অনেককালের পুরনো একটি দিন ফিরে এলো

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি
লিখেছেন মুহম্মদ জুবায়ের (তারিখ: সোম, ৩০/০৭/২০০৭ - ১২:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত বছর ছেলেমেয়েদের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। এর আগেরবার যাওয়া হয়েছিলো ২০০০-এ। তখন পুত্রের বয়স তিন হয়নি, ফলে সেই সফরের কিছুই তার মনে নেই। এবারের যাওয়া মূলত তারই আগ্রহ ও উৎসাহে।

একদিন দুই বাপ-ব্যাটা রওনা হয়েছি বিখ্যাত মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি দেখতে। ডাইনোসর বিষয়ে তার আগ্রহ সেই আধো আধো বোলের বয়স থেকে, ক্রমে বিবিধ প্রকারের ডাইনোসর সংক্রান্ত তথ্যের চলমান ভাণ্ডার হয়ে ওঠে সে। এই মিউজিয়ামে অনেক ডাইনোসর-কংকাল আছে সে জেনেছে। সুতরাং সেখানে যাওয়া তো আবশ্যক।

ছেলেকে নিয়ে সাবওয়েতে। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট চিনি না, সাবওয়ে সম্পর্কে ততোধিক অজ্ঞ। আমরা যে শহরে বাস করি, সেখানে সীমিত দূরত্বে কিছু ট্রেন চলাচল সবে শুরু হয়েছে। কোন ট্রেনে উঠতে হবে, কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, কোথায় যাত্রা শেষ করতে হবে এইসব তথ্য লেখা কাগজ পকেটে।

নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ভূগর্ভে, ফলে ট্রেন চলাকালে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার টানেল ছাড়া কিছু দেখার নেই। পুত্রের বিবিধ কৌতূহল, সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। এইসব আমাদের হয় নিত্যদিন। ভাবি, আমাদের বাবাদের আমরা এতো প্রশ্ন করতে পারতাম না। ওই বয়সে পিতা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে সমীহ বা ভয়ের অনুভূতিই বেশি ছিলো মনে আছে।

ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা অনেককাল আগের একটি কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার পিতার সঙ্গে ট্রেনে করে যশোর যাচ্ছি। আমার বয়সও তখন দশ হয়েছে কি হয়নি। সেই যাওয়ার উপলক্ষ কী ছিলো, কেন শুধু আমরা দুই পিতাপুত্র যাচ্ছি সেসব কিছুই মনে পড়ে না। সেই ভ্রমণটি আমার স্পষ্ট স্মরণে আছে।

বগুড়া থেকে শান্তাহার জংশন। সেখানে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ রেলে ওঠা। ব্রডগেজে এই আমার প্রথম নয়। দাদার বাড়ি জয়পুরহাট যেতে হলেও শান্তাহারে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে হয়। তখন বগুড়ার সঙ্গে জয়পুরহাটের নামমাত্র সড়কপথ থাকলেও তা ছিলো অতিশয় দুর্গম এবং বাস সার্ভিস বলে কিছু ছিলো না।

শান্তাহার থেকে জয়পুরহাট মাত্র পাঁচটি স্টেশনের দূরত্ব। এবারে আমরা যাচ্ছি জয়পুরহাটের উল্টোদিকে এবং দূরত্বও অনেক অনেক বেশি।

ব্রডগেজে দীর্ঘযাত্রায় ট্রেনের দুলুনি খূব বেশি করে টের পাওয়া যায়। দুলুনিতে শুধু বালক কেন, বয়স্কদেরও ঘুম পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে বাবা আমাকে দর্শনীয়গুলো দেখান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রাজশাহীর বিখ্যাত চলনবিলের বিশাল বিস্তার। নাটোরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাওয়া হলো। আবার ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে। চৌকোনা এক ধরনের মিষ্টি কোনো স্টেশন থেকে কিনেছেন, আমাকে খাওয়াবেন। ঘুমচোখে বাইরে তাকাই। জানালার পাশে বসেছি বলে বাইরে মুখ বাড়ালে বাতাসের তীব্র ঝাপটা মুখে লাগে। হাত প্রসারিত করে দিলে বাতাসের তোড়ে হাতটা খুলে যাবে মনে হয়। মিষ্টি মুখে দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখি বেশ বড়ো একটা বাঁক নিচ্ছে ট্রেন। আমি পেছনের সবগুলো বগি দেখতে পাচ্ছি। রোদ পড়ে ট্রেনের ধাতব শরীর চকচক করে। ট্রেনের গতির প্রতিক্রিয়ায় রেললাইনের পাশে ধুলোর ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। বালক বিস্ময়-বিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তখন সে জানে না, এই দৃশ্য তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। চোখ বুজলে এই ছবি অবিকল দেখবে সে বারংবার।

নিউ ইয়র্কের চলন্ত সাবওয়েতে বসে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অনেক অনেক বছর পর, যখন বাবা আর কোথাও নেই, এই ট্রেনযাত্রা কি তার মনে পড়বে? যেমন আমার পড়লো?


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

আপনার ছেলেবেলার ট্রেনযাত্রাটা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো। সত্যই দারুন।
স্মৃতিগুলো আসলেই অদ্ভুদরকম অনুভুতির জন্ম দেয় মনে।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ধন্যবাদ, শামীম।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নজমুল আলবাব এর ছবি

আজকে পুত্রধন মোটর সাইকেল চড়ে শহরে এলেন। সামনে বসে আছেন আর নানা কিসিমের প্রশ্ন। এইটা কেন, ওইটা কেন। এইটা কার, আমারটা কই। দাদা কই... ২৫/৩০ মিনিটের ভ্রমনে তিনি ২৫ সে. টানা মুখ বন্ধ রাখছেন বলে মনে হয়না।

অরূপ এর ছবি

জুবায়ের ভাই এর তুলনা জুবায়ের ভাই!
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে। নিজের বাবার সাথে স্মৃতি গুলো নিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু বাব হিসেবে এবং সন্তান হিসেবে এই দুই অবস্থার স্যান্ডউইচ অনুভুতির অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ক্ষণিকের কর্মবিরতি এর ছবি

ভালো লাগলো পড়ে। আমার শৈশবে প্রচুর রেলভ্রমণের স্মৃতি আছে, সব ঋতুতে। সময়ের সাথে যেমন রেলপথের দু'পাশে দৃশ্যপট পাল্টেছে, পাশের সীটে বসা মানুষরা পাল্টে গেছে, তেমনি পাল্টে গেছে রোমাঞ্চের অনুভূতিও। পাটের গন্ধের একটা স্মৃতি এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্নে ঢুকে পড়ে গোঁয়ারের মতো। ট্রেন থেকে মেঘনা নদী দেখে মাথা ঘুরে ওঠার ব্যাপারটাও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। আমার শৈশবের খুব ভালোলাগার ছোট্ট শহরটাও এখন একদম পাল্টে গেছে, নিজেকে সেখানে আগন্তুক মনে হয়।

তারেক এর ছবি

অসাধারণ। টুকরো স্মৃতিগুলো এভাবেই ফিরে ফিরে আসুক। ভাল লাগল খুব। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

স্মৃতি আমাকে খুবই কষ্ট দেয়। লেখাটা পড়ে আবার সেই কষ্ট পেলাম।

শ্যাজা এর ছবি

চমৎকার।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ট্রেনেই তো জীবন কাটলো। বেশিরভাগ ভ্রমণই ট্রেনে।
লেখাটা স্মৃতিকে উসকে দেয়।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

নজমুল, বালক বয়সে এদের বকবক শুনে আমরা বিরক্ত হই কখনো কখনো। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, একটা সময় আসবে যখন ওদের কথা বলানোর জন্যে সাধ্য-সাধনা করতে হবে। নিজেদের দিয়েই তো বুঝি! হাসি

অরূপ, আপনার মন্তব্য দুই দিকেই যায়। চোখ টিপি আপনি কোনদিকে পাঠালেন?

মাহবুব মুর্শেদ, আপনার স্যান্ডউইচ হওয়ার সময়ও আসিবে!

তারেক, শ্যাজা শোমচৌ, ধন্যবাদ আপনাদের মন্তব্যের জন্যে।

ক্ষণিকের কর্মবিরতি আসলে কি হিমু? নামের ওপর ক্লিক করতে হিমুর ব্লগস্পটে গিয়ে হাজির হলাম। তবে হিমু বা অজানা অতিথি যে-ই হোন, আপনার মন্তব্য ভালো লেগেছে। বীটলস-এর একটি গানে আপনার-আমার কথাগুলি আছে:

There are places I remember
All my life, though some have changed,
Some forever, not for better,
Some have gone and some remain.
All these places had their moments,
With lovers and friends I still can recall,
Some are dead and some are living,
In my life I've loved them all.

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

জ্বি, আমিই ছিলাম। বীটলসের গানের কলিটা শুনে একটু বিষণ্ন লাগলো আবারও। আমরাও বার বার বাঁক ঘুরে যেন নিজেদের পেছনের বগিগুলোকে দেখছি। এত কিছুর পরও ফেলে আসা দিনগুলি কি অদ্ভুত, অতুলনীয়। ফেলে আসা সময়ের স্থানে মুহাম্মদ বখতিয়ারের মতো জোরজার করে হানা দিলেও সেই সময়গুলি আর পাওয়া যায় না, লক্ষণ সেনের মতো পালিয়ে যায় সব, ভাতের থালার মতো কিছু নিদর্শন পেছনে ফেলে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বখতিয়ার খিলজি আর লক্ষ্ণণ সেনের উপমাগুলি দারুণ টেনেছেন, হিমু। আপনার মন্তব্যগুলির গুণেই হয়তো অকিঞ্চিৎকর রচনাটি জাতে উঠে গেলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অরূপ এর ছবি

অরূপ, আপনার মন্তব্য দুই দিকেই যায়। আপনি কোনদিকে পাঠালেন?

ত্যানা প্যাঁচাইতেও পারেন রে ভাই ইয়ে, মানে...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

অরূপ, আমি ত্যানা প্যাঁচানোর মানুষ নই। আমি বলেছিলাম স্রেফ মজা করার জন্যে। সঙ্গে একটা ইমোটিকনও জুড়ে দেওয়া ছিলো। দুঃখিত, ব্যাখ্যা দিতে হলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অরূপ এর ছবি

আচ্ছা, ধন্যবাদ হাসি

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত এর ছবি

আপনার লেখাটা পড়ে কেন জানি "দা নেমসেক" মুভিটার কথা মনে পড়ল। অসাধারণ লেখা।
_____ ____________________
suspended animation...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দ্য নেমসেক ছবিতে দেখিনি, বই পড়েছি। ভালো লেগেছে।

আপনার মন্তব্যে খুশি। হাসি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ঝরাপাতা এর ছবি

সবাই নিজের ছায়া খুঁজে ফেরে। স্নিগ্ধতা মূক করে দিলো ক্ষণিকের তরে।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সেই ছায়াই হয়তো প্রশান্তি দেয়, জীবনকে অনেক অর্থপূর্ণ করে তোলে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

বুকটা হু হু করে উঠল ,,, অনেক আগে একদিন বাবার হাত ধরে কমলাপুর স্টেশনের আশপাশটায় হেঁটেছিলাম, মনে পড়ল
চমৎকার লেখনী
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

প্রাণ হুহু করা অনেক গল্প আমরা সবাই বুকের ভেতরে বয়ে বেড়াই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত আহমেদ এর ছবি
আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এ স্মৃতিগুলো প্রজন্মান্তরে ফিরে আসবে।
আমার ধারণা, আজ থেকে ৪০ বছর পর এরকম আরেকটি স্মৃতিকথা লেখা হবে, অনেকদিন আগে নিউইয়র্কের সাবওয়েতে বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা ওঠে আসবে লেখনীতে, ততদিনে হয়তো ব্লগ সমাজের আরো বিস্তৃতি ঘটবে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে ইন্টারনেট ফোরামে আসবে নতুন মাত্রা। পাল্টাবে অনেক কিছু। অম্লান থাকবে পিতা-পূত্রের ভালোবাসা।
শুভকামনা!!!

_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

তোমার মন্তব্যটি খুব ভালো লাগলো, শিমুল। কবিরা কতো সহজে বলেন, তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে / তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে..

তবু কি ইচ্ছে হয় না, আমি চলে যাওয়ার পর কারো মনের কোনো কন্দরে এক চিলতে জায়গা যদি আমার জন্যে থাকে!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।