অস্পষ্ট কুয়াশাভরা রাত। যতোটা আলো না হলে হাঁটা যায় না, ঠিক ততোটুকুই আলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সবখানে। রাস্তার পাশে এক বিরাট রেইনট্রি। জালের মতো অসংখ্য বাহু গাছটার। সাধ্যের সীমা পর্যন্ত আকাশ দখলে নিয়ে সদর্পে আরো উপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সঙ্গে এক নিবিষ্ট মনে চাঁদের সঙ্গে মেঘেদের আসা-যাওয়ার খেলা দেখছে। মাঝে মাঝে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কোত্থেকে আসছে ডাল-পাতাগুলো নাড়িয়ে, তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে যেনো গাছটি!
গাছটির ঠিক নিচে একটি কুটির। চার পায়ের ওপর একঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় কয়েকটি বিভিন্ন রকমের পাতা ধূসর হয়ে পুরনো হতে হতে কিম্ভূতকিমাকাররূপে কোনো রকমে ঝুলে আছে। চারটি পা এবং মাচাসহ পাতাগুলো অনেকদিন ধরে প্রকৃতির ভার বইতে বইতে ক্লান্ত। সামান্য বাতাস, একটু ঝড় কিংবা কোনোকিছুর একটা ধাক্কা প্রত্যাশা করছে ওরা এখন। অবশ্য এমনিতেই চিরবিশ্রাম নিতে পারে ওগুলো। কিন্তু একটু উপলক্ষ পেলে, একটু সহানুভূতি পেলে বর্তে যায় ওরা- তখন ওদের আর কেউ দোষ দিতে পারবে না; কেউ বলতে পারবে না মাচায়, খুঁটিতে ঘুণ ধরেছিলো; কেউ বলতে পারবে না পাতাগুলো বড্ড শুকিয়ে গিয়েছিলো! কিন্তু বাতাস নেই। যা আছে তাতে বাতাসের নিজেরই কুলোয় না, অন্যকে দিবে কী! অনাগত চিরশান্তির প্রত্যাশায় খুঁটি, মাচা ও পাতাগুলো এখন প্রহর গুনছে।
কুটিরের চার ধার সস্তা পলিথিনে ঘেরা। অবশ্য এজন্যই এটিকে কুটিরের মর্যাদা দিতে হচ্ছে। বলা যায়, পলিথিনের কারণে খুঁটি, মাচা ও পাতাগুলোর গৌরব খানিকটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে খুঁটি, মাচা ও পাতাগুলোর কারণেই পলিথিনের আভিজাত্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তাও বোধহয় বলা যায়।
‘ইশ্, কী শীতরে বাবা! গাও-গতর ঠাণ্ডা য্যান বরফ’ কুটিরের ভেতর থেকে শব্দ ভেসে আসে। অনেকক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে উঃ! আঃ! শব্দ শোনা যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে কাঁপা কাঁপা গলার স্বর শোনা যায় ‘কাইল বিয়ানেই একখান হুইস আর একখান গুইট্ট্যা হুতা কিনতে অইবো’। আবার দীর্ঘ নীরবতা।
মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। উত্তর থেকে সামান্য ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসে। বিশাল গাছটিতে মৃদু তরঙ্গ আপনলয়ে খেলে যায়। টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা শিশির ঝরে পড়ে। সঙ্গী হিসেবে বেশ কয়েকটি পাতাও পড়ে।
অনেকক্ষণ যাবৎ প্রকৃতি একইরকম থাকে। মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। কোত্থেকে আসে কে জানে!
আকাশ লাল হতে থাকে। পাখির কলরব, মেট্রোপলিটনের ময়লার ট্রাকের যান্ত্রিক আওয়াজ, গাছের পাতার খসখস শব্দ- সব একসঙ্গে মিলে পরিবেশটাকে কেমন যেনো মোহনীয় করে তোলে। কুটিরের ভেতর থেকেও কিছু শব্দ ভেসে আসে।
শব্দ তুলে পলিথিনের বেড়া ফাঁক হয়। খুব সরু একটি বাঁশের লাঠি বাইরের পৃথিবীতে তার অস্তিত্বকে সগৌরবে প্রকাশ করে। পেছনে দেখা যায় এক অতি বুড়ি, মাথায় যার সাদা ফেনার মতো চুল, আবশ্যিকভাবে গাল তোবড়ানো এবং কুঁজো। অতি চিকন বাঁশের লাঠিটা বুড়ির অন্ধের যষ্ঠী। এটি তার একমাত্র আশ্রয়-আত্মীয় সব।
‘আ মর জ্বালা, পুটলিডা গেলো কই।’ বুড়ি এদিক-ওদিক খোঁজে। ঘাড় নেড়ে এদিক-ওদিক তাকায়। চুলার পাশে ইট দিয়ে চাপা রাখা পুটলিটা চোখে পড়ামাত্র বুড়ির তোবড়ানো গাল সহজাত নির্মিলিত হাসিতে ভরে ওঠে।
পুঁটলিটা কাঁধে ফেলে বুড়ি হাঁটতে থাকে। হাঁটার কোনো শব্দ হয় না। কেবল আত্মীয় ‘অতি চিকন বাঁশের লাঠি’ টুকটুক করে বুড়ির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বুড়ির মুখও নিশ্চুপ।
অনেকক্ষণ পর বুড়ির মনে পড়ে। লাঠিটাকে উঁচু করে তুলে নিয়ে বলে, ‘আইজকা একখান হুইস আর একখান গুইট্ট্যা হুতা কিনন লাগবো।’ তারপর হঠাৎ লাঠিটাকে নামিয়ে সামনে পড়ে থাকা কলার খোসাটাকে সরিয়ে দেয়। বুড়ি আবার বলে, ‘রাইতে কী শীত করেরে বাবা! খেতাডাও তো শেষ।’...
এবারো বুড়ি কথা শেষ করতে পারে না। হঠাৎ করেই যেনো তার সামনে চেনা একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে। একটি না... বেশ কতোগুলো... এক এক করে ভেসে উঠতে থাকে। বুড়ি দেখতে চায় না। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে দৃশ্যটা সরাতে চেষ্টা করে। কিছুটা পারে, কিছুটা পারে না। চোখ জলে ভিজে যায়। দৃশ্যটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে। বুড়ি হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে যখন বিরাট শব্দে বাস-ট্রাক পাশ দিয়ে যায়, বুড়ি আঁতকে ওঠে। মন-মেজাজ খারাপ থাকলে কিছু গালাগালও করে। তখন বুড়ি বড় সুখ পায়। বাস-ট্রাক বুড়িকে ফেলে চলে যায় দূরে, কিন্তু বুড়ির গালাগাল থেকে রেহাই পায় না। যতোক্ষণ শক্তি থাকে, বুড়ির গালাগালও সমানতালে চলে।
একটু পরেই হাঁপিয়ে যায় বুড়ি। পথের ধারেই বসে পড়ে। পুঁটলিটাকে দুই বাহুর ওপর ফেলে খোলার চেষ্টা করে। পুঁটলির রং অদ্ভুত রকমের। একটু সাদা, একটু কালো আবার একটু... কেমন যেনো বোঝা যায় না। শুধু বোঝা যায় রংটা কী রকম। প্রকৃতি নিজেই কয়েক মাসে কয়েক হাজারের বেশি শেড দিয়ে দিয়েছে পুঁটলির কাপড়টাতে। একটু পরেই পুঁটলির ভেতর থেকে সাদা রঙের একটি পলিথিন উঁকি মারে। তার ভেতর থেকে বেরোয় হয়তো দিন তিনেক আগের একটি বাসি পাউরুটি এবং একটি কৌটা। কৌটায় পাওয়া যায় একটুকরো গুড়। বুড়ি সামনে তাকায়। জলের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকায়। রাস্তার ওই পাড়ে ওয়াসার কল দেখা যায়। বুড়ি নিশ্চিন্ত মনে পাউরুটি-গুড় চিবাতে শুরু করে।
পানি নেই। বার কয়েক মোচড় দেয়ার পরও কল থেকে একটুও পানি বেরোয় না। বুড়ি উঠে দাঁড়ায়। পুঁটলিটা ভালো করে বেঁধে আবার হাঁটতে থাকে। অনুসন্ধানী চোখ দুটি এদিক-ওদিক জলের অনুসন্ধান করতে থাকে।
বুড়ি হাঁটতে থাকে। একপা, দুপা করে এগিয়ে যায়। বুড়ির পাশ দিয়ে গাড়ি যায়, মানুষ যায়। মাঝে মাঝে দুএকটি খোলা ছোট মাঠও যায়। উপরে পাখি যায়, মেঘেরা ভেসে বেড়ায়। সময় যায়। সূর্যও খানিকটা যায়। বুড়ি হাঁটে, হাঁটতে থাকে।
মাঝে মাঝে বুড়িকে দেখা যায় কোনো দোকানের সামনে হাত পাততে। মাঝে মাঝে কোনো বাসায় কিংবা চলমান কারো কাছে। পায় না, কিছুই পায় না বুড়ি। অবশ্য মাঝে মাঝে অর্ধচন্দ্র পায়, দূর দূর পায়, বকাবকি শুনতে পায়, তিরস্কার পায়। অনেক কষ্টের পর এক দোকান থেকে এক ঠোঙা মুড়ি পায় বুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে ফোকলা দাঁতে কড়মড় শব্দ করে সেগুলো চিবোতে থাকে।
বুড়ি পড়তে জানে না। জানলে কি করতো? দেখতো ঠোঙার গায়ে লেখা, ঘুণে ধরা সমাজের প্রতিনিধি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা দিয়ে বানানো ঠোঙার গায়ে লেখা আছে, সরকার সবার জন্য ভাত-কাপড়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পেশাদার ফটোগ্রাফারের তোলা সরকারের চাররঙা ছবিটি, যেটি ভাত-কাপড়ের অধিকার নিশ্চিত করা সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে, তাদের একজনের নরম হাতের অশক্ত তালুর ভেতরে আটকে হাঁসফাঁস করছে। বাসি খবরের কাগজ দ্বারা তৈরি ঠোঙায় বুড়ি খাওয়া শেষ করে। কিন্তু আঁশ মেটে না। ঠোঙার তলা থেকে একটা একটা করে শেষ দানাটি পর্যন্ত খায়। কিছুক্ষণ শূন্য ঠোঙাটির দিকে চেয়ে থাকে বুড়ি। তারপর প্রবল আক্রোশে দলামচা পাকিয়ে ঠোঙাটি ছুঁড়ে মারে। গড়াতে গড়াতে কাকের বিষ্ঠার ওপর গিয়ে ঠোঙাটি থামে।
বুড়ি আবার ওঠে। হাঁটে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। ইচ্ছে করলেই কারো বাসার দরজায় টুকটুক করে, হাত পাতে। রাস্তার প্রখর রোদে মাঝে মাঝে চলৎশক্তিহীনভাবে দাঁড়িয়ে কী যেনো চিন্তা করে। বাস-ট্রাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ওগুলোর চাকায় গিয়ে কয়েকটা দমাদম পিটুনি লাগায়। থুথু ফেলে একরাশ। বকাবকি করে। লোকজন তাকিয়ে থাকে-দেখে-হাসে। কয়েকজন উস্কানি দেয়। টোকাইরাও তাতে যোগ দেয়। আবার বাস-ট্রাকওয়ালা বুড়িকে ধমকিয়ে ভাগিয়ে দেয়। বুড়ির গালাগাল তখন আরো বাড়ে, বাড়তে থাকে, একসময় থেমে যায়।
বুড়ি হাঁটে, হাঁটতে থাকে।
সকাল যায়, দুপুর আসে। দুপুর যায়, বিকেল; বিকেলের পর সন্ধ্যা। বুড়ি উল্টো পথ ধরে হাঁটে। সেইদিকে, যেদিক থেকে এসেছিলো। বুড়ির হাঁটতে কষ্ট হয়। পুঁটলিটা ভারি লাগে। এক বাসা থেকে কিছু ফেলে দেয়া খাবার পেয়েছে বুড়ি। বুড়ি চিন্তা করে খাবারটা কখন খাবে? রাতে? সকালে?
হঠাৎ সামনে প্রকাণ্ড এক শব্দ হয়। বুড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। কী হয়েছে দেখতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। শুধু একদল মানুষের জটলা সামনে। একটু গোঙানির শব্দ। ভিড় ঠেলে এগোতে সাহস করে না। উঁকিঝুঁকি মারে। লাভ হয় না। হাল ছেড়ে দিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে। টুকটাক কিছু কথা কানে ভেসে আসে ‘মাসুম পোলাডা টেরাকের নিচে...’
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বুড়ি। তার চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। একেবারে জীবন্ত, একেবারে বাস্তব। বুড়ি ফিরে যায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে...
আয়লা বিবি তার স্বামীর হাত ধরে হাঁটছে। ঠিক হাঁটছে না, লাফাচ্ছে। এতো বড় শহর সে আগে কখনো দেখেনি। দুচোখ ভরা তাই বিস্ময়। একটু পরপর স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, এইডা কী? ওইডা কী? স্বামী একসময় বিরক্ত হয়ে যায়। ধমকায়। তবু আয়লা বিবির উচ্ছ্বাস থামে না। আবার একটু পরে আরেকটা প্রশ্ন করে। আবারো ধমক খায়। এবার একটু অভিমান করে। কিছুক্ষণ পর স্বামী সেই অভিমান ভাঙায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আয়লা বিবির উচ্ছ্বাস আরো বেড়ে যায়।
ব্যস্ত রাস্তা। দেখে-শুনে রাস্তা পার হতে হয়। স্বামীর হাত ছেড়ে নাচতে নাচতে রাস্তা পার হয়ে যায় আয়লা বিবি। স্বামী দেখে-শুনে আসতে থাকে। আয়লা বিবি মজা পায়। এতো সাবধানে হাঁটে মানুষটা? খিলখিল করে হেসে ওঠে।
হাসি থামাতে পারে না। আয়লা বিবি দেখে, আর তার স্বামীও দেখে। একদিক থেকে মালবোঝাই একটি ট্রাক প্রচণ্ড গতিতে আসছে। অপরদিকে আসছে একটি বাস। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে আয়লা বিবি। স্বামী হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। পা নাড়াতে পারে না। গোটা শরীরটাই যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে। আয়লা বিবি স্বামীকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। বাস-ট্রাক প্রায় মুখোমুখি। মাঝখানে তার স্বামী। আর কয়েক সেকেন্ড। তারপর?... অজ্ঞান হয়ে পড়ে আয়লা বিবি।
বাস্তবে ফিরে আসে বুড়ি। দুচোখ তার জলে টলমল করছে। ঝাপসা চোখে রাস্তায় কিছু রক্তের ছোপ দেখতে পায়। বুড়ির মাথা ঠিক থাকে না। শ্রাব্য-অশ্রাব্য গালাগাল শুরু করে। কিছু লোক বিরক্ত হয়, ভাগিয়ে দেয় তাকে। কিন্তু বুড়ির সেই গালাগাল আর থামে না। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এক অদৃশ্যের বিরুদ্ধে গালি বর্ষণ করতে থাকে।
রাতের আঁধার নামে। নিয়ন আলোর কৃত্রিমতা যারা সহ্য করতে পারে না, তারা, পাখিরা নিজ আশ্রয়ে অন্ধকার অভিমুখে ছুটে চলে। দ্রুত পা চালায় বুড়িও। অন্ধকারের সঙ্গে অসম এক প্রতিযোগিতার চেষ্টা করতে থাকে।
নিচে দলাপাকানো খড়ের ওপর পুরনো কাঁথার ওপর বসে পুঁটলিটা খোলে বুড়ি। পরম মমতায় একটি একটি জিনিস বের করে আর দেখে। একটা ছেঁড়া গামছা, কাঁকই, গুড়ের ডিব্বা, দুটি পলিথিনের ব্যাগ, একটি ব্লাউজ, তেলের শিশি আর একটা ভাঙ্গা সুই। বুড়ির চট করে মনে পড়ে যায় কাঁথার কথা। অনেকটাই ছিঁড়ে গেছে। অনেক জায়গায় ফেঁসে গেছে। সেলাই করতে হবে। ‘একখান হুই কিননের কাম আছিলো। হুতাও তো নাই। মাথাডা আউলাইয়া গেছে গা। কিস্যু মনে থাহে না।’ থাকবে কীভাবে? বুড়ি ভাবে। মাথায় টোকা মেরে বলে, ‘কাইল য্যান মনে থাহে।’
অর্ধেকটা খাবার শেষ করে বাকি অর্ধেকটা পরদিন সকালের জন্য তুলে রেখে ছেঁড়া কাঁথাটাকেই পরম যতনে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে বুড়ি। ঘুম আসে না। শুধু লোকটার কথা মনে পড়ে। কাঁথাটার কথা মনে পড়ে। বুড়ির চোখে ভাসে, তাদের বিয়ের সময় বাপজান কাঁথাটা দিয়েছিলো। স্বামী তো দারুণ খুশি। এতো সুন্দর কাঁথা! বলে, ‘বিবি খেতাডারে তুইলা থোও। নইলে ময়লা অইয়া যাইবো।’ স্বামীর খুশি দেখে সেদিন সে কী কম খুশি হয়েছিলো! এসব দৃশ্য একের পর এক চোখে ভাসতে থাকে। চোখের পানি আর সামলাতে পারে না। বাঁধভাঙা জলের মতো সবেগে ঝরতে থাকে।
কুয়াশাভরা রাত। একটু আগে চাঁদ ডুবে গেছে। উত্তুরে হাওয়া বইছে। গাছের ঘুমন্ত পাতাগুলো নড়ছে। সঙ্গে নড়ছে কুটিরের মাচা, মাচার ওপর পাতাগুলো, খুঁটিগুলো। যেনো পড়ে যাবে এক্ষুণি।
হঠাৎ একটা বিদ্রোহ হয়ে গেলো। গোপন বিদ্রোহ। কুটিরের মাচা, পাতা, খুঁটি সবাই মিলে বাতাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুললো। পড়বে না ওরা, ভাঙবে না ওরা। ওরা ভেঙে পড়লে বুড়ির কী হবে? বুড়িকে কে দেখবে? বুড়িকে আশ্রয় দেবে কে?
মৃদু হাওয়া বয়। মাচার পাতাগুলো নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে। শিশির বিন্দু পাতার চোখের পানি হয়ে ঝরে। বুড়ির জন্য পাতাগুলো এক অদ্ভুত রকমের মায়া অনুভব করে। ভাবে, আর কটা দিন মাত্র। মরলে বুড়িকে নিয়ে একসঙ্গেই মরবো। কিছুদিন পরেই আসছে কালবৈশাখী ঝড়। পাতাগুলো বুঝতে পারে বুড়ির ঝরে পড়ার সময়ও সেটাই হবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী?
বুড়ি ঘুমায়। জেগে থাকে পাতাগুলো, মাচা ও খুঁটিগুলো। বুড়ির শেষ ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
মন্তব্য
ছোট ছোট বর্ণনাগুলো খুব ভাল লাগলো। মন্তব্যশূন্য লেখা। তবে আমি পড়ে শূন্য হাতে ফিরিনি।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন