আমার একটা খুব বিরক্তিকর স্বভাব আছে, যেইটা আমার পরিচিত লোকজন খুব ভালোমতই জানেন। এখন আপনারাও জানবেন। আমার খুব পছন্দের কোন ব্যপার বা কোন জিনিস আমার খুব ভালো লাগলে; সেইটা দেখার জিনিস হোক, খাবার জিনিস হোক, পড়ার জিনিস হোক বা শোনার জিনিস হোক, পরিচিত মানুষজনকে জোর করে দেখানো, খাওয়ানো, পড়ানো বা শোনানোর আগ পর্যন্ত আমার পেটের ভাত হজম হয়না, রাতের বেলা ঘুমোতেও কষ্ট হয়। দুপুরবেলাও ঘুমোতে কষ্ট হয়, যদিও আমি দুপুরে ঘুমোই না। কিন্তু আজকে দুপুরে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে।
তেমনি গুরু সুকুমার রায় এর একটা প্রভুখন্ড বা মাস্টারপিস হইলো এই দ্রিঘাংচু। এইটা আজকে জোর করে সবাইকে পড়াইতে ইচ্ছে করতেছে খুব। যদিও এই দুই হাজার তেরো সালের এপ্রিল মাসের আর্থসামাজিকধর্মীয়রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতার সাথে এই ননসেন্স লেখার কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর যদি কোন মিল খুঁজে পান- তাইলে আপনার দোষ আপনার। আপনার মনে খালি দুষ্টচিন্তা ঘুরঘুর করে। আপনে একটা দুষ্টু লোক।
নিঝুম দুপুর। আসেন, ফেসবুকিং বাদ দিয়া ইট্টু ননসেন্স কিছু পড়ি।
এক ছিল রাজা।
রাজা একদিন সভায় বসেছেন- চারিদিকে তাঁর পাত্র-মিত্র আমির ওমরা সিপাই শান্ত্রী গিজ গিজ করছে- এমন সময় কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক উড়ে এসে সিংহাসনের ডান দিকে উঁচু থামের ওপর বসে ঘাড় নিচু ক'রে চারিদিক তাকিয়ে, অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, "`কঃ"'।
কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এরকম গম্ভীর শব্দ- সভাসুদ্ধ সকলের চোখ এক সঙ্গে গোল হয়ে উঠল- সকলে একেবারে এক সঙ্গে হাঁ করে রইল। মন্ত্রী এক তাড়া কাগজ নিয়ে কি যেন বোঝাতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ বক্তৃতার খেই হারিয়ে তিনি বোকার মত তাকিয়ে রইলেন। দরজার কাছে একটা ছেলে বসে ছিল, সে হঠাত্ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, যে লোকটা চামর দোলাচ্ছিল, চামরটা তার হাত থেকে ঠাঁই করে রাজার মাথার ওপর পড়ে গেল। রাজামশায়ের চোখ ঘুমে ঢুলে এসেছিল, তিনি হঠাৎ জেগে উঠেই বললেন, "জল্লাদ ডাক।"
বলতেই জল্লাদ এসে হাজির। রাজামশাই বললেন, "মাথা কেটে ফেল।" সর্বনাশ! কার মাথা কাটতে বলে; সকলে ভয়ে ভয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। রাজামশাই খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে আবার তাকিয়ে বললেন, "কই, মাথা কই?" জল্লাদ বেচারা হাত জোড় করে বলল, "আজ্ঞে মহারাজ, কার মাথা?" রাজা বললেন, "বেটা গোমুখ্যু কোথাকার, কার মাথা কিরে! যে ঐরকম বিটকেল শব্দ করেছিল, তার মাথা।" শুনে সভাসুদ্ধ সকলে হাঁফ ছেড়ে এমন ভয়ানক নিশ্বাস ফেলল যে, কাকটা হঠাৎ ধড়ফড় করে সেখান থেকে উড়ে পালাল।
তখন মন্ত্রীমশাই রাজাকে বুঝিয়ে বললেন যে, ঐ কাকটাই ওরকম আওয়াজ করেছিল! তখন রাজামশাই বললেন, "ডাকো পণ্ডিত সভার যত পণ্ডিত সবাইকে।" হুকুম হওয়া মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজ্যের যত পণ্ডিত সব সভায় এসে হাজির। তখন রাজামশাই পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করলেন, "এই যে একটা কাক এসে আমার সভার মধ্যে আওয়াজ করে এমন গোল বাধিয়ে গেল, এর কারণ কিছু বলতে পার?"
