ব্যার্থ শৈশব

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০১/২০০৬ - ৩:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি যখন শিশুশিক্ষায় স্বরে অ স্বরে আ হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ শুরু করেছি তখন আমাদের বাসার আশেপাশে বিদু্যৎ ছিলো না। পড়তে হতো তেলের বাতিতে। সন্ধ্যা হলে নিয়ম ছিলো সাঁঝ বাতি জ্বালানোর। একটা লম্প জ্বেলে মা কোনার ঘর মাঝের ঘর বড় ঘর শেষে আবার রান্না ঘরে। নিয়মটা এমন কেন আমি জানি না। তবে প্রতিটা ঘরে একবার সন্ধ্যার পর সাঁঝ দিতে হবে, আয়না ঢেকে রাখতে হবে, খোলা চুলে উঠানে নামা যাবে না। রীতিমতো রোমহর্ষক পরিবেশ। ভুতের ভয় যদি আমার না থাকে থাকবে কার?

আমি কোনার ঘরে যাব দুপুর বেলা,একা, অসম্ভব। সেখানে মাঝেমাঝে সাদা শাড়ী পড়া এক রমনী বসে থাকে। অনেকে দেখেছে। আর রাতে ও ঘরে যাওয়া ওটা আমার সাধ্যের বাইরে।
উঠানে জোড়া আম গাছ, প্রতিবার মুকুল আসে গুটি ধরে না। কারন জ্বীনের নজর। পেয়ারা গাছ আর জাম গাছ। মায়ের ঘরের বারান্দায় বরই গাছ। সামনে রান্না ঘর পাশে গোয়াল ঘর। আর রান্না ঘরের পাশের উঠানে মৌসুমি সবজি বাগান। লাউ কুমড়া শশা করল্লা বেগুন ঢেরস যখন যেটা ইচ্ছা তাই লাগানো হতো। আব্বার সরকারী চাকরি পোষ্টিং যশোর এর পর কুমিল্লা। আমরা বড় হয়েছি নানীর বাসায়। আব্বা ছুটিতে আসতো বছরে 2 3 বার। আমি ভয় পেতাম। অপরিচিত একজন মানুষ আসছে গভীর রাতে আর তনু খালা দুলাভাই আসছে দুলা ভাই আসছে , সান্নু বু বলে ঘরে আসতো। আমার মায়ের ডাকনাম সানাই। সেই দুলাভাই সাথে আনতো বিস্কিট। এ বি সি ডি বিস্কিট , মুড়ি বিস্কিট, আরও কিছু বিস্কুট ছিলো যা বড় হয়ে আর খুজে পাই নি। সেই রাতে কলপাড়ে ঝপাত ঝপাত পানি ঢেলে গোসল শেষে খাওয়া।

ওখানে নানার বাবা বসতি গড়েছিলেন যখন মানুষ ছিলো 5 ঘর। তাদের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এলাকার সবাই আমার মামা খালা নানা নানী। আর আমার নানা এবং দাদার পরিবারে আমরাই প্রথম অন্য কোন মামা চাচার বিয়ে হয় নি। অত্যাধিক আদরে বখে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না কোন।
আমার নানী জেদী নিয়মতান্ত্রিক মহিলা। নানা মারা যাওয়ার পর একলা হাতে 3 পরিবারের বোঝা বয়েছেন। ছোট বোনের জামাই যুদ্ধে মরে যাওয়ার পর সেই পরিবার। সম্বল ছিলো একটা হোটেল সেখানে আমার বাসার সবাই কাজ করেছে। সে সময় আমাদের সামাজিক অবস্থান নিম্ন মধ্যবিত্ত। কোনমতো 3 বেলা খেতে পারি, বছরের 2 ঈদে থান কাপড় কিনে জামা তৈরি হয় সেই জামা পড়ি। আমার জন্মের সময় আব্বার চাকরি হয়তো হয়েছে তবে বড় বোনের জন্মের সময় বেকার ছিলেন। এই অবস্থায় কেন কিভাবে বিয়েটা হলো সেই ইতিহাস জানা হয় নি।

আমি ল্যাম্পএর আলোয় শিশুশিক্ষা শেষ করে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বাসায় বিদু্যৎ লাইন আনলো। লাবু কাকা ঠুকঠুক বিড লাগাচ্ছেন তারপর তার লাগানো তারপর সুইচ বসানো সব শেষ করে টুক করে বাতি জ্বালানো।

নিয়ম বদলে গেল। সাঁঝ দিতে এখন লম্প জ্বালানো লাগে না গিয়ে সুইচ চাপলেই আলো। আর আলো থাকে গোটা ঘর জুড়ে হারিকেন লম্পর মতো সীমিত জায়গায় না। উৎসব হয় নি। সহসাই বেশ বদল হয়ে গেলো জীবনে। সামান্য বিদু্যৎ কতটা বদলাতে পারে? আগে বিনোদন ছিলো রেডিও। ব্যাটারি লাগতো 3টা । হক এর ব্যাটারি, কিছুদিন পর ব্যাটারি নরম হয়ে যেত । স্যাঁতসেতে ব্যাটারি ফেলে নতুন ব্যাটারি ভরো।

পড়তে শেখার পর এ বি সি ডি বিসকুটের সাথে নতুন যন্ত্রনা হলো শিশু একাডেমির বই। মুক্তধারা আর কোন এক প্রকাশনী ছাপত নবারুন । সব মিলিয়ে জীবন বরবাদ। যন্ত্র এলো কি করে সাগরতলের জীবন এইসব অখাদ্য আমার শিশুসাহিত্য। আমি সুকুমার রায় পড়ছি বড় হয়ে। অবনী র বুড়া আংলা ও অনান্য গল্প অর্ধেক পড়েছি বাকি এখনও পড়া হয় নি। আর চয়নিকা ওটা এখনও পর্যন্ত সেরা সংকলন। ঠাকুর মার ঝুলি দিয়ে শিশু সাহিত্য পাঠ শেষ। আর এর সাথে বাবার সল্প অবকাশ জীবনের উত্তেজনা হলো --আসো বসো একটা ছবি আকোঁ --- কিছুই হতো না বাবা ছড়া লিখো --- পারতাম না। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না এটা বুঝে যাওয়ার পর জীবন সহজ হয়ে গেল, আমি এখনও ছড়া লিখতে পারি না ছবি আকতে পারি না। এ লাইনে আমার কিছু হবে না বুঝার পর গেলাম গান শিখতে। এলাকার নতুন ক্রেজ। তিন দিনের মাথায় গাইতো হলো সাগর আমায় ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয়-- আমার গান শুনে ওস্তাদ আশচর্য। তার অবাক মুখ দেখে চমৎকার ফুরফুরে লাগছিল। মুখ খুললেন ওস্তাদ বললেন বাবা তোমার তাল লয় সুর কোন বোধ নেই। অন্য কিছু চেষ্টা কর। শিল্প সাহিত্যের জগতে কিছু করতে পারবো না নিশ্চিত হওয়ার পর আমি অন্তত পরবর্তী 6 বছর কিছুই করি নি।

আমি এখনও ঠিক সুরে গান গাইতে পারি না। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে নাচছে গাইছে ছবি আকছে আর আমি এক পাবলিক ভোক্তা শ্রেনিতে থাকলাম। উৎপাদক হতে পারলাম না।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।