মুহম্মদ জাফর ইকবাল; লেখক, গবেষক, সংগঠক, শিক্ষক, কলামিস্ট, সমাজকর্মী; আমাদের অনেকেরই প্রিয় মানুষ। তাঁর যে বিপুল পরিমাণ গুণগ্রাহী এদেশে ছড়িয়ে আছে তা তাঁর ঘোর নিন্দুকও অস্বীকার করতে পারবে না। আর এজন্যই ‘তাদের’ যতো ভয়। তাঁর মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বর্তমানে দেশে খুব কমই আছে। নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষ তাঁর খবর রাখে না; তিনি মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মাঝেই অসম্ভব জনপ্রিয়। তরুণদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া, যার সাথে শুধুমাত্র অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের জনপ্রিয়তারই তুলনা চলে। একটি জরিপে বেরিয়ে এসেছে যে, তিনি বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। জরিপে ৪৫০ জনের মধ্যে ২৩৫জনই (৫২.২২%) তাঁর পক্ষে মত দিয়েছে। [সুত্রঃ তান-জিনা হোসেন ও সিমু নাসের (ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০০২ খ্রিস্টাব্দ)। (ছুটির দিনে, দৈনিক প্রথম আলো: পৃ. ৫, ৬। ]
কিন্তু আমি জাফর স্যারের জনপ্রিয়তা বয়ান করতে বসিনি। যা বলতে চাইছি সেখানে আসছি। আমার মনে হয়, জাফর ইকবাল স্যারের অসম্ভব জনপ্রিয়তা তাঁর জন্য এসব সমস্যা ডেকে আনছে। তবে জনপ্রিয়তাই শুধু একমাত্র বিষয় নয়, আরো ব্যাপার আছে। খেয়াল করলে দেখা যায় জামাত-শিবির-হিযবুত তাহরীরের সমর্থক-গোষ্ঠী আর কর্মীরা, যারা উনাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, তারাই সবচেয়ে বেশি মুখর হচ্ছে তাঁর নিন্দায়। কিন্তু কেন তারা স্যারকে পছন্দ করেনা?
ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিগত জোট সরকারের সময় দেশজুড়ে জেঁকে বসেছিল, সে ইতিহাস আর বলার প্রয়োজন নেই, সবাই জানেন। সেসময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পালটে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, মৌলবাদ খুব সযত্নে লালন করা হয়েছে, দেশের গুণী লোকদের উপর হামলা হয়েছে ( যেমন হুমায়ুন আজাদ), জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়েছে ( যেমন হাসান আজিজুল হক এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল)। আর সে সময়েই আপন মহিমায় জ্বলে উঠেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর শক্তিশালী লেখনী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরেছিল অনেকটাই, বিশেষ করে রাজাকার-আলবদরদের পরিচয় তিনি সাহসের সাথে তরুণ-তরুণীদের চোখে তুলে ধরেছিলেন; তাঁর মৌলবাদ-বিরোধী লেখাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল, যা পড়ে আমাদের প্রজন্মের অনেক তরুণই শিবিরের পাতা ফাঁদ থেকে দূরে সরে যেতে পেরেছিল। আজকের কিশোর-তরুণরাও জামাত-শিবিরের পরিচয় সম্বন্ধে খুব ভালোভাবেই জ্ঞাত- তার কারণ অনেকটাই জাফর ইকবাল স্যার। আর এটাই জামাত-শিবির তথা গোটা মৌলবাদী গোষ্ঠীর গাত্রদাহের কারণ। মৌলবাদীরা এসব কারণে জাফর ইকবাল স্যারকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তরুণদের কাছে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারানোর আর ঘৃণিত হবার কারণ হিসেবে ভেবেছে জাফর স্যারের নাম। প্রগতিশীল তরুণদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা তারা খুব ভালোমতোই জানে, তাই প্রগতিশীলতার পায়ে বেড়ী বাধানোর একটা উপায় হিসেবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল’এর বিরোধিতা বেছে নিয়েছে। এটা যে সঠিক তা জানার জন্য কোনো রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না, যেকোনো জামাত-শিবির কর্মীর সামনে স্যারের নাম নিলেই তাঁর প্রতি তাদের মনোভাব খুব ভালোমতোই ফুটে ওঠে। তাদের মোটা মাথা হয়ত ভেবে নিয়েছে যে জাফর ইকবাল স্যারকে পচাতে পারলেই তাঁর আদর্শকে মাটিচাপা দেয়া যাবে। এজন্য তাঁকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনার বদলে চলে কুৎসিত অপপ্রচার। তাঁর নির্দোষ নাচের ভিডিও নেটে ছেড়ে দিয়ে লেখা হয় ব্লগের পর ব্লগ।
জাফর ইকবাল স্যার ধর্ম নিয়ে সরাসরি খুব কম কথাই বলেছেন, যদিও মৌলবাদ নিয়ে লিখেছেন অনেক। তিনি হয়ত নাস্তিক, কিংবা অজ্ঞেয়বাদী, অথবা আস্তিক; আমি জানিনা। তবে এটা জানি তিনি কখনো ঘোষণা দিয়ে নাস্তিকতা প্রচার করেননি, যেমনটা করেছেন ডঃ আহমদ শরীফ কিংবা ডঃ হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু তবু তাঁর নামে প্রচার করা হয়েছে যে “তিনি তার বইগুলোতে ও লেখাগুলোতে অত্যন্ত সুকৌশলে মানুষকে নাস্তিকতার দীক্ষা দেন। তার লেখায় ইসলাম বিরোধিতাও বাড়াবাড়ি রকমে চোখে পড়ে“। কিন্তু আমিতো বরং উলটো দেখতে পাই। তাঁর গল্পের পাত্র-পাত্রী বিপদে পড়লে খোদাকে ডাকে, তাঁর কাহিনীতে মাঝে মধ্যে অলৌকিক কাণ্ডও ঘটতে দেখা যায়। এমনকি তিনি তাঁর কিছু সায়েন্স ফিকশনে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের আভাস দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তাঁকে নিয়ে এমন প্রচারের কারণ আমার জানা নেই। খুব সম্ভবত তাঁর জামাত-শিবির আর মৌলবাদ-বিরোধিতা তাঁকে ওদের কাছে নাস্তিক বানিয়েছে। হয়ত ভেবেছে, যে মানুষটা স্বাধীনতা-বিরোধীদের এতো ঘৃণা করতে পারে সে নাস্তিক না হয়ে যায় ই না!
সম্প্রতি যে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে জাফর স্যারকে নিয়ে তার সূচনা দৈনিক প্রথম আলো‘র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে “ওদের নিয়ে কেন স্বপ্ন দেখব না?” শীর্ষক লেখা থেকে। এই লেখাটা মৌলবাদী গোষ্ঠীর দারুণ গা চুলকানোর কারণ হয়েছে গত কয়েক দিনে। এমনও বলা হয়েছে- ইসলামকে ভালবাসুন অথবা জাফর ইকবালকে ভালবাসুন, দুটিই একসাথে নয়! তাঁর লেখার কিছু পয়েন্ট অনলাইন ছাগুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এরপর তাঁকে নিয়ে গত কয়েকদিনে মোটামুটি কয়েকটি মহাভারত ( লিংক ) রচনা করা হয়ে গেছে এবং আরো কিছু রচিত হবার অপেক্ষা রয়েছে। লেখাটার যেসব পয়েন্ট নিয়ে ছাগুদের লম্ফঝম্ফ মাত্রা ছাড়িয়েছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি।
# স্যারের লেখার শুরু একটা লাইন নিয়ে প্রথম আক্রমণের সূচনা। তিনি লিখেছেন- ” ‘তরুণ প্রজন্ম’ বললেই আমাদের চোখে টি-শার্ট পরা সুদর্শন কিছু তরুণ ও উজ্জ্বল রঙের ফতুয়া পরা হাসিখুশি কিছু তরুণীর চেহারা ভেসে ওঠে।” এর এর মাধ্যমে তিনি নাকি “তরুণীদেরকে” এই বানী পৌঁছে দিলেন যে, তোমরা যদি ফতুয়া পরে রাস্তায় না বের হও তোমাদেরকে সত্যিকার অর্থে সম্ভাবনাময় তরুণী বলা যাবে না! এখানে “তরুণী‘ শব্দের প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ করুন, তাহলে তাদের কু-প্রচারণার স্বরূপ বোঝা যাবে। স্যার লিখেছেন ‘তরুণ প্রজন্ম‘র কথা যেখানে তরুণ-তরুণী উভয়েই আছে, আর এখানে বানিয়ে ফেলা হয়েছে ‘তরুণী‘! আচ্ছা, পাল্টা বলতে পারে যে তরুণ প্রজন্মের মাঝে তো তরুণীরাও আছে। ঠিক আছে। কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। ও সমস্ত নিন্দুকদের বুদ্ধিমত্তার লেভেল কতোটুকু তা বোঝা যায় পরের লাইনগুলো পড়ে দেখলে।এবার পুরো প্যারাটি পড়ে দেখি, স্যার লিখেছেন- ” ‘তরুণ প্রজন্ম’ বললেই আমাদের চোখে টি-শার্ট পরা সুদর্শন কিছু তরুণ ও উজ্জ্বল রঙের ফতুয়া পরা হাসিখুশি কিছু তরুণীর চেহারা ভেসে ওঠে। আমাদের দেশে মোবাইল ফোন আসার পর কোম্পানিগুলো পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আর এ বিজ্ঞাপনের কারণেই সম্ভবত তরুণ-তরুণীদের এ ছবি আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি অবশ্য বিজ্ঞাপনের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে কাছাকাছি বাস করি, তাই মাঝেমধ্যেই আমি ভুলে যাই যে ছবিটি সম্পূর্ণ নয়।”
কী বুঝলেন? স্যার বলেছেন তরুণ প্রজন্ম বলতে আমাদের চোখে যে টি-শার্ট পরা সুদর্শন তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় আসে তা এদেশের মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি করেছে। তিনি বলেননি তরুণ-তরুণীদের টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াতে হবে। তিনি পরের লাইনে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে এই তরুণদের এই ছবিটি সম্পূর্ণ নয়। তাহলে কেন এই প্রোপাগান্ডা?
# এরপর লেখাটির আরেকটি বিশেষ প্যারা পড়ে তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। স্যার লিখেছেন- ” বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছিল। আমি আর আমার স্ত্রী সেটা দেখতে গিয়েছিলাম। বড় বড় ছবি দেখতে দেখতে আমার স্ত্রী আমাকে বলল, ‘একটা জিনিস লক্ষ করেছ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী জিনিস?’ আমার স্ত্রী বলল, ‘ভাষা আন্দোলনে কত মেয়ে! কিন্তু একটি মেয়েও বোরকা পরে নেই, একটি মেয়েও হিজাব পরে নেই।’ আমি তাকিয়ে দেখি, তার কথা সত্যি। ষাট বছর আগে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের বোরকা পরতে হতো না, এখন মেয়েদের বোরকা পরতে হয়। ষাট বছর আগে এ দেশের মেয়েরা ধর্মহীন ছিল, এখন মেয়েরা ধর্মভীরু হয়ে গেছে আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যারা জ্ঞানীগুণী গবেষক, তাঁরা প্রকৃত কারণটি খুঁজে বের করবেন। আমি সোজাভাবে বিষয়টি এভাবে দেখি, যে সমাজে পুরুষ আর নারী সমান সমানভাবে পাশাপাশি থেকে কাজ করে, সেই সমাজকে মৌলবাদীদের, ধর্ম ব্যবসায়ীদের খুব ভয়। তাই মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। একান্তই যদি ঘরের ভেতর আটকে রাখা না যায় অন্তত বোরকার ভেতর আটকে রাখা যাক।”
এটুকু পড়ে তাদের মন্তব্য হলো- এর দ্বারা তিনি আল্লাহর ফরজ বিধান হিজাবের বিরুদ্ধে স্পষ্টতই অবস্থান নিয়েছেন!
আচ্ছা, এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমি হিজাব ভালো নাকি খারাপ, সেদিকে যাচ্ছি না। যারা হিজাবের কথা বলছে তারা নিশ্চয়ই জানে হিজাব কী জিনিশ, নিশ্চয়ই জানে কোরান-হাদিসে এ বিষয়ে কী আছে। তাদের প্রতি প্রশ্ন হলো- ওখানে কি কোথাও নির্দিষ্টভাবে লেখা আছে যে নারীদের ‘বোরকা‘ পরতে হবে? আমি জানি পর্দা করার কথা বলা হয়েছে( সেটা ভালো কি খারাপ তার আলোচনা এটা নয়), কিন্তু বোরকা? হ্যাঁ, তারা বলতে পারে যে বোরকা পরে পর্দা করা যায়। ওদের জন্য বলি, বোরকা আসলে যতোটা না একটা পোশাক তার চেয়ে বেশি এটি বন্দিত্বের প্রতীক। জাফর স্যার ঠিক এ বিষয়টির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। ষাট বছর আগে যেখানে মেয়েরা বোরকা পরার প্রয়োজন বোধ করেনি সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেন ব্যাপক হারে বোরকার পুনর্প্রবর্তন ঘটছে? এটা হয়েছে মৌলবাদীদের ব্যাপক প্রচারের ফলেই। মানুষকে বোঝানো হয়েছে পর্দা করা মানে বোরকা পরা। তারা ভেবেছে মেয়েদেরকে তো আর শারীরিকভাবে আটকে রাখা সম্ভব না এই যুগে, তাই মানসিকভাবেই আটকে রাখা হোক! তাদেরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে হবে যে তোমরা স্বাধীন নয়, তোমাদের যা খুশি করার অধিকার নেই, তোমাদের আসলে ঘরে থাকার কথা- কিন্তু বেরিয়েছ যখন তখনো বন্দীই আছো, তোমরা তোমাদের মালিক নও- পুরুষের ইচ্ছাই তোমাদের জীবন। জাফর ইকবাল স্যার এই বিষয়টাই বলেছেন। নারীদের স্বাধীনতাকেই বেশি ভয় পায় মৌলবাদীরা, কেননা নারী-স্বাধীনতা সমাজে ঠিকমতো প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মানেই হলো ধর্মব্যবসার লাল বাতি জ্বলে ওঠা। আর তাঁর এই বক্তব্যকে বলা হলো হিজাব বিরোধিতা। (আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতাম যদি তিনি একেবারে সরাসরি বলে দিতেন বোরকা না পরতে, কিন্তু তিনি তাও বলেননি)
# এর পরের একটি প্যারাও তাদের গায়ে চুলকানি বাড়িয়ে দিয়েছে যা আসলে আগের প্যারার বাই-প্রোডাক্ট। স্যার লিখেছেন- “আমাদের সমাজে মেয়েদের পিছিয়ে নেওয়ার এ পরিকল্পনাটুকু কারা করেছে, তারা কীভাবে কাজ করেছে, গবেষকেরা সেগুলো বের করতে থাকুন। কিন্তু আমরা জানি, এ কাজ করেছে পুরুষেরা। কক্সবাজারের পথে একবার হঠাৎ একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা। মেয়েটি বলল, ‘স্যার, আমি আপনার ছাত্রী।’ আমি খুবই অপ্রস্তুত হলাম, নিজের ডিপার্টমেন্টের একটা ছাত্রীকে আমি চিনতে পারছি না। আমি এত বড় গবেট! ছাত্রীটি তখন নিজেই ব্যাখ্যা করল। বলল, ‘স্যার, আমি তো ডিপার্টমেন্টে বোরকা পরে যাই, তাই আপনি চিনতে পারছেন না।’ আমি তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্লাসে যার শুধু এক জোড়া চোখ দেখেছি, তাকে আমি কেমন করে চিনব? কিন্তু গত ৫০ বছরে যে মেয়েদের একটি প্রজন্মকে ঘরের ভেতর আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই প্রজন্মকে নিয়ে আমরা কী স্বপ্ন দেখব?”
এটুকু নিয়ে এক মহান চিন্তাবিদের মন্তব্য- ” এর দ্বারা তরুণ প্রজন্মের আদর্শ(!) জাফর ইকবাল সাহেব তরুণীদের বোঝালেন, হিযাব পরলে তোমাদের কোনো দাম নেই! সুতরাং হিজাব খুলে ফেল, টি-শার্ট, ফতুয়া ও জিনস পর। আর নিজেদেরকে পুরুষের ভোগ্য সামগ্রীতে পরিণত করার ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাও! নিজেদেরকে পতিতাদের চেয়েও সস্তা করে ফেলো।“
স্বাভাবিক বিদ্যা-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চট করে বুঝে ফেলার কথা যে তিনি কী বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু উলটো বলা হলো তিনি নাকি মেয়েদেরকে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হতে বলছেন! যেখানে তিনি প্রথম লাইনেই বলে ফেলেছেন যে মেয়েদের বর্তমান অবস্থাটুকুর জন্য পুরুষেরা দায়ী সেখানে তিনিই বলবেন পুরুষের স্বার্থের কথা! কতোটুকু নির্বোধ হলে একথা বলা যায় আমি জানি না।
# এবার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক অংশটুকুর কথা বলি। জাফর স্যারের এই লেখার পর কয়েকটি ব্লগে স্যারের মেয়েকে নিয়ে কিছু কুৎসিত লেখা পোস্ট করা হয়েছে। উনার মেয়ের বন্ধুদের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু নির্দোষ ছবি অনুমতি ছাড়াই নেটে প্রকাশ করে দিয়ে বলা হয়েছে- মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আমাদেরকে হেদায়েত করা আগে নিজের মেয়েকে সামলাও! এ নিয়ে যা হয়েছে তা বলতে আমার রুচিতেও বাঁধে। এ বিষয়ে অনেকেই লিখেছেন তাই আমি ওদিকে আর যাচ্ছি না। শুধু একটা প্রশ্ন করব। জাফর স্যারের মেয়ের ওয়েস্টার্ন পোশাক পরার কথা উচ্চস্বরে প্রচার করছেন, তাকে বাঙ্গালী-ত্ব শেখানোর পরামর্শও দিচ্ছেন, ভালো কথা। কিন্তু আমাকে কি বলবেন যে বোরকা আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে কখন থেকে ছিল? টি-শার্ট জিনস পরা যদি ভিন্ন দেশীয় অপসংস্কৃতি হয় তাহলে বোরকা পরাও কি ভিনদেশী অপসংস্কৃতি হবে না? বোরকা কি বাঙ্গালী নারীর আবহমান কালের পোশাক??
