ডাল গুড়ো করার যাঁতাকলে ক্যাঁচর ম্যাঁচর শব্দ করে ডাল পিশাচ্ছে ব্লাউজ না-পড়া দুটি পৌঢ়া; যে কুটনী মহিলা তাদের এই কাজের তদারকি করতে এসে চেয়ারে বসে গুড়গুড় করে হুক্কা টানছে তার গায়েও ব্লাউজ ছিল না,- কাছেই জানালার ফাঁক গলে ভেসে আসছে ঘেঁটুপুত্র কমলার ফুঁপানো কান্না। তার কান্না ল্যাপটপ থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আমাদের মাথায় নেশা ধরায়, স্তব্ধ স্থির পাতলা কুয়াশার মত ঝুলে থাকে ঘরের ছাদের নিচে। আমরা কমলার কান্নাপর্বের জাগিয়ে তোলা নেশায় যখন ঝিম ধরে বসে আছি, ছবিওয়ালা ভাইয়ের আঁকা চৌধুরী সাহেবের ঝকঝকে পোট্রেট যেন গম্ভীর মুখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর পোট্রেটের চোখে তখন সহানুভূতির ছায়া বড্ডো বেমানান লাগে। শিল্পীরা যখন নাত্সী হিটলারের ছবি আঁকেন তখনও বুঝি ঐসব ছবিতে চোখের কোণে ভালোবাসার ছায়া আর্দ্র হয়ে থাকে?
আমরা শিল্পী নই; শুধুই একটা রাতখোর মাতাল পাখির মত উড়ে উড়ে বেড়াতে এসেছি শহীদ মিনারের পায়ের কাছে। শহীদমিনার কথা বলে না, কথা বলে যাই আমরা। ফেসবুকে কার পাছায় কে আঙ্গুল দিয়ে কতটা মল বের করে আনলো তার আলোচনায় দূর্গন্ধময় হয়ে ওঠলো মিনারের পাদদেশের বাতাস; জয় আচার্যী ভাই আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠলেন, 'বাদ দাও তো।' মিনারের পাশে একটা গাছের পাতা উল্টো করে লাইটিংএ ঝলমলিয়ে আছে। শাহবাগের দিকে মাঝ রাত্রির এই নির্জন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম, পিচঢালা রাস্তায় জুতোর ঠোকাঠুকির শব্দে রাতের শহুরে আওয়াজ হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির শাঁ শাঁ আওয়াজ আমার ভেতরকার নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আর আমার দৃষ্টি বারবার আটকে যাচ্ছে রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা জীবন্ত বস্তাগুলোর দিকে। আমরা আর তাকাই না, বরং চোখ গিয়ে পড়ে বুদ্ধিজীবী এবং ভাষাসৈনিকদের বুক সমান পোর্ট্রোট ভাস্কর্যগুলো দিকে। আমরা একে একে চিনতে চেষ্টা করি প্রত্যককে। গোবিন্দ স্যার এতরাতে আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন বলে বেশ বিব্রতবোধ করি; রফিক সালাম হামিদুলরা চুপচাপ তাদের পাশে বসে আছে। পিচের নির্জন রাস্তা বেয়ে বেয়ে আমাদের ছায়া চারটি এগুতে থাকলে, বাঁ দিক থেকে দ্রুত ছুটে আসা উন্মাদ ট্রাকটির প্রতি ভয় জাগে। চোখে ভেসে ওঠে 'বিজ্ঞাপণ ও মানুষের গল্পে'র আবু নাসেরের অনন্য অভূতপূর্ব এক রাত্রির অভিজ্ঞতার কথাঃ
"ওদিকে এক রাতে নাসেরের জীবনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। যথারীতি সে বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ করে বিদ্যুত চলে যায়, সে তাকিয়ে দেখে- যতোদূর চোখ যায়, রাস্তাঘাট-দোকানপাট-বাড়িঘর, কোথাও বাতি জ্বলছে না। মনে হয় শহর জুড়েই লোডশেডিং শুরু হলো। অথচ, অদ্ভুত ব্যাপার, সারা শহরে ছড়িয়ে আছে এক কোমল-মায়াবী-রহস্যময় আলো। আলোর উৎস সন্ধান করার জন্য আকাশের দিকে তাকালে সে দেখে সংখ্যাহীন নক্ষত্র বেলিফুলের মতো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। নক্ষত্ররাও এমন আলো ছড়ায়! তার জানা ছিলো না। সেই অচেনা আলোয় মিতুলকে দেখার বাসনায় সে আবারও বিলবোর্ডের দিকে তাকালে এক অদ্ভুত-অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। ছবির মিতুল জীবন্ত হয়ে উঠেছে, ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা স্নিগ্ধ হাসিটি ছড়িয়ে পড়ছে সারা মুখে, চুল উড়ছে বাতাসে, মুখে লেগে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো জল মুছে নিচ্ছে হাত দিয়ে। সে শুনতে পায় মিতুল ডাকছে_ এই দাঁড়াও, আমি আসছি। সে দাঁড়ায়, আর মিতুল সত্যি সত্যি বিলবোর্ড ছেড়ে তার কাছে নেমে এসে বলে_ তুমি শুধু তাকিয়ে থাকো, একা একা কথা বলো, একদিনও তো আমাকে ডাকো না, আমার বুঝি খারাপ লাগে না! আজকে চল একসাথে হাঁটি।
তারা হাঁটতে থাকে। রাস্তাঘাট জনশূন্য, একটা রিকশা পর্যন্ত নেই। যে মাতাল, নিশিকন্যা ও ভবঘুরেরা সারারাত এ শহরকে জাগিয়ে রাখে তাদের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। শুনশান নীরবতা চারপাশে_ যেন এক অচেনা বনভূমির মাঝখানে একটি পায়ে চলা পথে তারা হেঁটে চলেছে। কতো রাত হলো, রাস্তাঘাট এত ফাঁকা কেন_ এ প্রশ্ন একবার মনে এলেও নাসের ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয় না। পাশে হাঁটতে হাঁটতে মিতুল অবিরাম কথা বলে চলেছে_ কতোদিন ও এইভাবে কথা বলে না_ নাসের তাই মনোযোগ দিয়ে শোনে।
হয়তো সত্যি সেদিন লোডশেডিং ছিলো কিংবা ছিলো না, হয়তো সত্যি আকাশ জুড়ে নক্ষত্ররা ফুটেছিলো অথবা ছিলো না, হয়তো সত্যি রাস্তাঘাট জনশূন্য ছিলো অথবা সে ভুলেই গিয়েছিলো_ গভীর রাতে বাস ট্রাকগুলো নিয়ন্ত্রহীন দানবের মতো চলাচল করে_ আর তাই কখন কোন দিক থেকে কে যে এসে তাকে রাজপথের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে যায়, সে টেরও পায় না।"
টের আসলে আমরাও পাই না। পলাশীর মোড়, চানখাঁরপুল, ভিসি চত্বর, কার্জন হলসহ কয়েকটা হল পেরিয়ে কথন যে শাহবাগের মোড়ে এসে পৌঁচ্ছলাম, আমি ঠিক ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। জয় আচার্যী দা, সাইকো শুভদা আর পিয়াস ভাইয়ের এলোমেলা কথাবার্তার তালে চলছিল আমার এলোমেলো পা ফেলা। চারপাশের এত নির্জনতার মাঝে কান পাতলাম বাতাসে। কার যেন মিহি গলায় ফোঁপানো কান্নার শব্দে হতচকিত হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। অর্ধেক চাঁদ নিয়ে শহুরে বুড়ো আকাশ গম্ভীর মুখ করে শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো, কমলার মত এই শহরটাও প্রতিদিন রাতে ধর্ষিত হয়ে এখন কাঁদছে, কাঁদে অন্য সময়েও; আমরা শুনি না। আমি মনোযোগ দিয়ে বুড়ো আকাশের কাছে ধর্ষিত হওয়া ঢাকা শহরের ফোঁপানে কান্না শুনতে থাকি। আমরা কজন ব্লাউজ ছাড়া মহিলাগুলোর মতো পথচারী এই কান্না শুনেও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ক্লান্তিতে ভাঙতে ভাঙতে হাঁটতে থাকি গন্তব্যের দিকে।
আর সন্ধ্যায় মানুষের ভিড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লুচি রুটি চা খাই; খাওয়া শেষে সিগারেটে সুখ টানের ফাঁকে ফাঁকে টিএসসির দিকে হাঁটতে থাকি- জম্পেস একটা আড্ডা হবে আজ। কমলাকে ছবি উপহার দিবে বলে ছবিওয়ালা কমলার স্কেচ আঁকে আর হাসে। আমরা দেখতে পাই না। এত এত জীবনের কোলাহল আর মানুষের ভিড়ের মাঝে আমরা শহরের কান্না শুনি না।
অথচ, আমরা ঘেঁটু কমলা অথবা বেশ্যার মত করে এই ঢাকা শহরটিকে প্রতিদিন রেইপ করেই যাচ্ছি!
-কিঙ্কর আহসান
মন্তব্য
বাহ! আপনার লেখার ভঙ্গী তো দারুন! খুবই সুখপাঠ্য। আরো পড়ার প্রত্যাশা জানিয়ে গেলাম।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
অনেক ধন্যবাদ ক্রেসিডা আপু। আপনিও ভালো লিখেন। আমি সাইলেন্ট রিডার, তাই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়ে ওঠে না।
আরো আরো লেখার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন
ভাই হৈবে।
সাইলেন্ট রিডারও খেই হারায়, নামখানার পরিবর্তন অতি আবশ্যক নয়কি, ক্রেসিডা ভাই?
ঠিক হয়ে যাবে মামুন ভাই। এভাবেই সম্পর্ক বাড়বে.. ভুল করে করে..
আছেন কেমন?
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
এত হতাশা !
হতাশা যতই থাক, আপনার লেখায় স্বকীয়তা আছে, তাই আশায় থাকলাম।
আমি ব্লগে নতুন এবং মোবাইল ইউজার। তাই কীভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কমেন্টের উত্তর দিতে হয় ঠিক শিখে ওঠতে পারিনি এখনো। এজন্য আগাম দুঃখ প্রকাশ করছি। সবার জন্য এখানেই উত্তর দিচ্ছি। দয়া করে, কেউ কিছু মনে করবেন না।
মৃত্যুময় ঈষৎ(অফলাইন)
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
কাজি মামুন
। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ব্যাঙের ছাতা
হতাশা আমার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী ভাইয়া। পরিত্রাণ আমিও চাই। ধন্যবাদ।
প্রদীপ্তময় সাহা
মূল্যায়নের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। আমিও চাই, আরো আরো লিখতে। ভালো থাকবেন।
ক্রেসিডা
দুঃখিত ভাইয়া। ভুল হয়ে গেছে। আর ভুল হবে না। মাথায় গেঁথে নিলাম।
লেখা ভালা পাইছি, আপনার লেখা গুলো আত্মার ভেতরে এক ঘোর তৈরি করে। নিয়মিত লেখা চাই
হিমু ভাইয়াকে ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন