হে ক্ষণিকের অতিথি.......

শামীমা রিমা এর ছবি
লিখেছেন শামীমা রিমা (তারিখ: সোম, ২৪/১০/২০১১ - ১০:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হে ক্ষণিকের অতিথি.......
শামীমা রিমা

‘সুবেহ্ সাদিক’,শব্দ দুটির জোর এত বেশী যে সমস্ত অশুভ শক্তি পরাভূত এবং পরাজিত হয় তার কাছে। আর ঊষার পূর্বাভাস মানেই সমস্ত অন্ধকার দাপিয়ে আলোর জগতের আমন্ত্রণ। তবে সবার কাছে ঊষার পূর্বাভাস হয়তো সবসময় আনন্দবার্তা বয়ে নিয়ে আসে না।বিশেষ করে নাইট ডিউটিরত কোন চিকিৎসকের কাছে আর সেটা যদি হয় এডমিশন নাইট তাও আবার নিউনেটের মতো জায়গায়। পাখির কিচিরমিচির ঘুমন্ত মানুষের এলার্ম ঘড়ির দায়িত্ব পালন করলেও জাগ্রত মানুষের জন্যে তা মোটেও সুখকর কোন কিছু নয়। যারা ঘুম কাতুরে কিংবা যাদের বালিশ ঘুমের বাতিক আছে তাদের কথা ভিন্ন। তবে ইনসমনিয়া যাদের নিত্য সঙ্গী তাদের কাছে ভোরের আলো ফোটা মানে আরও একটা দীর্ঘশ্বাস- আরও একটা নির্ঘুম রাত আর তার সাথে মিশে থাকে কিছুটা হতাশা আর একরাশ বিরক্তি। আর আমার কাছে এখন তা হতাশা,বিরক্তি এই সবকিছু ছাপিয়ে মোটামুটি অসহনীয় পর্যায়ে পদার্পন। নাইট ডিউটিতে আমার খারাপ লাগাটা শুরুই হয় শেষ রাতের দিকে। এর কারণ হতে পারে আমি এখনো পরিপূর্ণ ডাক্তার হতে পারিনি। কারণ স্যার ম্যাডামরা বলেন,যেদিন নাইট ডিউটি করার পরও দেখবে কোন খারাপ লাগছে না সেদিন বুঝতে পারবে তুমি পরিপূর্ণ ডাক্তার হয়েছ। আর পরিপূর্ণ ডাক্তার হবার কোন লক্ষণ আমি আমার মাঝে খুঁজেও পাচ্ছি না। যতই দিন যাচ্ছে খারাপ লাগার পরিমানটাও বাড়ছে বৈ কমছে না।

নিউনেটে ডিউটি তাই টেনশানটাও একটু বেশি। এতো ছোট ছোট বাচ্চা,কখন কোনটা খারাপ হয়ে যায় কিছুই বলা যায় না। একটা বাচ্চা ভর্তি হয়েছে রাত সাড়ে দশটায় । বাবা মায়ের প্রথম সন্তান । আমি কিছুক্ষণ পরপর তাদের চিন্তিত মুখগুলো দেখছিলাম । যদিও নতুন অতিথির আগমন উদযাপনে তাদের কোন কমতি নেই । বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছে তাকে দেখতে সাথে নতুন পোশাক। অক্সিজেন দেয়া অবস্থাতেও তার গায়ে একটা নতুন জামা জড়ানো হলো।ব াচ্চার মা গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি তাইতো বাবা,নানী সাথে আরও আত্মীয় স্বজন বাচ্চার পাশে।শিশুর প্রথম কান্না - যা শোনার সৌভাগ্য এদের হয়নি। তবুও আশা থেমে থাকে না আর তার ব্যপ্তিও কম না । তাইতো ওরা আশার সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়েছে । বাচ্চাটা যেকোনো মুহূর্তে খারাপ হয়ে যেতে পারে ,একথাটা আমি তাদেরকে যতবার বলতে গিয়েছি ততবারই উল্টো তাদের কাছ থেকে শুনে এসেছি ‘বাচ্চার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো এবং ভোর নাগাত তারা চলে যেতে পারবে কি-না?’। কারণ এটা তাদের বংশের প্রথম বাচ্চা। প্রথম সবকিছুর গুরুত্বই আলাদা। জীবনের প্রথম কান্না,প্রথম কথা বলা,প্রথম হাঁটতে শেখা,প্রথম হোঁচট খাওয়া,প্রথম ভালোলাগা,প্রথম প্রেম,এমনকি প্রথম বিরহ........সবকিছুই মনে আলাদা দাগ কাটে আর সেই দাগগুলোও অমোচনীয় কালি দিয়ে কাটা ।ত াইতো ইচ্ছে করলেই তা মুছে ফেলা যায় না বরং মুছতে গেলে তা আরও ঘনীভূত হতে থাকে । এটা হয়তো প্রথম অনুভূতিগুলোর রক্ষণশীলতা ।

বেশ কয়েকবার আমি বাচ্চাটার কাছে গেলাম এবং তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী নিষ্পাপ মুখখানা। প্রতিটি শিশুরই আলাদা সৌন্দর্য থাকে ।স বচেয়ে কালো যে শিশুটি ত্যাবড়ানো নাক নিয়ে জন্মায় তার চেহারায়ও কি কম আকর্ষণ থাকে। তবে বড় হবার সাথে সাথে চেহারার কমনীয়তা কমতে থাকে হয়তো কুটিলতা বাড়ে বলে।

বাচ্চাটা মারা যাবার তিন ঘন্টা পরও আমি তাদেরকে কথাটা বলতে পারলাম না। ব্যাপারটা এমন না যে,আমি এর আগে কখনো মৃত্যু দৃশ্য দেখিনি কিংবা মৃত্যুর প্রমাণপত্র লিখিনি। তবুও কেন জানি বলতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছিল,এই শিশুটির আগমন উপলক্ষে বাড়ির সবাই অনেক আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। অতিথিকে বরণ করার পূর্বপ্রস্তুতিও নিতান্তই সাধারণ ছিল না। তার নানী,দাদী অনেকগুলো নকশীকাঁথা সেলাই করেছিল হয়তো। হয়তোবা তার জন্যে ছোট্ট একটা বালিশ,একটা ছোট্ট দোলনাও বানানো হয়েছিল। আর মা সে নিশ্চয়ই কাজল বানিয়েছিল নিজ হাতে অনেক যত্ম করে,অনাগত সন্তানকে নজর ফোঁটা দিতে। যার জন্যে এতো আয়োজন,এতো প্রতীক্ষাÑতাকে কেন এভাবে চলে যেতে হলো ? তার মুখের আধো আধো কথা,গুটিগুটি পায়ে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ানো,লুকোচুরি খেলা,জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলে সঙ্কিত হওয়া আর বকার বদলে মায়ের আদরের আলিঙ্গনে খিলখিল করে হেসে উঠা,হোঁচট খেয়ে কান্না আবার মায়ের কোলে নিরাপদ আশ্রয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়া।

এখনো সে ঘুমাচ্ছে।ঘুমন্ত রাজকন্যা। যার ঘুম আর ভাঙ্গবে না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,ঘুমন্ত রাজকন্যা ,তুমি এতো আয়োজন উপেক্ষা করে চলে যেও না। তুমি না থাকলে এসবই তো অর্থহীন । এতোদিন তুমি তোমার মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলে ,সেই মা তোমাকে সারাজীবন আগলে রাখবে,তাকে ফেলে কেন তুমি চলে যাবে ?

তবে এটাও তো ঠিক ডাস্টবিনও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে সদ্যজাত শিশুর কান্নায় । তখন কী আমরা তাকে কোলে তুলে নেয়ার সাহস দেখাই ? তার কান্নার স্বরে শুধুতো আশ্রয় প্রার্থনা থাকে না তার সাথে মিশে থাকে প্রতিটি মা বাবার প্রতি ঘৃনা আর ধিক্কার । মিশে থাকে এই সভ্যসমাজের কিছু মুখোশধারী মানুষের প্রতি অভিযোগ,অনুযোগ। এই শিশুটিও তো আগের শিশুটির মতোই মায়ের গর্ভেই বেড়ে ওঠেছে এবং তারও একজন পিতা রয়েছে। কিন্তু তার জন্যে তো কেউ নকশী কাঁথা সেলাই করেনি । আর তার মা নজর ফোঁটা দেয়ার জন্য কাজলও বানায়নি । অন্যের বদ নজর থেকে সন্তানকে রক্ষা করার বদলে তাকে করেছে কুকুরের এক বেলা তৃপ্ত আহারের সামগ্রী ।

কী অদ্ভুত ব্যাপার ,একজনকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা আমরা করছি অথচ পারছি না। সে চলে যাচ্ছে। আর অন্যজন তারস্বরে চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে তার জন্যে আমরা কিছুই করছি না । তারও তো সুন্দর স্বাভাবিক জীবনের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারতো আমরা তাকে দিতে পারছি না।তাহলে এ দায় কার ? তবে কী এতো আয়োজন উপেক্ষা করে এই শিশুটির চলে যাওয়া আর ডাস্টবিনে পড়ে থাকা শিশুটির মাঝখানে কোন যোগসূত্র আছে ? না-কি এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ ?


মন্তব্য

guest_writer এর ছবি

না-কি এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ ?

সত্যিই আপনার লেখাটা খুব ভাল লেগেছে।

প্রৌঢ়ভাবনা

শামীমা রিমা এর ছবি

আমরা যখন নির্বাক তখন প্রকৃতিই তো প্রতিশোধ নিবে তাই না?
ধন্যবাদ

শামীমা রিমা

বন্দনা কবীর এর ছবি

প্রকৃতির প্রতিশোধ" এটা আমিও বিশ্বাস করি।

সারা বিশ্ব যখন ভ্রুন হত্যা বিরুধে আন্দোন চলে তখন এই উপমহাদেশে কেবন কন্যা ভ্রুন হত্যা নিয়ে প্রিবেদন পড়ি রোজ। ডাস্টবিনে কাঁচা কঁচি নাভি নিয়ে পড়ে থাকতে দেখি অনাহুত কন্যাদের। সেসব দেখে আমরা অল্প একটু মন খারাপ করে একটা নাতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দি। আর কেউ কেউ কাঁদি নিজেদের রাজকন্যাদের জন্য মন খারাপ

শামীমা রিমা এর ছবি

প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে কারণ আমরা তাকে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি।
অথচ আমরা কিন্তু পারি আমাদের রাজকণ্যাদের জন্য নিরবে চোখের পানি না ফেলে তাদের সুন্দর একটা জীবন দিতে।
ধন্যবাদ আপনাকে।

শামীমা রিমা

উচ্ছলা এর ছবি
শামীমা রিমা এর ছবি

তবে উপলব্দিটা কষ্টের।

Russel এর ছবি

ভাল লিখেছেন আপু ।

শামীমা রিমা এর ছবি

হাসি হাসি

শাব্দিক এর ছবি

খুব কষ্টের কিছু কথা তবুও লেখাটা ভাল লাগল।

শামীমা রিমা এর ছবি

এই কষ্ট থেকেও যদি ওদের জন্য এতটুকু মমতা আর ভালোবাসার উদ্রেক হতো ।তাহলে হয়তো ওরা আর ক্ষণিকের অতিথি হতো না।

ধন্যবাদ

অঅসাধারন এর ছবি

প্রকৃতির প্রতিশোধ

ভাবালেন!

শামীমা রিমা এর ছবি

বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। তাইতো অন‌্যদেরকেও ভাবাতে ইচ্ছে হলো।

বন্দনা এর ছবি

লিখাটা খুব ছুয়ে গেলো রিমা।

শামীমা রিমা এর ছবি

কষ্ট করে পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।