এইতো জীবন। ০৩

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৮/১১/২০১১ - ১২:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাতে টাকা ছিলনা। ডুম্বুরভ্যালীতে গিয়ে থাকা এবং শুটিং এর কাজ সারতে যে পরিমাণে টাকা দরকার তার চার ভাগের একভাগও আমার কাছে ছিলনা। কি করা যায় তাই ভাবছিলাম। যদিও শুটিং এর ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে স্পটবয় সব আমি নিজে, তবুও অনেক খরচ আছে। আর আমার পকেটে টাকা নেই। বাড়িতে টাকা চাইতে লজ্জা করে। কয়েকজন বন্ধুর কাছে চাইলাম। একেবারেই যে নিরাশ হলাম তা নয়। কিন্তু..., আচ্ছা একটা ঘটনা বলি তাহলেই বোঝা যাবে।

আমার অনেক দিনের পরিচিত সহদেব বসাক। তার কাছে যখন কিছু টাকা ধার চাইতে গেলাম। সে ধারের কারণ জিজ্ঞাসা করে বলল- কি জন্য ?

আমি বললাম এই তো ডুম্বুরে যাচ্ছি। তারপর আমার অভিপ্রায়ের কথা জানালাম। সে বলল ডিপার্টমেন্টের কাজে জাচ্ছিস যা না, তার মধ্যে আবার সিনেমা ঢুকালি কেন। দিব্যি ঘুরে ফিরে আসবি। খামোকা উৎকট ঝামেলা বাধাচ্ছিস কেন।

বুঝলাম, টাকা তো দেবেই না, বরং হাজারটা নীতিকথার ঝোল ধরিয়ে এবার রান্না চাপাবে। আর কথা বাড়ালাম না, আসলে বলতে ইচ্ছে করছিল না। আর কিই বা বলব, আমি জানি ওর কাছেও পয়সা নেই। সাংবাদিকতা করে আর ক’পয়সা কামায়। তারমধ্যে নিজের চলা, সংসারের খরচ, গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো। তবু একবার বললাম – কিছু দিতে পারবি। সে বলল- পাঁচশ টাকার মতো দিতে পারি, কিন্তু আগামি মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হবে।

পেলাম কিছু। তারপর আর উপায় না দেখে মাকে ফোন লাগালাম। আমতা আমতা করে বললাম, মা কিছু টাকা দরকার। শত অভাবেও মা কোনদিন আমাকে না করেন নি। এইবারও নিরাশ করলেন না। বললেন, আয় এসে নিয়ে যা। আমার জন্য আমার পরিবার আরও কত সেক্রিফাইস করেছে তা আমি ধীরে ধীরে বলব, আগামী পোস্ট গুলোতে।

২.

স্ট্যান্ডার্ড থ্রিতে থাকার সময় একদিন ক্লাসে এসে স্যার বললেন – ২১’শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়ে নাটক করানো হবে। তোমরা যারা যারা অংশগ্রহণ করতে চাও তারা সুভাষ স্যারের কাছে নাম জমা দিয়ে দিও। শৈশবের অফুরন্ত প্রাণে কিসের দোলা লেগেছিল জানিনা। আমাদের ক্লাসের অনেকেই নাম লেখাতে গেল। আমি যাবো কিনা ভাবছি। এমন সময় সুস্মিতা এসে বলল- কি’রে জাবিনা নাম লেখাতে, আমি কিন্তু যাচ্ছি। সুস্মিতাকে আমার খুব পছন্দ হতো। আমরাদের বাড়ি একই পাড়ায়। দুজনে একসাথে স্কুলে যেতাম। বাড়িতে ঘড়ঘড় খেলায় আমার কাকাতো এবং জ্যঠতুতো ভাইদের সাথে প্রায় দিনই ঝগড়া লেগে যেত, কে সুস্মিতার বর হবে এই নিয়ে। বেশির ভাগ সময় আমিই সুস্মিতার বর হতাম। অবশ্য পরে বড় হয়ে সুস্মিতার প্রতি আমার আর কোন ক্রাশ ছিলনা। সেও অন্য একজনের সাথে চুটিয়ে প্রেম করত, আর আমি- ছাত্র রাজনীতি আর গ্রুপ থিয়েটার।

