ফিকশন ও বাস্তবের মাঝে কোথাওঃ এক চরিত্র লিখছে নূপুরের গল্প

কাজী আফসিন শিরাজী এর ছবি
লিখেছেন কাজী আফসিন শিরাজী [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৬/১০/২০০৯ - ৫:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠিক যেমনটা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি প্রশস্ত একটা বারান্দায় পা রেখে হাসান ঘুরে ঘুরে তাকায়। উঠানে কামরাঙ্গা গাছের একটা ডাল নুয়ে এসে বারান্দার গ্রিলের সাথে খুনসুটি করছে। পাচিলের উপর অন্যমনস্ক একটা কাক রোদ পোহাচ্ছে, কাকটাকে দেখে খুব ক্ষুধার্ত মনে হল। ঘরের আবজানো দরজাটা টেনে বেড়িয়ে এল হাসানের সেই কবেকার শীতের সামাজিক অঙ্গিকারবদ্ধ স্ত্রী রিধি। সমাজ শিক্ষার যে বাড়াবাড়ি রকমের কড়াকড়ি তার দুরন্ত চোখ ঢাকতে ঘোমটার বেড়ি পড়িয়েছিল, বিকেলের হালকা বাতাসেই সেই ঠুনকো ঘোমটা কাঁধে এসে পড়ল। হাসান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে রিধির দিকে তাকিয়েই পর মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল। রিধির চোখের গাঢ় কাজলের সাজ ধুয়ে দিচ্ছে নোনতা পানিগুলো, গল্পের এই পর্যায় সঞ্জিবদার গানের মত মনে হচ্ছে সমুদ্র কী ঐ জলের ছেলে! এত মমতা শিখল কোথায় ঐ জলগুলো!

মাস ছয়েক আগে ভাড়া বাসায় লিমাকে নিয়েই রিধির সমস্ত দিন কেটে যেত। ছোট্ট বাসা। দৌড় তো দূরের কথা হাঁটার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না। সেইখানেও লিমা নিজের খেলার জায়গা করে নিয়েছিল। সমস্তদিন সবাইকে মস্ত জ্বালিয়ে গলা ছেড়ে টিভির বিভিন্ন এডের জিঙ্গেলগুলো চেঁচিয়ে গাইত। আর মায়ের নূপুর পরে হাঁসের মত পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাত দুটো উচিয়ে কী মায়া কাড়া নাচাটাই না নাচত! রিধির খুব সখ ছিল আগামী বছর লিমার বয়স সাত হলেই তাকে নাচের স্কুলে দিবে। সেই আগামী বছরটা কী অনেক অনেক দূরে সরে গেল আজ! দু মাস আগে সরকারী বাসায় ওঠার আগে লিমার প্রচণ্ড জ্বর এল, তারপর ঐ বাড়িটায় কেউ আর নাচল না নূপুর পরে।

