আমরা যা সত্য ভাবি সত্য কি আসলে তাই? আমদের কল্পনার নির্মান আর আমাদের বাস্তবতার মধ্যে সীমানা টানে আমাদের অভিজ্ঞতা- আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে চলে গেলেই পরিচিত সত্যের বাইরেও জীবন যাপন সম্ভব, হয়তো জীবনটা কোনো দীর্ঘস্বপ্ন দৃশ্য, আমাদের চারপাশে যা ঘটছে সবই মায়া-এই দর্শনকে ধারন করে আছে ম্যাট্রিক্স ট্রিলজি।প্রায় 600 মিলিয়ন ডলার আয় করেছে ছবিটা। ঘটনার অভিনবত্বের চেয়ে বেশী আসলে এর ক্যামেরার কাজ। যতটা সম্ভব ততটা সফল ভাবে প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করা একটা ভিন্ন ধারার ছবি এটা। মানুষের নিজস্ব দ্্বিধা, অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতার উপর শঙ্কা, এবং মানুষের বিবেচনা বোধের উপর বিশ্বাস না থাকার বিষয়টা প্রধান হয়ে এসেছে ছবিতে। মানুষ কোনো একদিন সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেলবে এই ধারনাটা গভীর ভাবে বিশ্বাস করে মানুষ।যন্ত্র মানুষকে শোষন করে, যন্ত্র মানুষকে ব্যাবহার করে, অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা এবং ভবিষ্যত সময়ের প্রাযুক্তিক অগ্রগতি কোনো না কোনো ভাবে একটা ভয়ংকর রূপ ধারন করতে পারে এমনটা বলে দেওয়া হয়েছে ছবিতে, তবে অন্য একটা বক্তব্যও চলে আসছে এখানে সকল আশার আস্থার আধার নিজেই মানুষ, তাই একদল মানুষ সামগ্রিক মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে। এদের কেউ কেউ তাদের সামর্থের শেষ বিন্দুটা দিয়ে মানবতাকে জয়ী করতে চায়। তাদের উপর বিশ্বাস করে মানুষ, মানুষের মানুষের মুক্তির জন্য একজন মানুষের খোঁজ করে যে বিধাতার কাছ থেকে তাদের মুক্তির সনদ এনে দিবে।মানুষের যুথবদ্ধতা মানুষের বীর পূজা, মানুষের শ্রেনী সংঘাত, মানুষের ব্যক্তিগত রিরংসা, সব মিলিয়ে মানুষের আবেগ আর অপ্রাপ্তিবোধ মানুষকে কখনও ঘৃনিত করে তুলে, মানুষের ভালোবাসা মানুষকে মহৎ করে, অসম্ভবের পায়ে আঘাত করে তার মুর্তি ভেঙে দেওয়ার অনুপ্রেরনা দেয়।ঘটনা সংক্ষেপে এমন, এক বিংশ শতাব্দির কোনো এক পর্যায়ে যন্ত্র মানুষের উপর কতৃত্বস্থাপন করেছে, তারা মানুষকে তাদের শক্তির উৎস হিসেবে ব্যাবহার করছে, পাশার দান বদলে গেছে, এর মধ্যে একদল মানুষ, মর্ফিউস যাদের নেতা তারা মানুষের এই দাসত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে, এবং স্বভাবতই কতৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিচ্ছে, মর্ফিউসের বিশ্বাস একজন আসবে যে তাদের সম্পুর্ন মুক্তির বিধান নিয়ে আসবে, এই খোঁজের একটা পর্যায়ে নিওর দেখা পায় মর্ফিউস এবং তার মনে হয় নিঐ সেই ব্যাক্তি যার খোঁজ সে করেছে এত দিন,ওরাকল নামক ভবিষ্যতবেত্তা চরিত্রটা সবসময় একটা বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষের বাছাই করার সময়টায় তার এই সিদ্ধান্তগুলোই আসলে তার ভবিষ্যত নির্ধারন করবে, তার কাছে সবার পরিনতির একটা আভাষ থাকে, তবে সেই পরিনতি মেনে নেওয়া কিংবা মেনে না নেওয়ার বিষয়টা চরিত্রের উপর নির্ভর করে। প্রথম পর্বের সম্পুর্ন ঘটনাই এই বিষয়টার উপর ভিত্তি করে ঘটতে থাকে, আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের কল্পনাকে নিয়ন্ত্রন করে, আমাদের কল্পনার জায়গায় আমরা বিভিন্ন স্বাধীনতা রাখলেও আসলে অবাস্তব কল্পনা আমরা বেশি ক্ষন বহন করতে পারি না, তাই নিও চরিত্রটার ভেতরের এই অভিজ্ঞতাজনিত বাধা দুর না হওয়া পর্যন্ত তার নির্বান নেই, প্রথম পর্ব নিওর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা।প্রথম পর্বের ঘটনায় যা মনে হয় সেটা সম্পুর্ন বদলে যায় 2য়, 3য় পর্বে এসে, প্রথম পর্বে একটা আশ্বাস থাকে, যা ঘটছে সবটাই ম্যাট্রিক্সের ভেতরে, সেখানে মানুষের 2টা আলাদা সত্তা একটা ভার্চুয়াল জীবন, যে জীবনে তার মস্তিস্কের ভেতরের আন্দোলন তারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে যায়, সেখানে তার লড়াই চলতে থাকে, এবং সেখানের অভিজ্ঞতা তার বাস্তব শরীরকে নিয়ন্ত্রন করে, অন্যটা বাস্তব জগত, ভার্চুয়াল জগতের প্রহরীরা মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংস করেআর ভার্চুয়াল জগতের বাইরে যে জগত সেখানে শৃংখলা রক্ষার জন্য একদল যন্ত্র সৈনিক কাজ করছে যাদের ভাইরাস বলা হচ্ছে ছবিতে, তারা মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চাইছে।2য় পর্বে এসে যেই ধারনা ছড়িয়ে দেওয়া হয় তা হলো সম্পুর্ন বিষয়টাই একটা কল্পলোক, এখানের ঘটনা নিয়ন্ত্রন করছে আর্কিটেক্ট বলে এক ব্যাক্তি, তার নির্দেশে এবং মেধায় নির্মিত হয়েছে এই ম্যাট্রিক্স, নিও সেখানে গানিতিক সমাধানের ধ্রুবক, যাকে অস্ব ীকার করতে পারে না,ম্যাট্রিক্সের অস্তিত্বের জন্যই নিওকে প্রয়োজন, এবং নিওর ধ্রুবক মানকে বিলীন করার জন্য অন্য একটা ধ্রুবক ব্যাবহার করা হয়েছে সমীকরনে যা নিওর প্রধান প্রতিপক্ষ, স্মিথ, তবে ভার্চুয়াল জগতের সাথে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারলেও মর্ফিউসরা সম্পুর্নটাই কল্পলোক এই বিষয়টা অনুধাবন করতে পারে না। এখানেই নিওর সাথে অন্য সবার পার্থক্য, মানুষের বসতি নির্মিত হয়েছে, সেখানে যেহেতু সমাজ তৈরি হয়েছে সামাজিক বিশ্বাসও তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে ধর্ম ভালোবাসা, ঘৃনা, সংঘাত সবই সেখানে বিদ্যমান,সেখানেও নেতৃত্বের সংঘাত আছে, প্রেমের দ্্বন্দ্ব, তবে এই বিচ্ছিন্ন মানুষরা সব মানুষের জন্য বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে লড়াই করছে এটাই ছবির ঘুটনা।নিও একা গিয়ে ম্যাশিন ওয়ার্লডের কর্তার সাথে দেখা করে তার কাছে মানবজাতির মুক্তি দাবি করে, অবশেষে নিও সবার মুক্তি নিয়ে আসে।ছবিরা দেখার পর আমার ভেতরে 2 ধরনের ভাবনা তৈরি হয়েছে,প্রথম ভাবনাটা তৈরি হয় প্রথম পর্ব দেখার সময়, শোষনের জন্য আমাদের সামনে একটা কাল্পনিক জগত তৈরি করা হয়,সেখানে কিছু নিয়ম তৈরি করা হয় এবং একেবারে পারফেকশনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে নিলে এই শোষনের বিরুদ্ধ দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষকে শোষক শত্রু মনে করে এবং তাকে নির্মুলের চেষ্টা করে, এমন একটা কল্পলোকের ভেতরে মানুষকে বন্দি করে শোষক গোষ্ঠি নিজেদের চাহিদা পুরন করছে, এবং কিছু মানুষ এটাকে নৈতিক ভাবছে না তাই তারা এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার যোগ্য নেতা খুঁজছে, এবং যোগ্য নেতা তৈরিও হচ্ছে, তারা শোষককে পরাস্ত করছে অবশেষে, তবে 2য় পর্ব দেখার পর ভাবনার স্রোত যায় ভিন্ন জায়গায়, সেখানে ভাবনা জুড়ে থাকে আমাদের নেটঅস্তিত্ব, যদি কোনো এক উপায়ে আমাদের ব্লগ জীবনকে জীবন্ত করে তোলা যেতো, এত মতাদর্শিক সংঘাত, রিরংসা, সবাই ব্লগের ভেতরে বদ্ধ থেকে লড়াই করতো। এবং েএই চরিত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রনের জন্য মডারেটর থাকতো, তারা চরিত্রের ওজন বুঝে তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করতো। ম্যাট্রিক্স কি সেই অর্থে এমন কোনো ভার্চুয়াল জীবনের রূপক? কারন এখানেও সব রকম কম্পিউটার ব্যাবহৃত বিষয়াবলি উপস্থিত, এখানেও প্রোগ্রাম আছে, প্রোগামের বাগ আছে, সেই বাগ এক্টিভেট হয়ে যায়, এবং এক্টিভেট হওয়ার পর তা প্রোগ্রামের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে,ম্যাশিন ওয়ার্লডের সৈনিকদের সাথে লড়াইটা এরকমই মনে হয়েছে আমার। কোনো একটা হার্ড ডিস্কের গল্প মনে হয়েছে, যেখানে সফট ওয়্যার আছে, সেই সফট ওয়্যারের ভেতরে ককিছু লজিক দেওয়া আছে, হার্ড ডিস্কে জমা হওয়া ডাটা তার জন্য নির্দিষ্ট করা কাজ সম্পাদন করতে সফটওয়্যারের সহায়তা নেয় এবং একজন নিয়ন্ত্রনকারী আছে যার হাতে সর্বময় ক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়ার।সফট ওয়্যারের কাজ ম্যাশিনের নির্দেশ তথা কর্তার নির্দেশকে পালন করার জন্য ইন পুট গুলোকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া।এবং ডাটা সেই নির্দেশ ধারন করে আবার উপাত্ত নিয়ে ফিরে যায় ম্যাশিনে এবং সেখানে আউটপুট দিয়ে আসে।কোন এক কারনে এই হার্ড ডিস্কে সমসয়া দেখা দিয়েছে, কোনো একটা প্রোগ্রাম কাজ করছে না ঠিক ভাবে, এই সমস্যা এড়ানোর জন্য রিবুট করতে হবে বা হার্ডডিস্কের ডাটা সব মুছে দিয়ে নতুন করে সব ইনস্টল করতে হবে। এবং ডাটাগুলো একটা পর্যায়ে বিদ্্রোহি হয়ে উঠেছে, তাদের ধ্বংস না করার জন্য লড়াই করছে।তারা নিজেরাই ভাইরাসের িরুদ্ধে লড়াই করছে, এবং এই লড়াইটাই ফুটে উঠেছে ম্যাট্রিক্স ট্রিলজিতে।আমি অবশ্য এটাকে হার্ড ডিস্ক ভাবতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি, তাহলে ছবির ব্যাবহৃত দৃশ্য এবং কল্পনাগুলো যৌক্তিক মনে হয়।যেভাবেই গ্রহন করা হোক না কেনো ছবিটা উপভোগ্য, এমনি এটা 600 মিলিয়ন ডলার আয় করে নি।
মন্তব্য
ম্যাট্রিক্স সিনেমাটা দেখার পর গুগলে বাংলায় সার্চ দিলাম এর উপর রিভিউর জন্য। সেখান থেকেই এই লেখাটার সন্ধান পেলাম। পড়লাম। তবে একটু জটিল মনে হল।
নতুন মন্তব্য করুন