বুদ্ধিমত্তার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা নিরুপণ করতে হয়। বুদ্ধি কি? অধিকাংশ মানুষের মতে সমস্যার সঠিক সমাধান করাই বুদ্ধিমত্তার আসল পরিচয়।তবে বারট্রান্ড রাসেলের মতে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিও বুদ্ধি যাচাই করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ – বারবার প্রচেষ্টায় সমস্যার সমাধান করা আর সমস্যার গভীরে গিয়ে মৌলিক সমাধান করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। বুদ্ধিমত্তার আরেকটা নিদর্শন পাওয়া যায় দূরদর্শিতার মধ্যে। নিউরোলজিস্ট হোয়ার্স বার্লোর মতে, আপাতদৃষ্টিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু ঘটনার মধ্যে নির্দিষ্ট সূত্র খুঁজে বের করার মধ্যেই বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। আলোচনায় যুক্তিপূর্ণ মতামত জ্ঞাপন, নিখুঁত তুলনা খুঁজে বের করা, ভবিষ্যতবাচ্যতা বা অনুমান করা যা এরপরে কি উত্তর পেতে চলেছে – এ সবই বুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ। বুদ্ধিমত্তার সর্বজনীন সংজ্ঞা হয়ত দেওয়া সম্ভব নয়, যেমন চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
যেকোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হল সে একাধারে একাধিক মতামত নিয়ে চিন্তা করতে পারে, এবং সে দ্রুত প্রত্যেকটি মতামতে অনেকগুলো দিক ভাবতে পারে। বহুমুখী প্রতিভাও বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন। খাবার ব্যাপারে জীবজগতে অধিকাংশই একমুখী, কিন্তু সর্বভুক প্রাণীরা সবসময়েই সুবিধা পেয়ে আসে। যেমন প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতা সর্বভুক প্রাণীদেরই বেশি, তাই বরফ যুগে (ice age) যখন খাবারের অভাব দেখা দিয়েছিল, তখন সর্বভুক প্রাণীরা বিশেষ অসুবিধা ছাড়াই বেঁচে থাকতে পেরেছিল।
জীবজগতের মধ্যে অনেক বিস্ময়কর কার্যকারিতা দেখা যায় যা তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আপাত ধারণা তৈরি করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় কোনো প্রোটিন, উৎসেচক বা হরমোন নিয়ন্ত্রিত। খুব সহজেই তাদের বোকা বানানো সম্ভব। কাঠবেড়ালি শীত পড়ার আগেই খাবারদাবার সঞ্চয় করে রাখে। কাঠবেড়ালির ক্ষেত্রে মেলাটোমিন নামে এক হরমোন রাতে ক্ষরিত হয়, তাই রাতের দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে সাথে সেই হরমোনের প্রভাবে তারা বুঝে নেয় যে শীত আসন্ন। তাই, পরিকল্পনার নিদর্শন হলেও এটা কাঠবেড়ালির বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
পরিকল্পনা বুদ্ধিমত্তার এক অন্যতম নিদর্শন। আর এই পরিকল্পনা যত দূরদর্শী, জীব তত বেশী বুদ্ধিমান। ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করার ক্ষমতা তাই জীবজগতে শুধুমাত্র উন্নততর প্রাণীদের মধ্যেই দেখা যায়। ধরা যাক একটা শিম্পাঞ্জী বনে এক জায়গায় খাবারের সন্ধান পেল। সে তখন অন্য কোনো জায়গায় সরে গিয়ে চিৎকার করে তার সঙ্গীদের ডাকবে। অন্য শিম্পাঞ্জীরা যতক্ষণে ভুল গন্তব্যে পৌঁছবে, ততক্ষণে সে খাবার নিয়ে সটকে পড়বে, অন্যেদের ভাগ না দিয়েই। সন্দেহ নেই, পরবর্তী কয়েকটি ধাপে চিন্তা করার ক্ষমতার জন্যেই শিম্পাঞ্জীরা এরকম পরিকল্পনা করতে সক্ষম।
ভাল করে ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে উপরোক্ত ক্ষেত্রে একই কাজ বারবার করতে থাকলে বাকিরা তো বুঝে যাবে, তাহলে এটা কিভাবে বুদ্ধিমত্তা বলা যায়? তাই আসল বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় অনন্য পরিস্থিতিতে – যে অবস্থায় জীব আগে কখনও আসে নি। আর এখানেই মানুষের জয়জয়কার। উপরোক্ত ক্ষেত্রে মানুষ যদি তার সঙ্গীদের এভাবে ধোঁকা দিত, তাহলে প্রতারক মানুষটিকে বারবার নতুন নতুন পন্থার সাহায্য নিতে হবে – উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে। এই উদ্ভাবনী ক্ষমতাই মানুষের সাথে অন্যেদের তফাৎ গড়ে দেয়।
জীবজগতে বুদ্ধির আরেক নিদর্শন পাওয়া যায় নকল করার ক্ষমতার মধ্যে। এই ক্ষমতা বিশেষত দেখা যায় কুকুর আর বানরের মধ্যে। কুকুর আসলে সামাজিক জীব, মানুষের শারীরিক ভাষা (body language) থেকে বুঝে নেয় হাবভাব। তাই, খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে খবর পড়ার মত করে কুকুরকে বল আনতে বললে কুকুর বল আনার প্রচেষ্টাও দেখাবে না। কুকুরের স্বাধীন ভাবে বোঝার ক্ষমতা খুবই সীমিত, তাই একটা কুকুরকে তালিম দিয়ে দশ-বারোটা বিভিন্ন কাজ করানো খুবই শক্ত কাজ।
মানুষের বুদ্ধিমত্তার অন্যতম প্রমাণ হল ভাষা – ধ্বনি বা শব্দ থেকে নির্দিষ্ট ব্যাকরণ সম্মত ভাবে বাক্য গঠন করা। জীবজগতে অনেক প্রাণীও বিভিন্ন ধ্বনি ব্যবহার করে, কিন্তু ব্যাকরণ ব্যবহার করার নিদর্শন অনন্য। শিম্পাঞ্জীরা প্রায় বারো ধরণের ধ্বনি ব্যবহার করে তথ্য আদানপ্রদানের জন্য – প্রতিটি ধ্বনি আবার বিভিন্ন প্রাবল্যে উচ্চারণ করে তাদের অনুভূতিও জানিয়ে দেয়। মানুষও মাত্র ত্রিশ-চল্লিশটি বিভিন্ন মৌলিক ধ্বনি ব্যবহার করেই ভাষা গঠন করেছে। কিন্তু মানুষ একই ধ্বনি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে পারে, এভাবেই সে তার ভাষার পরিধি বিস্তৃত করেছে। একই ধ্বনি দুটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থ বহন করেছে বা পরের পর এরকম ধ্বনি বা শব্দ জুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাব প্রকাশের নিদর্শন শিম্পাঞ্জীর মধ্যে নেই, যা আছে মৌমাছিদের মধ্যে।
একই ইঙ্গিত যে বিভিন্ন অর্থবহ হতে পারে, তা জীবজগতে মৌমাছিদের মধ্যে দেখা যায়। কিছু মৌমাছি যখন খাবার খুঁজে পায়, তারা তাদের মৌচাকে ফিরে এক অদ্ভূত নৃত্যে যোগদান করে। তারা লেজ ও পাখা শৃঙ্খলাবদ্ধ করে শেকলের (পরপর কয়েকটি বাংলা সংখ্যা ‘৪’-এর মত শেকল) মত আকার ধারণ করে। সেই শেকলের নির্দিষ্ট কোণ বলে দেয় খাবারের উৎস কোন অভিমুখে, আর শেকলের বলয়ের সংখ্যা নির্ধারিত হয় দূরত্ব অনুসারে। সাধারণভাবে দেখা গেছে, জার্মান মৌমাছিরা তিনটি বলয়ের মাধ্যমে ১৫০ মিটার বোঝায় আর ইটালিয়ান মৌমাছিরা বোঝায় ৬০ মিটার। তবে ভাষাতত্ত্ববিদেরা একে আলাদা গুরুত্ব দিতে নারাজ। আসলে, মৌমাছিদের বেঁচে থাকার একটি অভিন্ন অঙ্গ হল তাদের এই খাদ্যসংগ্রহের প্রক্রিয়া। তাদের অনন্য প্রক্রিয়া তাদের প্রাকৃতিক নির্বাচনে অন্য জীবের তুলনায় সুবিধা প্রদান করে, তাই জিনগত ভাবে এই প্রক্রিয়া এখন তাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। কিন্তু একই ঘটনা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় – মানুষ ভাষা ব্যবহার করে যেকোনো কাজে, যেকোনো অনুভূতিতে – যা তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করতেও পারে, নাও পারে।
আমাদের এই বুদ্ধির রহস্য কি? বিজ্ঞানীদের মতে – আমাদের মস্তিষ্ক। আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে – আমাদের সেরিব্রাল করটেক্স। ভাঁজ হয়ে থাকা আমাদের সেরিব্রাল করটেক্স চারটে A4 সাইজের পেপারের সমান আকার নিতে পারে। শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রে এই আকার একটি সাইজের পেপারের মত, বানরের ক্ষেত্রে একটা পোস্টকার্ডের আকার আর ইঁদুরের ক্ষেত্রে এটার আকার মাত্র একটা স্ট্যাম্পের সমান। মস্তিষ্কের অনন্য বৈশিষ্ট্যই মানুষকে জীবজগতের চালকের আসনে বসিয়েছে – নিয়ে গেছে আন্টার্কটিকা থেকে হিমালয়ের চূড়ায়। কিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হল এই মস্তিষ্ক। কিভাবেই বা শিশুর সাধারণ বুদ্ধিমত্তা প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে বিকশিত হয়ে পরিণতি লাভ করে?
মন্তব্য
বিবর্তনবাদ নিয়ে সামহয়্যারে দিগন্ত নামে এক ব্লগারের কিছু অসাধারণ লেখা পড়েছি। আপনি কি সেই ব্যক্তি? স্বাগতম জানাচ্ছি, সচলায়তন নিশ্চয় আপনার লেখনীতে সমৃদ্ধ হবে। আজকের পোস্টটাও অসাধারণ।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
চমৎকার লেখা!
আমার মনে হয় জীবের একটা বেসিক বৈশিষ্ট্য - সারাক্ষণ'এরপর কি ঘটবে'এটা অনুমান করা ,,, বুদ্ধির বিবর্তন হয়ত সেখান থেকেই
ওহ, শিম্পাঞ্জিরা ১২ টা ধ্বনি ব্যবহার করে, এটা জানতামনা ,,, অন্যন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা কেমন? ,,, মানুষ সম্ভবত ভাষার কারণেই এত বড় ডিফারেন্স তৈরী করতে পেরেছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
ধন্যবাদ, আমিই সামহোয়্যারের দিগন্ত। তবে আমি এবার থেকে এখানেই লিখব।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
ভাল বলতে বলতে বোরিং হয়ে যাবে। সামহোয়্যারের দিগন্তেরও সব লেখা পড়তে চাই। লিংক মেইল করেন!
নতুন মন্তব্য করুন