কাকে আওয়াজ করল তার আবার কারণ কি? পণ্ডিতেরা সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। একজন ছোকরা মতো পণ্ডিত খানিকক্ষণ কাঁচুমাচু ক'রে জবাব দিল, "আজ্ঞে, বোধ হয় তার খিদে পেয়েছিল।" রাজামশাই বললেন, "তোমার যেমন বুদ্ধি! খিদে পেয়েছিল, তা সভার মধ্যে আসতে যাবে কেন? এখানে কি মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হয়! মন্ত্রী ওকে বিদেয় করে দাও- " সকলে মহা তম্বি ক'রে বললে, "হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ওকে বিদায় করুন।"
আর-একজন পণ্ডিত বললেন, "মহারাজ, কার্য থাকলেই তার কারণ আছে- বৃষ্টি হলেই বুঝবে মেঘ আছে, আলো দেখলেই বুঝবে প্রদীপ আছে, সুতরাং বায়স পক্ষীর কণ্ঠ নির্গত এই অপরূপ ধ্বনিরূপ কার্যের নিশ্চয়ই কোন কারণ থাকবে, এতে আশ্চর্য কি?"
রাজা বললেন, "আশ্চর্য এই যে, তোমার মতো মোটা বুদ্ধি লোকেও এইরকম আবোল তাবোল বকে মোটা মোটা মাইনে পাও। মন্ত্রী, আজ থেকে এঁর মাইনে বন্ধ কর।" অমনি সকলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, "মাইনে বন্ধ কর।"
দুই পণ্ডিতের এরকম দুর্দশা দেখে সবাই কেমন ঘাবড়ে গেল। মিনিটের পর মিনিট যায়, কেউ আর কথা কয় না। তখন রাজামশাই দস্তুরমত খেপে গেলেন। তিনি হুকুম দিলেন, এর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন সভা ছেড়ে না ওঠে। রাজার হুকুম- সকলে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ ঘেমে ঝোল হয়ে উঠল, চুলকে চুলকে কারো কারো মাথায় প্রকাণ্ড টাক পড়ে গেল। বসে বসে সকলের খিদে বাড়তে লাগল- রাজামশাইয়ের খিদেও নেই, বিশ্রামও নেই- তিনি বসে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
সকলে যখন হতাশ হয়ে এসেছে, আর মনে মনে পণ্ডিতদের 'মূর্খ অপদার্থ নিষ্কর্মা' বলে গাল দিচ্ছে, এমন সময় রোগা শুঁটকো মতো একজন লোক হঠাৎ বিকট চিৎকার করে সভার মাঝখানে পড়ে গেল। রাজা মন্ত্রী পাত্র-মিত্র উজির-নাজির সবাই ব্যস্ত হয়ে বললেন, "কি হলো, কি হলো?" তখন অনেক জলের ছিটে পাখার বাতাস আর বলা কওয়ার পর লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে বলল, "মহারাজ সেটা কি দাঁড়কাক ছিল?" সকলে বলল, "হাঁ-হাঁ-হাঁ, কেন বল দেখি?" লোকটা আবার বলল, "মহারাজ, সে কি ঐ মাথার উপর দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসেছিল- আর মাথা নিচু করেছিল, আর চোখ পাকিয়েছিল, আর 'কঃ' করে শব্দ করেছিল?" সকলে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে বললে, "হাঁ, হাঁ- ঠিক ঐরকম হয়েছিল।" তাই শুনে লোকটা আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল- আর বলতে লাগল, "হায় হায়, সেই সময়ে কেউ আমায় খবর দিলে না কেন?"
রাজা বললেন, "তাই তো, একে তোমরা তখন খবর দাও নি কেন?" লোকটাকে কেউই চেনে না, তবু সে কথা বলতে সাহস পেল না, সবাই বললে, "হ্যাঁ, ওকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল"- যদিও কেন তাকে খবর দেবে, আর কি খবর দেবে, এ কথা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটা তখন খুব খানিকটা কেঁদে তারপর মুখ বিকৃত করে বলল, "দ্রিঘাংচু!" সে আবার কি! সবাই ভাবল, লোকটা খেপে গেছে।
মন্ত্রী বললেন, "দ্রিঘাঞ্চু কি হে?" লোকটা বলল, "দ্রিঘাঞ্চু নয়, দ্রিঘাংচু।" কেউ কিছু বুঝতে পারল না- তবু সবাই মাথা নেড়ে বলল, "ও!" তখন রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, "সে কিরকম হে," লোকটা বলল, "আজ্ঞে আমি মূর্খ মানুষ, আমি কি অত খবর রাখি, ছেলেবেলা থেকে দ্রিঘাংচু শুনে আসছি, তাই জানি দ্রিঘাংচু যখন রাজার সামনে আসে, তখন তাকে দেখতে দেখায় দাঁড়কাকের মতো। সে যখন সভায় ঢোকে, তখন সিংহাসনের ডান দিকের থামের উপর বসে মাথা নিচু করে দক্ষিণ দিকে মুখ করে, চোখ পাকিয়ে 'কঃ' বলে শব্দ করে। আমি তো আর কিছুই জানি না- তবে পণ্ডিতেরা যদি জানেন।" পণ্ডিতেরা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন, "না, না, ওর সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় নি।"
রাজা বললেন, "তোমায় খবর দেয় নি ব'লে কাঁদছিলে, তুমি থাকলে করতে কি?"
