জমি জিরাত বিস্তর। কিন্তু খুদা বক্স বিখ্যাত ছিল তার ঘোড়ার গাড়ি আর পিস্তলের জন্য। গন্ডগ্রামে খামার বাড়ি থেকে হাটে সে আসে সপ্তাহে একদিনই। কিন্তু সেই একদিনের গল্পই বাকী ছয়দিন করে হাটের মানুষ। কিন্তু সব গল্পকে ছাড়িয়ে গেল খুদা বক্সের বিবাহের গল্প। সে গল্প প্রায় অমর। দশগ্রামের মুরুব্বিরা আজো যে কারো বিয়েতে...জমি জিরাত বিস্তর। কিন্তু খুদা বক্স বিখ্যাত ছিল তার ঘোড়ার গাড়ি আর পিস্তলের জন্য। গন্ডগ্রামে খামার বাড়ি থেকে হাটে সে আসে সপ্তাহে একদিনই। কিন্তু সেই একদিনের গল্পই বাকী ছয়দিন করে হাটের মানুষ। কিন্তু সব গল্পকে ছাড়িয়ে গেল খুদা বক্সের বিবাহের গল্প। সে গল্প প্রায় অমর। দশগ্রামের মুরুব্বিরা আজো যে কারো বিয়েতে প্রথমে সেই গল্পই শোনায়।
বিয়ের পরদিন বউকে নিয়ে প্রিয় ঘোড়া পঙ্খিরাজের টানা গাড়িতে উঠলো খুদা বক্স। কোমরে সর্বক্ষণের সঙ্গী পিস্তলটা গোঁজা। গাড়ি ছুটলো তার জমি জিরাতের বুক চিড়ে। বউকে তখন নিজের বংশ গরিমার গল্প শোনাচ্ছে খুদা বক্স।“আমরা হচ্ছি বংশ পরম্পরায় ঘোড়সওয়ার। বখতিয়ার উদ্দিন খিলজির নাম শুনছো? মাত্র ১৮ টা ঘোড়া দিয়া বাংলা জয় করছিলেন।” এই পর্যন্ত কথা হতেই খুদা বক্সের ঘোড়াটা হোঁচট খায়। ভালো করে রাস্তাটা পরীক্ষা করে দেখে খুদা বক্স। কোথাও কোন গর্ত নাই, ইট-পাথর নাই। ঘোড়াটা কি তবে নতুন বউ দেখে হিংসা করতেছে? সন্দেহ হয় খুদা বক্সের।
খুদা বক্স গল্প আবার শুরু করে। “বাংলার রাজা লক্ষণ সেন তখন পালায়া গেলেন। বাংলা আমাদের দখলে এলো। ঐ যে ১৮ ঘোড়ার একবারে শেষের ঘোড়াটা যিনি চালাচ্ছিলেন...”। কথাটা শেষ না করার আগেই ঘোড়াটা আবার হোঁচট খায়। নতুন বৌয়ের মাথার ওড়নাটা ছিটকে পড়ে যায়। খুদা বক্স রাস্তার অবস্থা দ্রুত দেখে নিয়ে ঘোড়া টারে খোঁচা দেয় চাবুক দিয়ে আর জোরে একটা হাঁক দেয়, “এ্যাক”।
সেই হাঁক শুনে নতুন বউয়ের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। খুদা বক্স নির্বিকার। সে আবার গল্প শুরু করে। “ঐ শেষের ঘোড়াটা যিনি চালাচ্ছিলেন তিনি আমাদের বংশের পূর্বপুরুষ। এই ঘোড়াও সেই ঘোড়া-বংশের ঘোড়া”। আবার হোঁচট খায় ঘোড়াটা। খুদা বক্স রীতিমত বিরক্ত। এরকম ঘটনা কোনোদিন ঘটে নাই। ঘোড়ার বেতমজিতে গোস্বা উঠে খুদা বক্সের। এইবার আর সে পথের দিকে তাকায় না। জোরে হাঁক দেয়, “দো”। হাঁকটা এত জোরে ছিলো যে বসা থেকে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় নতুন বউ। দ্রুত স্বামীর কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সামাল দিয়ে কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কী হয়েছে হুজুর”। খুদা বক্স নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “আমার না ঘোড়ার”। “কিন্তু আপনি এই এ্যাক, দো বলে হাঁক দিচ্ছেন কেন?” “ঘোড়াটা ফাউল করতেছে দেখ না। ওরে দুইটা ওয়ার্নিং দিলাম।
তারপর সব ঠিকঠাক। ঘোড়া ছুটছে আবার আগের মত। খুদা বক্সের গল্পও শুরু হয়েছে, “এই দশ গ্রামে আমরা ছাড়া কেউ ঘোড়া পালে না। আমরা ছাড়া কেউ ঘোড়ার মাংসও খায় না”। এইবার আবার ঘোড়াটা হোঁচট খায়। বেশ জোরেই। খুদা বক্সের মাথাটা নতুন বউয়ের মাথার সাথে ঠুকে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে খুদা বক্স কোমর থেকে পিস্তল বের করে হাঁক দেয়, “তিন”। তারপর ঘোড়ার মাথা সই করে পর পর তিনটা গুলি। এ্যাক, দো, তিন...। ঢলে পড়ে ঘোড়া পঙ্খিরাজ। কাত হয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে বউকে সযত্নে নামিয়ে খুদা বক্স বলে “চলো, ঐ রাস্তায় উঠলে গরুর গাড়ি পাওয়া যাবে। তাতে চড়েই বাড়ি ফিরবো আমরা”।
নতুন বউ এ ঘটনার তখন বাকরুদ্ধ। তার গোবিন্দা-মার্কা চেহারার স্বামীর মধ্যে এরকম একটা গব্বর সিং বাস করে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বিস্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। স্বামীর শেরওয়ানির কোণা খামচে ধরে গলার সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে চিত্কার করে উঠলো, “আপনি এত নিষ্ঠুর। আপনার এত প্রিয় ঘোড়াটারে আপনি এইভাবে মারতে পারলেন। আপনার বুকে তো মায়াদয়া বলে কিছু নাই। এই নিষ্ঠুর মানুষের সাথে আমি সারাজীবন কীভাবে কাটাবো? ও আমার আল্লাগো”...বলে এক আকাশ ফাটানো চিতকার।
খুদা বক্স একটুও বিচলিত হলেন না। স্ত্রীর মুঠো থেকে শেরওয়ানির কোণাটা উদ্ধার করে পিস্তলটা কোমরে রাখলেন ঠান্ডা মাথায় আর স্ত্রীর কানের কাছে মুখ এনে গম্ভীরভাবে বললেন ‘এ্যাক’। ধারাপাতের প্রথম সংখ্যা। শোনামাত্র নতুন বউয়ের শরীর-মন-মগজে দশ হাজার ভোল্টের বিদ্যুত খেলে গেল। এক সেকেন্ডও লাগলো না বউটার। দূরের রাস্তার দিকে হাত দেখিয়ে বাক-বাকুম করে আহ্লাদী গলায় নতুন বউ বলে উঠলো, “ঐ যে একটা গরুর গাড়ি দেখা যায়”।
এর পর খুদা বক্সের বউ সাত সাতটা বাচ্চার মা হয়েছে। তাদের সংসারে কোনোদিন কোনো অশান্তি হয়েছে, দশ গ্রামের কেউ শোনেনি। (খুদা বক্সকেও আর কোনোদিন দো তিন বলতে হয়নি।)
মন্তব্য
অসাধারন হয়েছে। ঃ)
নতুন মন্তব্য করুন