তথ্য জানার অধিকার নাগরিকের আছে, আর এ কাজে সহায়ক হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের এই ভুমিকাটা তার দুঃসংবাদ বিতরণের তুলনায় কম নয় মোটেও। তথ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের দায়িত্বশীলতার পরিমাণ মাঝে মাঝেই কম।
বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের আচরণ অনেকটা হলুদ সাংবাদিকতার পর্যায়ে পড়ে। তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য উপস্থাপনের জন্যই পেশাদার নানা রকম প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত সংবাদপত্রকর্মীর দল, যারা ইন হাউস কাজ করেন, যারা মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং আঞ্চলিক সংবাদদাতা তাদের সবাই আসলে দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার ভাষ্য তুলে ধরেন। তাদের এই পেশার প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার, তবে সাম্প্রতিক কালে গণমাধ্যমের নিকৃষ্ট সাংবাদিকতার অনেক নিদর্শন চোখে পড়ছে।
হলুদ সাংবাদিকতা বলা যাচ্ছে না- হলুদ সাংবাদিকতায় গুজব ছড়ানো এবং এটা দিয়ে মানুষের মোনোরঞ্জনের বিষয়টা থাকে। এখানে নিকৃষ্ট সাংবাদিকতা হচ্ছে অনুমাণের উপরে ভিত্তি করে অনুমাণ দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতাকে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টা সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন আসছে। আমাদের দারিদ্র প্রকট হয়ে উঠছে। আমাদের সঞ্চিতি করে যাচ্ছে। আমরা আমাদের সঞ্চিত সম্পদ আমাদের পুষ্টির চাহিদা পুরণে ব্যয় করে ফেলছি। এ নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।
দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত খবরের বাজার এবং রাজনৈতিক মূল্য আছে। এমন কি এটার ব্যবসায়িক মূল্যও আছে। তবে সাংবাদিকদের সংবাদ প্রচারণের ধরণটাকে আমার ভীষণ রকমের আপত্তিকর মনে হয়েছে।
সিডর পরবর্তী সময়ে আমাদের ৫ লক্ষ টন খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে আমাদের তখনকার উপদেষ্টামন্ডলীর সবাই বলেছিলেন আমাদের পর্যাপ্ত মজুত আছে- আমাদের খাদ্যসহায়তার প্রয়োজন নেই।
যদিও আশংকা করা হয়েছিলো তখনই যে দেশে চালের উদ্বৃত্ব অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত এই দক্ষিণ অঞ্চলের সিডরের আঘাত দেশে চালের সংকট সৃষ্টি করবে।
এমন কি তখনও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য ছিলো ৩৫০ ডলারের কম। তবে সরকার সে সময় এ প্রস্তাবেও সম্মতি দেয় নি এমন কি চাল সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ গ্রহন করে নি- এই কান্ডজ্ঞানহীনতার কারণ তাদের উদাসীনতা। হয়তো তাদের অহং বোধ। যেকোনো কারণেই হোক না কেনো তাদের দুরদর্শীতার অভাবে এবং সিডরের পরে দ্বীতিয়দফা বন্যায় আমাদের সমস্ত দেশেই চালের উৎপাদন মারাত্বক ভাবে হ্রাস পায়।
তখনও সময় ছিলো। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য তখনও আকাশ ছো্যাঁ হয় নি। তবে সরকারের কোনো তৎপরতা তখনও ছিলো না।
ঘরে আগুন লাগবার পরে সরকার যখন সংগ্রহের কাজ শুরু করলো তখন বিশ্ববাজারে চালের সরবরাহ কমে গেছে।
এবং সবাই কোনো না কোনো ভাবে একটা খাদ্যসংকটের মোকাবেলা করছে। যারা চাল রপ্তানি করতো তারাও চাল রপ্তানি সীমিত করে ফেলেছে। যাদের চাল বেচে জ্বালানী তেল কিনতে হয় তারাও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের সাথে পাল্লা দিতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবং ভারতের সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাল ক্রয় চুক্তি সম্পাদনের কুটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে সরকার।