লোকটা বলল, "মহারাজ, সে কথা বললে যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তাই বলতে সাহস হয় না।"
রাজা বললেন, "যে বিশ্বাস করবে না, তার মাথা কাটা যাবে- তুমি নির্ভয়ে বলে ফেল।" সভাসুদ্ধ লোক তাতে হাঁ হাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।
লোকটা তখন বলল, "মহারাজ, আমি একটা মন্ত্র জানি, আমি যুগজন্ম ধরে বসে আছি, দ্রিঘাংচুর দেখা পেলে সেই মন্ত্র তাকে যদি বলতে পারতাম তা হলে কি যে আশ্চর্য কাণ্ড হত তা কেউ জানে না। কারণ, তার কথা কোন বইয়ে লেখে নি। হায় রে হায়, এমন সুযোগ আর কি পাব?"
রাজা বললেন, "মন্ত্রটা আমায় বল তো।"
লোকটা বলল, "সর্বনাশ! সে মন্ত্র দ্রিঘাংচুর সামনে ছাড়া কারুর কাছে উচ্চারণ করতে নেই। আমি একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি- আপনি দু'দিন উপোস ক'রে তিন দিনের দিন সকালে উঠে সেটা পড়ে দেখবেন। আপনার সামনে দাঁড়কাক দেখলে, তাকে আপনি মন্ত্র শোনাতে পারেন, কিন্তু খবরদার, আর কেউ যেন তা না শোনে- কারণ, দাঁড়কাক যদি দ্রিঘাংচু না হয়, আর তাকে মন্ত্র বলতে গিয়ে অন্য লোকে শুনে ফেলে, তা হলেই সর্বনাশ!"
তখন সভা ভঙ্গ হল। সভার সকলে এতক্ষণ হাঁ ক'রে শুনছিল, তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; সকলে দ্রিঘাংচুর কথা, মন্ত্রের কথা আর আশ্চর্য ফল পাওয়ার কথা বলা-বলি করতে করতে বাড়ি চলে গেল।
তারপর রাজামশাই দু'দিন উপোস করে তিন দিনের দিন সকালবেলা- সেই লোকটার লেখা কাগজখানা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে-
হল্দে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাট্কেল চিত্ পটাং
মুস্কিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।
রাজামশাই গম্ভীরভাবে এটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর থেকে তিনি দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন সব তাড়িয়ে তাকে মন্ত্র শোনাতেন, আর চেয়ে দেখতেন কোনরকম আশ্চর্য কিছু হয় কি না!
কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি দ্রিঘাংচুর কোনো সন্ধান পান নি।
মন্তব্য
এটা আমারও ছেলেবেলার অসম্ভব পছন্দের এক্তা গল্প। কতবার যে পড়েছি, আবারও পড়লাম। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমাদের সরকার কি কোন দ্রিঘাংচুর মন্ত্র পেয়েছে নাকি??
-আামার প্রিয়
আর
এই মুহুর্তে পাঠ্য,
-দু্টোই স্মৃতি থেকে লেখা, স্মৃতিবিভ্রমের দায়ে সুকুমার-অনুভূতি আহত হলে, ক্ষমাপ্রার্থী
মিল আছে গো মিল আছে, মিল আছে গো এই দেশে
@আইলসা
হবে মনে হয়...
অটঃ "খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না" আর কতদিন????
হুম দ্যাট মেইক সেন্স।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আপনাকে ধন্যবাদ ওডিন, খুব প্রিয় অথচ ভুলে যাওয়া একটা লেখা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। সুকুমার রচনা নিয়ে আবার বসা উচিত মনে হচ্ছে!
-চক্রবাক।
এটা আমারও অনেক পছন্দের একটা লেখা।
ধরে ধরে সবডির মাইনে বন্ধ করা দরকার। আহাম্মুকের দল।
..................................................................
#Banshibir.
ওডিন এর 'গেমিং' নিয়ে লেখা আসবেনা?
চামে ভাল বাঁশ হইল
facebook
অনেএএএএএএক দিন পর ওডিনদা!! তাও আবার হাতে বাঁশ নিয়া হাজির! এইগুলা ঠিক না। ভালু ছেলেরা ব্লগ-টলগ লেখেনা। এইগুলা বেদাতি জিনিস। ছিহ।
দুনিয়া গদ্যময়!
---- মনজুর এলাহী ----
---- মনজুর এলাহী ----
আহা মনের মুকুরে!
সুকুমারের নামা ভাঙ্গায়া কারে কটাক্ষ করেন, হুমম?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন