প্রথম দুইটা দিন খুব স্বাভাবিক ছিলাম। বলতে গেলে একটু বেশিই স্বাভাবিক। এতো সব মন খারাপ করা খবরেও পেশাগত কাজে কোন বাধা পড়ে নাই। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে কাজ কিছু করতে হইছে। স্বাভাবিকভাবেই । খুব একটা ঝামেলা হয় নাই। যা করার, যদ্দুর করার, যেইভাবে করার- করার চেষ্টা করেছি। গত কয়টা বছরে আমাকে এইরকমভাবেই ট্রেইন আপ করা হয়েছে। শারীরিক ভাবে, মানসিকভাবেও । একজন প্রফেশনাল হিসেবে এইসব ব্যপারে এখন আর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। আক্ষরিক অর্থেই ক্লিনিক্যাল প্রিসিশান যাকে বলে, কাজকর্ম সেইভাবেই চলতে থাকে।
আমি সব রকম অর্থোপেডিক অপারেশনই খুব আগ্রহ নিয়ে করি অথবা করার চেষ্টা করি। একটা বিশেষ শ্রেণীর অপারেশন বাদে, সেইটা হলো অ্যামপুটেশন। শরীরের লিম্ব , মানে হাত, পা বা এর কোন অংশ কেটে বাদ দেয়া। এইরকম আগ্রহহীনতার কারন খুবই সরলসোজা- আমার ভালো লাগে না। দুম করে একটা মানুষের একটা (বা দুইটা, বা আরো বেশি) হাত অথবা পা কেটে ফেলা হবে, এইটা কোন কথা নাকি? আর আজকাল এই এতো আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে একটা মানুষের হাত-পা কেটে ফেলবে- এইটা কি কোন কথা হইলো? ইনফ্যাক্ট আমাদের বিষয়ে আস্ত একটা সাবজেক্টই আছে - লিম্ব স্যালভেজ প্রসিডিওর। কেমনে হাত পা না কেটে বাদ দিয়ে কায়দাকানুন করে সেইটাকে মোটামুটি একটা চলনসই পর্যায়ে রাখা যায়, সেইসব ব্যপারস্যাপার।
তারপরেও অনেক কারনেই অ্যামপুটেশন করতে হয়। টিউমার বা ক্যানসার এর কারনে হতে পারে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে পচন ধরতে পারে। এছাড়া হাত বা পায়ের কোন অংশ খুব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেই জায়গায় পচন ধরে, আর পচন ধরার ফলে সেইখানে ইনফেকশন হয়ে সেইটা সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। ক্রাশ সিনড্রোম বলে একটা ব্যপারও হয়। নামই বলে দিচ্ছে ব্যপারটা কি, কোন অংগপ্রত্যংগ আক্ষরিক অর্থেই 'ক্রাশড' হয়ে গেলে সেইখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু আর টিস্যু থেকে বের হওয়া নানান উপাদান রক্তে মিশে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, সেইখান থেকেও নানান সমস্যা দেখা দেয়। ফলে এইরকম অপারেশন অতিজরুরী হয়ে পড়ে।
আরেকটা খুব রেয়ার কারন হলো কোন ধসে পড়া দালানের অংশ বা রাবল এ হাত বা পা আটকা পড়ে গেছে, মানুষটাকে বের করা যাচ্ছে না। হাত-পা বা এর আটকে পড়া অংশ কেটে মানুষটাকে বের করা হয়। থিওরিটিকালি খুবই সরলসোজা একটা ব্যপার। যে জায়গা কাটা হবে, তার ওপরে কষে বেঁধে নাও যাতে রক্তপাতে মানুষটা শকে চলে না যায়। এরপরে কেটে ফেলো। মানুষটাকে বের করে আনো। একেবারে ডাল ভাত না হলেও কুপার'স এর প্লেইন কেকের টুকরোর মতো সিম্পল একটা ব্যপার।
গত দুই তিন দিনে সাভারে এইরকম অনেকগুলো ব্যপার হয়েছে। হাত কনক্রিটের স্ল্যাবের নিচে আটকা পড়েছে, মানুষটাকে বের করা যাচ্ছিল না। ওনাকে হাত কেটে বের করা হয়েছে, কাউকে পা কেটে। একজনের দুটো পা ই কেটে বের করে আনা হয়েছে। পরদিন সকালবেলায় লোকটা একটু পর পর জানতে চাচ্ছিলো নকল পায়ের ব্যবস্থাট্যবস্থা কি? হাঁটা যাবে তো ঠিকমতো? "একটা পা না কাইটা দুইটা পা কাটা পইড়া ভাল হইছে, সার! দুইটা পায়েই একলগে নকল পা লাগায়া ভালোমতো হাঁটতে পারুম, কি কন?" ম্লান হাসি হাসছিলো লোকটা।
মানুষটা মারা গেছে।
সন্ধেবেলা চা খাচ্ছি। চায়ের সাথে ডুবিয়ে একটা নতুন ধরনের বিস্কুট, লম্বা কাঠির মতন, চিনি ছড়ানো। চিনিগুলো ক্যারামেলাইজড হয়ে গেছে। পাতলা পাতলা অনেকগুলো লেয়ার। চাপ দিলে ভেঙ্গে গিয়ে একটার ওপর আরেকটা কলাপস করে। সাসলিজ না জানি কি নাম দোকানটার, সেইখান থেকে নিয়া আসছিলাম। এইসময় আরেকজনের কথা শুনলাম। ভদ্রমহিলা কোন এক ক্লিনিকের নার্স। ধ্বংসস্তুপে দুই দিনের ওপরে আটকা পড়ে আছেন, মোটামুটি অ্যাক্সেস করা যায় এইরকম একটা জায়গায়তেই, কিন্তু বের করার উপায় নেই। হাত কনুই এর নিচ থেকে একটা পিলার এর নিচে আটকা পড়ে আছে। প্রবল ব্যথায় আজকে নাকি একটা খুব ধারালো হ্যাক স দিয়ে নিজেই নিজের কনুই এর জয়েন্ট বরাবর কেটে নিজেকে মুক্ত করেছেন।
বিস্কুট খেতে খেতে ভাবছিলাম আমার বাম হাতটা কনুই এর ঠিক মাঝ বরাবর কেটে ফেলতে খুব বেশি ব্যথা লাগবে কি না। খুব ধারাল একটা হ্যাক স' এর ব্লেড দিয়ে। আমি বাম হাতি মানুষ, ডান হাত দিয়ে কাটতে একটু ঝামেলা হতে পারে অবশ্য।
আর হ্যাঁ, অবশ-টবশ না করে।
খুব একটা বেশি ব্যথা লাগার কথা না। অবশ তো হয়েই আছি আমরা।
মন্তব্য
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
লেখা পড়ার কারনে NITOR এ কেঁটেছে প্রায় ৬ বছর।
এত এত দেখেও এখনো চোখ ভিজে আসে!!!
সুবোধ অবোধ
অর্ধেক পড়েই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
facebook
এ ধরনের লেখা লেইখেন না ভাই। সত্য জানার দরকার নাই , মিথ্যা নিয়েই থাকি।
হ্যাঁ।
..................................................................
#Banshibir.
হ্যাঁ
হ
---------------------
আমার ফ্লিকার
---------------------
আমার ফ্লিকার
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
হাজার হাজার আটকা পড়াদের প্রতি মুহূর্তের জীবনবাজির কথা, শত শত লাশগুলোর কষ্টমৃত্যুর অমানবিক চিত্র সবকিছুতে মানবিকতার কী চরম বিপর্যয় হয়েছে তা লিস্ট করতে গেলে খাতা ফুরিয়ে যাবে............ ব্যথা পেতে পেতে কোন বোধ কাজ করে না আর............
_____________________
Give Her Freedom!
কি আর বলব , কাননা আসে খালি।
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
আসলেই অবশ হয়ে আছি । :D
সাম্পানওয়ালা
আপনার লেখা কোনদিকে যাচ্ছে তা আন্দাজ করছিলাম, কিন্তু শেষে চরম ধাক্কা খেলাম। আসলেই আমরা অবস হয়ে আছি
অন্যসময় এরকম লেখা পড়লে খুব অস্থির লাগতো। অথচ এখন লাগছে না। সত্যি কেমন যেন অবশ হয়ে আছি।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ আহত জীবন!
ভেতর থেকে কান্না আসতে চায়, কিন্তু অবশ হয়ে আছি বোধ হয়।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
আমি তাঁর জায়গায় হলে হাত আর অদৃশ্য পা ছুড়ে কাঁদতাম।
এই মানুষগুলা অনেক আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, অঙ্গহানিতেও এখন এঁদের ম্লান হাসি মুছে না। ফেসবুকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী ভিডিওগুলোতে এঁদেরকে কারখানায় কাজ করতে দেখি, ম্লান হাসির পেছনের ট্র্যাজেডিগুলো দেখি না। মধ্যবিত্তের অহমে এসব স্থান পায় না।
Big Brother is watching you.
Goodreads shelf
এই হাত পা কাটা মানুষগুলোর কী হবে আসলে?
বেশিরভাগের ভবিষতই কি ভিক্ষাবৃত্তি?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এভাবে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর ভবিষ্যত কি? আরেকটা ঘটনা এসে যখন চাপা দেবে তখন সবাই ভুলে যাবে কি মর্মান্তিক জীবন কাটিয়ে যাবে এই মানুষগুলো। মৃত্যুই যেখানে এত সুলভ, তখন পঙ্গুত্ব তো গণনাতেই থাকবে না হয়তো।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
হ নির্বিকারে ভাবে পুরা লেখা পইড়া ফেললাম, দীর্ঘশ্বাসটা যদিও ঠেকাইতে পারিনাই
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
দুদিন ধরে লেখাটার কাছে ফিরে ফিরে আসছি। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে ভীষন, কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি জানি আমি আরও অনেকবার এই লেখাটা খুঁজে বের করে পড়ব। স্বদেশের বিপদ থেকে বহুদুরে, অকল্পনীয় নিরাপদ একটা শহরে বসে শীতল বাতাস গায়ে মেখে মনে মনে ভাবব, কতই না সুখে আছি
নতুন মন্তব্য করুন