ধ্যাড়ধেড়ে একঘেঁয়ে জীবনটায় আর রসকষ বলে কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। সব পেয়ে বসা রস ছাড়া এই কষটে জীবনে একটু আনন্দের খোরাক যোগায় এমন ঘটনাও বিরল। টিভির মেগা সিরিয়ালের মত মিঠেহীন চুইংগাম চিবানোর মতই দিন-রাত পার করতে করতে ত্যাক্ত হয়ে অবশেষে ঘর ছাড়ার স্বিদ্ধান্ত নেয় শান্ত। বাবা-মা ব্যাস্ত শত কাজে। তাকে সময় দেবার সময় তাদের নেই। প্রয়োজনও বোধ করেনা হয়তো ছেলে বড় হয়ে গেছে ভেবে। ভাল রেজাল্ট করা নামি-দামী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের তো বন্ধুর অভাব হবার কথা নয়!
কিন্তু অদ্ভুত ভাবে শান্তর কোন বন্ধু নেই। যারা আছে তারা সবাই পরিচিত। পেটে খাতির বন্ধুত্ব আজ পর্যন্ত কারো সাথেই হয় নাই তার। এমন কি একটি মেয়ে বন্ধুও… যাকে লোকে গার্লফ্রেন্ড বলে তেমন। এ নিয়ে দুঃখবোধও নেই তার।
বিড়ি সিগারেট খাওয়া বা পাড়ার কোন চায়ের দোকানে বসে ঘন্টা ঘন্টা আড্ডা দেওয়া কিছুই নেই তার স্বভাবে। এক্কেবারে লক্ষি-পক্ষি, রবোটিক’ ছেলে বলেই হয়তো কেউ তার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করেনা। নিশ্চিন্দির জীবন আর পড়ালেখা নিয়েই বেশ সন্তষ্ট ছিল শান্ত এতোকাল। হঠাৎ কোনো কারন ছাড়া, কথা বার্তা ছাড়াই যেন অশান্ত হয়ে উঠলো সে!
ওয়াল আলমিরার ড্রয়ার টেনে যা কিছু সঞ্চয় সব পকেটে পোরে প্রথমে। দামী সাত আটটা ঘড়ি, দুনিয়া জুড়ে নামকরা কোম্পানির প্রায় ডজন খানেক কলম, একটা দামি ক্যামেরা, আর কিছু শার্ট-জামা-জিন্স একটা ব্যাগে প্যাক করে বের হতে গিয়ে কি মনে করে থমকে দাঁড়ায়।
‘নাহ, মা-বাবাকে অন্ততঃ কিছু একটা বলে যাওয়া উচিত’
বইয়ের স্তুপ সরিয়ে একটু জায়গা বের করে প্যাড টেনে নেয় শান্ত।
আম্মু,
ভাল লাগছেনা বাসায় থাকতে। তাই বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি এখনো জানিনা। নিরুদ্দেশ যাত্রা বলতে পারো। চিন্তা করোনা। সমস্যা হবেনা।
গেলাম।
শান্ত।
মায়ের শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের উপরে চিঠিটা একটা লোশনের বোতলে চাপা দিয়ে বের হয়ে আসে শান্ত।
২/
রাত সাড়ে এগোটায় রাত্রিকালীন প্রসাধনি সারতে এসে চিঠিটার সন্ধান পান রিজিয়া। সাথে সাথেই চিৎকার।
‘মলির মা…
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে আসে বয়সি কাজের বুয়া।
- জ্বে আম্মা।
- শান্ত কখোন বের হয়েছে?
- জ্বি, হাইঞ্জাবেলায় মুনয়।
এহ্। বুয়ার ভাষা শুনে বিরক্তিতে ঠোঁট কোঁচকান রিজিয়া।
- তোমাকে না কতবার বলেছি এই সব ভাষা বলবেনা? হাইঞ্জাবেলা কি হ্যা?
মলির মা’র মুখ কাঁচুমাচু।
- ওকে… শান্ত বেরোনোর সময় তুমি ঘরে ছিলেনা?
- জ্বে আছিলাম তো’ বলেই জ্বীভ কামড় দেয় মলির মা, জ্বি ছিলাম।
- শান্তর পরনে কি কাপড় ছিল? হাতে কিছু ছিল? ব্যাগ বা এরকম কিছু?
মলির মা জেরার জবাব আগেই নাট্যমঞ্চে শান্তর বাবা শাহদাত হোসেনের প্রবেশ।
- এনি প্রব্লেম?
চিঠিটা তার দিকে এগিয়ে ধরেন রিজিয়া। কাগজটায় চোখ বুলিয়েই বুয়াকে আগে বিদায় করেন শাহদাত হোসেন।
- আহ, এতে এতো অস্থির হওয়ার কি হল? শান্তকে ফোন করলেই তো হয়’ বলে নিজেই ফোন তুলে নিয়ে ছেলেকে ফোন করেন শাহদাত হোসেন। দু’বারের চেষ্টায় ছেলের ফোনের রিং শুনতে পান তিনি। স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলে ছেলের গলা শোনবার অপেক্ষায় থাকেন।
- হ্যালো?
- কোথায় তুমি?
- আমি তো ট্রেনে।
- ট্রেনে?! ট্রেনে কি করো?!
-…… যাচ্ছি।(নেটওয়ার্কের কারনে অর্ধেক কথা শোনা যায় কি যায় না)
- কোথায় যাচ্ছো?! ওখানে কি?!
- কিছুনা বাবা। ঘরে থাকতে ভাল লাগছিল না…
এবার গর্জে ওঠেন শাহাদাত হোসেন।
- ভাল লাগছেনা বলে না বলে যেতে হবে? আমাকে বললে তো আমি-ই তোমাকে ভালো কোন জায়গায় যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিতে…
এই পর্যায়ে টু…টু…টুউ…’ লাইন কাটার শব্দ। নেটওয়ার্ক অ-ব্যাবস্থার উপরে যারপর নাই বিরক্ত হয়ে নাকে ‘ঘোৎ’ একটা শব্দ তুলে ফোন ছুড়ে মারেন বিছানায়। শাহাদাত হোসেন
- কি হল? ফোন রেখে দিলে যে?! শান্ত কোথায়?
শাহদাত হোসেনের কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। জবাব দিতে ইচ্ছা করেনা। তাও দিতে হবে। নইলে এই রাত দুপুরে বিশ্রি ঝগড়া করতে হবে বৌ’র সাথে।
- রিল্যাক্স, শান্ত ট্রেনে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। নেটওয়ার্ক সমস্যা করছে তাই ঠিক মত শোনা গেল না। কাল সকালে ফোন করে জেনে নেবো।
একটু চুপ করে থেকে প্রায় স্বগোতোক্তির মত করে বলে ওঠেন, ‘ছেলেটাকে তো ফার্মের চিকেন করে গড়ে তুলেছো… হঠাৎ করে সে যে রোমিং চিকেন হওয়ার চেষ্টা করছে, এইটুকুই যা ভাবনার’…
শাহদাত সাহেবের এই কথাটায় চমকে তাকান রিজিয়া। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে তার। তার সেই চেহারা দেখে তাকে আস্বস্ত করেন শাহদাত সাহেব,
- ইজি… অতো চিন্তা করার কিছু নেই। কালকেই খুঁজে বের করে ফেলবো কোথায় আছে সে। এখন ওকে একটু এডভেঞ্চার করতে দাও…’ স্ত্রীকে বললেন বটে কিন্তু কথাটা নিজের কাছেই কেমন যেন সান্তনার মত শোনালো।
স্বামীর কথায় রিজিয়া একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মুখে পায়ে ক্রিম লোশন ঘষে ঘুমের তোড়জোড় শুরু করেন।
৩/
ভোরবেলা, ময়মনসিংহের শশী লজের পঞ্চাশ গজের ধারে কাছে একটি যুবককে উলটো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে একটি অল্প বয়সি মেয়ে দৌড়ে অন্যদের খবর দেয়। তারা এসে খবর দেয় পুলিশকে। অচেতন অবস্থায় যুবকটিকে তারা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর কিছুক্ষন বাদেই তাকে মৃত ঘোষনা করে কর্তব্যরত ডাক্তার। হাজার চেষ্টা করেও যুবকের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়না পুলিশের পক্ষে। যুবকের পকেটে একটা ছেঁড়া কাগজের টুকরোও পাওয়া যায়নি। দু’দিন বাদে স্থানিয় পত্রিকায় একটা ছবি ছাপে পুলিশ তার পরিচয় জানতে চেয়ে। কেউ তাকে সনাক্ত করতে আসেনা।
চারদিন বাদে পাঁচ দিনের দিন শান্তকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়’ এই তথ্যটা তার বাবা-মায়ের এই জীবনেও জানা হয়ে ওঠেনা।
বন্দনা কবীর
মন্তব্য
অসাধারণ ছাড়া বলার কিছু নেই। চমৎকার সমসাময়িক গল্প।
পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ
ভাল থাকুন
সুন্দর গল্প।
মন খারাপ হয়ে গেলো।
তাপস'দা, গল্পটা একটা উদ্দেশ্যে লিখেছি। সেটা কি, তা কি ধরতে পেরেছেন?
ভাল থাকুন।
হাই সোসাইটির অতি ব্যাস্ত কর্পোরেট বাপ-মা'র অতি আধুনিক সন্তান্দের উদ্দেশ্যে কি?
শুধু সন্তানদের উদ্দেশ্যেই নয়। অতি ব্যাস্ত পিতা মাতাদের উদ্দেশ্যেও বটে। আরেকটা ব্যাপার মনে হয় আমরা ভুল ধারনা নিয়ে আছি (আমার ব্যাক্তিগত মতামত)।
শুধু হাই সোসাইটির বাবা-মায়েরাই কিন্তু ব্যাস্ত থাকেন না। মধ্যবিত্ত উচ্ছ মধ্যবিত্ত অনেক মা-বাবাকেও জীবন জীবিকার জন্য বা আরো একটু ভাল থাকার জন্য হাই সোসাইটিওয়ালাদের চেয়েও বেশি ব্যাস্ত থাকতে হয় অনেক সময়। তাদের অনেকের সন্তানরাও বড় হয় বুয়াদের হাতে। আর যারা নিজের হাতেই যদিওবা বাচ্চা পালন করেন তো বাচ্চাগুলোকে এতো তুলে তুলে পালন করেন যে বাচ্চাগুলো স্কুল, কোচিং আর ঘর ছাড়া তেমন কিছুই চিনে উঠতে পারেনা। বড় হয়ে কলেজ ভার্সিটিতে গিয়ে খাবি খেতে থাকে কুয়োর ব্যাঙ সমুদ্রে পড়লে যেমন খাবি খায়।এই রকম খাবি খেতে খেতেই তারা কোনমতে পড় শেষ করেই মাল্টিন্যাশনালে বা এইরকম কর্পোরেট অফিসে কাজে জুটে যায় (গনহারে বলছিনা) তারপর তারাও জন্ম দেয় আরো কিছু ফার্মের চিকেন।
গত দুই আড়াই দশক ধরে আমি বাচ্চাগুলোকে এভাবেই বড় হতে দেখছি।
অনেক কস্টের .........মন খারাপ করে দিলেন ।
মন খারাপ করিয়ে দেবার জন্য দুঃখিত
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
ভাল থাকুন।
আহা রে
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
আহারে... উচ্ছলার কি মন খারাপ হল???
মন খারাপ নয়, উচ্ছলা উচ্ছলই থাকুক
কিন্তু অতগুলা ঘড়ি আর কলম সাথে নিল ক্যান?
কে জানে?! ছেলেটার মনে কি ছিল তা কি আমি জানি নাকি? হয়তো, টাকায় টান পড়লে দামি জিনিসগুলো বেচে পয়সা বানাবে এরকম চিন্তা ছিল, হয়তো ওগুলো তার ভীষন প্রিয় ছিল, তাই তাদেরকেও সঙ্গি করেছিল... কে জানে?!
অতিথি 'বন্দনা' আর 'বন্দনা কবীর' দুটো আলাদা নিক? হায় হায়, আমি তো উল্টো ভেবেছিলাম!
হ, এটা বুঝিনি।
বানানের দিকে আর একটু খেয়াল করা চাই।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অ-নে-ক-কা-ল আমি বন্দনা নামেই লেখালিখি করছি। ব্লগের অনেকেও আমাকে বন্দনাপা বলেই জানে। এখানে এসে দেখি আমার নামখানা ছিন্তাই করে বসে আছেন আরেকজন (আমার মিতা) তাই বাধ্য হয়ে পুরো নামটি-ই লিখতে হচ্ছে। তা উলটো কি ভাবা হয়েছিল? (চিন্তানোর ইমো)
আবার বানানের কি হল?!! ভাইরে/ বোনরে, অনেক্কাল ছাইপাশ যাই লিখেছি তা প্রুফ রিডারকে দিয়ে পড়িয়ে ঠিক ঠাক করিয়ে ছেপেছি কিনা... তাই আর মনে হয় বানান শত% শুদ্ধ করা এই জীবনেও আর হবেনা আমায় দিয়ে।
ভাল লেগেছে।
ভাল লাগাতে পেরে আমারো ভাল লাগছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভাল থাকুন।
ভাল থাকুন।
নামের ব্যাপারে কনফিউশানটা গেল না। এখানে সচল যিনি তিনিও তো বন্দনা কবীর, নাকি আমি ভুল করছি।
যাই হোক লেখাটা ভাল লাগল।
বন্দনা আর বন্দনা কবীর দুইজন আলাদা আলাদা ব্যাক্তি। বন্দনা নামে যিনি আছেন তিনি পুরো সচল কিনা জানিনা। তমে মামা কাহিনীর বন্দনা আর নীল জীবনের বন্দনা কবীর দুইজন স্বতন্ত্র স্বত্তা। এবার পরিষ্কার?
মন কি খুব বেশি খারাপ দিদি?? মন ভাল করুন । ভাল থাকুন।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ
কি বলবো! গল্পটা পড়ে নিজের চোখে দেখা এমন কিছু ফার্মের মুরগির কথা মনে পরে গেলো। বাবা মা নিজেদের ছাড়া ছেলে মেয়ের কথা ভাবার সময় করে উঠতে পারেন নি। আমি বুঝি না যারা নিজেদের নিয়ে এতো বেশী ব্যস্ত তারা বাচ্চা নিতে যায় কেন? কে বলেছে পৃথিবীতে ডেকে এনে কষ্ট দিতে?!
বন্দনাপু বানানের দিকে একটু খেয়াল করাটা যে জরুরী। খুব ভালো লেখার মান একটু হালকা হয়ে যায় বানানের কারনে আমার মনে হয়। স্যরি ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম
আমার গল্পটার মূল বক্তব্যটা ধরতে পারার জন্য অনেক ধন্যবাদ।সন্তানের প্রতি মা-বাবার দায় শুধু তাদেরকে সং দেওয়াতেই সিমাবদ্ধ নয়। তাদেরকে সঠিক জ্ঞানে দুনিয়ায় চরে খেতে শেখানোটাও অনেক কর্তব্যের মধ্যে একটি।
আরেকটা ব্যাপার, শুধু ঘর আর স্কুল কলেজ করে জীবন কাটানো ছেলেমেয়েদেরও এমন হুট করে এডভেঞ্চারে নেমে পড়াটাও কাজের কথা নয়। তাতে ফল খুব শুভ যে হয় না তা বার বার প্রমানিত হয়েছে। আপনার দেখা বাস্তবের ঘটনাটা এখন অহরহ ঘটছে। কদিন আগে কটা তাজা প্রাণ ঝরে গেল সাতার না জেনেও শখ করে পুকুরে গোছল করতে গিয়ে।
আর বানান? আপু, কি করা যায় বলেন তো? সচলে অতিথীরা লেখা একবার পোস্ট করে ফেলার পর আর ভুল ভ্রান্তি ঠিক করতে পারেনা। আর আমার বানান ঝামেলাটার জন্য আমি বার বার লজ্জায় পড়ছি। তবুও কিছু করতে পারছিনা। কোন বানান ভুল হল মনে হয় আমি সেটাই ধরতে পারিনা নাহ, লেখাই ছেড়ে দিতে হবে মনে হচ্ছে
অনেক ধন্যবাদ দিদিমনি ভুল ধরার জন্য। ছোট-বড় এতো কিছু বুঝিনা। ভুল হলে তা বলায় দোষও দেখিনা। দেখি নিজের কিছু উন্নতি করতে পারি কিনা।
ভাল থাকুন।
ভাই আপনার গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ । আপনার গল্প দিয়ে একটা শর্ট ফিল্ম বানাতে পারি
সুন্দর গল্প।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
"ইনটু দ্য ওয়াইল্ড"
নতুন মন্তব্য করুন