ভাষা আন্দোলন ২০০৮

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০২/২০০৮ - ২:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আদর্শ আধিপত্যবাদী, নৈতিকতা হয়তো সামান্য হলেও এই আধিপত্যবাদ দমিয়ে রাখতে পারে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে সব আদর্শই আধিপত্যবাদী ভুমিকাই গ্রহন করে। যেকোনো রকমের আধিপত্যবাদীই বর্জনীয় এমন আদর্শিক অবস্থানও সব সময় সঠিক কোনো পথের নির্দেশ দিতে পারে না। সব সময়ই পরিস্থিতি- পরিবেশ এবং সমাজমানস বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়। মধ্যবর্তী সময়ের জন্য আদতে কোন আদর্শ উপকারী।

ভাষার প্রশ্নে আমরা একতাবদ্ধ হয়েছিলাম, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই একটা পর্যায়ে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে অপরিহার্য ছিলো বলেই বাংলা গর্জে উঠেছিলো- পোশাকি, দরবারের ভাষা নয় বরং সার্বজনীন ভাষার অধিকারের লড়াইয়ে অবশেষে আমরা জয়ী হয়েছিলাম এ কথা মেনে নিলেও বলতে হবে, বাস্তবতা হলো বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আমরাও কিয়দংশে ভাষার আধিপত্যবাদী ভুমিকাকে যাচাই না করেই নানাবিধ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ভাষা প্রয়োজনীয় একটা উপাদান- যোগাযোগের মাধ্যম- আর এর গুরুত্ব এখানেই যে এই যোগাযোগের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয়- সার্বজনীন ভাষা হিসেবে ইংরেজির ব্যপকত্ব উপনিবেশিকতার কারণেই সম্ভব হয়েছে- ক্ষমতাসীনদের ভাষা অনুকরণ ও আত্মস্থ করেই দেশে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা শুরু হ্য। তাই অধিকৃত দেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকলেও একটা সময়ে অনুকরণকারীরা ক্ষমতা চক্রের আশে-পাশে থাকে- এবং সেখানের ভাষার পরিবর্তন হয়ে যায়। মানুষের সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস আর ভাষার আধিপত্যবাদ একই সুত্রে গাঁথা থাকে- তবে মাঝে মাঝেই ভাষার সীমানা অনির্ধারিত রয়ে যায় আর তখনই আদতে সামনে চলে আসে আমাদের বিপননের কৌশল নির্ধারণের বিষয়টি।

যে মানুষগুলো ৫০০ বছর আগে ভারতের উপকূলে নেমেছিলো- তাদের সবাই এসেছিলো সম্পদ আহরণের নেশায়- আর এ জন্যই তারা তাদের যোগাযোগের অবলম্বন হিসেবে নানাবিধ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলো- আমাদের বাংলা ভাষায় এমন বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশ আমরা রোধ করতে পারি নি। আমাদের পরাজিত হওয়ার ইতিহাস ধারণ করে আছে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা- ফার্সী, ফরাসি, ইংরেজি- পর্তুগীজ, সকল জাতির ভাষার শব্দ আর পদবী আমাদের সমাজে প্রপচলিত- যারা যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো- যারাই বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো- তারাই তাদের ভাষার দাসত্ব করতে বাধ্য করেছে-

প্রতিষ্ঠালোভী আমাদের বনিক পূর্বপুরুষেরা নত হয়েছে তাদের সামনে- প্রতিষ্ঠার লোভেই তারা বিদেশী ভাষা শিখেছে- বাঙালী যখন আধিপত্যবাদী ভুমিকা নিয়েছিলো, তখন বাংলাও একই পথ অনুসরণ করেছে- তবে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তেমন অর্থে বলশালী এবং আধিপত্যবাদী ছিলাম না- আমাদের বিজয়ের রথ আদতে খুব বেশী প্রসারিত হতে পারে নি- বরং আমরা বিজিত হয়েই আনন্দিত ছিলাম- যেটুকু সময় আমরা আধিপত্যবাদী ভুমিকায় ছিলাম সেটুকু সময়ে ভাষার বিকাশে আমাদের বাংলাদেশের প্রচলিত ভাষাও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিলো- হয়তো ভাষার সম্প্রসারণের ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে আমাদের মাতৃভাষার অনেক শব্দই মালয় আর মালাবারের উপকূলে ছড়িয়ে আছে- সেটাকে আদৌ বাংলা বলা চলে কি না এটাও বিবেচনার বিষয়- নেপালের প্রচলিত ভাষা বাংলার পুর্ব রূপ- সেখানের মানুষের ভাষার গন্ধ বুঁঝি, ভাষার উচচারণ রীতি নিজের মনে হয়- তবে যখন মনোযোগ দিয়ে শুনি তখন বুঝতে পারি আদতে এ ভাষা বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই-

ভাষার বিবর্তনের গল্পে আমরা সবাই যদি অভ্যস্ত না হই তবে সমস্যা হবে- ভাষা জীবন্ত এবং নদীর মতো- উতস থেকে শুরু হলেও- আদতে পরবর্তীতে এটা কোন রুপ গ্রহন করবে- কতটা প্রসারিত হবে এবং কতদুরে ছড়িয়ে পড়বে তা নির্ধারণ করে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা- চীনের ভাষা কিংবা জাপানের ভাষা শেখবার ঝোঁক এখন বেশী- বাংলাদেশের যুবকেরা এখন আগ্রহ নিয়ে কোরিয়ান ভাষা শিখছে- তারাও ভাগ্যবদলাতে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যেতে চায়- সে দেশের ভাষা বুঝতে চায়- সেখানের যোগ্য অভিবাসি হতে চায়- এবং এই চাওয়াটাকে আমি মোটেও নীচু চোখে দেখি না- বরং ভালো লাগে দেখে-

কষ্ট হয় যখন আমাদের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর আন্তর্জাতিকরণের বিষয়ে আমাদের যে গর্ব যে গর্ব আমারা নিজেরাই রাখতে পারি না- আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সূচনা কিংবা প্রচলনের কারণ আদতে আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে স্বীকার করবার প্রচেষ্টা- আমাদের প্রতিটা সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করবার মানসিকতা এবং তারা যেনো নিজেদের মতো করেই তাদের জীবন যাপন করতে পারে এই সুযোগ তাদের করে দেওয়ার ভেতরেই আদতে ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রকৃত সম্মান রক্ষিত-

আমাদের কাছে যেটা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম- আমরা যখন উচচ কণ্ঠে বলছি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে , তখন আমাদের এই দাবীটাই অন্য কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠির ভাষা আর সংস্কৃতির উপরে মরণ কামড় হয়ে যাচ্ছে- আমাদের আত্তীকরণের কারণে আত্মবিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে কেউ কেউ-

সুরঞ্জিত কান্থৌমের সাথে আমি এখানে একমত- অনেক আগে থেকেই তার একটা দাবী ছিলো মনিপুরি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার- তাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে সম্মান করবার এবং তাদের ছেলেমেয়ারা যেনো নিজের ভাষাটা শেখবার সুযোগ পায় এই ব্যবস্থা যেনো উপযুক্ত কতৃপক্ষ করে দেন তাদের বদান্যতা এবং শুভ দৃষ্টি কামনাকে আমি সমর্থন করি-

আর একই সাথে ভীত হই আমাদের আকাশ দখলের লড়াইয়ে, আমাদের বাণিজ্য দখলের লড়াইয়ে- আমাদের কতিপয় মানুষের সমৃদ্ধি কামনায় আবারও আমরা নিজেদের চরিত্র বিসর্জন দিচ্ছি- এই সামনে আগানো আর পিছিয়ে আসবার প্রক্রিয়াটা চলছে- ফারুকির নাটকের বাজারদর ভালো- ফারুকির নাটক মানেই দর্শক দেখবে- এবং ফারুকি মানুষের মুখের ভাষা তুলে আনবার নামে যেই ভাষার প্রসার করতে চাইছে- আমাদের ডিজুস- ইউনুস প্রজন্ম যা অনুকরন করছে- সেই সংস্কৃতি কি আদতেই অনুসরণযোগ্য? প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংস্কৃতি কি আমাদের মূল সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে? সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জায়গাটাতে আমরা কতটুকু গ্রহন করবো? কতটুকু বর্জন করবো? ইদানিং আমার টিভি দেখতে ভয় করে- ইদানিং আমি রেডিও শুনে হতবাক হই- আমাদের প্রমিত ভাষার প্রয়োজন আছে কি নেই- এই বিতর্কে আপাতত না গিয়েই বলি- ভাষাটা বাংলা এটা আমাকে যদি বুঝতে হয় তবে সেখানে বাংলা ভাষার গুনাবলী থাকতে হবে- আর বাংলা ভাষার বিশিষ্ঠতা এর কোমল স্বর-

আমি ঠিক জানি না ভাষাতাত্বিক বিবেচনায় এটার নামকরণ কি? তবে বাংলা ভাষা আদতে কোমল একটা ভাষা- আমাদের বদ্বীপের মাটির মতোই কোমল একটা ভাষা বাংলা- এখানের মানুষের জিহ্বার জড়তা নেই- বরং এখানের মানুষের জিহ্বা সহজে কঠোর গম্ভীর স্বর ধারণ করতে পারে না- তারা শান্ত এবং সৌম ভাষায় কথা বলে- এখানে বেশীর ভাগ শব্দেই কড়া টান নেই- আমরা প্রচলিত ভাষায় খুব কমই ড়,য, ঢ় ব্যবহার করি- এমন কি প্রয়োজনের তাগিদেও কঠোর হতে পারি না- তাই আমাদের অধিকাংশ মানুষেরাই কঠোর হওয়ার সময় ইংরেজির দারস্থ হয়- সংস্কৃতির লেখ্য ভাষার কঠোর উচচারন বিধিকে আমরা নিজেদের মতো ক্রে নিয়েছি- আমাদের নিজস্ব অভিধানে এসব শব্দই আলাদা ভাবে প্রচলিত আছে- আর নানাবিধ ভাষাতাত্বিক বিবর্তনের কথা বললেও আদতে আমাদের গ্রামীন কবিরাই নিরবে এই বিবর্তনের চালিকা শক্তি ছিলো- প্রাচীন পুঁথি আর লোক গানের জগতটা কপি রাইট আইন মানে না-

গানের মুখ আর শরীর এক রেখে- ভনিতা এক রেখে- সমাপ্তিতে গিয়ে নিজের বক্তব্য প্রকাশের এই বিশিষ্ঠ ধরণটা আদতে অন্য কোথাও প্রচলিত আছে কি না আমার জানা নেই- হয়তো এই প্রথাটাই বিলুপ্ত- নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করে রাখা নিজের ছাপ রেখে যাওয়া বাদ দিয়ে এখন আমাদের লালন রিমিক্সের যুগে শিল্পীর উপলব্ধি বুঝবার সুযোগ হয় না- লালন কয় সিরাজ সাঁইর গুণে আর কেউ বলবে না- আর কেউ বলবে না লালন ফকির ভেবে মলো কাঙ্গাল হরিদাস কেনো ভাবলো না=
আমাদের কবিরাও তেমন ভাবে সরব নয় এই প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসরনে- আমাদের আধুনিক কবিতার গতি প্রকৃতি- আমাদের আধুনিক গান আর আধুনিক কথা সাহিত্যের মান নিয়ে কথা না বলে বলি আমাদের প্রাচীনত্ব প্রয়াসী অভিনবত্বের স্বাদ দিতে চেষ্টা করছে আমাদের লিটল ম্যাগের কতিপয় সাহিত্যিকেরা - হয়ত তারাও অনুকরন করছে- তবে নিজের যোগ্যতায় মহিরুহ হয়ে উঠতে পারবে কি না এটা আসলে আমাদের সময়ই আমাদের বলে দিবে-

ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা, উপস্থাপন রীতি নিয়ে নিরীক্ষা বলে যা কিছু বাজারজাত করবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করছে প্রথম আলো এবং এর অনুগত পা চাটা মানুষের দলেরা- তা নিয়ে আমার নিজের বিশাল সংশয়- বাংলা ভাষায় ল্যাটিন সাহিত্যের ভাবধারা আনবার প্রয়াস পুরোনো- তবে এ রীতিটা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে- তেমন ভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ধারা বর্ণনার ভঙ্গি- আমাদের বর্তমান গদ্য সাহিত্যের ভাব প্রকৃতিতে খুব বেশী ব্যতিক্রম নেই- হয়তো হাতে গোনা ৪টা উপস্থাপন রীতি প্রচলিত- এবং সব বেশী সব রচনাই এই ৪ রীতির অপভ্রংশ- কথ্য ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা হবে মানুষ অনুভব প্রকাশের জন্য ভাষার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের চেষ্টা করবে এটাই সাহিত্যিক আর সাহিত্যসেবীদের কাছে কাম্য, তবে আমাদের বর্তমান কথা সাহিত্যে এমন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যসেবীর আকাল- সবাই আদতে পরিচিত আদলেই নিজের অনুভব প্রকাশের চেষ্টা করছে- সাহিত্যের প্রয়োজনেও কেউ নতুন ভাষারীতি নিয়ে আসছে না- কিংবা পরিচিত শব্দের ভিন্নার্থে ব্যবহার তেমন চোখে পড়ে না আজকাল- সবাই অনুকরণ করে যাচ্ছে- তোতা পাখি সাহিত্যকর্মীতে বাজার সয়লাব-

সবচেয়ে পরিচিত গদ্যসাহিত্যের মাধ্যম হলো হুমায়ুন আহমেদীয় ধারা- তেমন বিশিষ্ঠতা নেই- বরং ছোটো ছোটো বাক্য- সরল এবং সহজবোধ্য- এবং মাত্রাতিরিক্ত আবেগ এবং অনুভুতি- সংবাদপত্রের ভাষার মতো সংক্ষিপ্ত নয় তবে মাপে, কাঠামোতে তেমন ভিন্নতা নেই-
এর বাইরে আছে লিরিক্যাল গদ্য- আবুল হাসানের গদ্যের ভেতরে কবিতার প্রভাব সবচেয়ে বেশী থাকলেও এখন এই একটা রীতিও কেউ কেউ অনুকরণ করছে- উপমা আর উপমিতের সাথে শব্দ জুড়ে জুড়ে একটা ধাঁধা তৈরি- একটা মায়াজাল তৈরির চেষ্টা- এ ধারায় লিখেছেন অনেকেই- তবে ৯০ পরবর্তী গদ্যে এটা আরও বেশী প্রকট বৈশিষ্ঠ-

এর বাইরে আছে একেবারে প্রথাগত চলতি বা ব্যকরণসম্মত চলতি রীতিতে লেখা- এবং এ রীতিতে লিখছে খুবই কম- তবে গদ্যের মান হিসেবে সবচেয়ে করুণ গদ্য যারা একদা পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন করেছে এবং এই রীতির প্রবক্তাদের ভক্ত এবং অনুকরণকারী বাঁদর- তাদের লেখার ভেতরে একটা হামবড়া ভাব প্রবল-

আর বিশেষ ভাবে বলতেই হয় যারা আঞচলিক ভাষা নিয়ে কাজ করছেন তাদের কথা- নির্দিষ্ট একটা লোকালয়ের ভাষা নিয়ে কাজ করলেও অবশ্য উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে আদিবাসীদের ভাষা- কিংবা সঠিক অর্থে আদিবাসীদের ভাষা নয়, বরং আদিবাসী মানুষেরা যখন বাংলা ভাষার আধিপত্যবাদের কাছে নতি স্বীকার করে হলেও তাদের নিজস্ব উচচারণ সূষ্মা নিয়েই বাংলা বলছেন সেই বিশিষ্ট ভাষাটার প্রয়োগ নেই সাহিত্যে-

তবে এই প্রবনতা একেবারে নতুন তা নয়- ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আগ্রাসনের আগেই নাটকে কৌতুককর হিসেবে উপস্থাপিত বিশেষ একটা অঞচলের ভাষারীতিকে হেনেস্থা করবার বিষয়টাকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলতে পেরেছে আহসান হাবীব- উন্মাদের মোতাব্বির চরিত্রটি নোয়াখালী অঞচলের ভাষাকে সঠিক সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ-

স্থানীয় অর্থনীতিতে নোয়াখালীর মানুষের ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থান এবং তাদের কর্মপটুত্ব কিংবা তাদের লড়াকু মনোভাবকে শ্রদ্ধা করতে পারে নি আমাদের সাহিত্য- আমাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক ঘৃণার নির্মম শিকার এই নির্দিষ্ট অঞচলের মানুষেরা- ভাষার আগ্রাসনের শিকার-

ট্রাডিশনাল চলতি ভাষা নিয়েও কেউ কেউ কাজ করছে- এবং বাজারের যেকোন একটা বই হাতে নিলেই দেখা যাবে এখানে অযোগ্যতা ভাষা ব্যবহারের অদক্ষতা- এটা ঢাকতেই মূলত সলিমুল্লাহ খানের পুর্ব বঙ্গের ভাষা রীতি নিয়ে মাতম-
তার নিবন্ধ পড়লাম- রবি ঠাকুরের কাছেই অবশেষে ফিরে তিনি যা বললেন তার মাহত্ব্য হলো- আদতে আমাদের সাহিত্যে যেটা ব্যবহৃত হয়ে সেটা পশ্চিম বাংলার ভাষা, সেটা কোলকাতার ভাষা- সেটা কোলকাতার উপকণ্ঠের ভাষা- অবশ্য হুতোম প্যাঁচার নক্সা কিংবা ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যের সাথে এ ভাষার মিল নেই-

আমি অবশ্য এই শব্দটার অর্থ বুঝি না। পশ্চিম বাংলার বিশেষত কোলকাতার প্রতিটা স্টেশন পার হলেই ভাষার উচচারণ রীতি বদলে যায়- হলদিয়ার মানুষ- মেদিনীপুরের মানুষ, বর্ধমানের মানুষ- চব্বিশ পরগণার মানুষ একই স্বরে কথা বলে না- এমন কি তারা একই বস্তুকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডেকে থাকে- তবে কেনো এই হয়রানি- বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা জেলার নিজস্ব উচচারণ রীতি আছে- তবে এই জ্ঞানী মুর্খ ঠিক কোনটাকে পুর্ব বঙ্গের ভাষা হিসেবে পরিচিত করতে চায়- পুর্ব বঙ্গের ভাষা হিসেবে আসলে কতগুলো ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়- প্রমিত ভাষা নিয়েও বিতর্ক- আদতে সবার বোধগম্যতা বিবেচনা করলে কোনো স্থায়ী ভাষারুপ আমাদের সামনে নেই- এমন কি বাংরবার স্পষ্ট করে বলেও কি আমরা আমাদের বর্তমান এবং পুর্বতন শাসক গোষ্ঠিকে এতা বুঝাতে পেরেছি যে আমরা সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই- আমরা সবাই পাকিস্তানের সরকারের কাছে থেকে আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে চাই- আমাদের লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া অর্থে নির্মিত পাকিস্তানের শহরের ইট কাঠ আমরা চাই না- তবে আমাদের পাট বেচা- চা বেচা টাকার অংশ আমরা ফেরত চাই- শুধুমাত্র ক্ষমা প্রার্থনা করে যে উদারতা তারা দেখিয়েছে এর বাইরেও অনেক হিসাব অনাদায়ী রয়ে গেছে-

তবে সমস্যা হলো আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ এমন ভঙ্গুর যে আমরা আমাদের দাবীকে উপস্থাপন করতে ভয় পাই- আমাদের অনেক কিছুই বিবেচনা করতে হয়- আমাদের আত্নর্জাতিক আধিপত্যবাদ মেনে নিতে হয়- ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন- আর তাদের আদলেই আমাদের সংস্কৃতি নির্মানের নকশাকে অনুমোদন দিতে হয়- আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় আমাদের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ভেতরে আদতে তেমন মাত্রায় সৃষ্টিশীলতা নেই- তারা ইন্ডিয়ান আইডলের অনুকরণে তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ বললেই আমাদের এস এম এস পাঠানোর হিরিক পরে- টেলি মার্কেটিং এ আমরাও দক্ষ হয়ে উঠছি, আমাদের পণ্য সেবার মান উন্নত না হলেও কাস্টমার কেয়ারের ধারণা আমাদের ভেতরে প্রবেশ করেছে- আমাদের খাদ্য এবং স্বাস্থ নিরাপত্তার বিষয়টা সরকারী পর্যায়ে অবহেলিত হলেও আমাদের পণ্যের মোড়কে এক্সাপায়ারি ডেট লিখবার প্রথা চালু আছে- যদিও আমি বুঝি না কিভাবে এটা নির্ধারণ করে তারা-

আমাদের অনুকরণপ্রিয়তার মাত্রা এমন বেশী আমরা শুদ্ধ ভাবে বাংলা বলতে পারি না এটা নিয়ে আমাদের আক্ষেপ নেই- আমদের এই অযোগ্যতাকে আমরা প্রমিত বাংলার বিরোধিতার মোড়কে উপস্থাপন করতে চাই- এবং আমাদের ভেতরে একতা সচেতন স্বত্তা সব সময় ক্রিয়াশীল সেটা আমাদের বাধ্য করে আমাদের জাহির করতে - তাই আমরা কতটা সঠিক ভাবে এবং কতটা কেতাদুরস্ত ভাবে বিদেশী ভাষা উচচারণ করতে পারি এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বাধ্য করে আমাদের-

আমাদের বিদেশী ভাষার ব্যকরণ শিখবার আন্তরিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই আমাদের দেশী ব্যকরণ শিখবার প্রচেষ্টায়- বিদেশীদের কাছে আমরা আশাও করি না তারা সঠিক উচচারণে বাংলা বলবে- তবে আমরা সব সময়ই আমাদের ইংরেজী কিংবা ফ্রেঞচ কিংবা জর্মন ভাষার বিশুদ্ধতা নিয়ে চিন্তিত- আমাদের বাবা মায়েরাও আমাদের ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে আমাদের উঠতি কর্পোরেট শ্রেণীও আমাদের চাপে রেখেছে- ইংরেজী শিখো- হয় ব্রিটিশ একসেন্টে বলো- পিওর বিবিসি টোনে অথবা ম্যারিক্যান ইংরেজী বলো-

হলিউডের ছবি দেখে ইংরেজী উচচারণ শেখা মানুষেরা যখন ইংরেজীতে বকবক করে তখন আমার অনেক কিছুই ভাঙতে ইচ্ছা হয়- আদতে আঞচলিকতার দায় এড়াতে পারে না কোনো দেশই- তাই বিবিসিতে যে ইংরেজি শোনা যায় সেটা আদতে কুলীন উচচারণ- সেখানের প্রমিত ভাষা- আর সিএন এন দেখে বুঝা যায় ম্যারিকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আদতে আলাদা উচচারণে কথা বললেও তারা একটা মাণ ধরে রাখবার চেষ্টা করছে-

আমাদের প্রমিত বাংলার প্রয়োজন আছে কি নেই এটা অবশ্য বুদ্ধিজীবিদের আলোচনার টেবিলেই ফেলে রাখা ভালো- পূঁজিবাদ বলে যে ভাষার কাটতি ভালো- যে ভাষার বাজার দর বেশী সে ভাষাই উঠে আসবে- তাই যেহেতু এখন আভিজাত্য আর পশ্নেসের পরিভাষা হলো ফারুকির নাটকের ভাষা আর প্রাইভেট রেডিওর জকিদের ভাষা তাই আমাদের অনুকরনপ্রিয় মানুষেরা খুব শীঘ্রি এই উচচারণ নকলের চেষ্টা করবে- আর আমাদের হাই সোসাইটির মানুষেরাই এই যানো য়্যমরা না কালকে অওনেক মযা করেসি-হাস্তে হাসতে প্যাট ব্যাঠা হয়ে গেসে- শুনো না যা বলি- এই রকম ভাষাটা একটা সময়ে স্মার্টনেসের সমার্থক হবে তখন আমার মফস্বলী উচচারণ হয়তো খুব খেলো শোনাবে- আমি যখন নিজের ভাষায় কথা বলবো তখন আমাকেও হয়তো শুনতে হবে ও এ ড়কম ভাবে ব্যাংলা বলে ক্যানো-

আমার নিজের সংস্কৃতিই এখন হুমকির মুখে- আর ২১শের জয়গান গেয়ে কি হবে- আমি আমার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার জন্যই এখন আন্তর্জাতিকতার দারস্থ-


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।