সাদা চোখে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৮/১০/২০১১ - ৮:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আসুন বিশ বছর পর কোনো এক সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের বুকে চোখ রাখি। সারি সারি গাড়ি দৌড়চ্ছে,প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি চত্বরে চোখে পড়ছে না ছাত্র-শিক্ষকদের আড্ডা,ভাবতেই অবাক লাগছে মাত্র দু দশক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পদচারনায় মুখর থাকত এই জায়গাটুকু! কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত,একে অন্যকে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিচ্ছে নিজের জন্য! ছোটো শিশুরা মাঠে যাচ্ছে না,তাদের জীবনে খেলাধুলার প্রয়োজন নেই,হাতে ট্যাবলেট কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে ঘরের ভিতরে!

এবার চোখ রাখি বিশ বছর আগে! নব্বই দশকের প্রথমভাগ। দেশজুড়ে তখন নতুন শিহরণ,নতুন স্বপ্ন।স্বৈরাচারের বিদায়ে নতুনভাবে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছে মানুষ,বেঁচে থাকার নতুন আশাবাদ সবার চোখেমুখে,বারবার ঠোক্কর খাওয়া বাঙ্গালির স্বপ্ন নতুন দিগন্ত দেখছে, প্রতিটি সূর্য যেন আসছে নতুন কোনও বারতা নিয়ে.........

বেশীদিন নয়, মাত্র চার দশক! এর মাঝে দেশের মানুষ রোবট হয়ে যাবে, এবং আশ্চর্যের বিষয়, এটি কষ্টকল্পনা নয়, আজকে, মাঝখানের সন্ধিক্ষনে দাড়িয়ে এ অবস্থাকেই আমার চরম বাস্তবতা মনে হচ্ছে! সাদা চোখে যা দেখছি,যা মনে হচ্ছে, তাই বলব, আমি ভুল হতে পারি, হয়ত একটু বাড়াবাড়ি রকমের কল্পনা করছি, কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হয়ত এর থেকে খুব বেশী ভালো নয়!

কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রণীত কৌশলপত্র বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে মৌলিক জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো বাদ যাচ্ছে, শুনে সে খুবই পুলকিত হল! তাঁর মতে, গবেষণা বিলাসিতা, আমাদের মত গরিব দেশের উচিত টেকনিকাল লেখাপড়ার উন্নতি ঘটিয়ে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে কর্মী নিয়োগ করা! খুব ই যৌক্তিক চিন্তা, সন্দেহ নেই, আর ভয়ের ব্যাপার এখানেই যে, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এই একটা ক্ষেত্রে যুক্তির বাইরে কিছু বুঝতে চায় না! আসুন আরেকদিকে চোখ দি। বছর কয়েক আগে এদেশের একটি টিভি চ্যানেল স্বাধীনতা দিবসে প্রচার করেছিল, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কতটুকু জানে। অনুষ্ঠানখানা দেখে চোখ কেবল চড়কগাছ হয়নি, কানটাও মনে হয় কানপুর থেকে ঘুরে আসতে চেয়েছিল! দেশের স্বনামধন্য এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করা হল, স্বাধীনতা দিবস কি? জবাবে তিনি বললেন, এদিন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে! আরেক বড় আপু খুব আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে শুরু করলেন, কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞানের দৌড় বোঝা গেল, যখন তিনি বললেন, ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা এদেশে হামলা করে, হামলার পর শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়! পাশে বসে থাকা আমার ভাই বলল, তাহলে ২৫মার্চ কি পাক সেনারা হা ডু ডু খেলেছিল? সেদিন সাক্ষাতকার নেওয়া সাংবাদিককে লাল হয়ে যেতে দেখেছিলাম, আমার ভুল ও হতে পারে, তবে টিভি সেটের সামনে বসে আমারই কানের কাছটা গরম গরম লাগছিল!

ঘটনাটা দুবছর আগের। এবার অতি সাম্প্রতিক একটা ঘটনা বলি। আমার এক আপুর বাসায় বেড়াতে গেলাম, আপুর বাচ্চাটা নার্সারিতে পড়ে, এখনি দিমদাম করে মুখের উপর ইংরেজি বলে, আপুকে জিজ্ঞেস করতে বলল, ওদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলায় কথা বলা বারণ! বাচ্চাটা আধো আধো বোলে বলতে পারে, দা আর্থ ইজ রাউন্ড, কিন্তু জানে না রাউন্ড মানে গোলাকার! কি আজব না? কি দরকার বাংলা শিখে? আইবিএ পরীক্ষায় বাংলায় প্রশ্ন আসে না!
অবাক হলাম শুনে, ওদের স্কুলে ড্রইং ক্লাস হয় না, যা একটা নামমাত্র হয়, সেখানে কার্টুন আকা শেখায়, না, শিশির ভট্যাচাজের কার্টুন নয়, পিটার প্যান বা টম অ্যান্ড জেরি! অদ্ভুত না? কি দরকার প্রাকৃতিক দৃশ্য শিখে? তুমি কোনোদিন শিল্পী হবে না বাছা, গ্রামেও যাবে না, এর চেয়ে বাড়ি বসে যা দেখো, তাই আঁক!

আসুন এবার এই ঘটনাগুলো একসুতোয় গাঁথি। প্রথম কথা, এদেশের পরবর্তী প্রজন্ম হবে বোবা ও কালা! তাদের কিছু শোনার বা শুনে বোঝার ক্ষমতা থাকবে না, নিজের কথা বলার ও ক্ষমতা থাকবে না.........। তারা শুধু রোবটের মত খাটবে, আর উন্নত বিশ্বের পদলেহন করবে! দ্বিতীয়ত, আমরা আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্য আমাদের ইতিহাস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলব, মুক্তিযুদ্ধটুকুও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না! তৃতীয়ত, মননশীলতা বলে এদেশে কিছু থাকবে না, মন ই থাকবে না, মননশীলতা অনেক দূর! চতুর্থত, আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথ পৌছবে না তারুণ্যের কাছে, কিভাবে পৌছবে? পৌছনোর সেতুই তো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে! লালনকে জাতে ওঠানোর মত কোনও গবেষক খুজে পাওয়া যাবে না, যাবে কিভাবে? দেশে মৌলিক জ্ঞানচর্চার পথ যে রুদ্ধ করে ফেলা হবে! আমাদের দেশের স্কুল গুলোয় কি শেখানো হচ্ছে, তা তো আমরা দেখলাম, দ্বিমত থাকতে পারে, তবে আমার মনে হয়, সরকারি স্কুল ও কলেজেই মননশীলতার মোটামুটি চর্চা হয়! কিন্তু এখান থাকে ঝরে পড়ার হারও অস্বীকার করার মত না। এখন এই মননশীলতার চর্চা যদি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে ভাবা যায়? বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হবে, তাহলে বিশ বছর পর আমরা বাংলাদেশকে সেই অবস্থায় দেখব, যে অবস্থার কথা আমি শুরুতে লিখেছি!
আমাদের সামনে অতল খাঁদ। সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে, আমরা খাঁদের অতলে হারাব, নাকি নতুন গিরি জয়ের পথে এগিয়ে যাব!

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

মর্ম এর ছবি

১। লেখা ভাল লাগল। হয়ত কথাগুলো সত্যই হয়ে যাবে ২০ বছর পর। তারপরও নিরাশ না হয়ে আশাবাদী হয়ে থাকতেই ভাল লাগে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন ২০ বছর পরও কিছু মানুষ একজন সত্যিকারের বাঙ্গালী হয়ে থাকবে, এ নিয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই।

২। লেখার সাথে ছবিটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ঠেকছে। আর লেখার শেষে আপনার নাম বা নিবন্ধিত নিকটিও দেবার কথাটি মনে রাখা দরকার।

৩। সচলে স্বাগতম হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

কালো কাক এর ছবি

২০ বছর পরে অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু সেটা যে খারাপই হবে তা নয়। আমাদের ২০ বছর আগে সমাজ যেমন ছিল এখন তেমন নাই। কিন্তু তাই বলে কি ২০ বছর আগে যা ছিল তাই সহী, এখন যা আছে সব ভুল, খারাপ তা বলা যায়? নিশ্চয়ই না। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সমাজের, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। এটা নিয়ে কান্নাকাটি করার কিছু নাই।

ছবিটা ক্যান ভাই? ২০ বছর পরে আরেকটা দিবেন? মিলায়া দেখব আমরা ??? লেখাটা বুঝছি, ছবির মাজেজা বুঝিনাই চিন্তিত

আশালতা এর ছবি

এই জিনিসগুলো আমরা কমবেশি জানিনা তা নয়, কিন্তু ভুলে থাকতে ইচ্ছে করে। ভাবতে বসলে ভয় ধরে যায় সত্যি ।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ছবি ক্যান?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নিটোল. এর ছবি

আমি ভুল হতে পারি, কিন্তু আপনার লেখা পড়ে আপনাকে কট্টর-নৈরাশ্যবাদী মনে হলো। আপনার অনেক কল্পনার সাথেই একমত নই। যাই হোক, এটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি।

কিন্তু কথা হইল, এইটা কার ছবি?লেখার সাথে এর সম্পর্ক কী?

কল্যাণF এর ছবি

এই সব আমরা যেমুন বুঝলাম, তেমুন যারা কিছুদিন আগে বাপ মা হইছে বা হইতাছে তারা কি বুঝে না? তারা তো আমাদেরি আশে পাশে আছে নাকি? এইটা কি সাধারন? নাকি একটা বিশেষ গোষ্ঠী এইরাম হইতাছে? ভাই কিছু মনে নিয়েন না, আমার মনে হইলো পোস্ট সম্পূর্ণ হয় নাই। লেখালেখি চালু থাকুক, শেষে ছবিটার মাজেজা ধর্তারি নাই।

তাপস শর্মা এর ছবি

বেশ ঝকঝকে লেখা। ভালো লাগলো চলুক

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

খুবই নৈরাশ্যবাদী লেখা। আসেন একটু আশাবাদী হই।

নিক পেলাম না, নিকের বদলে ছবি নিষ্প্রয়োজন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

শাব্দিক এর ছবি

জানি না আমার ধারণাটা সত্যি কি না, কিন্তু আমার সব সময় মনে হয় সুশিক্ষিত বাবা-মা এর ছেলে মেয়েরা সুশিক্ষিত হয়।

অরিত্র অরিত্র এর ছবি

যাই হোক, এটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গী।
একটা কথা, আপনি সচল পড়েন না? পড়লে ছবি দেয়ার তো কথা না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।