ছোট পিসি বড় পিসি

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/১০/২০১১ - ১:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১.
আমার দুপিসি। বড় পিসি ক্ষেপি পিসি। ছোট পিসি পচি পিসি। নামের মতই তারা নির্মল।

ক্ষেপি পিসি বাবার বড়। দুজনের মা বাল্যকালে মারা যান। তিনি ছিলেন হীরা বাড়ির সাতভাই চম্পা পারুল। ছিলেন শ্যামলা মেয়ে। ছিলেন মুখ বুজে কাজ করা বউ। তার স্বামী গান বাজনা নিয়ে ব্যস্ত। একদিন চুনখোলা থেকে গান গেয়ে ফেরার সময় তার সাইকেলে চড়ে বসেছিল ফুটফুটে মেয়ে। তিনি ছিলেন সুন্দর। তিনি আমার গোরা ঠাকুরমা। এই সময় আমার ঠাকুরমা ছায়ার মত ফুরিয়ে গেলেন। সকলের মাঝ থেকে হাওয়া।

আমাদের পারিবারিক একমাত্র ছবিতে এই ঠাকুরমা ঘাড় নিচু করে বসেছিলেন। মুখে ঘোমটা। মলিন মুখ। হাসি নেই। একটু দূরে ঠাকুরদা—চোখে গোল্ড রিমের চশমা, পাশে গোরা ছোট বউ। কাছাকাছি ছোট পিসি। পরনে ফ্রক। বাবার গায়ে হাফ শার্ট। চুলে বাঁদিকে সিঁথি। আর মাঝখানে ক্ষেপি পিসি জোড় হাতে বসে বসে। সামনে তাদের মৃত ঠাকুরমা। সবার হয়ে ঠাকুরমার জন্য প্রার্থনা করছে। তার চক্ষু মুঞ্জা।

আমাদের বড় ঠাকুরমা মারা গেলে ছোট ঠাকুরমা ধীরে ধীরে পাগল হয়ে গেল। পরপর দুটি কাকা হয়েছিল। তারা জন্মকালেই সূর্য দেখেনি। এরপর থেকে পাগল ঠাকুরমা কারো সঙ্গে আর কথা বলেনি। পুকুরপাড়ে বসে থেকেছে—রাতের আঁধারে ঘুর ঘুর করেছে উঠোনে। একা একা বিড়বিড় করেছে। কোনো কোনো ছায়ার দিকে চেঁচিয়ে বলেছে, যারে যা, নিব্বুংইশা।

এই দুই ঠাকুরমার নাম কোথাও লেখা নেই। জোঁকা নেই। কি নাম ছিল তাদের?

২.
আমাদের কোনো স্মৃতিচিহ্ণ থাকতে নেই। শুধু একজনের আছে। তিনি মেজোঠাকুরদার তৃতীয় বউ। তিনি লীলাবতী। লীলাবতী মেঘে এলো তন্দ্রা। তিনি আমাদের মাইজারদ্দি। তার চুল ছিল রাত্রির মত কালো। আর চোখ ছিল জ্যোৎস্নার মত ধলো। এই চুল আর চোখ নিয়ে বহুদিন বেঁচে ছিলেন তার ঘর গেরস্থালীসমেত।

আর এই মধ্যে আমার ক্ষেপি পিসি পচি পিসি—আর মাঝখানে একটিমাত্র ভাই, এই তিনজন-- তিন ভাইবোন এই বড় বাড়ির মধ্যে একা হয়ে ছন্ন হয়ে ঘুরছে। মা নেই। ছোট মা পাগল। তাদের বাবা বাইরের মানুষ। বছরে কয়েকবার বেড়াতে আসেন। হাতে বোতলেবন্দি জল। সুতরাং তারা পচি-ক্ষেপি। তারা নো স্কুল। নো সাজন গোজন। আর আমাদের মাইজারদ্দির দু মেয়ে প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো। তারা নাচ। তারা গান। তাদের চুলে লাল রিবন। হাতে বালা। গলায় হার। তারা ক্লাশ টেন।

আমার পিসিদের কথা হেতা কেহ তো বলে না। তারা পচি। তারা ক্ষেপি। আর আছে শুধু মিছে কোলাহল।

৩.
ক্ষেপি পিসির বিয়ে হয়েছিল বেদগ্রামে। সেই বাড়ির চারিধারে বড়সড়ো মাঠ। বাড়িটির নাম ছিল পোড়া বাড়ি। বাড়িটিতে একটি ঘরে আগুন লেগেছিল। সে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল ক্ষেপি পিসির বড় ছেলে বড় মেয়ে। এরপরে পিসেমশাই মোল্লাকান্দি---এরপর পিসেমশাই ছোট বউ। ছোট বউ বলে, আমার যেমন বেণী তেমন রবে চুল ভেজাব না। তার চুল কখনো ভেজেনি। তার কোল আলো করা ছেলে। ছেলে গ গ করে বলে, অ মা, তোমার চুল কেন ভেজে না?

বড় পিসির বাড়িতে কখনো বেড়াতে যাওয়া হয়নি। বছরে দুকএবার নেমতন্ন করতে গেছি। তখন পিসেমশাই বাড়িতে নেই। বাজারে গেছেন। তার ছোট ভাইটি ভাসাবাবু—বটতলায় মদ গিলছেন। আমাদের দেখে বলছেন, এ আজাদি ঝুটা হ্যায়—লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। তার হাতে চকচকে রূপোর বালা। বলি, ভাসাকাকু, ইনসান মানে কি? তিনি হা হা করে হেসে ওঠেন। বোতলটা মাথার উপরে একটু ছুড়ে মেরে আবার ধরেন। আবার ছুড়ে মারেন। আবার ধরে ফেলেন। ঠা ঠা করে বলেন, কদম কদম বাড়ায়ে যা। আমরা কদম কদম বাড়ায়ে যাই।

পিসিদের বারান্দায় মোল্লাকান্দির সতীন পিসি তখন ছেলেটিকে মাই দিচ্ছেন। মুখ উঁচিয়ে বলছেন, তোমাগো পিসির কাণ্ড শুনিছো? হ্যায় শ্বশুরমশাইয়ের চশমা ভাংছে।

আমরা ভয়ে ভয়ে গোয়ালঘরের পানে যাই। দেখতে পাই হাদঅ বিশ্বাস ছড় বেছড় গালি পাড়ছে। সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষেপি পিসি-- হাতে গোবর গোলা। চোখ তার ঘোলা। পায়ের কাছে সুতা দিয়ে গাঁথা চশমার ফ্রেম। আর উবু হয়ে ভাঙা কাঁচের টুকরো কুড়োচ্ছে আমাদের পিসাতো বোন তৃপ্তি। এই তৃপ্তি ক্লাশ ফাইভ। এই তৃপ্তি ভাঙা কাঁচ। এই তৃপ্তি ঝড়ে ভাঙা গাছ। এই তৃপ্তি স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলমল॥

৪.
ছোট পিসির বাড়ি কোন্দরগাতি। ইউনিয়ন মাঝিগাতি। খাল থেকে একটু দূরে। চারিদিকে ধানক্ষেত। বাকা জল করিছে খেলা। এর মধ্যে মজুমদার বাড়ি। পিসমশাই এই বাড়ির হরিদাস।

একটি ঘরের বারান্দায় পিসিদের গেরস্থালী। দুটো ছাগলছানা। গোটা ছয়েক পাক পাক হাঁস। একটি তিলকী মিঁয়াও। বিড়াল কহে মাছ মাছ খাব না—কাশি যাব। কাশি যেয়ে মেকুর হব। মাঠে ধলি গাইটিকে আনতে গেলে ওরা সবাই পিসির আগে পাছে হাঁটে। আর মা মা করে ডাকে। এই এরা আমার পিসাতো ভাইবোন।
হরিদাস পিসেমশাই নৌকার ঠুকঠুক মিস্ত্রি। তাঁর এক বাক্স যন্ত্রপাতি। একটা গুপি যন্ত্র। আর এক জোড়া প্রেমজুড়ি। আর গান। গান বলে, তুমি নির্মল করে মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে। মর্ম শুনে হাসে।

ছোট পিসির বাড়ি আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম একাত্তরে। পাক হানাদার বাহিনী তার পরদিন গুলি করে সব সাফা করে দিয়েছিল। আমরা মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, কয়লা হয়ে পুড়ে গেছে সেই ছাগল ছানাটি। ধলি গরুটি।

চুয়াত্তরে যখন দুর্ভিক্ষ এসেছিল, তখন পচি পিসি আর পিসেমশাই কোন্দরগাতি ছেড়ে জন্মের মত চলে এসেছিল আমাদের শহরে। একটা ছাড়াবাড়িতে ঝুপড়ি ঘর তুলেছিল। সেই ঘরে রাতবিরেতে জোনাকি জ্বলত। আর ঝিঁঝিঁ পোকা। এই সময় আমাদের ছোট বোনটি হামাগুড়ি দিয়ে পিসির কোলে উঠে বলেছিল, পে। পচি পিসি সেই থেকে ছোট বোনটির প্রিয় পে। আর কিছু নয়।

