একটি অলস কর্পোরেট দুপুর, অতঃপর... (দ্বিতীয় পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২২/১০/২০১১ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্বের শেষ দিয়েই, দ্বিতীয় পর্বের শুরু...

৬টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাব? জীবন কত দ্রুত পাল্টে যায়। কিছুদিন আগেও অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি বের হতে পারলে ক্যাম্পাস-এ চলে যেতাম। আইবিএ অথবা বিজনেস ফ্যাকাল্টি’র বারান্দায় রাত পর্যন্ত চলত আড্ডা আর ইন্টারন্যাশনাল ব্রীজ। প্রেমে আর সাহিত্য চর্চার মত আড্ডা আর তাস খেলাটাও বোধহয় যৌবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এমনও সময় ছিল সকাল ৭টার বাস ধরে ইউনিভার্সিটি পৌঁছে সোজা ক্যান্টিনে। সকালে ক্লাস থাকলেও করিনি কিংবা ক্লাস শেষেই ক্যান্টিন-এ প্রিয় জায়গাটায় বসার জন্যে ছুট। ক্যান্টিন বন্ধের সময় হলে শামসু মামা যখন জয়নাল কে পাঠাতেন সেদিন কার মত অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করতে তখনও আমাদের সাধ মেটেনি। অতঃপর সিঁড়িতে বসে আরও কিছুক্ষণ চলত দিনের আলোচনার আরেক দফা পর্যালোচনা।

আইবিএ’র একটা দুর্নাম আছে। অনেকেই ভাবে এখানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা বহির্জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এরকম ধারনা যে একেবারেই ভিত্তিহীন তা নয়। অবশ্য, এজন্য শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আনুষ্ঠানিক ভাবে না হলেও, প্রথম দিন থেকেই বুঝিয়ে দেয়া হয় আইবিএ’র বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর জগতটা আমাদের জন্য নয়। আমারা সেরাদের সেরা – আমাদের হাতেই ভবিষ্যৎ “কর্পোরেট বাংলাদেশ”-এর দায়িত্ব। আমরা বড়জোর ব্র্যাণ্ডিং কম্পিটিশন এ নিজের মেধার প্রমাণ দিতে পারি, অন্যান্য ছাত্র আন্দলন ধরনের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য নয়।

সামসুর নাহার হলে পুলিশি হামলার পর যখন গোটা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত, আইবিএ’র কতৃপক্ষ সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতঃ “অল্টারনেট ভেন্যু” তে ক্লাস আর পরীক্ষা নিয়ে সময়মত সেমেস্টার শেষ করাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অবশ্য এর সুফল স্বরূপ সেশনজট নামক বিদঘুটে বস্তুটির সাথে আমদের দেখা হয় নি। এভাবেই আমাদের আলাদা করে রাখা হয়। এ দায় শুধু আইবিএ’র নয়। অভিবাবকরাও যে বহির্জগতটাকে জানতে খুব একটা উৎসাহিত করেন সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবেনা। জেনে অবাক হবেন, চার বছরের পড়ালেখা শেষ করে যখন পাশ করলাম তখনও সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে একটি বারের জন্যেও “মধুর ক্যান্টিন”-এ যায় নি, কেউ কেউ আবার গ্র্যাজুয়েশনের দিন প্রথম বার টিএসসি তে পা রাখে। আমরা বেড়ে উঠি, বড় হই ফার্মের মুরগির মত, লজ্জা বৈকি।

যাই হোক, এই ক্যান্টিনের আড্ডা আর তাস খেলার সুবাদে ঢাকা বিশবিদ্যালয়-এর জগত কিছুটা হলেও অন্যরকম করে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাসের আড্ডায় সহপাঠীদের সাথে সাথে মার্কেটিং আর ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট এর কয়েকজন ছিল নিত্য সঙ্গী। একটা সময় ওদের সাথেই আমার গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে।

সেই আড্ডা’র সবাই এখন ভীষণ ব্যস্ত। কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর শিক্ষক, কেউ বহুজাতিক কোম্পানি তে চাকুরীরত। আমার মত ওদেরও কি এই আড্ডা’র জন্য মন ভিজে ওঠে? খুব জানতে ইচ্ছে করে ওদেরও নতুন করে সেই আড্ডায় মশগুল হতে ইচ্ছে করে কিনা। একটা ফোন করে দেখব? বন্ধুদের সাথে অনেক দিন কথা না হলে, কেমন যেন দূরত্ব তৈরী হয়। একটা অদৃশ্য কাঁচের দেয়াল সৃষ্টি হয়। বন্ধুর খুব পরিচিত “নখরামি” গুলোও অপিরিচিত লাগে। মনে হয়, “শালা ভাব নিচ্ছে, সিটিএন!”। চাকুরীতে ঢোকার পরে থেকেই আমাদের মধ্যে একটা বিরাট মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আসে। এটা শুধুই অনেক দিন কথা না হওয়ার কারণে নিজের বন্ধু-সত্ত্বার অনুযোগপূর্ণ অভিমান নাকি দেশবরেণ্য কোম্পানি তে চাকুরীরত দাম্ভিক কর্পোরেট সত্ত্বার একটু ভিন্ন ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করার অপ-প্রচেষ্টা - সেটা চিন্তার বিষয়।

নিজের সাথে যুক্তিতর্ক ও বাকবিতণ্ডা শেষে আমার বন্ধু সত্ত্বার জয় হল। ফোনের “এড্রেস বুক” থেকে নাম্বার বের করে ডায়াল করলাম। ওপাশে কৃষ্ণকলি’র গান বেজে উঠলো, “... বন্ধু আমার বন্ধু তুমি বন্ধু মোরা কজন, তবুও বন্ধু মন হল না আপন...”।
ঃ হ্যালো, আসসালামু ওয়ালাইকুম।
ঃ কিরে কেমন আছিস?
ঃ কে বলছেন? ঠিক চিনতে পারলাম না।
ঃ দোস্ত আমি - “অচেনা আগুন্তুক”
ঃ হঠাৎ! কি ব্যাপার? সব ভাল? ফোন হারায় গেসিলো রে, তাই নাম্বার সেভ করা নাই।
ঃ অসুবিধা নাই, এমনিই ফোন করলাম। কেমন আসিস? অনেকদিন কথা হয় না।
ঃ হুম্‌, সে তো অনেকদিন কথা হয় না। আমি আসি ভালই। তোর কাজ কেমন চলে?
ঃ কাজ আর কি, চলে এক রকম।

এ পর্যায়ে, কথা খুঁজে না পেয়ে আমরা দুজনই শাস্রুদ্ধকর অস্বস্তিতে পরে গেলাম। কথা চালিয়ে নেয়াটাই কষ্টকর। আরও কিছু এলোমেলো কথাবার্তা বলে কোন রকম দায়সাড়া ভাবে ফোন রেখে হাঁফ ছেড়ে বাচলাম দুজনই। আর কিছুদিন পর হয়ত এ বন্ধুদের সাথে আমার সম্পর্কটা “তুই” থেকে “তুমি”তে এসে ঠেকবে। অদ্ভুত, দুর্ভাগ্যজনক কিন্তু এটাই হয়ত জীবনের রূঢ় বাস্তবতা।

তবুও জীবন এগিয়ে চলে। আমরাও নিজেদের একটু আধটু পরিবর্তন, পরিশোধন করে আবহমান স্রোতের সাথে ভেসে চলি - মাতাল সমুদ্রে খড়কুটোর মত, ঝড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতার মত। ভাসতে ভাসতে অতি পরিচিত মুখ গুলো থেকে একটু একটু করে অনেক দূরে সরে যাই।

অগত্যা, ফোন রেখে আমি বাড়ির পথে রিক্সা ঠিক করলাম। সারাদিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অফিসে আসা আর ফেরার পথে এই দুই ঘণ্টা যত টুকু সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখি। ব্যস্ততা আর প্রত্যাশা’র মাঝে এটুকু সময়ই আমাকে নিজের মুখোমুখি এনে দাড় করায়। এ সময়টুকু একান্তই আমার, নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাবার জন্যে।

ঢাকার ভয়াবহ যানজট-ব্যূহ ভেদ করে রিক্সা যখন ছুটে চলছিল, মনে হচ্ছিল একটু একটু করে জীবন ফিরে পাচ্ছে আমার নিথর দেহটা। যতই বাড়ির কাছাকাছি আসছিলাম, এক অদ্ভুত ধরনের উদ্দীপনা আমার শিরা-উপশিরা বেয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পরছিল। আমি ছুটলাম। কলিং বেল বাজাতেই শুনতে পেলাম, খুব উত্তেজিত একটা মিহি গলার আওয়াজ, “বা-আ-বা আ-ত্‌তে”। আমার ঠোঁটের কোনে রাজ্যের সুখ উঁকি দেয়।

অচেনা আগুন্তুক
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

জ.ই মানিক এর ছবি

জীবন যখন যেমন।

দ্যা রিডার এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

শেষ লাইনটার আগ পর্যন্ত বেশ ভার ভার লাগছিল

সজল এর ছবি

চলুক

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মৌনকুহর এর ছবি

চলুক

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

ইমন এর ছবি

গল্পের শেষটা চমৎকার।

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

ভালোলাগা......... চলুক

প্রতিক এর ছবি

একজন কর্পোরেট ই বোঝে আরেক কর্পোরেট এর দুঃখ। এই প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় দুটো পয়সা আর সমাজে বলার মত একটু ভাল পরিচয় দেয়ার লোভে জীবনের কত সাধ আহ্লাদ কে বিসর্জন দিলাম আমরা। আপনার এই লেখা শত শত যুবকের হাহাকার এর প্রতিধধনি। তবে শেষে যা লিখলেন, সেটার কোনও জবাব নেই। সব বাবাই দিন শেষের ঐ ডাক-টার টােনই কর্পোরেট নামক জাহান্নাম কেও হজম করে ফেলে পাছে ডাকটা মলিন না হোয়ে যায়।

এই নিয়েই আরো লিখুন। অনেক সময় কষ্ট জিনিস টাও উপভোগ করা যায় যদি নিজের সাথে মিলে যায় অন্য কারো কথা। কোলাকুলি

প্রতিক।

অচেনা আগুন্তুক এর ছবি

ধন্যবাদ প্রতিক। ছাত্র জীবন শেষ করে চাকুরী তে এসেই আমাদের চিন্তাধারা বিরাট একটা ধাক্কা খায়। এখানে অনুভূতির চাইতে তথ্য উপাত্য নিয়েই সবাই বেশি ব্যস্ত। আপনার-আমার মনের ভেতর কি চলছে তাতে কার কি এসে যায়। কোম্পানি শুধু সিন শেষে হিসেব মেলায় - আপনাকে কোম্পানি কি দিল আর আপনি কি দিলেন। স্বভাবতই আপনি-আমি নিজেদের নিঃশেষ করে দেই...

অচেনা আগুন্তুক
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"

আশালতা এর ছবি

ভারী সুন্দর করে লিখেছেন। ভালো লাগলো। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

বা-আ-বা আ-ততে

এভাবেই পাল্টায় সুখের ধরন!

তানিম এহসান এর ছবি

আরে কমেন্ট করেছিলাম সেটা গেলো কোথায়? গুম হয়ে গেছে সাদা পোষাকধারী লোকজনের হাতে!

অচেনা আগন্তুকের দ্বিতীয় আগমন ভালো লাগলো। তৃতীয়আগমন হওক!

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

চলুক

বন্দনা এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো লিখাটা। আর ও লিখুন অচেনা আগন্তুক।

উচ্ছলা এর ছবি
ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।