একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২১/১০/২০১১ - ১:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মন খারাপ নাকি মেজাজ খারাপ ঠিক বুঝতে পারছিনা। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি যে, অফিসে ভাল লাগছেনা। মাত্র দু’সপ্তাহ হল আমি একটা লম্বা ছুটি কাটিয়ে ফিরেছি। এরই মধ্যে বেজায় ক্লান্তি জেঁকে বসেছে। গত কদিন ধরে চিত্তে উচাটন, বালুর মাঠ - কাশ বন ছাড়িয়ে ছুটেই চলেছে কল্পনাপ্রসূত মন। “ইচ্ছে করে যাই চলে যাই অনেক দূর...”।

হঠাৎ ডেস্ক-এর ফোন বেজে ওঠায় কল্পনা’র জগত ছেরে স্বপ্নাচ্ছন্ন আমি বাস্তবতায় ফিরে আসি। সেলস ফ্লোর থেকে ফোন – অমুক মাল নেই, তমুক মাল কখন আসবে। ধুত, হল কিছু? কি সুন্দর দিবা-স্বপ্ন দেখছিলাম। প্রতিদিনকার ঝঞ্জাপূর্ন অফিস রুটিন থেকে আমার মন কি সুন্দর ডলফিনের মত ডাইভ দিয়ে সীমানা বেষ্টনীর ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছিল। টেলিফোনের যান্ত্রিক আর্তি আমার উড়ন্ত মনের পায়ে বেড়ি পরিয়ে, টেনে হিঁচড়ে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে এলো। চাইলেই আর ক্লাস এর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে শামসু মামার ক্যান্টিনে গিয়ে চা-সিঙ্গারা খাওয়া যায়না। হ্যাঁ, এক কাপ চা বরং খাওয়া যায়। পিওন কে হাঁক দিলাম, “ডাবল টি-ব্যাগ দিয়ে এক কাপ চা দাও”।

শান্ত পুকুরে ঢিল ছুড়লে যে ঢেউ ওঠে, সেটা মিলিয়ে আবার শান্ত পুকুরের সেই একই চেহারা ফিরে আসতে সময় লাগে খানিকক্ষণ। অনেক চেষ্টা করেও আমি আর সেই “ডলফিন ডাইভ”টা দিতে পারলাম না। পরে রইলাম; পায়ে কর্তব্যের বেড়ি আর কাঁধে প্রত্যাশার ঝোলা নিয়ে… অপারগ।

এলোমেলো চিন্তা গুলোকে একটু গুছিয়ে লিখে ফেললেই হয়। একগুঁয়েমিটাও কিছুটা কাটবে। এই ভাবনা থেকেই, ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নতুন একটা ওয়ার্ড ফাইল খুলে মননিবেশ করলাম। সচলায়তনের কিছুটা প্রভাব আছে বৈকি - সচলাসক্তি। অফিসে কে যেন সেদিন বলছিল – “ব্লগ ইজ দ্যা নেক্সট ফ্যাড”। আরে মজা নাকি? ব্লগ কে হুজুগ বলে আখ্যায়িত করা বানীটি কেন অপাংক্তেয় বলে গণ্য হবেনা – এই মর্মে একটি রিট জারি করা উচিৎ। ঠিক এই মুহূর্তেও আমার আশেপাশের “ওয়ার্ক স্টেশন” গুলোর প্রায় সবকটাতেই সচলায়তন এর নীড়পাতা খোলা। না হয় মানলাম, আজকে কাজ একটু কম। অন্যদিন গুলতেও এর খুব একটা বিচ্যুতি ঘটে না।

মাঝে মাঝে এমন হয়। অনেক ভাবনা মাথায় আসে, কিন্তু লিখতে বসলেই সেগুলো কেমন কর্পূরের মত বেমালুম উবে যায়। মাথার ভেতর শব্দজট দেখতে দেখতে পর্বত সম ঘূর্ণিতে পরিণত হল। হৃত্তিক এর মত “হিরো হোন্ডা”য় চরে আমি সেই ঘূর্ণি’র মাঝখান থেকে “অ্যাপ্প্রোপ্রিয়েট” শব্দ গুলো লুফে নিতে পারছিনা। [পাঠক, ক্ষমা করবেন। “অ্যাপ্প্রোপ্রিয়েট” শব্দের সমার্থক যুতসই বাংলা শব্দ এ মুহূর্তে মনে পরছেনা।]

এই সময় আবার ফোন এলো। নাহ্‌, এবার সেলস ফ্লোর থেকে না। আমাদের জামান সাহেব। তিনি বিশিষ্ট চাটুকার, কথার জাদুকর। অনায়াসেই আপনাকে তৈল মর্দন করত: তাঁর কাজটি করিয়ে নিতে পারবেন। আমি পারলাম না তাঁর মোহনীয় কথার মারপ্যাঁচ কে ফাঁকি দিতে। মেসির মত মনোমুগ্ধকর নৈপুণ্য দেখিয়ে ভদ্রলোক আমার ডিফেন্স কে তছনছ করে আলতো শটে গোল দিলেন। আমাকে এখন তাঁর হয়ে খ্যাপ খেলতে হবে - একটা প্রেজেন্টেশন বানিয়ে দিতে হবে। [মূল কাজের বাইরে পদাতিক বলে চাপিয়ে দেয়া কোন “আজাইরা কাজ” অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিনয়াবনত: হয়ে করে দিতে হলে ব্যাপারটিকে আমরা “খ্যাপ খেলা” বলে থাকি।]

ডেস্ক এ ফিরে এসে মনিটরের কোনায় সময় দেখলাম ৪:৩০। প্রকিউরমেন্ট অথবা কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্ট-এ থাকলে এতক্ষণ বাড়ি যাবার জন্য গোছগাছ শুরু করে দেয়া যেত। ৪:৪৫ এ লিফট ধরে নিচে নেমে, একটা সিগারেট। ৪:৫৫ এ রিক্সা যোগে বাড়ির পথে। হাতের কাজ শেষ, চাইলে বেড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে, এজেন্সি থেকে প্রেস লেআউট পাঠাবার কথা। সেটা অ্যাপ্রুভ করে বের হবো। এখন সেটা তাড়াতাড়ি পাঠালেই বাঁচি।

ঠিক তখনই গিন্নির ফোন
“অ্যাই, বাসায় ফেরার পথে মেঘা’র জন্যে সেরেল্যাক নিয়ে এসো”
“ঠিক আছে, নিয়ে আসবো”
“ভুলে যেওনা যেন। তোমার কি আজকেও দেরি হবে?”
“না বোধহয়। একটা মেইল দিয়েই বেড়িয়ে যাব। কোথাও যাবার প্ল্যান আছে?”
“নাহ্‌, বাসায় গেস্ট আসবে। তাড়াতাড়ি চলে এস”।

মেঘা আমার মেয়ে। বয়েস দেড় বছর। পুরো নাম – মন্তিকা মেঘায়ন্তি। অনেক চিন্তা ভাবনা করে ১০৮টা নামের বিশাল লিস্ট থেকে এই নামটা বেছে নেয়া হয়েছিল। নামের অন্তর্নিহিত অর্থটা আমাদের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। সবার ক্ষেত্রেই নিশ্চয় তাই। এ নিয়ে নাহয় আরেকদিন লিখব।

যা বলছিলাম, ফোন রেখে তীর্থের কাকের মত “অফিস আউটলুক” খুলে বসে রইলাম। অবশেষে বহু অপেক্ষার মেইল এলো। সম্মতিসূচক ফিরতি মেইল পাঠিয়ে যখন ভাবছি আজকের মত পরিত্রাণ পেলাম, তখনই আমাদের জামান সাহেব আবার ফোন করলেন। পাক্কা ৭মি ৪৩সেক সময় নিয়ে, ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হল – এক ঘণ্টা সময় নিয়ে যে প্রেজেন্টেশনটা তৈরি করা হয়েছে সেটা তিনি কোথায় সংরক্ষণ করেছেন খুঁজে পাচ্ছেন না, ভুলবশত মুছে ফেলেছেন কিনা তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। স্বভাবসুলভ বিগলিত কণ্ঠে খুব করে অনুরোধ করলেন তাঁর সমস্যার সমাধান করে দিতেই হবে, “আরে আপনার জন্যে তো এটা কোন ব্যাপারই না, খালি একটা তুড়ি বাজাইবেন”।

আমার অস্থির মন বাড়ি ফিরতে চায়, সেটা উনাকে কিভাবে বোঝাই। অতঃপর আবারও অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। তুড়ি বাজানো শেষ করে যখন অফিস থেকে বেড় হলাম, সূর্য তখন আমেরিকায় উঁকি দিচ্ছে। জানিনা কতকাল অফিস থেকে বেড়িয়ে দিনের আলো দেখতে পাইনা। সূর্যের সাথে আমার দেখা হয় দিনে মোটে এক ঘণ্টা – সকালে অফিসে আসার সময়।

৬টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাব? জীবন কত দ্রুত পাল্টে যায়। কিছুদিন আগেও অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি বের হতে পারলে ক্যাম্পাস-এ চলে যেতাম। আইবিএ অথবা বিজনেস ফ্যাকাল্টি’র বারান্দায় রাত পর্যন্ত চলত আড্ডা আর ইন্টারন্যাশনাল ব্রীজ। সাহিত্য চর্চার মত তাস খেলাটাও বোধহয় যৌবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাই হোক, আমি বাড়ির পথেই রিক্সা ঠিক করলাম।

অচেনা আগুন্তুক
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"


মন্তব্য

সাফি এর ছবি

মেয়ের তো নিজের নাম উচ্চারণ করতে করতেই সব দাঁত পড়ে যাবে।

এপ্পরোপ্রিয়েটের বাংলা হতে পারে "যথাযথ"

reenreen এর ছবি

দোস্ত, মেয়ের নাম দেখে confirm হলাম এটা তুই!
আমারও আজকে অফিস করতে ভালো লাগতেছেনা, কোনোদিন ই অবশ্য লাগেনা মন খারাপ

চল, একদিন একসাথে lunch করি....

