মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন একটা বড় মাপের পরিবর্তন বাঙালি সমাজের জন্য এটাকে সম্মান করতে হবে, এসব কেউ শিখিয়ে দেয় নাই আমাকে। 26শে মার্চের সকালে আমি যেই ঘরে শৈশব কাটিয়েছি সেই ঘরে 1 জনকে খুঁচিয়ে মারা হয়, আমি যেই মাঠে খেলে বড় হয়েছি সেই মাঠের পাশের বাড়ীর দরজায় একজনকে হত্যা করা হয়, আমি যেই বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি সেখানে 10 জনের মতো নিহত হয়। আমার বাড়ীর পাশের যেই মানুষটা দিনমজুরের কাজ করতো সেও মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, এদের দেখে বড় হয়েছি কিন্তু এদের কখনই কোনো আত্মপ্রচারনা ছিলো না।
চারপাশে ক্ষয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখলাম, দেখলাম আপোষ করা মুক্তিযোদ্ধাদের- কিন্তু এদের জন্য আমার খারাপ লাগলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানটা এখনও অক্ষুন্ন আছে।
আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু এই গর্বের চেয়ে লজ্জার বিষয় হলো আমার দাদা শান্তি বাহিনীর সদস্য ছিলো এটা। এই লজ্জা আমি অতিক্রম করতে পারি না। সব সময় নিজের কাছে ছোটো হয়ে থাকতে হয়, আমার সাথে দাদার সম্পর্ক খারাপ এমনও না, পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলের একমাত্র ছেলে হিসেবে আমার প্রাপ্য আদর পেয়েছি, আব্দার করতে পেরেছি, কিন্তু তার অতীতের এই কাজকে কোনো ভাবেই যুক্তিসংগত দাবি করতে পারি নি।
মুসলিম লীগের আদর্শিক বিরোধটা ছিলোই, ছিলো দেশতয়াগের ক্ষত। আমার পরিবার এসেছে পশ্চিম বাংলা ছেড়ে, সেখান থেকে শেকড়উঠিয়ে চলে আসা মানুষের একটাই সান্তনা ছিলো তারা মুসলিম ভূমিতে হিজরত করেছে-এই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা অখন্ড পাকিস্তানের জন্য আদর্শিক সংগ্রাম করেছে- এটা একটা আবেগের বিষয়- কিন্তু তৎকালীন রাজনীতি এবং পরিস্থিতির সাথে এই আদর্শটা যায় না। এই সমস্যাটা কখনই কাটিয়ে উঠতে পারলাম না।
আমার বাবা সৎ মানুষ ছিলো, যতটা সৎ থাকা সম্ভব, শিক্ষক ছিলো, তাই অন্যায় উপার্জনের সম্ভবনাও ছিলো না কোনো। কোনো এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যখন তাকে বদলী করা হলো এক আওয়ামি লীগের এমপির ছেলেকে অন্যায় সুযোগ না দেওয়ার জন্য তখন তার অশায়ত্ব দেখেছি। স্বজনপ্র ীতি খারাপ জিনিষ, অন্যায় কিন্তু এই অন্যায়টা করছে প্রশাসন তাই আমার ক্ষোভটা প্রশাসনের উপরে ছিলো, ঐটাকে ব্যাক্তি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, বলা যায় এম পির ছেলের সুযোগ সুবিধা না দেখে সরকারি কর্মচারি হিসেবে তার অপরাধের শাস্তি হওয়ার দরকার ছিলো এমনটাই ভেবেছিলেন এম পি সাহেব।
তার ক্ষমতার অপব্যাবহারের সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছিলাম আমরাই, আমাদের মতো সাধারন মানুষের সহ্য করার ক্ষমতার কারনেই এই অন্যায় মাথাচাড়া দিয়েছে- এর দায় আমার বাবার উপরেও পড়ে। তার দায়িত্ব ছিলো সমাজ বদলের জন্য লড়াই করা, নিজের অবস্থানে সততার কোনো মূল্য নেই, নিজে সৎ থেকে বড়াই করে বলা যায় আমি অন্যায় করি নি কিন্তু তিনি যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন নাই তার প্রতিফল হলো এই রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যাবহারের প্রয়োগ তার জীবনে হতে দেখা।
আমার সাথে তার সম্পর্ক দুরের। আমি নিজের জগত নিয়ে ব্যাস্ত- তিনি তার জগত নিয়ে ব্যাস্ত। ঠিক যে মুহূর্তে এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি হলেন সেই সময় আশ্রয়ের জন্য আমার কাছে এসেছিলেন, সান্তনার জন্য হয়তো, সঠিক কারন জানি না, আমি তাকে নতুন কর্মস্থলে নিয়ে যাই, তার হতাশা দেখে ভিতরে ভিতরে আক্রোশ হয়, নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জা হয়, কারন আমি জানতাম বাবার কোনো অপরাধ ছিলো না সম্পুর্ন বিষয়ে- সেই ছেলেটার যদি পরীক্ষা পাশের যোগ্যতা থাকতো তাহলে তাকে সহয়তা করতেন হয়তো, কিন্তু গাধাকে রাজনৈতিক কারনে পাশ করিয়ে দেওয়ার মতো অসৎ হতে পারেন নাই।
এই সব নিয়ে গর্ব করা যায় হয়তো, কিন্তু আমি গর্ব না করে বলছি তার ভুলগুলোর কথা- যা আমরা করছি এখনও।
আমার মনে হয় না বাবা কোনো দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমি তাকে যতটুকু দেখেছি আমার মনে হয় সহযোদ্ধাদের সাথে বন্দুক নিয়ে যাওয়া, গুলি করাটাই তার মুক্তিযোদ্ধা জীবন ছিলো। এমন কি মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় একটা মানুষ গুলি করে মারার পরের অবস্থা সহ্য করার মতো মানসিক ক্ষমতা তার ছিলো না। শত্রু পক্ষ হলেও মানুষ মানুষের মতো এই বিষয়টা আমি শিখেছি তাই েই সব ধন্দ কাজ করে ভেতরে।
আমি কল্পনায় কখনই বাবাকে দেখি না গ্রেনেড হাতে গোপন অপারেশনে যাচ্ছেন, কখনও দেখি না একাই স্টেন গান নিয়ে ঠাশ ঠাশ গুলি করতে করতে সহযোদ্ধাদের কভার দিচ্ছেন এমন ভুমিকায়, বরং আড্ডায় উচ্ছল, সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা আনুগত্য দিয়ে নিজের মতো ধর্ম পালন করছেন, যুদ্ধ করছেন হয়তো শত্রুর দিকে গুলিও ছুড়েছেন, কিন্তু খুন করে ফেলেছেন কোনো সৈন্যকে এইটা মেনে নিতেপ ারি না আমি।
আমার বাবা তার শৈশব থেকে মৃতু্য পর্যন্ত নামাজ কাযা করেন নাই, নিয়মিত আইনানুগ নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন, আয়কর দিয়েছেন হিসেব করে, যাকাত দিয়েছেন, এতসব করার পরও নৈতিক বলিষ্ঠতা ছাড়া যোদ্ধার বলিষ্ঠতা আমি খুঁজে পাই না তার ভিতরে।
আমর সেই শান্তি বাহিনীর সদস্য দাদার কারনে আমার লজ্জার পরিমান আমাকে কখনই মাথা তুলতে দিচ্ছে। আজকে হাসান মোরশেদের পোষ্টে দেখলাম এই রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাওয়ার প্রানান্ত প্রচেষ্টা চলছে, দেখে হাসি লাগলো। তার পরও আমার আদর্শ এখনও একই আছে- আগার পূর্বপুরুষের একজন এই দেশের বিরোধিতা করেছেন, আমাকে 2 জন মানুষের সমান কাজ করে তার ঋন শুধতে হবে, আমার সামান্য বরখেলাপের সুযোগ নেই এখানে। সবাই যদি বিরুদ্ধে যায় এর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে আমাকে। এটাই আমার দায়, পূর্বপুরুষের ঋনের বোঝা আমার উপরে- তাই আমি নত হয়ে থাকি সেই সব মানুষের সামনে যাদের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
অযথা কথা না বাড়িয়ে নটে গাছ মুড়ে ফেলা দরকার। রাজাকার হওয়াটা লজ্জার কি না জানি না কিন্তু রাজাকার পূর্বপুরুষ থাকাটা লজ্জার একটা বিষয়।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন