শাং গ্রি লা কথাটা প্রথম উঠে আসে জেমস হিলটনের উপন্যাস লস্ট হরাইজন এ। তিবেতান হিমালয়ের এর দুর্গম অংশ, যেখানে আধুনিক মানুষের পা এখনো পড়ে নাই, সেইখানে আছে এক রহস্যময় উপত্যকা। ওইখানে মানুষের বয়স বাড়ে না, কোন অসুখবিসুখ হয় না। লোকজন আক্ষরিক অর্থেই অমর।
এই শাং গ্রি লা র ধারণাটা এসেছে তিবেতান বুদ্ধিজম এর কিংবদন্তী 'বিইয়ুল' এর আইডিয়া থেকে। এই বিইয়ুল হলো এমন একটা পবিত্র জায়গা যেইটা সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে, অনেক দুর্গম এলাকায় অবস্থিত, আর সেইখানে যাওয়া মানে হলো মোক্ষ লাভ করা। তিবেতান মিথোলজি এর মতে এইরকম বেশ কয়েকটা জায়গা আছে। যতো দুর্গম জায়গা, তার মাহাত্ম ততোই বেশি, এইরকমই ব্যপার আরকি।
ব্রহ্মপুত্র, যাকে চিনা নাম সাংপো, নদী হিমালয়ের উত্তরে তিব্বত থেকে শুরু হয়ে পূর্বদিকে অনেকদূর গিয়ে তিব্বতের পূর্ব অংশ, চীনের ইউনান আর ভারত এর অরুণাচল প্রদেশ এর উত্তরে কয়েকটা গিরিখাত এর মাঝ দিয়ে হিমালয় অতিক্রম করে প্রায় ইউ টার্নের মতো নিয়ে আসাম এর সমতলে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে আবার পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। এই গিরিখাতগুলোতেই নাকি অনেক গুলো জলপ্রপাতের আড়ালে লুকোনো প্রধান বিইয়ুল এর অবস্থান। তিবেতানরা এইটাকে বলে পেমাকো। যার অর্থ পদ্মের সমাহার। আরেকটা অর্থ দাঁড়ায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র। বলা হয় সমস্ত তিব্বতের সবচাইতে পবিত্র জায়গা এটা। তিবেতান মিথোলজি তে এর অনেক রেফারেন্স আছে। । শত শত বছর ধরে অনেক অভিযাত্রী এই এলাকা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু কিংবদন্তীর বাইরে কেউ এর খোঁজ পায়নি।
হিমালয়- মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করা ব্রিটিশ অভিযাত্রীরাও এই মিথ থেকে আকৃষ্ট হয়ে আঠারো শতক থেকেই বেশ কয়েকটা অভিযান পরিচালনা করেছিলো, কিন্তু ১৯২৫ এ ব্রিটিশ বটানিস্ট ফ্রাঙ্ক কিংডন ছাড়া। উনিও অবশ্য সেই দুর্ভেদ্য গিরিখাতগুলোর সব জায়গা দেখে আসতে পারেন নি, এবং অনেক কষ্টের পরেও সেই জলপ্রপাত এর দেখা না পেয়ে ্সেইটাকে কিংবদন্তী বলেই আখ্যা দেন। পরে অবশ্য জানা যায় উনি মাত্র পাঁচ মাইলের জন্য সেই জলপ্রপাতটার কাছে যেতে পারেন নি।
পেমাকো র ব্যপারটা অনেকদিন পর্যন্ত একটা কিংবদন্তী আর ওই অঞ্চলের ম্যাপের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা হিসেবেই আটকে ছিলো, যতোদিন পর্যন্ত না অভিযাত্রী, পর্বতারোহি আর বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ওপর পড়ালেখা করা ইয়ান বেকার এর নজর এইদিকে পড়লো। ধর্ম , কিংবদন্তী, ইতিহাস আর রূপকথা, সবকিছুতে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা পেমাকো কে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হলেও সেইটা বাস্তবে রূপ দেয়া একেবারে আলাদা একটা ব্যপার। আকাশছোঁয়া পর্বত, গভীর গিরিখাত, তীব্র স্রোত এর নদী, ঘন জঙ্গল, রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল সীমান্ত, সব মিলিয়ে কয়েক বছর ধরে নিয়মিত অনিয়মিত অভিযানের পরে যখন যেই কিংবদন্তীর জলপ্রপাত খুঁজে পাওয়া গেলো, সেইটাকে বিংশ শতাব্দীর সেরা ভৌগলিক আবিষ্কার বলেও অনেকে আখ্যা দিয়েছেন।
'দ্য হার্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড - আ জার্নি টু দ্য লাস্ট সিক্রেট প্লেস' - এই অভিযানেরই গল্প। কিংবদন্তী, ধর্ম, ভূগোল আর অ্যাডভেঞ্চার যেইখানে মিলেমিশে একাকার।
বইটার নাম শুনেছিলাম অনেক আগেই, গত সেপ্টেম্বরে নেপাল গিয়ে কাঠমান্ডুর বিখ্যাত পিলগ্রিমস বুক শপে প্রথম দেখি। টেকাটুকার অভাবে কিনতে পারি নাই। কিন্তু ফেরার পথে এয়ারপোর্টের বুকশপে এইটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। পকেটে পঞ্চাশ ডলার ছিলো, সেইটা ভাঙ্গিয়ে কিনে ফেলেছি। মাটি টেকা, টেকা মাটি। নেপালে এমনিতে বইয়ের দাম বেশ কম, পেঙ্গুইন এর হার্ডকাভার এডিশান দুই হাজার নেপালি টাকা। ঢাকায় পাওয়া যায় কি না জানি না। সম্ভাবনা কম। টরেন্ট করে মোবি/ইপাব পেয়ে যেতে পারেন
এক্সপ্লোরেশন, তিব্বত, তিবেতান বুদ্ধিজম আর হিমালয় এর ব্যপারস্যাপার নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই বইটা অবশ্যপাঠ্য।
ডিসক্লেইমারঃ
______________________________________________________________________________
বাইশে ফেব্রুয়ারি, দুপুর একটা চল্লিশ।
মন্তব্য
বেকার সাহেব পেমাকো নিয়া একটু বেশিই প্যাঁচাইছেন মনে হয়। তিব্বত আর ভুটানের লোকজন হরহামেশা পেমাকো যাতায়ত করে আসছে বহু শতাব্দী ধরে। অরুণাচল আর ইউনানের লোকজনের কথা না হয় বাদই দিলাম। পেমাকোর দুনিয়াছাড়া সৌন্দর্য বা সেখানে যাবার পথের দুর্গমতার কথা সত্য, তবে "সাহেবরা না গেলে সেই জায়গা এখনো অনাবিষ্কৃত বলে ধরতে হবে" প্রবণতাটাই বিরক্তিকর। এই ব্যাপারে সাহেবরা কোনদিন মানুষ হবে না।
যাকগে, তুমি তোমার পছন্দের বিষয় নিয়ে বুক রিভিউ লিখছ দেখে ভালো লাগলো। তবে আমি একান্তভাবেই তোমার ভ্রমণাভিজ্ঞতা পড়তে আগ্রহী। ছবি আছে কি নাই ব্যাপারটা একেবারেই অদরকারী। তুমি যেভাবে বর্ণনা দাও বা যেভাবে ইন্টারপ্রেট করো সেটাই আকর্ষণীয়। সুতরাং আমি কী বললাম সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলো। তাইলে তার আগে ঐ ভূখণ্ডে যারা ছিলো তারা কী?
এই ব্যাপারটা সত্যিই বিরক্তিকর। যেহেতু এই কিংবদন্তী চালু, স্থানীয়রা তো জায়গাটা দেখেই গল্প প্রচার করেছে। কিন্তু সাদারা সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত সেইটা যেন 'আবিষ্কৃত' হয় নাই!
যাহোক লেখা ভালো লাগছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পেমাকো সম্পর্কে জানতাম না। অনেক ধন্যবাদ, ওডিন, বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য।
আপনার লেখাটি পড়ে আমার এখুনি ইচ্ছে হচ্ছে, বইটি পড়ি। তবে আপনার বুক রিভিউয়ের অবদান এখানে সামান্য, বরং, আপনার পেমাকো সম্পর্কিত বর্ণনাই বইটি পড়ার দুর্নিবার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে।
আপনার বুক রিভিউ বরং সেই অর্থে একেবারেই ক্ষুদ্র, যেন বা উপরের একটি বাক্যেই শেষ হয়েছে। "এক্সপ্লোরেশন, তিব্বত, তিবেতান বুদ্ধিজম আর হিমালয় এর ব্যপারস্যাপার নিয়ে" কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে রিভিউটি আরও বৃহত করা যেত মনে হয়।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
এমনভাবেই শেষ টান দিলেন ওডিনদা, বইটা এখুনি পড়তে ইচ্ছে করছে।
তাত্তারি আমাজনের জঙ্গলে "পৃথিবীর হৃদয়ের" তালাশ পাঠাই।
আর ইয়ে পাণ্ডবদা কি জানি বলছিলেন শুনেই তো
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
পড়িতে হইবেক !
অবশ্যই খাসা হয়েছে, পড়ুন আর লিখুন। আপনার সংগ্রহে যত হিমালয়ের বই আছে, সবগুলো নিয়ে অল্প অল্প লেখা আসলে আমরা বিশেষ উপকৃত হতাম
facebook
স্রেফ ফাঁকিবাজি ! এই রিভিয়্যু পড়ে বইটি সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারলাম না, কারণ বইটার কোন অনুবাদ বের হয়েছে কিনা সেটা ওডিন সাহেব বলেননি।
আমি আবার যথার্থ বাঙাল কিনা, বেনিয়া ভাষায় অক্ষমতাজনিত অরুচি আছে !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
পড়তে হবে এটা। কিন্তু এতো ছুডু পোস্ট কেনু?
আর ইতিহাসপাতাল কৈ?
রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি বলে একটা যে জিনিস ছিল, সেখানে গিয়ে নাকি সব এক্সপ্লোরার তাদের এক্সপ্লোরেশনের গল্প করতো। ওদের সেই মিটিং এর কোন লগ রাখা আছে কি না কোথাও কে জানে। পড়তে কেমন হবে ভাবছিলাম।
গ্রন্থালোচনা ভালো লেগেছে, আমাদের প্রিয় ড্যালরিম্পলের সেই বইটার একটা রিভিউ দিন না।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
ফাঁকিবাজি করলেও গ্রন্থালোচনা ভালো লাগলো।
দোষের দায়ভার অণুর ভাগে পড়লে প্রশংসার ভাগও তো তার পাতে যাওয়ার কথা নাকি?
পানির দরে বার্ণস এণ্ড নোবেলে বইটা পাওয়া যাচ্ছে দেখলাম।
দ্য হার্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড- আ জার্নি টু টিব্বতস লস্ট প্যারাডাইস' কী আরেকটি খণ্ড নাকি বেকার সাহেবের?
ছিঃ ছিঃ এসব কী বলেন
এট্টুশ খানি বেকার আপনার জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন