পুরাণকথা, পর্ব-৩

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ৩১/১০/২০১১ - ৫:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পুরাণকথা, পর্ব-১
http://www.sachalayatan.com/node/41739
পুরাণকথা, পর্ব-২
http://www.sachalayatan.com/node/41779

বিভিন্ন পুরাণ কাহিনী থেকে জানা যায় যে, স্বর্গলোকের রাজ্যগুলো বিভিন্ন অধিপতির নামানুসারেই পরিচিত ছিল। সে নামগুলোও আসলে একই জনের নাম না। বরং বলা যায় এগুলো বংশানুক্রমিক উপাধি।

স্বর্গলোকের বিভিন্ন রাজ্যের অধিপতিরা জাতিতে ছিলেন দেবতা।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সূর্য, যম, চন্দ্র, ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ এঁরাই ছিলেন মূলত প্রধান দেবতা।

এ হেন যমও একজন দেবতা। ইনি ছিলেন সূর্যের পুত্র। বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার গর্ভে সূর্যের ঔরষে বৈবস্বত মনু, যম ও যমীর জন্ম হয়। যম ও যমী ছিলেন যমজ ভ্রাতা-ভগ্নী।
(মহাভারত/আদিপর্ব: ৬৬, বিষ্ণুপুরাণ:১/৬৬, মার্কন্ডেয় পুরাণ: ৭৭/১০৬)

সূর্য দেবতার অপর নাম বিবস্বান। বিবস্বান-এর পুত্র হিসেবে, তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বৈবস্বাত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে ইনি বৈবস্বত মনু নামে খ্যাত।
বেদে আছে যমী তাঁর ভাই যমের সাথে দৈহিক মিলন কামনা করলে যম তা প্রত্যাখ্যান করেন। অন্য মতে যমীর অপর নাম যমুনা।
"ও চিৎসখায়ং সখ্যা ববৃত্যাং তিরঃ পুরূ চিদর্ণবং জগন্বান্।
পিতুর্নপাতমা দধীত বেধা অধি ক্ষমি প্রতরং দীধ্যানঃ ৷৷" (ঋগ্বেদ/১ম মন্ডল/সূক্ত: ১০/ঋক: ১)
অর্থাৎ,
যম ও যমী যমজ ভাই-বোন, যমী যমকে বলছেন- বিস্তীর্ণ সমুদ্রমধ্যবর্তী এ দ্বীপে এসে এ নির্জন প্রদেশে তোমার সহবাসের জন্য আমি অভিলাষিণী, কারণ গর্ভাবস্থা অবধি তুমি আমার
সহোচর। বিধাতা মনে মনে চিন্তা করে রেখেছেন, তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দর নপ্তা (নাতি) জন্মিবে।

এ সূক্তে ভগ্নী যমী ভ্রাতা যমকে আলিঙ্গন করবার অভিলাষ প্রকাশ করছেন, তাঁর দেহসঙ্গ কামনা করেছেন, কিন্তু যম একে পাপকার্য মনে করে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।

ঋগ্বেদের টীকাকার সায়ণাচার্যের ভাষ্যমতে যম ও যমীর আদি অর্থ দিবা ও রাত্রি। রাত্রি দিবার পশ্চাতে আসে কিন্তু তাঁদের সঙ্গমন হয়না।

ঋগ্বেদের টীকাকার সায়ণাচার্য এই সূক্তের ভাষ্যে বলছেন, ঋগ্বৈদিক যম আর পৌরাণিক যম ভিন্ন। ঋগ্বেদের যম পুণ্যকর্মের পুরস্কারবিধাতা।
"সং গচ্ছস্ব পিতৃভিঃ সং যমেনেষ্টাপূর্তেন পরমে ব্যোমন্।
হিত্বায়াবদ্যং পুনরস্তমেহি সং গচ্ছস্ব তন্বা সুবর্চাঃ ৷৷" (ঋগ্বেদ/১ম মন্ডল/সূক্ত: ১৪/ঋক: ৮)
অর্থাৎ,
যজ্ঞকর্তা ব্যক্তির মৃত্যু হলে তাকে সম্বোধন করে এ উক্তি- সেই চমৎকার স্বর্গধামে পিতৃলোকদের সঙ্গে মিলিত হও, যমের সঙ্গে ও তোমার ধর্মানুষ্ঠানের ফলের সাথে মিলিত হও। পাপ
পরিত্যাগ পূর্বক অস্ত নামক গৃহে প্রবেশ কর এবং উজ্জ্বল দেহ গ্রহণ কর।

