ভোর 3টা না বলে গভীর রাত বলি, ঘুম ভাঙ্গলো। হাসপাতালে ফোন, ডাক্তারের সাথে কথা । সিদ্ধান্ত সময় হয়েছে হাসপাতালে যেতে হবে। এতরাতে ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া যায় আবার কুর্নিয়াকেও ফোন করে আসতে বলা যায়। আমার গাড়ী নেই, চালাতেও শিখি নি।এত রাতে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ফোন করলাম মেঘকে। তার পর গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিয়ে হাসপাতাল। ঋক এর জন্ম হওয়ার সময় হয়েছে। পুর্নিমা রাত তাই প্রসুতি কক্ষে অত্যাধিক ব্যাস্ততা। এর মধ্যেই কোন এক ঘরে অবস্থান হলো আমাদের। নার্সের আগমন, বিভিন্ন যন্ত্র জুড়ে দেওয়া প্রসুতির শরীরে। অতপর প্রশ্ন কে থাকবে প্রসুতি কক্ষে। অন্য কেউ নেই। হারাধনের একটা ছেলেই আছে আমি। পর পর কয়েক দিনের না ঘুমানো ক্লান্তি নিয়ে অপেক্ষা। প্রসবযন্ত্রনার ভয়াবহতার কথা শুনেছিলাম এখন সম্পূর্নটাই দেখতে হবে না শুধু পাশে থেকে সহযোগিতা করতেও হবে। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই তাই থেকে গেলাম। সকাল হলো ডাক্তার এসে আশ্বাস দিলো আর ঘন্টাখানেক এর পরশেষ। আশার ছলনে ভুলে গেল 2 ঘন্টা। 8টায় কুর্নিয়া হাজির ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম সকালের নাস্তা করতে। ফিরলাম কোন অগ্রগতি নেই। যন্ত্রের গ্রাফে বিভিন্ন আকিবুিক দেখি আর না ঘুমানোর চেষ্টা করে করে 9টা। বীমার লোক আসলো তার হাজার প্রশ্নের উত্তর। 10টা। আসার পর 5 ঘন্টা গেছে এখনও সেই একই উত্তর নার্সের। আর 1 ঘন্টায় শেষ হয়ে যাবে। আমি সিগারেটের নেশায় অস্থির। বাইরে গিয়ে কয়েকটান দিয়ে আবার বসে থাকো। মরুভূমির বৃষ্টি হয়ে আসলো জোএনা। আমি কখনও দেখি নি। কুর্নিয়ার অসংখ্য বন্ধুর একজন। মিকি নামের এক জাপানী মেয়ের আসার কথা ছিলো তার ছেলের টিকাদিবস তাই জেএনাকে অনুরোধ করেছে আসারজন্যে। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হলো। জেএনার এক মেয়ে বয়েস 9 মাস নাম এলোরী। ইংল্যান্ডে এই নামের কোন এক নদী আছে যেটা তারা মধুচন্দ্রিমায় দেখেছে। প্রথম পরিচয়ে এর বেশী আলাপ আগায় না। আবার ধুমপান বিরতি। ফিরে এসে একই বক্তব্য হয়ে এলো বলে সামান্য অপেক্ষা করুন। প্রসুতির ব্যাথার তীব্রতা বাড়ে আর আমার জ্ঞানের বোঝা বাড়ে।
প্রসবের শেষ মাসে হঠাৎ হঠাৎ তীব্রএক ব্যাথার ঝলক আসবে ওটা প্রসববেদনা নয়। ওটা শরীরের প্রস্তুতি পর্ব আসন্ন প্রসবপ্রস্তুতি। শেষ দুই সপ্তাহে ব্যাথার মধ্যবর্তী সময় কমবে। শেষ সপ্তাহে প্রতি ঘন্টায় একবার। এর পর প্রতি 30 মিনিট। ভয়ের কিছু নেই। যখন প্রতি ব্যাথার মধ্যের ব্যবধান হবে 3 থেকে 5 মিনিট এবং তার স্থায়িত্বহবে 30 সেকেন্ড থেকে 1 মিনিট হাসপাতালে চলে যান।
সবই পুথি পড়ে জানাআর ব্যবহারিক চলছে এখন। আমি গ্রফের আকিবুকি দেখি। অবশেষে বুঝতে পারি সেসবের অর্থ। উপরে 138 যে সংখ্যা তা ঋকের হার্টবীট, নিচের 0থেকে 100 দাগানো রেখা ব্যাথার তীব্রতা মাপছে। ওখানে লিখিত প্রতি 5 মিনিটে 45 সেকেন্ডের 90 থেকে 100 মানের ব্যাথা আসছে। 12টার পর ব্যাথার তীব্রতা এতবেশী যে ক্ষীন কনেঠর অনুরোধ শুধলাম। আর পারতেছি না আমাকে পেইনকিলার দিতে বলেন। নার্সের আপত্তি নেই কিন্তু আশংকা যদি পেইনকিলার দেওয়া হয় প্রসব দীর্ঘায়িত হবে। আমি এর পর বললাম আরো 1 ঘন্টা অপেক্ষা করে পেইন কিলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাবো। জেএনা প্রতি ব্যাথার শুরুতে বলছে শরীর তাকে শিথিল করে দাও। যদি ব্যাথার তৗব্রতায় শরীর শক্ত করে রাখো ব্যাথা বাড়বে কমবে না। যুক্তির কথা। কিন্তু 8 ঘন্টার পর এসব যুক্তি বোঝার মানসিক অবস্থা থাকে না। আমি গ্রাফের দিকে তাকাই, যন্ত্রনা রেখা উপরে উঠতে দেখলে চিৎকার করি বড় করে শ্বাস নাও শরীর হালকা করো। বহুভাষিক মিছিলের মতো জেএনা আমি নার্স একই শ্লোগান দেই। 2টা 30 অবশেষে আসে চুড়ান্ত মুহূর্ত। ডাক্তার নার্স এসে জানায় এবার সব শক্তি সঞ্চয় করে শেষ কয়েকটা ধাক্কা তুমি মা হয়ে যাবে। 3টায় মাথা দেখা গেল, চুলে ভরা মাথা আর 3 মিনিট পর টেনে আনলো ঋক এর নাড়ী কেটে 3টা 5 এ সে স্বাধীন মানব শিশু হলো। পাছায় থাবড়া দিয়ে ডাক্তার কাদিয়ে তুলে দিলো মায়ের বুকে। আমাকে বললো ধরবে না। জেলীর মতো তুলতুলে বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার সাহস হয় নি। এর পর বাইরে গিয়ে কুর্নিয়ার সাথে হাত মেলানো। রাজা নামের আরেক বন্ধুর সাথে বাইরে যাওয়া। নতুন পিতা হিসেবে প্রথম সিগারেট আর বিভিন্ন মানুষকে ফোনে জানানো।
আমার কিংবা তার বাসার কেউ জানে না। জানে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু। তাই ঋকের প্রথম মুহূর্ত থেকে এখন পর্যন্থ আমরাই সব করছি। যদিও ঋকের মা হয়তো বেশী করেছে তারপরও ঋক এখন আমার ন্যাওটা আর এটা ওর মায়ের কষ্ট ।।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন