কলেজে পড়াকালিন ছুটিছাটাতে প্রায়ই আমি গ্রামের বাড়িতে যেতাম। যদিও আমরা তখন মফস্বল শহরেই থাকতাম তথাপিও গ্রাম আমাকে প্রচন্ডভাবেই আকৃষ্ট করত।
গ্রামে আমাদের বাড়ির সামনেই বিশাল একটি বাওড় আছে। চাঁদনিরাতে আমরা নৌকায় চড়ে বাওড়ে ঘুরতে বেরোতাম। সাথে থাকতো কোঁচড়ভর্তি মুড়ি আর পাটালি। জোছনারাতে নৌকায় করে বাওড়ে ঘুরতে কী ভাল যে লাগত!
চাঁদের আলো বাওড়ের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক ধরনের রূপোলী আমেজ তৈরি করত। যতদুর চোঁখ যায় শুধুই রূপোলী রং এর অদ্ভুদ মাখামাখি। যখন ঢেউগুলো ভেঙে পড়ত তখন এক ধরনের আলোআঁধারির লুকোচুরি। দেখতে দেখতে আমি যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়তাম।
আমাদের গ্রামে বাজার সংলগ্ন একটি চালকল ছিল। চালকলের পাশেই একটি বড় বটগাছের নিচে একটি চালাঘর ছিল। যেটার শুধু চালটাই ছিল বাকি চারদিকই খোলা। প্রচন্ড গরমের সময়ও সেখানে ঝির ঝির করে মৃদু বাতাশ বইত। বেশ আরাম বোধ করতাম। বাজারে গেলে আমি সাধারণত ঐ চালাঘরটিতেই বসতাম। চালকলের মালিকের পক্ষ থেকে মুফতে চা-বিস্কুট, পান-সিগারেট ইত্যাদি খাওয়াও হতো।
চালকলে অনেক মহিলাই ধানঝাড়ার কাজ করতেন, দিনান্তে তাদের প্রাপ্য ছিল কয়েকটি টাকা আর আঁচলভর্তি চালের ক্ষুদ। ওখানে একজন প্রৌঢ়াও চালঝাড়ার কাজ করতেন।
একদিন আমি চালাঘর থেকে নেমে যাবার সময় হঠাৎই তিনি আমার সামনে এসে আমার উদ্দেশ্যে বললেন, " ভাই, আমারে কডা টাকা দিবি ? পরনের কাপরডা ছিঁড়ে গিয়েছে, শরম ঢাকতি পাচ্ছিনে।" ঐ মূহুর্তে আমার কাছে তাঁকে দেবার মত প্রয়োজনীয় টাকা ছিলনা। তাঁকে কথা দিয়েছিলাম, ফিরে যাবার আগে তাঁকে কাপড় কেনার টাকা দিয়ে যাব। আমি আমার কথা রেখেছিলাম। এভাবেই তাঁর সাথে আমার জানাশোনা।
এরপর যতবার গ্রামে গিয়েছি দেখা হলেই বলতেন, " ভাই কিরাম আছিস? যাওয়ার সুমায় কডা টাকা দিয়ে যাইস, বড্ড অভাব যাতিছে।" আমিও মাঝেমধ্যে জিজ্ঞাসা করতাম, " বু, তুমি কেমন আছ?" ফিরে আসবার সময় তাঁর হাতে বিশ-পঞ্চাশ যা পারতাম দিয়ে আসতাম।
একবার পুজোর ছুটিতে গ্রামে গিয়েছি, ওঁর সাথে দেখা হতেই বললেন, " শুনিছি তুই আইচিস, দুদিন ধইরে তোরে খুঁজছি, ভাই, আমার ঘরে একবেলা দুটো ডাইলভাত খাবি?" আমি সম্মতি জানাতেই বললেন, " তালি কাইল সন্দেয় আমার ঘরে আসিস।"
আমি পরদিন লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়ে ওঁর ঘরে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি খুবই উৎফুল্ল। বললেন, "ভাই তুই আইচিছ?" আমাকে তাঁর ভাঙাচোরা খড়ওঠা একচালা ঘরের কোনে একটি শতছিন্ন মাদুর পেতে দিলেন। সেটার যা অবস্থা তখন সেটাকে আর যাই হোক মাদুর বলে চেনা যায়না।
যাহোক, আমি বসলাম। তিনি কাঁচের গ্লাসে একগ্লাস পানি ও একটি চিনামাটির বাসনে কয়েকটি পাকান পিঠা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেল, " তুই আসপি তাই একজনের কাছতে গিলাস আর পেলেটটা চেয়ে আনিছি।" আমি দুটো পিঠে খেয়ে বাসনটা সরিয়ে দিলুম। বললেন, " ভাই পিঠে ভাল হইনি না? গুড় ছিলনা, নাছিমার কাছে চাতি গিইলাম তা সে এট্টুখানিই দিল। তাই দিয়ে কোনরকমে.....।"
তিনি থালায় করে আমাকে ভাত দিলেন। ভাতের পাশে দুটুকরো বেগুনভাজি। আর দুটো পুরোনো বাটির একটিতে বেগুন দিয়ে পুঁটিমাছ রান্না তরকারি আর অপরটিতে একটি কচি মুরগীর কয়েকটুকরো রান্নাকরা মাংস। বললেন, " ডাইল আছে।"
ভড়ং করবোনা, খেলাম বটে তবে ঠিক রুচিতে নেয়নি। কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকছিল।
যাহোক, খাওয়াদাওয়া সেরে উঠে দাঁড়ালাম, বিদায় নিয়ে চলে আসবো। উনি তখন বললেন, " তুই যে খেইয়ে মজা পাইসনি সেডা আমি বুজিছি, তুইতো পতিদিন এরচে ভাল খাওয়াই খাইস। বড় সাধ ছিল তোরে একদিন খাওয়াবো তাই....।"
ওঁর চোখের কোনা তখন চিকচিক করছে। আমিও তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে নিজের চোখের জল লুকিয়ে পালিয়ে এলুম।
পরীক্ষা ইত্যাদির কারনে বেশ কিছুদিন পর গ্রামে গিয়েছি। দিন দুয়েক পার হয়ে যাবার পরও ওঁকে না দেখতে পেয়ে চালকলের এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেল, " বুড়িতো মারা গিয়েছে। কদিন থেকেই শরীলডা ভাল ছিলনা, মিলিও আসিনি। সেদিন আইসলো, আমরা কাজ কত্তি বারণ কল্লাম, বল্লাম বাড়ি যাও, তা আমাদের কথা শুইনলোনা। বইল্লো, কাজ না কল্লি খাবোকি? কদিন চেইয়েচিন্তে খাইছি, এখন আর কেউ দিতি চাচ্ছেনা। সেদিন দুপুরির পর শরীলডা খারাপ লাগছিল তাই এক কুনায় শুয়ে ছিল। আমরা কাজ শেষ কইরে যাওয়ায় সুমায় ডাকতি যেইয়ে দেখি শরীলডা একদম হীম হইয়ে গিয়েছে। আমরা হাউমাউ কইরে উটতিই মালিক তাই দেইখে ডাক্কার ডেকে আইনলো। ডাক্তার বইল্লো মারা গিয়েছে।"
আমার পাশ থেকে তখন একজন বলল, " আমাদের একটা ভুল হয়ে গিয়েছে, আপনারে জানানো হইনি, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাজারের পাশে আপনাদের যে পড়ো জমিডা আছে ওর এক কুনায় বুড়ির কবর দিইয়া হইয়েছে।"
আমি তখন খুবই বিষণ্ণ বোধ করছিলাম। সত্যিই সে আমার `বু'ইতো ছিল!
শুধু মাত্র পারিবারিক সম্পর্কের কারনেইতো আর আত্মীয় হয়না। আত্মার সাথে যার সম্পর্ক সেইতো আত্মীয়।
অনেক পরে ঐ কবরটা আমি বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম।
প্রৌঢ়ভাবনা
মন্তব্য
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাই
দুরকে করলে নিকট বন্ধু
পরকে করলে ভাই।
facebook
পারফেক্ট, অণু ধন্যবাদ, আমার আর কিছু বলা লাগলো না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
এক একটা মানুষের সাথে আরও কত মানুষের প্রাণের গল্পই যে জড়িয়ে থাকে। আহা।
লেখা ভালো হয়েছে, টাইপো গুলো দেখে নেবেন আরেকবার নইলে বকা খাবার রিস্ক আছে আর সাধু চলিতের মিশ্রণটাও একটু খিয়াল কৈরা। আমি নিজেও এই দোষে দুষ্ট, তাও চান্স পেয়ে এক হাত মাস্টারি ফলালাম আরকি !
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
অনেক ধন্যবাদ। আজকাল বিনে পয়সায় যে মাস্টারনী পাওয়া যায় সেটাইতো জানতামনা।
প্রৌঢ়ভাবনা
তারেক অনু, কল্যান ফৌজদার, মৌনকুহর, তানিম এহসান, ত্রিমাত্রিক কবি সকলকে ধন্যবাদ।
প্রৌঢ়ভাবনা
সম্পর্কগুলো অদ্ভুত। কখন যে কার সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হবে সেটা বোধহয় অনুমান ও করা যায়না আগে থেকে।
ঠিক তাই।
প্রৌঢ়ভাবনার লেখা খুব মায়াময়। লেখা থামাবেন না, প্লীজ
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
বন্দনা, উচ্ছলা, অতিথি অন্যকেউ, বন্দনা কবীর, আপনাদের সকলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রৌঢ়ভাবনা
জীবনের পথে পথে কত নতুন সম্পর্ক যে তৈরী হয়! আমার সহোদর ভাই দুইজন, একজন ছোট আর একজন বড়। কিন্তু জীবনের প্রথম চাকরী (এখনও সেখানেই আছি) করতে ঢাকায় এসে চারজন সহকর্মীর সাথে এমন আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে যে আমি সবাইকে বলি যে, পৃথিবীতে আসবার সময় কিছু সম্পর্ক উপরওয়ালা সাথে দিয়ে পাঠিয়েছেন যেমন ভাই-বোন, বাবা-মা (রক্তের সম্পর্ক) আর কিছু সম্পর্ক আমরা নিজেরা তৈরী করি যেগুলো আত্মার সম্পর্ক। এই চারজন আমার আত্মার সম্পর্কের ভাই। আপনি কি আবুল ফজলের "আহবাণ" গল্পটি পড়েছেন? সেখানেও এমন একটি অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে। আপনার লেখাটি পড়ে আবারো প্রিয় লেখাটি পড়তে মন চাইছে। ধন্যবাদ।
দুঃখিত। আমি ঐ লেখাটা সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানিনা।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
'আহ্বান' গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, আবুল ফজলের নয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যে বিব্রত বোধ করছি।
জীবনে কিছু এমন মানুষের সাথে দেখা হয় যারা কোন কারণ ছাড়াই অন্যকে বিরক্ত করে। আবার কিছু এমন মানুষও আছে যারা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে কোন কারণ ছাড়াই। কিছু আপন মানুষ থাকে যারা আসলে কখনোই আপন হয় না। আবার কিছু অপরিচিত মানুষ আছে যারা অপরিচিত হয়েও আপনের চেয়ে বেশী করে। এক অদৃশ্য সুতার বন্ধন যেন। কেন এমন হয় কে জানে? শূন্যের উপর এই পৃথিবীটাকে যিনি ধরে রেখেছেন তার কাছে জিজ্ঞেস করা যায় হয়তো কিন্তু তিনি কি উত্তর দিতে বাধ্য?
লেখাটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
ফাহিমা দিলশাদ
ধন্যবাদ, বিশদে ভাললাগা জানাবার জন্য।
[url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42460 ]এই লেখাটি[/url] পড়ে দেখতে পারেন।
নতুন মন্তব্য করুন