আবু সাইয়িদের নিরন্তর দেখলাম, হুমায়ুন আহমেদের জনম জনম উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচিত্র। ভালো লাগলো না, অবশ্য আমি নাদান দর্শক, কোথাও ফিল্ম এপ্রেসিয়েশন কোর্স করা নেই, তাই শটের পরতে পরতে যে কাব্য লুকানো বা যেই সব অনিবার্য বিষয় অভিজ্ঞ সমালোচক দেখতে পারে সেই চোখও আমার নেই।
যদিও আমি মোটামুটি নিশ্চিত বাংলাদেশের অধিকাংশ দর্শকই আমার কাতারের দর্শক, তাই অভিজ্ঞ চলচিত্র সেবী হিসাবে কোনো মন্তব্য করতে না পারলেও ছবির বিষয়বস্তু দেখে এইটা বলতে পারি এই ছবি কেউ হলে গিয়ে 2য় বার দেখার চিন্তা করবে না, হয়তো মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শক সুস্থ চলচিত্রের ফেরেরবাজীতে একবার গিয়ে দেখতেও দেখতে পারে তবে এই জিনিষ 2য় বার পয়সা খরচ করে দেখার মতো মুর্খ বা অভিজ্ঞ বোদ্ধা দর্শক নেই।
আমি উপন্যাসটা পড়েছিলাম সদ্য কৌশোরে, তখন সব কিছু দেখার আলাদা চোখ থাকে, সব কিছুর উপরে একটা আলাদা আস্তরন থাকে, কৌশোরে সব কিছুই সম্ভব, এমন কি একটা সময়ে আমার ধারনা ছিলো এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে আমি একদিন চলচিত্র নির্মান করবো। সাইয়িদ সাহেবের এই রূপান্তরিত চিত্রনাট্যে আমার সেই কৌশোরিয় আবেগের ধর্ষণ হলো মাত্র। 2 ঘন্টা বসে বসে সমাপ্তির প্রতীক্ষায় কাটানো সময়টাকে নিজের কাছে জনম জনমের অপেক্ষা মনে হচ্ছিল, এই দিক থেকে ছবিটা সফল, অন্তত দৃশ্যায়নে মূল উপন্যাসের নাম মনে করিয়ে দিয়েছে। আরও একটা বিষয় বুঝলাম প্রত্যেকের দেখার চোখ আলাদা, জনম জনমের তিথি চরিত্রটাকে আমি যেই অবস্থান থেকে দেখেছি সাইয়িদ সাহেব সেই অবস্থান থেকে দেখেন নাই। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ তাই তার কাছে এই উপন্যাসের বিষয়টা নিছক একটা মেয়ের অভিজ্ঞতার রোমান্টিক রূপায়ন নয়।
শাবনুর, ইলিয়াস কাঞ্চন, লিটু আনাম,সবাই হয়তো সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে, তবে অভিনয়ের মান তেমন ভালো না, বাংলা ছবির নায়িকার চিরন্তর শীৎকার ভঙ্গিতে কথা বলার প্রকোপ কম থাকলেও একেবারে এড়িয়ে স্বাভাবিক কথা বলার চেষ্টাটা কবে সম্পূর্ন হবে আমি জানি না,অবশ্য আমি জনম জনম পড়ার কল্পনা থেকে ভাবছি-মূল উপন্যাসের সাথে এই ছবির ঘটনা প্রবাহের মিল থাকলেও এটা একেবারে মূল উপন্যাসকে অনুসরন করে নির্মিত চলচিত্র নয়,ছবির বিষয়ে একটা উপলব্ধি হলো চলচিত্র এমন একটা বিষয় যা পরিচালক যেভাবে পেশ করতে চায় তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, পরিচালকের ডিকটেটর শিপ প্রবল, তিনি আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি নির্দিষ্ট করেন, আমাদের বলে দেন এইভাবে ভাবতে হবে, আমি বিষয়টাকে এইভাবে দেখছি,সেটা অধিকাংশ মানুষ কিভাবে দেখবে এই বিষয়টা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা থাকবেই, তার হাতে ক্যামেরা, তার হাতে চিত্রনাট্য রচনার ভার, তার কাছে জিম্মি হয়ে থাকো, সম্পাদনার টেবিলে বসে যে জীবন কখনও কোথাও পৌঁছায় না, যার জীবনের কোনো পরিনতি নেই, কোনো প্রবাহ নেই এবং যা জীবন ঘনিষ্ট নয় এমন কিছুকে জীবন ঘনিষ্ট বলে চালাতে চাওয়ার চেষ্টাটা সফল হয় না।
আমার কাছে যেজন্য আপত্তিকর লেগেছে উপন্যাসের চলচিত্রায়ন তাই বলি,
আমাদের সামাজিকতাবোধ পতিতাবৃত্তির একটা করুন রস সামনে নিয়ে আসে, বোধ হয় বিষয়টা আমাদের অত্যাধিক দৈহিক শুচিতার ভাবনা থেকেই উদ্ভুত, সেখানে একজন মেয়েকে অপরিচিত হাজার মানুষের সাথে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারনে যৌনতার সম্পর্ক স্থাপন করতে হচ্ছে এই ধাককাটা আমাদের ভেতরে একটা চিরজাগ্রত অপরাধবোধের সৃষ্টি করে, উপন্যাসটা পড়ার সময় এই চিরজাগ্রত অপরাধবোধের বিষয়টা মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো, কিন্তু ছবির ভেতরে এই চিরজাগ্রত অপরাধবোধের বিষয়টা অনুপস্থিত,
অন্য একটা দূর্বলতা হলো এই ছবিতে ভাববার অবকাশ কম, উপন্যাস পড়ার সময় কল্পনায় অনেকগুলো বিষয়কে একটা পরিপূর্নকরি, যেমন সেই অসুস্থ মহিলা যখন তিথিকে ডেকে নিয়ে এসে তার স্বামির কাজকারবার সম্পর্কে জানতে চায় আমরা একটা কার্যকরন নির্ধারনের চেষ্টাও করি, কেনো একজন অসুস্থ মহিলা একজন পতিতার সাথে কাটানো সময় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তার মানসিক প্রেষণাটা কি, এইসব প্রশ্নের একটা উত্তর আমরা নিজেরাই তৈরি করে নেই, এবং সেই দালাল যার কাজ বিভিন্ন পার্টিকে মেয়ে সরবরাহ করা তার ভেতরেও একটা মানবিক দিক থাকে, একটা লজ্জাবোধের আড়াল আমরা তৈরি করে ফেলি,
কিন্তু মানবিকতার পরিস্ফুটনট া আমরা আরও পরিস্কার ভাবে দেখটে চাই।
আমি হয়তো যখন এই উপন্যাস নিয়ে চলচিত্র নির্মানের কথা ভেবেছিলাম তখন এই বিষয়গুলোকে ভিত্তি করেই নির্মানের চিন্তা করেছিলাম।
একজন অভাবী মানুষ আরও একজন অভাবী মানুষের সাথে একটা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে গিয়েছে, এবং তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা একটা বন্ধন তৈরি করে, একে অন্যকে ছাড়া অসম্পূর্ন বলেই তারা নিজেদের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একটা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়ছে।
তিথি চরিত্রটার ভেতরে একটা পবিত্রতা আরোপের চেষ্টা ছিলো, একটা কষ্টবোধ ছিলো কিংবা আমার অপরাধবোধ ছিলো, এই ছবিতে এই বিষয়গুলো অনুপস্থিত বলেই আমার কাছে ভালো লাগলো না।
পাওনা বলতে একটা ভালো গান, অন্য যে গানটা তা পুরোনো একটা গানের সূরের অনুকরনে করা,এবং সবচেয়ে বিশ্র ী লাগে বাসের ভেতরে কাঠ হয়ে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখতে যারা প্রানপনে ক্যামেরার উপস্থিতি ভূলে থাকার চেষ্টা করছে। যদি আরও ভালো কোনো অভিনেতাকে নেওয়া হতো বা আরও সুযোগ দেওয়া যেতো এই অভিনেতাগুলোকে তাহলেহয়তো একটা ভালো ছবি পাওয়ার আশা করতে পারতাম।
ডলি জহুরের এক্সপ্রেশন সব সময়ই অদ্ভুত, এখানেও তার ব্যাতিক্রম নেই, ছবির সবচেয়ে ভালো অভিনয়টা এসেছে তার কাছ থেকে ,এর পরের ভালো অভিনয় এসেছে হিরুর স্ত্র ীর ভূমিকায় অভিনয় করা ময়েটির কাছ থেকে, এর পর শাবনুর, জয়ন্ত, অপু, ইলিয়াস কাঞ্চন এবং অতঃপর লিটু আনাম, সবচেয়ে বাজে অভিনয় বোধ হয় আমিরুল ইসলাম নামক অভিনেতার।
সমাজটা পুরুষ বেশী নারী খাদকের সমষ্ঠি এই ভাবনাটাকে মনে প্রাণে এড়িয়ে যারা উপন্যাসটা পড়েছেন তারা মোটামুটি হতাশ হবেন কারন এইখানের চিত্রায়নে এই নারী খাদক পুরুষবাদী সমাজটাই হাইলাইটেড হয়েছে, মূল পরিবেশনার ঝোঁকটা একটা চরিত্রের উপর না পড়ে নৈর্ব্যাক্তিক একটা সমাজব্যাবস্থার উপর ফেলে দেওয়ার পর যদি সেখানে পর্যাপ্ত পরিমান মানসিক অভিক্ষেপ ফেলানোর ব্যার্থতা থাকে তাহলে ছবিটা না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে যায়, চরিত্রগুলো অপুষ্ট শরীর নিয়ে ঘুরে, পরিবেশও তেমনভাবে প্রকাশিত হয় না, কারন পরিবেশের ভূমিকা মানুষের মানসিকতার উপর কিভাবে প্রভাব ফেলবে তার জন্য আলোছায়ার ব্যাবহারের বিষয়টাও থাকে-
হয়তি সাইয়িদ সাহেব একটা সমসত্ত মিশ্রন তৈরি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি ব্যার্থ, আমার হাতে না পড়লে এই উপন্যাসের সফল চিত্রায়ন সম্ভব না।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন