নরওয়ে-০১/তারেক মাহমুদ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১০/২০১১ - ৯:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নরওয়ে-০১
তারেক মাহমুদ

সম্প্রতি টিভিতে প্রচারিত একটা বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে। চাকুরিপ্রার্থী ছেলেটি চাকুরিদাতাদের দাড়ি, কমা , সেমিকোলনহীন প্রশ্নবানে নিজের খেই হারিয়ে ফেলে। পরে সে একটা বিশেষ কোম্পানীর ঝাল চানাচুর খেয়ে একদমে হড়হড় করে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। বিজ্ঞাপনের কথাটি বললাম এই জন্য যে, তৃতীয় বিশ্বের এই গরীব দেশের মানুষ যারা প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশে যেতে চান তারা বিমানবন্দরের কর্মচারি-কর্মকর্তাদের অহেতুক হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য অবশ্যই ঐ কোম্পানীর এক প্যাকেট ঝাল চানাচুর সঙ্গে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাবেন।
যাত্রী ভোগান্তির আরেক নাম শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দর। একবার যারা এখানে গেছে তারাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে, কত ধানে কত চাল। দেশের বাইরে যেতে বা দেশে ফিরতে এদের দ্বারা নাজেহাল হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। নরওয়ে যাবার সময় বিমান বন্দরে ঢুকে জেট এয়ার ওয়েজের কাউন্টারে দাঁড়াতেই তিন চার জন এসে ঘিরে ধরল। কোথায় যাবেন?
নরওয়ে
কেন?
পড়তে
ওখানে পড়তে কেন?
বলুনতো এই প্রশ্নের সদুত্তর কি?
এইভাবে প্রায় ৩০ মিনিট বাকবিতন্ডার পরে একজন বলে বসলো ভিসার উপরে এই ছবি কার? কোথা থেকে ভিসা নিয়েছেন? ভিসার জন্য যে আবেদন করেছেন তার ফটোকপি দেখান। অ্যাম্বেসি ভিসার যে রিসিট দিয়েছে তার নমুণা দেখান। মেজাজ ঠান্ডা রাখা দুষ্কর, তারপরেও শান্ত গলায় বললাম, ভাই আমার দাদার বা তার বাবার বা তার বাবার ম্যারেজ সার্টিফিকেটও দেখাতে হবে? ভদ্রলোক (?) বোধহয় আমার কথায় একটু বিব্রত হলেন। পাশের জন বললো- কোথায় চাকরি করেন? ভিজিটিং কার্ড দেন। কার্ড দেখেই বললো, ও আপনি সাংবাদিক, আগে বলবেন না। কেন ভাই, সাংবাদিক জানলে কি ’৭১ সালে পাক সেনারা যেমন এই দেশের মানুষের লুঙ্গি খুলে ধর্ম পরীক্ষা করেছিলো তেমনভাবে আমাকে পরীক্ষা করতেন। আমার উত্তর বোধহয় তাদের মনঃপুত হয়নি তাই দুইজন তাড়াতাড়ি চলে গেল আর অন্যজন পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে হরিপদ ডাক্তারের মত ভিসার নাড়ি-ভুড়ি টিপে বললো, ভিসা ঠিক আছে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দেন।
নরওয়ে গাডারমেনন বিমানবন্দরে পৌঁছালাম স্থানীয় সময় রাত এগারটায় । সত্যিকার অর্থে এটাকে রাত বললে ভুল হবে। সূর্ষ্যি মামা তখনও জেগে আছে। চারিদিকে ঝলমল করছে রৌদ্দুর। এতদিন বইতে পড়েছি নরওয়ে নিশিথ সূর্ষের দেশ। এবার নিজ চোখে দেখলাম। নরওয়েতে এটা গ্রীষ্মকাল হলেও আবহাওয়া আামদের দেশের বসন্তকালের মত। হালকা শীত আর মৃদুমন্দ দখিনা সমীরণ। এই বিমানবন্দরে আমাদের দেশের মত করিৎকর্মা কর্মচারি-কর্মকর্তার বড্ড অভাব। বাংলাদেশে এয়ারপোর্টের লোকজন যেমন শকুনের মত যাত্রীর ব্যাগের দিক তাকিয়ে থাকে, এখানে তার বালাই নেই। কোন ফরমালিটিজ আছে কিনা একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ট্যাক্স দেবার মত কিছু থাকলে লাল আলো আর না থাকলে সবুজ আলো চিহ্নিত রাস্তা দিয়ে চলে যান।
গাডারমেনন থেকে অসলো প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এয়ারপোর্ট থেকে বাস বা ট্রেন দুইভাবেই এখান থেকে অসলোতে যাওয়া যায়। বাস ভেদে ভাড়া বাংলাদেশী টাকায় ২২০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর দ্রুতগতির ট্রেন যেটাতে অসলো পোঁছতে সময় লাগে মাত্র ১৯ মিনিট তার ভাড়া ২৬০০ টাকার মত। তবে লোকাল ট্রেনে ভাড়া একটু কম এবং সময়ও লাগে বেশী। টাকা যায়ই লাগুকনা কেন অবশ্যই এই দ্রুতগতির ট্রেনে ভ্রমণ এক অন্যরকম আনন্দের। গ্রীষ্মকালে ইউরোপের প্রকৃতি এবং মানুষের সৌন্দর্যই আলাদা। রাস্তার দুইধারে সবুজ প্রকৃতি, মাঝে মাঝে গম ও আলুর ক্ষেত পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তা আর এই ৫০ কিলোমিটারে হাতেগোনা দুইএকজন মানুষ।
ঢাকা ছাড়ার আগে কয়েকবার কথা হয় আলম ভাইয়ের সাথে। আলম ভাই, পুরো নাম মোহাম্মদ আলম খুরশীদ, আমার পাশের গ্রামেই তার বাড়ি। প্রায় ২৫ বছর যাবৎ নরওয়েতে আছেন। পরোপকারি এবং বন্ধুবৎসল মানুষ তিনি। দেশের কাউকে পেলে আনন্দের সীমা থাকেনা তার। নিজের কাজের ফাঁকের সব সময়টুকু উজাড় করে দেন দেশের মানুষের জন্য। সময়ের অভাবে এয়ারপোর্টে আসতে পারেননি। কথাছিলো আলম ভাই অসলো সেন্ট্রাল ষ্টেশনে অপেক্ষা করবেন। সেখানে নামতেই পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সোজা তার বাসা। হতবাক হলাম ভাবী আর তার দুই মেয়েকে দেখে। আমার জন্য টেবিলে খাবার সাঁজিয়ে তারা অপেক্ষা করছে। এ যেন চিরায়ত বাঙ্গালীয়ানা। টেবিলে মাছ, মাংশ, সব্জি, ডাল ও ভাত। ভাবীর রান্নার তুলনা হয়না আর প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে বাঙ্গালী খাবার, অমৃত তুল্য মনে হল। নরওয়েতে সবারই ব্যস্ত জীবন। তারপরেও গল্পের ছলে ভাবী যখনই আমার পছন্দের কোন খাবারের কথা জেনেছেন তারপরদিনই আলম ভাইয়ের ফোন, তারেক তাড়াতাড়ি চলে আস, আমরা তোমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছি। এইভাবে টেবিলে খাবার সাঁজিয়ে অনেকদিন অপেক্ষা করেছেন আলম ভাই আর ভাবী। কখনই বুঝতে পারিনি স্বদেশে না বিদেশে আছি। প্রতিদিন তিন-চার ফোন করে খোঁজ নেন আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে কী না, কিছু লাগবে কী না? আবার কোনদিন ছোট মেয়ে আনিয়াকে নিয়ে সোজা আমার বাসায় হাজির।
(চলবে...)

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

দ্যা রিডার এর ছবি

চলুক

সাফি এর ছবি

গাডারমেনন থেকে তো শুধুই দ্রুত গতির ট্রেইনটা যেত, এখন কী লোকাল ট্রেইনগুলোও যায়?

সাংবাদিকে পেশা বলায় জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি ভাই প্রথম আলোর স্পোর্ট্স রিপোর্টার তারেক মাহমুদ? তাহলে দুইখান কথা আছে।

কল্যাণF এর ছবি

ভাই কিছু মনে করবেন না তবে একটা কথা বলি, বাংলাদেশের বাইরে বসে বাংলাদেশী টাকায় কত খরচ হচ্ছে সেই হিসাব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, মেলা শান্তি পাবেন দেঁতো হাসি

অঅসাধারন এর ছবি

ভাই কিছু মনে করবেন না তবে একটা কথা বলি, বাংলাদেশের বাইরে বসে বাংলাদেশী টাকায় কত খরচ হচ্ছে সেই হিসাব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, মেলা শান্তি পাবেন

দেঁতো হাসি

কারো একটু বেশি সময় লাগে কারো কম। দুই বছর হয়ে গেল, এখনো হিসাবটা চট করে চলে আসে, তবে অশান্তি সৃষ্টি করে না

রু (অতিথি) এর ছবি

পরের পর্বটা দিতে দেরি করেন না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।