জাফর ইকবাল স্যারের হয়ত অনেক ভুল ত্রুটি আছে, তার যৌক্তিক সমালোচনা আমরা করতেই পারি। কিন্তু তাঁর কোনো লেখার জন্য তার মেয়ের ছবি প্রচার করে নোংরা লেখা পোস্ট করব ব্লগে ব্লগে- এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? ধর্ম কি আপনাদেরকে এটাই শিক্ষা দিয়েছে? মেয়েদেরকে বোরকা পরানোর জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন, আর তারপর একটা মেয়ের ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে উল্লাস করছেন- এই ভণ্ডামি কি আমাদের চোখে পড়ে না ভেবেছেন? মেয়েদের পর্দা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেবে এমন অবস্থা কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম? এই ভণ্ডামিকেই ধর্ম বলে প্রচার করছেন? তাহলে আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলব- প্রয়োজন নেই আমার সেই ধর্ম, সেই রীতি যা আমাকে অসভ্য হতে শেখায়, যা আমাকে নারীদের অপমান করতে শেখায়, যা আমাকে ভণ্ডামি শেখায়।
আমার লেখা শেষ। নিচের অংশটুকু মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের জন্য। এটুকু আপনারা না পড়লেও চলবে।
স্যার, আমি জানি আপনি অনেক ব্যস্ত মানুষ। এই যে এতো এতো সমালোচনা কিংবা প্রশংসা কোনোটাই শোনার সময় আপনার নেই। তারপরও যদি চোখে পড়ে তাহলে আপনাকে বলছি- আমাকে ক্ষমা করুন, আমাদের ক্ষমা করুন। ওই লেখাগুলোকে হয়ত আপনি গুরুত্বই দেবেন না, না দেয়াই উচিত, তারপরও যদি ওসব আপনাকে এতোটুকুও বিষণ্ণ করে তোলে, যদি বুক থেকে নিজের অজান্তেই ছোট এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে- তাহলে বলব, আমাদের ক্ষমা করুন। বাঙ্গালী গুণীর মর্যাদা কখনো দিতে পারেনি। আমাদের ক্ষমা করুন। দয়া করে আমাদের মতো তরুণদের উপর থেকে কখনো বিশ্বাস হারাবেন না, আপনাকে যে আমরা অনেক ভালোবাসি!
মন্তব্য
যে মানুষ কে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়, পৃথিবীটা এখনো মানুষের জন্য এই বিশ্বাস টা ফীরে আসে, তাকে নিয়ে মন্দ কথা মন্দ লোক ই বলবে। নোংরা আছে বলেই আমরা পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যাকুল, কুৎসিত থেকে পরিত্রাণের জন্যেই সুন্দরের পিপাসা।
মন্তব্য গুলো পড়ে আবার মনে হল মানুষ যে কোন ধর্মাবলম্বীর চেয়ে অনেক অনেক বড়। যারা ধার্মিক তাঁদের কে কিছু বলার নেই।
আমার মানুষ হবার জন্যই সকল প্রচেষ্টা। বড় হতে কে না চায়?
হিজাব??? নেকাব?? পর্দা? কিছু ধর্মাবলম্বী খড় কুটুর মতো এটাকে আঁকড়ে ধরছে। এই পৃথিবী তে যে তাঁদের আশ্রয়ের জায়গা কমে যাচ্ছে সেটা তারা জানে।
৫২'র ভাষা আন্দোলনে, ৬৯ এর গন অভ্যুত্থানে, ৭১ এর মুক্তি সংগ্রামে যারা আমাদের হত্যা করেছিলো তারা কি কাফের? মুসলমান রা যদি তাদের এবং তাদের অনুগামীদের কাফের বলে তাহলে ভেবে দেখা যাবে।
নতুন মন্তব্য করুন