আর “বয় ব্লু” রং এর বেবিক্লথের মোড়কে চোখ বুজে হাসছে আমার গোলাপি রং এর জ্যান্ত পুতুলটা।
সাত/
ছেলে কোলে নিয়ে প্রথম সংসার করতে গেলাম চিটাগাং এ। বুবু সাথে। আমার ঘর গুছিয়ে দিয়ে আসবে। ভোর ভেলা ট্রেন থেকে নামলাম আর বিকেল বেলা জীবনে প্রথমবারের মত নীল সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম (পতেঙ্গায়) পৃথিবীতে আমার সব চেয়ে ভালবাসার তিন জনের হাত ধরে।
অদ্ভুত ভাবে সেদিনও আমার পরনে ছিল নীল সাদা সালোয়ার কামিজ।
আট/
বুবু মরে যাওয়ার মাত্র দুই দিন আগে ওর সাথে আমার কথা হল। কর্তার চিটাগাং থেকে সিলেট পোস্টিং হয়েছে শুনে লাফিয়ে উঠলো বুবু।
‘গ্রেট!!’
বললাম, তার আগে ঈদে ঢাকায় আসবো। কি আনবো তোর আর ছোঁয়ার জন্য?
একটুও সময় না নিয়ে বুবু বললো, ‘তোর পছন্দের নীল রঙ এর শাড়ী-জামা’।
মাত্র দুটো দিন পরেই একটা সংবাদে নিজেই পুরোটা নীল হয়ে গেলাম।
সেই নীল শাড়ি আর কেনা হয় নাই। ছোঁয়াকেও এই জীবনে নীল রং এর কিছু কিনে দেওয়া হয় নাই। আমার জীবন থেকেও নীল বিদায় নিল পাঁকাপাকিভাবে।
**
অনেক অনেক বছর পর… জন্মদিনে একটা জর্জেটের শাড়ি উপহার পেলাম ‘বুবুর মেয়েটার’ কাছ থেকে।
মাত্র ১৪ বছর বয়স তখন ছোঁয়ার। হাত খরচের টাকা জমিয়ে মা’য়ের জন্য উপহার কিনেছে।
ওকে খুশি করতেই পরলাম শাড়ীটা। মেয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরে বল্লো,
‘আম্মু, তুমি নীল পরোনা কেন? নীল শাড়ীতে তোমাকে পুরা নীল পরীর মত লাগছে। এখন থেকে…’ আমার চোখ টলমল করে উঠলো।
সেই থেকে আমার জীবনে আবার নীলের ছড়াছড়ি। জানালার পর্দা, বিছানার চাঁদর, পানির মাগ, চায়ের কাপ- সব নীল। নানুর বাড়ি থেকে মেয়ে মায়ের বাড়ি বেড়াতে এলে হি হি করে হাসে,
‘তুমি তো দেখি পুরাই স্ক্রু ঢিলা!! নীল শাড়ীতে তোমাকে ভাললাগে বলছি আর তুমি তো দেখি পুরা বাড়ী-ই নীল বানায় ফেলছো!’
ওর হাসি দেখে ঠোট ছড়িয়ে হাসি আর কান্নায় গলা ব্যাথা করে। কোনোভাবেই বলতে পারিনা, শুধু বাড়ীটা নারে মা, পুরো কলজেটাই যে নীল হয়ে আছে সেটা যদি তোকে কখনো দেখাতে পারতাম…
কাল ছোঁয়ার ১৮তম জন্মদিন ছিল। আঠারোটা জন্মদিনের একটিতেও তার জন্মদাত্রী তার সাথে থাকতে পারেনি। প্রতিবার ঘটা করে ওর জন্মদিন পালন করা হয়। কেক কাটার সময় কত আনন্দ হয়। কারোর মনে থাকেনা মেয়েটি আমার পেটের মেয়ে নয়। বুবুর। কেউ তার নামটিও উচ্চারণ করে না এই দিনে। সবাই কি ‘ওকে’ ভুলে থাকার ভান করে নাকি সত্যি-ই ভুলে থাকে?!
সবাই ভুলে থাকতে পারে, শুধু আমি পারিনা।
নীল ভালবাসি বলে ‘যে’ একরাশ নীল নীল কষ্ট উপহার দিয়ে গেছে, ‘তাকে’ কি করে ভুলে থাকি?!
মন্তব্য
অসাধারন...।
নীল আমার অ---------স-ম্ভ-ব প্রিয় রং।
লেখায় এক আকাশ ভরা 'আসমানি' রঙের পাঁচ তারা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নীল রঙ সবচাইতে প্রিয় বলে দেখেছি নীল এর কথা সবাই বলতে পারেনা। অদ্ভুত লাগলো আপনার এ কথন, অদ্ভুত!
ছোঁয়ার 'আম্মু'র লেখাটুকু মন ছুঁয়ে গেল।
আর কিছু বলার নেই আসল, এমন লেখায় আর কিছু বলার থাকে না।
লিখুন আরো, সচলে স্বাগতম।
অফটপিকঃ প্রথমদিকে ভুল হয়ে যায়, লেখা পোস্ট করার সময় মনে করে আপনার নাম বা 'নিক'-টি (যে নামে নিবন্ধন করেছেন)ও দিয়ে দেবেন। ভাল একটা লেখা পড়ে কে লিখলো তা জানতে ইচ্ছে করে, আর নামহীন লেখা প্রকাশ সচলে নিরুৎসাহিত করা হয়। ভাল থাকুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, সুন্দর মন্তব্যের জন্য ।
আসলে কোন লেখার শেষে নাম সই করার অভ্যেস করা হয়ে ওঠেনি। তাও যথা যে নিয়ম তা তো মানতেই হয়।
সচলের নিয়মকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাই 'অটোগ্রাফ' রেখে গেলাম...
এই লেখার লেখকের নাম, বন্দনা কবীর'
এই পোস্টের লেখক/লেখিকা কে???
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নীলে নীলান্তর..............
_____________________
Give Her Freedom!
মনে থাকবে... অনেকদিন...
মনে থাকবে... অনেকদিন...
এক/
সচলে স্বাগতম
।
দুই/
লেখার শেষে নাম/নিক অবশ্যই উল্লেখ করবেন। নাম নাই দেখে আপনাকে ইতিমধ্যে মনে মনে নীলাপা বানিয়ে দিয়েছি।
তিন/
লেখাটা ভীষন ভাল লেগেছে। লেখায় হলুদ ৫ তারা।
চার/
অতিথি লেখকরা মনে হয় তারা দেখতে পায়না,
লেখাটা খুবই ভালো লেগেছে। আপনার জীবন নীলময় থাকুক, আনন্দের নীল রঙে...এটা আমারও প্রিয় একটা রঙ।
মন্তব্যের ঘরে আপনার নামটা জানিয়ে দিন।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনেকেই বলে কষ্টের রং নীল। অামি মানি না। অাপনার লেখায় নীল তারা।
অসাধারন, চলুক চলুক
কাল দুপুরে লেখাটা পোস্ট করার পর একবার সচলের পাতা খোলা হয়েছিল। লেখাটা এসেছে দেখেওছিলাম।
কিন্তু লেখার শেষে যে নাম লিখিনি তা খেয়ালে আসেনি।
লেখায় মন্তব্যকারিদের সকলকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আর আন্তরিক ভাবে দুঃখিত লেখার শেষে নাম না দেওয়ায়।
এই লেখা তাইলে এখুন থিকা আমার
আচ্ছা আপনারই হোক। সমস্যা নেই
থেঙ্কু থেঙ্কু, আমি লিখতে টিখতে পারি না, তাই চেয়ে চিন্তে লেখা জমাচ্ছি আর কি ।
কী সুন্দর লিখেছেন...খুব ছুঁয়ে গেলো...মনে থাকবে এই লেখাটা।
ইদানীং পৃথিবী অনুভব করে, একটা সূর্যে চলছেনা আর
এতো পাপ, অন্ধকার
ডজনখানেক সূর্য দরকার।
মন খারাপ নিয়ে কি লিখেছি না লিখেছি...
প্রশংসা শুনে ধন্যবাদ বলতে ইচ্ছা করেনা কেন যেন। মনে হয় ভাললাগাটাকে মেকি করা হয় তাতে।
তাও ভদ্রতা করে বলতে হয়... সামাজীক হবার বড্ড জ্বালা
পড়লাম।
ভাল লাগলো।
এক টুকরো জানালার মত।
ভাললাগা জানাতে কষ্ট করে তিন তিনবার কমেন্ট লিখেছেন!!! অশেষ কৃতজ্ঞতা কর্ণজয় দাদাকে।
অনেক ভাল থাকুন।
আপনার লেখা ভালো লাগলো...
Nil হোক নীল বেদনা...
(নীল আমার প্রিয় রং...)
অসম্ভব ভাল লাগল।
আপনাকে এক নীল আকাশ শুভেচ্ছা।
কাশফুল
উপহার দিলাম। লেখা মন ছুঁয়ে গেছে, তাই
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
ওহ, এই একটি বিষয়ে লিখতে ভুল হয়েছে। আমার সবচেয়ে পছন্দ দুটি ফুলের সর্বাগ্রে অপরাজিতা (আমার ব্যালকনির তিনটা টবে অপরাজিতার ঝাড় দোল খায় বারো মাস) আর দ্বিতীয়তে আছে দোলন চাঁপা
অনেক অনেক ধন্যবাদ উচ্ছলা খুঁজে খুঁজে প্রিয় ফুলটি-ই উপহার দেবার জন্য (কোলাকুলির ইমো হবে)
নীল একটা নাম। লেখাটা খুবই ভালো লেগেছে।
নীল আমার ও প্রিয়, আপনার নীলরঙ্গা লিখায় আমি ও নীল হলাম।
অনেক অনেক ভালো থাকুন।
নামে নামে মিলে গেলে কি বলে জানেন তো বন্দনা?
মিতা।
মিতা আমার বুবুর নাম।
আপ্নিও ভাল থাকুন অনেক।
দিদি, লেখাটা অসম্ভব ভাল লাগল।
মূলত পড়তেই বেশী ভাল লাগে, আর লিখতে লাগে ভয়। তবে যখন অসাধারন এই লেখাগুলো দেখি তখন হিংসা হয়, লোভ হয় লেখার জন্য। অনেক ভাললেগেছে। চালিয়ে যান।শুভ কামনা রইল।
খুব সুন্দর লিখেছেন, কষ্টে মনটা ভরে গেলো। ছোয়া ভাল থাকুক।
অনেকদিন পর আপনার লিখা পড়লাম। মিস করি আপনার লিখা।
ছুজুরান
নতুন মন্তব্য করুন