দেবগণের মধ্যে যম অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ, পুণ্যবান হওয়ায় ইনি ধর্ম বা ধর্মরাজ নামে খ্যাত। শান্তি এনে দেন বলে এঁর অপর নাম শমন। জীবনের অন্ত এনে দেন বলে ইনি কৃতান্ত
বা অন্তক। পিতৃপুরুষের উপর এঁর প্রাধান্য আছে বলে ইনি পিতৃপতি। এঁর পুরীর নাম সংযমনী। বনে অবস্থানকালে পান্ডুর অনুরোধে কুন্তি, ঋষি দুর্ব্বাসা প্রদত্ত বরের সাহায্যে যমকে
আহ্বান করে তাঁর গর্ভসঞ্চারের অনুরোধ করলে যমের ঔরসে কুন্তির গর্ভে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। যমের ঔরসে জন্ম বলে এঁকে ধর্মপুত্তুরও বলা হয়।

শাস্ত্রকথায় যমকে একজন নিয়মনিষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, পরম ধার্মিক এবং সুশাসক হিসাবেই পাওয়া যায়। তিনিই প্রথম গুরতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই থেকে
নরকের অধিপতিমাত্রই `জীবন হন্তারক' বলে পরিচিত হতেন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে পালিত হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে
বলে-
''ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা৷৷''

আধুনিককালে যমকে পরলোকগত জীবের পাপপূণ্যের দন্ডদাতা রূপে দেখার মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্য নেই। যমলোকের অধিপতি সকল যমেরই মানুষের মতই মৃত্যু হয়েছে।

স্বর্গলোক অত্যন্ত সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর স্থান ছিল বলেই বেদে স্বর্গলোককে `অমৃতভূমি' এবং দেবতাদের `অমর' বলা হয়েছে।

প্রাচীনতর মানুষের কাছে মঙ্গোলিয়া ছিল পিতৃলোক, আর বৈদিক যুগের মানুষের কাছে ভারত ছিল ভূলোক।

ঝাঁপি খুলে বহু পুরাতন একটা নোটবই পেলাম। তখনকার সময়ে আমাদের দেশে ইন্টারনেটের সুবিধা ছিলনা। বইপুস্তক ঘেঁটেই যা কিছু পাওয়া। কখন, কোথায়, কিভাবে এসব পেয়েছিলাম আজ আর তা মনে করতে পারিনা। সূত্র জানতে চাইলে তাই দিতে পারবোনা, ক্ষমা করবেন।

চলবে?

প্রৌঢ়ভাবনা


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ,'মহাভারত' -এর একটা যুতসই মিনি সংস্করন হাতের কাছেই থাকলো। সময়ে অসময়ে রাজশেখর বসুর বিশাল বইটি ঘাটবার কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। পালামৌ পড়ে 'মানুষেতেই যে সুরাসুর' এই ধারনা আমার গাঢ় হয়।

আরেকটি কথা, অসুরের স্বভাবে যতই কালিমা লেপন করা হোক না কেন, সাগর মন্থনে উঠে আসা অমৃতের উপর একচ্ছত্র দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তথাকথিত দেবতাদের প্রকৃত চেহারা অতীতের মত বর্তমানেও সুস্পষ্ট হয়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

অসুরের স্বভাবে যতই কালিমা লেপন করা হোক না কেন, সাগর মন্থনে উঠে আসা অমৃতের উপর একচ্ছত্র দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তথাকথিত দেবতাদের প্রকৃত চেহারা অতীতের মত বর্তমানেও সুস্পষ্ট হয়।

চলুক

ফাহিম হাসান এর ছবি

চলুক ! ভালই লাগছে, তবে আরেকটু বড় পরিসরে লিখুন না।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সাগর মন্থনে উঠে আসা অমৃতের উপর একচ্ছত্র দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তথাকথিত দেবতাদের প্রকৃত চেহরা অতীতর মত বর্তমানেও সুস্পষ্ট হয়।

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

উচ্ছলা এর ছবি

খুবই চিত্তাকর্ষক হাসি
'ইন্টারেস্টিং' বললে ইংরেজি চর্চা হয়ে যায় কিনা তাই শুদ্ধ বাংলাতেই কমপ্লিমেন্ট দিলাম...ধুত্তারি!এখন আবার 'কমপ্লিমেন্ট'-এর বাংলা খোঁজা লাগবে মন খারাপ

শাব্দিক এর ছবি

আকারটা আর একটু বড় হলে ভাল হত।

সাফি এর ছবি

এই সিরিজের ৩টা পোস্ট যোগ করলে যে আকার হয়, প্রতিটা পোস্ট সেই আকারে চাই।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পাঠকদের প্রতি: দেখুন, আমি কিন্তু পুরাণকাহিনী লিখছিনা। সে আমার কম্ম নয়। সে কাহিনী লিখতে গেলে একজনমে শেষ হবেনা। এক মহাপুরাণই আছে ২০টা। এর সম্মিলিত শ্লোকের সংখ্যা ৭ লক্ষাধিক। তারপর আছে বৈষ্ণবপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, শৈবপুরাণ। আরও আছে উপপুরাণ, আবারও আছে বৌদ্ধপুরাণ, জৈনপুরাণ।

তাছাড়া আমার অতশত জানাও নেই। আমার এ সীমাবদ্ধতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আশাকরি।

"আমি পুরাণের ব্যাখাকারগণের কিছু মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।"

পড়ার জন্য এবং মতামত জানাবার জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

কল্যাণF এর ছবি

চলুক চলুক চলুক (হাততালির ইমো)

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলবে ? (ধন্যবাদের ইমো)

তারেক অণু এর ছবি

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আলতাই (অলটাই বা অলটে) পর্বতের সানুদেশে `দ্যারা' বা `মঙ্গোলিয়া'ই সমস্ত জীবের প্রথম জন্মভূমি।
এইটার রেফারেন্স কি ! মিথতো মানুষের তৈরি গল্প, মানুষ তো আফ্রিকা ছেড়েছে মাত্র ৭০,০০০ আগে। তার অনেক মিলিয়ন বছর আগেই অনেক জীবের জন্ম ও বিলুপ্তি ঘটেছে !

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

উইকি ঘেঁটে-ঘুঁটে আমিও আপনার সাথে একমত।

"আমি পুরাণের ব্যাখাকারগণের কিছু মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।"

নিটোল. এর ছবি

দারূণ চলছে। আরো চলুক!

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

বন্দনা এর ছবি

আমার এত্ত দেব-দেবীর নামই মনে থাকেনা। অল্প অল্প করে লিখসেন দেখে পড়ে আরাম পাচ্ছি।তবে এইসব কাহিনী বেশ লাগে পড়তে। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এটা নিয়ে লিখতে শুরু করার জন্য।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক অনেক ধ্যন্যবাদ।

দুর্দান্ত এর ছবি

মঙ্গোলিয়ার চাইতে বরং মধ্য এশিয়া আমার ভোট পাবে।

সজল এর ছবি

আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে মানুষের পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার উপর একটা চমৎকার ডকুমেন্টারি Journey of Man: A Genetic Odyssey

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, সংযোজনের জন্য। এবিষয়ে যৎসামান্যই জ্ঞান ছিল, আপনার কল্যানে অনেক কিছুই জানা হল। আশা করছি পাঠকগণও উপকৃত হবেন।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পুরাণকথা, পর্ব-৩ 'যম' বিষয়ক লেখাটির পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।