আসলে আমাদের সংবাদ পত্রের পাতায় এই সময় থেকেই অনুমাণ আর গুজবের প্রচারণা শুরু হলো। ভারতের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয় নি অথচ দেশের কয়েকটা পত্রিকায় ভারতের সাথে চাল আমদানি চুক্তি সাক্ষরিত, টন প্রতি চালের দাম লিখে দেওয়া হলো ৪০০ ডলার।
চালের সরবরাহ আটকে আছে বেনাপোলে। ভারত সরকার চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৫০৫ ডলার। এর কমে তারা চালের চালান খালাস করবে না।
এত দিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতা একটা চমৎকার কৌশলী উপাদান ছিলো তবে সংবাদপত্রের ভুমিকার কারণে এটা রাজনৈতিক পর্যায় থেকে একেবারে গনঘৃনার পর্যায়ে চলে গেছে। এত লাভবান হয়েছে কারা? আমাদের ধর্মের জুজুর ভয় দেখিয়ে যারা মৌলবাদের চাষাবাদ করে তারা একটা উপলক্ষ্য পেয়েছে। এই সুযোগে ভারতবিরোধিতার রাজনীতি করবার সুযোগ এসেছে।
তারা বিধর্মী একটা দেশের এহেন অমানবিক আচরণে বিস্মিত হয়েছে। তারা প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে না তবে তারা খুবই নাখোশ, ভারতের সরকার বেসরকারী পর্যায়ে চাল রপ্তানিতে আগ্রহী নয়।
ভারতের সরকার তাদের দেশ থেকে চাল রপ্তানী করবে না কি করবে না এটা ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত। পাকিস্তানের সরকারও চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে- তবে এ নিয়ে সংবাদপত্রে আলোচনা নেই। সংবাদপত্রে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে না পাকিস্তানের সরকার বাসমতি চালের কি মূল্য নির্ধারণ করেছে। পাকিস্তানের সরকার বিদেশী এবং বেসরকারী পর্যায়ে চালের রপ্তানি করতে ঠিক কি দাম ধার্য করেছে। কারণ পাকিস্তানের বিষয়ে আমাদের ভক্তি? নান পাকিস্তান বিষয়ে আমাদের ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকাংশের মোহ থাকলেও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থা কখনই পাকিস্তানকে খুব বেশী আগ্রাসী, সম্প্রসারণশীন এবং আধিপত্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে নি। প্রতিবেশী ভারতের বিরোধিতার রাজনৈতিক রসদে আমাদের নিত্যদিনই সংবাদপত্রের প্রচারিত গুজব দেখতে হচ্ছে।
ভারত সরকার বেসরকারি পর্যায়ে চালের মূল্য টন প্রতি করেছে ৫২৫, ৫৫০ ৫৭০ ৬০০ নানান রকম অঙ্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ভারত আসলে বৈরি। কিংবা অন্য ভাবে দেখলে এই ধারাবাহিক গুজব দেশের চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে।
দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করবার এই নিকৃষ্ট সাংবাদিকতার ভিত্তি শুধুমাত্র গুজব। ভারত বেসরকারী পর্যায়ে চল রপ্তানি করবে না বলেই এমন একটা মূল্য নির্ধারণ করেছে যে দামে বৈদেশিক আমদানিকারকেরা চাল আমদানিতে আগ্রহী হবে না।
যদি বাংলাদেশের কোনো আমদানিকারক ভারতের সাথে চাল আমদানীর বাণিজ্যিক চুক্তি করেই থাকে এবং সে যদি ভারতের বাজারমূল্য থেকে বেশী দামে চাল কিনতে চায় তবে ভারতের বাজারেও কালোবাজারী শুরু হবে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ ভাবে চাল প্রবেশ করবে বাংলাদেশের বাজারে। তবে সাম্প্রতিক প্রবনতা দেখে মনে হচ্ছে এখনও বাংলাদেশের বাজারে চালের মূল্য ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারের তুলনায় কম।
এখন এই প্রচারণা চালিয়ে লাভবান হতে পারে এমন কতিপয় পক্ষের ভেতরে অবৈধ ব্যবসায়ীরাও একটা পক্ষ যারা সীমান্ত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চালের চালান আনবে তাদের ক্রয় মূল্য মুনাফা এবং সরবরাহ মূল্যের তুলনায় দেশের বাজারে চালের মূল্য বাড়লে তারা লাভবান হবে। এই এক চোরাচালানিগোষ্ঠিকে সহয়তা দিতেই দেশের সবগুলো সংবাদপত্র এই গণ বিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
গুজবের অন্য কোনো ভিত্তি কি আছে। কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি, রাজনৈতিক আন্দোলনে চালের মূল্য একটা স্পর্শ্বকতার বিষয়।
যাই হোক ১৫ দিনের ধারাবাহিক জল্পনার পরেও বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের চাল রপ্তানি চুক্তি সম্পাদিত হয় নি। এর ভেতরে ভারত বাসমতি ছাড়া সকল চালের রপ্তানি বন্ধ করেছে। বাসমতির রপ্তানী মূল্য নির্ধারণ করেছে ১০০০ ডলার-
কথা হলো তথ্য জানবার অধিকার আমার আছে- অপ্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের ক্ষমতাও দেশের মানুষকে তথ্যপ্রদান করে মুনাফা করা সংবাদপত্র ব্যবসায়ীদের আছে- তবে এই অপ্রয়োজনীয় তথ্য কি আদতে আমাদের কোনো উপকারে আসছে। আমাদের ভেতরে ভীতি ছড়ানো ব্যতিত অন্য কোনো কাজ কি করতে পেরেছে এই অপ্রয়োজনীয় এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন তথ্য সরবরাহ।
ভারত তার দেশের চাল রপ্তানি করবে কি করবে না এটা নিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা যায়- তবে সেটা আদতে কোনো উপকারে আসবে না। আমাদের প্রকৃতপক্ষে যে তথ্য জানবার প্রয়োজন ছিলো তা হলো ভারত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ৫ লক্ষ টন চাল রপ্তানির যে সিদ্ধান্ত বা আগ্রহ জানিয়েছিলো সেটা সে পালন করতে আগ্রহী কি না। অনেক দেন দরবারের পরে জল্পনা এবং গুজব প্রচারের ৬ সপ্তাহ পরে সম্ভবত ৪৩০ ডলারেই ভারত বাংলাদেশ সরকারকে ৪ লক্ষ টন চাল সরবরাহ করবে।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো ঘটনা তবে আজকেও কোনো কোনো দৈনিকে সংবাদ শিরোণাম হয়েছে ভারতের চালের রপ্তানী মূল্য ১০০০ ডলার থেকে বেড়ে ১২০০ ডলার হয়েছে- বাসমতি চালের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য-
আমি পুনরায় অবাক হলাম, বরং অবাক না নিকৃষ্ট সাংবাদিকতায় চিন্তিত হলাম। আমাদের তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাথে বোধ দায়িত্বপূর্ন তথ্য সরবারহ এবং তথ্য সরবরাহের যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়েও কিছু আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নিকৃষ্ট সাংবাদিকতা এবং এর সাথে সংশ্লিট সকল দৈনিকের সাংবাদিকদের সচেতনতা আশা করতে পারি-
আশাবাদভিন্ন আসলে আমার অন্য কিছু করার নেই- সাংবাদিকদের যোগ্যতা বিষয়ে যে সংশয় আমার ছিলো তা কাটে নি, বরং দিন দিন বাড়ছে আর তারা যে পরিস্থিতি বুঝতে রীতিমতো অযোগ্য এবং তারা যে অনেকক্ষেত্রেই জনগণকে ভুল কিংবা অর্ধসত্য জানিয়ে উদ্বিগ্ন করছেন এবং তাদের মানসিক ক্ষতির কারণ হচ্ছেন এ বিষয় বুঝবার মতো মানসিক পরিপক্কতা এবং সচেতনতা তাদের নেই-
আশা করি আমাদের সংবাদপত্র কর্মী সাংবাদিক এবং সংবাদব্যবসায়ীরা একটু দায়িত্ববান হবেন এবং সচেতন সাংবাদিকের মতো তথ্য প্রবাহের সহয়ক ভুমিকা পালন করবেন।
মন্তব্য
হুমম। সচলে তো অনেক সাংবাদিক। এ বিষয়ে তাঁদের অভিমতটাও জানার ইচ্ছে আছে।
=============
"আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে"
কিছুদিন আগে জাতিসংঘ সরাসরি খাদ্যসাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল । আমাদের রাজন্যবর্গ সে প্রস্তাব ও প্রত্যাখান করেছেন ।
----------------------------------------
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
চাল নিয়ে যে চাল চালা হচ্ছে, সেটা কতদূর কার কীর্তি, সে বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু দুটো বিষয়ে সন্দেহ নেই। এক, চাল নিয়ে এই ব্যর্থতার দায় পুরোপুরি সরকারের। দুই, পত্রিকা বা গণমাধ্যম কিন্তু কখনো কখনো একটা জাতিকে পথ দেখায়, এটা যদি না করতে পারে, যদি শুধুমাত্র বিভ্রান্তি, ছটফটে গুজব, ষড়যন্ত্রের নীল নকশার খবর দিয়েই তারা হিরো হতে চায়, তাহলে সেটা তাদের অযোগ্যতা এবং মূর্খতার পরিচয়!
মৃদুল আহমেদ
নতুন মন্তব্য করুন