৫.
দুপিসি যখন আমাদের বাড়ি আসত তখন ক্ষেপি পিসি পথ থেকে তুলে আনত নটে শাক। কটা সজনের ডাঁটা। অথবা ক’গোছা শাপলা। ভুর ভুর গন্ধভাদুল।
আর পচি পিসি নিয়ে আসত এক টিন মুড়ি। কিছু খইয়া মুড়ি ধানের খই। দুহালি ডিম। পাকা কুমড়ো। কটা জালি লাউ। শুকনো মরিচ—মরিচের গুড়ো। নৌকা থেকে নেমেছে এক ধামা আলা চাল। আর কিছু কোটা চিড়ে। এক হাড়ি নলেন গুড়। জাবা চিনি। একটা হাত পাখা। পাখাটি দিয়ে বাতাস খাবে তার দাদা।
ক্ষেপি পিসি এসেই মন্দিরে প্রণাম করত। জোড় হাতে কৃষ্ণের আষ্টোত্তর শতনাম বলে যেত।

শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন।
যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।।

তারপর ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর ঝাঁপির সামনে বসে চক্ষু মুদে বলে যেত—
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল।।

আর উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে—পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-- সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই/ শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই। সেই সুর আমাদের হাসনুহেনার ঝাড়ে মিশে যেত দূরে—বহুদূরে। চারিদিক তখন আশ্চর্য ঠাণ্ডা হয়ে যেত। শুধু ক্ষেপি পিসির সুর ভেসে ভেসে বেড়াত।

এর ফাঁকে, আমরা তখন হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। বুড়ি দিদি অঙ্ক। দাদা দি কাউ ইজ এ ফোর ফুটেড এনিম্যাল। আর তেজো বোনটি সদা সত্য কথা কহিবে। কদাচ মিথ্যা নহে। পিসি সে বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করেছে, প্রথম পৃষ্ঠা থেকে—আদর্শ লিপি। লেখক—সীতানাথ বসাক। প্রকাশকের নাম। ছাপাখানার ধাম। আর মুল্য। আর ভূমিকাসমেত স্বরে অ-তে-অজগর। স্বরে আ-তে আম। পিসি এইসব বই পড়ে যাচ্ছে কৃষ্ণের শতনামের সুরে। ছন্দে। আলো নিভে গেলেও এই পড়া কখনো থামতে শুনিনি। অন্ধকারের থিকিথিকির মধ্যে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন চুপ করে শুনতে পেতাম পিসি আদি অনাদি অনন্তকাল থেকে আদর্শলিপি প্রথম পাঠ পড়ে চলেছে। থামাথামি নেই। চলছে। চলবে।

ছোট পিসি তখন রান্নাঘরে আনাজ কুটছে। ভাতের হাড়িতে দুটো বেগুন ফেলে দিচ্ছে। আলু ছুলে রেখেছে। এরপর বারাষি বরই দিয়ে খাট্টা রানবে। চুকাই শাক ধুয়ে রেখেছে। রসুন দিয়ে একটু সুক্তো হবে। সন্ধ্যা ঘুরে গেলে ঘষে ঘষে সিয়োই পিঠে বানাবে। দুটো নাড়ু বের করে দিয়ে বলছে, বউদিগো, দাদার পাতে দিয়ে আসো। আর মুছি পাটালি। তার ইচ্ছে এই বাড়ির পুকুরে কটা পাক পাক হাঁস ছেড়ে দিয়ে যায়। হাঁসগুলি পুকুরে ভাসবে। হাঁস ছাড়া গেরস্ত বাড়ি হয় কি করে?

৬.
মধ্য রাত্রি এলে বারান্দায় বড়পিসি ছোট পিসি ক্ষেপি পিসি পচি পিসি চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। বাইরে তখন ঝিরঝির হাওয়া। নিমফুলের গন্ধ। আর মাঠ থেকে উড়ে আসছে বুনো জ্যোৎস্না। বড় পিসির বেঁচে মেয়ে তৃপ্তি তখন দূর দেশে পথে পথে ঘুরছে। আর ছোট পিসির তিলকি বিড়ালটি মা মা করে ছাড়া বাড়ির আনাচে কানাচে ঢুঁড়ছে। এর মধ্যে দুবোন দেখতে পাচ্ছে, পুকুর ঘাটে বড়মা মাছ ধুতে নেমেছে। সিঁড়ি ভেঙে একটু একটু জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাসমান জল এসে গেছে। জলে চুল ভেসে গেছে। তারপর কে একজন উঠোন থেকে ছুটে যেতে যেতে বলছে, দিদিইই। দিদিইই।।

এরা দুবোন হয়তো আমার পিসিদের দুটো মা। অথবা আমার বড় পিসি-ছোট পিসি। ক্ষেপি পিসি-পচি পিসি। এরা ছাড়া আর কে হবে?


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অসাধারণ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।