যাই হোক সেই সুস্মিতার দৌলতেই তার বর হবার তাগিদে নাটকের খাতায় নাম লেখালাম। অবশ্য নাটকে সুস্মিতা আমার গৃহিণী হয়নি। ঐ নাটকে কোনো জামাই-বউ এর সিকোয়েন্স ছিলনা। আমার ভূমিকা ছিল একজন বেকার যুবকের। যে সারাক্ষণ বিব্রত থাকে। চাকরি নেই, কাজ নেই, ঠায়ঠায় বেকার, নিজের কর্মহীন জ্বালাকে ভুলতে সে মদ খায়। এখন ভাবলে হাসি পায় সেই নয় বছর বয়সে আমি ‘অগ্নিদগ্ধ’ নাটকে অপূর্ব সান্যালের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। নাটকটি দুইবার মঞ্চস্থ হয়েছিল। প্রথমবারের কথা না বললেই নয়। প্রথম দৃশ্যতেই আমার এন্ট্রি। মদ খেয়ে বুদ। তারপর ঢুলতে ঢুলতে মঞ্চে আগমন। প্রথমবার ঢুকেই আমার দেখা হয়ে যায় আমার পরিচিত বন্ধুর সাথে, তার সাথে ধাক্কা খাওয়ার সিন। ধাক্কা খেয়েই আমি আমার সকল ডায়ালগ ভুলে গেছি! একেবারে যা তা অবস্থা। বেগতিক বুঝে ডিরেক্টর মানে আমাদের সুভাষ স্যার পেছন থেকে সামনে চলে আসলেন এবং স্ক্রিপ্ট পড়তে শুরু করলেন। আগেই বলা ছিল এই কৌশল। আমি উনার সাথে সাথে ডায়ালগ বলা শুরু করলাম। সিরিয়াস সেই নাটককে আমি কৌতুক বানিয়ে দিয়েছিলাম। লোকে নাটক দেখবে না আমার ভয়ার্ত চেহারা! কোনো রকমে শেষ করলাম। স্যার অবশ্য কিছু বলেননি। আরও অনেকেরই একই দশা হয়েছিল। আমারা কচিকাচারা তখন প্রত্যেকেই জীবনের প্রথম মঞ্চাভিনয় করছি। পরের দফায় অবশ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম এবং শেষবার মঞ্চে উঠে আমার বুক কেঁপেছিল। তারপর আর কাপেনি। কিন্তু ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল একটা বীজ। একটা পাগলামি। যার পরিপূর্ণতা পেয়েছিলাম এর ছয় বছর পর সমন্বয় নাট্য সংস্থায় ডাক পেয়ে।

IMG_233144344

IMG_243553

ডুম্বুরভ্যালীতে যখন গিয়ে পৌছালাম তখন বিকেল নেমে গেছে। জার্নির ক্লান্তি ছিল।তবুও ভাত খয়েই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লাম। আর আমার বন্ধু যুগল লম্বা হাই তুলে গড়াগড়ি খেতে গেলো। সকাল বেলা এইদিকে প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিল। বাতাসের গায়ে তার গন্ধ লেগে আছে। ভরা বৃষ্টির সিজন।

যতদূর দেখা যায় দিগন্তের অসীম রূপরেখাকে স্পর্শ করে শুধুই সবুজের আস্তরণ। চড়াই উতরাই পরিয়ে পাহাড়ের খোপে খোপে ছনের ছাওনি দেওয়া ঘড়, কোথাওবা টিন আর বেড়ার কম্বিনেশন। ঝর্ণার কলকল শব্দ আর পাখিদের গুঞ্জনে মনটা ভালো হয়ে গেলো। আর সম্পূর্ণ ডুম্বুর উপত্যকা জুড়ে কলকল শব্দের উচ্ছ্বাসে বয়ে চলছে স্রোতস্বিনী গোমতী।

IMG_0974

সময়টা ১৯৭৫ সাল। কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় এবং ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠল গোমতী জল বিদ্যুৎ প্রকল্প। সমস্ত প্রতিকূলতাকে ঠেলে পাহাড়ের রুক্ষতার বুক চিরে গোমতীর জল তীর্থমুখে(ডুম্বুর) টারবাইনের গতিকে ছুঁতেই উৎপন্ন হতে শুরু হল ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তারপর ১৯৭৯ এ শুরু হল তৃতীয় ইউনিট।

IMG_3664774645

সমস্ত প্রকল্পের কাজ যখন চলছে, তখন এতসব এতসব এতসব মানুষ আর যন্ত্রের আস্ফালনে স্তব্ধ এবং স্তম্ভিত ছিল কিছু পাহাড়ি মানুষ। এরা ত্রিপুরার জনজাতি। তারপর গোমতী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নে বাস্তুহারা হল কয়েক হাজার পরিবার। সরকারি তরফে মিলল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু, সব সময় আমাদের তৃতীয় বিশ্বে যা হয়, তাই হল। প্রতিকানি বসত বাড়ি কিংবা ফসলের জমি বাবদ ভুমি মালিকেরা পেলেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এদের কথা লিখতেই আমার এখানে আসা। আর অন্য দিকে তথ্যচিত্র বানানোর পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আলো জ্বলে উঠল ঘরে ঘরে, কিন্তু অন্ধকার নেমে এলো বাস্তুহারাদের জীবনে।

IMG_2434350

IMG_2113333

IMG_213324255

IMG_76655

IMG_233144

IMG_324425535535

IMG_1223

IMG_3244355

IMG_32122133

IMG_278456577

IMG_24343535

ছবি তুলে, চারিদিকে নিঃশব্দে একা ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম। এসে দেখি আমার দুই সঙ্গী বেরাদার সুখ নিদ্রার শেষে হলিডে মুডে হুইস্কি নিয়ে বসছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করল - চলবে। কোথায় ছিলাম এতক্ষণ তা জানার প্রয়োজনও বোধ করল না ।

আমি বিনীত ভাবে জানালাম - না ভাই আমার থাক, তোরা চালিয়ে যা।

ওফ সে এক ভয়ংকর রাত। নিজে বেশি একটা না খেলেও আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে মদ খেলে প্রেম বিরহের বেদনা ভরা কাহিনি শোনার। ঐ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দুই মাতালের হুজুগে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। শেষে ঝড়ের অবসান হল মাতাল যুগলের সশব্দে নাক ডাকার মধ্যে দিয়ে। কোনরকমে ছাড় পেয়ে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম। বাইরে তখন বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই, পূর্ণিমার আলোয় চাঁদ হাসছে।

।।...............................................।।

এবং আমিঃ এইতো জীবন – ১

এবং আমিঃ এইতো জীবন – ২

======================================

আমার শহর
নভেম্বর, ০৭, ২০১১


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

বাহ!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

তাপস শর্মা  এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

তাসনীম এর ছবি

অনার্যের মন্তব্য কপি করছি - বাহ।

তবে "ডুম্বুরভ্যালীকে" কি কারণে জানি ভুরুঙ্গামারি পড়েছি হাসি

অটঃ আপনার তো একটি অতিথি একাউন্ট আছে, ওখান থেকে লেখা দেন না কেন?

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

তাপস শর্মা  এর ছবি

ধন্যবাদ।
চলে আসেন একদিন ভুরুঙ্গামারি দেখতে একসাথে যাবো। আজকাল আমার আবার ঠায়ঠায় কাঠখোট্টা জীবন চলছে হাসি

অটঃ ওটা আপাতত বন্ধ আছে। আমার কিছু দোষ ছিল তাই, মন খারাপ

কৌস্তুভ এর ছবি

সুন্দর।

তাপস শর্মা  এর ছবি

শুধু সুন্দর, খুব সুন্দর নয় কেন খোকা চোখ টিপি চোখ টিপি

সজল এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো, তিন পর্বই আজকে পড়লাম। ঘটনাপ্রবাহ একটু খাপছাড়া লাগলো যদিও। আর ছবিগুলো দারুণ তুলেছেন।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তাপস শর্মা  এর ছবি

ধন্যবাদ, সজল ভাই। প্রথম পর্বটাতে ভাবনা গুলি বিচ্ছিন্ন ছিল। শুরুরটা দিয়ে গোটা পর্বের আভাস দিতে চেয়েছিলাম তাই হাসি । পরের পর্ব থেকে একটু গতি পেয়েছেন আশা করি।

তিথীডোর এর ছবি

চলুক
৩য় ছবিটা সবচেয়ে ভাল।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

তাপস শর্মা  এর ছবি

আচ্ছা। হাসি ... বাকি গুলো ভালু নাই দেঁতো হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্রতিটা পর্বকে আরেকটু স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায় না?
মনে হয় যেন কিছুটা বাকি রয়ে গেছে

০২

ছবিগুলো দারুণ

তাপস শর্মা  এর ছবি

চেষ্টা করব লীলেন ভাই।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

ঘাসফড়িং-এর ছবিগুলো দারুণ! আর ডাবের খোল আর একাকী ফড়িংটা!

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

তাপস শর্মা  এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ দাদা।

কল্যাণF এর ছবি

ওটা ডাবের খোল নয়হে যাযাদিদি, প্রি-ডাব বা আঞ্চলিক ভাষায় ডাবের মুচি দেঁতো হাসি

তাপস শর্মা  এর ছবি

এই রে এই মাত্র যাযাবর দিদির প্রোফাইল এবং লেখায় ভালো ভাবে রাউন্ড মেরে এলাম। খাইছে খাইছে লইজ্জা লাগে আমি তো চরম মুর্খামি করলাম। দাদা লেইখা ফালাইছি দিদির জায়গায়। সরি সরি। সত্যিই লইজ্জা লাগে

কল্যাণF এর ছবি

আরে ভাই আপনিতো ছবিও ভাল তোলেন!!!! পরের পর্ব তাত্তাড়ি ছাড়েন। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

তাপস শর্মা  এর ছবি

আইচ্ছা। তবে এই লেখাটার আগামী সংখ্যার ছবির চেয়ে ভিডিও থাকবে হাসি

কল্যাণF এর ছবি

ঠিক আছে ভিডিওই সই

তারেক অণু এর ছবি
তাপস শর্মা  এর ছবি

কিরে ভাই এইডা কি দেখাইলা অনু হে হে ঠেংগা খাইছে

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

দারুণ দাদা চলুক


_____________________
Give Her Freedom!

তাপস শর্মা  এর ছবি

ধন্যবাদ অলি হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।