 তাপস শর্মা  এর ছবি

জীবন বয়ে যাক, আর আপনি এগিয়ে যান দাদা। মেঘার জন্য হাসি

আর লেখায় চলুক চলুক চলুক চলুক চলুক

কল্যাণF এর ছবি

তাপ্পর?

কালো কাক এর ছবি

প্রকিউরমেন্ট বা কমার্শিয়াল ৪ঃ৩০'এ গোছগাছ শুরু করতে পারেনা ভাইজান। চোখ টিপি

যাইহোক লেখা ভাল লাগছে .... হাসি

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

কালো কাক

এটা সম্পূর্ণ বেক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কাউকে হেয় করবার জন্যে নয়। তারপরও, আপনার অনুভূতিতে আঘাত এনে থাকলে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থী। লেখা ভাল লেগেছে শুনে ভাল লাগল।

অচেনা অগুন্তুক
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে

শাব্দিক এর ছবি

এটা কি ঠিক করলেন?
শুক্রুবার সকালে, আমাদের মত কর্পোরেট কামলাদের জীবন যে কত বিষাদগ্রস্ত মনে করিয়ে দিলেন। মন খারাপ
মনে হল নিজের দুপুরবেলাটাই পড়ছি।

যুমার এর ছবি

ভালো লেগেছে।

শিশিরকণা এর ছবি

অ্যাপ্রোপ্রিয়েটের সমার্থক যুতসই বাংলা শব্দ এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

... "যুতসই" শব্দটাই তো অ্যাপ্রোপ্রিয়েট সমার্থক বাংলা শব্দ।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

সার্থক  এর ছবি

চলুক

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

বোঝা যাচ্ছে ডায়েরী লেখায় আপনার বেশ ভালো দখল আছে।

তো, দিন না আরো কিছু পাতা।

লেখা ভালো লেগেছে। চলুক।

উচ্ছলা এর ছবি

ভালো লেগেছে হাসি

আপনার মেয়ের ১০৮টা নামের বিষয়টা পড়তেই আমার নিজের কাহিনী মনে পড়ে গেল। বাড়িশুদ্ধ লোকজন অসংখ্য নাম সাজেস্ট করেছিল আমার জন্মের আগেই। শর্টলিস্টেড হলো ৭৫টা নাম। টিকে গেল কোন্ দুইটা নাম, শুনবেন?....পুষু আর ঢেপী দেঁতো হাসি

আপনার মেয়ের নামটি অন্যরকম সুন্দর।

মর্ম এর ছবি

একটা সিরিজ করে ফেলতে পারেন কিন্তু চাইলে-

শিরোনাম হতে পারে- "কর্পোরেটের কলমে" কিংবা "কর্পোরেটের ডায়েরি" কিংবা "কর্পোলগ"-বা কিছু একটা! চিন্তিত

যাহোক সে আপনার ব্যাপার- তবে কর্পোকথন ভাল লাগছে। থামবেন না, পরের লেখার অপেক্ষায় পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

বন্দনা কবীর এর ছবি

আপনার মেয়েটার জন্য একটু দুসচিন্তা হচ্ছে. বাপ্রেহ! কী সাংঘাতিক নাম রেখেছেন!! হাসি

একগুঁয়েমি? নাকি এক ঘেঁইয়েমি?? :<

কর্পোরেট জীবনের আনন্দ-বেদনার গল্প চলতে থাকুক চলুক

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

আগেই বলেছি, ইংলিশ মিডিয়াম-এ পড়ালেখা। কিছু কিছু বানান ভুল হতে পারে... ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি তে দেখার অনুরোধ রইলো।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

অ্যাপ্রোপ্রিয়েটের বাংলা তো যুতসইই হয়! অথবা উপযুক্ত বা যথাযথ!

একেবারে আমার দুপুর! কিন্তু আমার বাড়ি যাবার পেটপুড়া শুরু করতে হয় সেই পোউনে ছয়টাত। মাঝে মাঝে আবার আউটলুকে বদামীতে আটকে পরা আটটার কাঁটায়! মন খারাপ

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

তানিম এহসান এর ছবি

অচেনা আগন্তুকের দ্বিতীয় আগমন ভালো লাগলো, তৃতীয়আগমন হওক!

reenreen এর ছবি

দোস্ত, মেয়ের নাম দেখে confirm হলাম এটা তুই!
আমারও আজকে অফিস করতে ভালো লাগতেছেনা, কোনোদিন ই অবশ্য লাগেনা মন খারাপ

চল, একদিন একসাথে lunch করি....

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।