হাসানের সরকারী চাকুরির সুবাদে পাওয়া বাড়িটা বেশ বড়। টিনের দোচালা ঘর, সামনে এক্কা দোক্কা খেলার প্রশস্ত উঠান। রিধির বাড়ি কেন্দ্রিক সব সখের এক নিষ্প্রাণ প্রাপ্তি এল, তবে নতুন বাড়িতে এলনা নূপুরের শব্দটা। হাসান আকাশের দুইটা আড়াআড়ি মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবে, নূপুরের শব্দ ছাড়া আর সব শব্দই কী প্রচণ্ড নিঃশব্দ আর চিৎকারে ভরপেট! একটা সখ পূরণের জন্যই কী বলি দিতে হয় একটা পিপীলিকার ডানা! পৌত্তলিক বলিদানের এ রীতিতে কতটা দুর্নীতি তার হিসাব কষতে আর ভালো লাগে না হাসানের। ইতিমধ্যে আড়াআড়ি মেঘ দুটোর এক নিষ্কাম মিলনে আকাশের মেঘগুলো ক্রমশ নিচে নেমে এল। অতঃপর রিধির বাম কপালে এক গোছা এলোমেলো চুলের ফাঁক দিয়ে একটি ফোটা জল পড়ল। হাসান উঠানে টিনের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ের গিয়ে দাঁড়ালো। টেরও পেল না কখন দোচালা ঘরের টিনের চাল কাঁপিয়ে তুমুল বৃষ্টি এল। সমস্ত শহরকে জানান দিয়ে নূপুর পরে নাচছে জলের মেয়েরা, লিমাও নাচছে অস্তিত্বের ক্ষেপাটে বোধে। হাসান রিধিকে ঘরে আসতে বলে না, নিজেও বৃষ্টিতে যায় না। রিধির গালে মিঠা আর নোনতা পানির মোহনা মুছে দিচ্ছে সব আগুনের কুপি বাতিগুলো। হাসানের আর কান্না পায় না, তাহলে কী সে একজন অযোগ্য বাবা? লেখক হিসেবে এর উত্তর আমার কাছেও নাই। আমিও হাসান আর রিধির সাথে দেখছি শূন্যতার এই ড্যান্সফ্লোরে একটানা মুষল ও বিরামহীন নাচছে লিমা।

পাঠক এই গল্পেও আপনাকেও কুসংস্কারবাদী হতে অনুরোধ করা হল। না হয় দশ মিনিটের জন্য ধরে নিন, কোন পরকাল নেই। মানুষ এই জীবনের পাঠ চুকিয়ে প্রকৃতিতে মিশে যায়। যেমন লিমা ফিরে আসে প্রতি বর্ষায়, নূপুর পরে একটানা নেচে নেচে হাসান আমার রিধিকে দেখায় সে কত সুন্দর নাচে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে লিমাকে কাকতালীয়ভাবে বাঁচিয়ে তুলি। কিন্তু আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র এক লেখক। আমি তা পারি না। গল্প লেখার এই ভঙ্গিটা আমি শিখেছি জীবনকে দেখে। আমার ধারণা ছিল আমার জীবনের লিখক নিতান্তই অদক্ষ, তাই আমার গল্পে এত গোঁজামিল। তাঁকে একদিন বললাম, “তোমার একটা চরিত্র কাজী আফসিন শিরাজীকে এক দিনের জন্য চুপি চুপি উড়ার ক্ষমতা দাও তো। আমি কাউকে বলব না”। বলুনতো তিনি কী বললেন!

তিনি কিছুই বলেননি। আমি কোনদিন উড়তেও পারিনাই। সেইভাবে লিমাও ফিরে আসবে না কোনদিন।


মন্তব্য

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

জীবন যদি এতো বাস্তবতাময় হয়, গল্পে সেটা তো আসবেই। গল্প জীবন বাস্তবতারই তো আরেক দিক। নাকি! সেজন্যই বুঝি তিনি আর কিছু বলেননি।
.........................................................................................

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

তোমার ক্ষমতা আছে নুহিন। খুব ভালো লেখার ক্ষমতা আছে তোমার হাতে। সেটা দিয়েই তুমি তোমার গল্পের চরিত্র দিয়ে আমাদের মাঝে নাড়া দিতে পারো।

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

নাতাশা এর ছবি

“তোমার একটা চরিত্র কাজী আফসিন শিরাজীকে এক দিনের জন্য চুপি চুপি উড়ার ক্ষমতা দাও তো। আমি কাউকে বলব না”।
অতো বিষাদ কেন আপনার লেখায়?

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

ভালো লাগলো গল্প লেখার ধরনটি। দারুণ একটি গল্প পড়া হল।

মামুন হক এর ছবি

আমি তোর আনন্দের লেখাগুলোও পড়তে চাই। সব সময়েই মন খারাপ করে দিস!

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

জন্মদিনটাকেও বিষাদময় করে তুললে কেনো ?? তোমার এইসব লেখা ভালো লাগে যদিও- কিন্তু বড্ড স্পর্শী, এরকম ঠিক না।

আমি কোনদিন উড়তেও পারিনাই।

দেখো, একদিন তুমি ঠিক উড়তে পারবে... উড়বেই...

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

কাজী আফসিন শিরাজী এর ছবি

সবার মন্তব্যের ইন্ডিভিজুয়াল উত্তর না দিয়ে এখানে কিছু মেদহীন কথা বলি, আমার লেখায় বিষাদ আছে কী নেই জানা নাই। তবে আমি যখন লেখালিখি শুরু করেছিলাম তখন খুব প্রাণচ্ছল বর্ণনা থাকত আমার লিখায়, খুব উচ্ছল ও স্বচ্ছল আনন্দের সাবলিল প্রকাশ ছিল বলেই আমার ধারণা। ক্রমশ আমি আবেগ নির্ভর লেখা শুরু করি। সেখান থেকেই লেখালিখির মজাটা পেয়েছি। তারপর দর্শনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হই। এখনকার লেখাগুলো জীবন দর্শনদ্বারা প্রভাবিত। দর্শনের সাথে রম্য রচনার কোন সন্ধি আমি ঘটাতে পারিনি দেখেই রম্য রচনা লিখিনা বা লেখার চেষ্টাও করিনি। জীবনে মানুষের টানাপোড়েন, অসঙ্গতি নিয়েই লিখতে বেশি আনন্দ পাই। আর আমার লেখাগুলো যেহেতু খুব বেশি স্বার্থপরের মত নিজেকে তৃপ্ত করার বেঘোর কামনায় লেখা তাই অনেকেরই ভালো লাগে না আমরা লিখা, তাছাড়া আমি ভালো লিখিও না।

হয়ত পরিবর্তনের আদি ধারাবাহিকতায় আমার লেখার ধরণ ও ভঙ্গিও বদলে যাবে, তবে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই হোক এটাই কামনা, তাই ঐচ্ছিক হস্তক্ষেপ থেকে লেখাকে বিরত রেখেছি। কাউকে নির্দিষ্ট করে বলছি না, তবে আমার বিগত কয়েকটি লেখায় মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে আমি বিষাদগ্রস্থ মানুষ,তাই আমার লেখাতেও তার ছাপ। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমি খুব হাসিখুশি বলেই আমি জানি। মানুষের এ ধারণা প্রেক্ষিতে আমি সচলে লিখাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। হটাৎ খায়ালের বশে এ লেখাটা লিখলাম এবং অতঃপর পোস্ট করেছি। এখানেও সেই একই অভিযোগ। তাহলে ভুলটা মনে হয় আমারই ছিল। একঘেয়েমী লেখা আসলে কারই পড়তে ভালো লাগে না। তাই ভিন্ন কোন লেখার ক্ষমতা লাভ করলে সেগুলো এখানে পোস্ট করব বলে ঠিক করেছি। এ যাবত পর্যন্ত সকলের আন্তরিকতা আর সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

ভালো থাকবেন, শুভ হোক।

শান্তি।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

হুউম, মন খারাপ হয়, তবু এই ধরন অসাধারণ! আবেগের (দুর্যোগ) ব্যবস্থাপনাও অনেক দক্ষ হয়েছে। চলুক
অনেক ভালো লাগলো ভাই নুহিন।
লেখো, অনেক লেখো। উড়বা কী? তুমি তো উড়ে গ্যাছো এরই মধ্যে। আমি তো দেখছি এই লেখাটাতেই তুমি উড়ছো। হুউম।

("তুমি"তে কিছু মনে করো নাই আশা করি)

অনেক অনেক শুভকামনা, সবকিছুর জন্য।

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

কাজী আফসিন শিরাজী এর ছবি

আমার ব্লগের সামান্য আয়োজনে আপনার পদার্পনকে সৌভাগ্য মনে করে সেখান থেকেই কিছুটা স্বস্তি খুঁজে নিলাম। ব্লগপাঠ শুভ হোক। একদিন আমরা সবাই উড়বোই। সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

চলুক

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।